গীতায় (৩.২৪) স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন—“উৎসীদেয়ুরিমে লোকা ন কুর্যাং কর্ম চেদহম্। সঙ্করস্য চ কর্তাস্যামুপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ।।”—অর্থাৎ, যদি আমি কর্ম না করি, তবে এই সমস্ত জগৎ ধ্বংস হয়ে যাবে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, প্রজাগণ বিপর্যস্ত হবে।
“উৎসীদেয়ুরিমে লোকা ন কুৰ্যাং কৰ্ম চেদহম্” অর্থ—যদি আমি (ঈশ্বর) কর্ম না করি, তবে এই সমস্ত জগৎ উৎচ্ছিন্ন (উৎসীদেয়ুঃ) বা ধ্বংস হয়ে যাবে।
“সঙ্করস্য চ কৰ্তা স্যাম্ উপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ” অর্থ—সেক্ষেত্রে আমিই বর্ণসঙ্করের (সামাজিক বিশৃঙ্খলা) কারণ হব এবং এই প্রজাদের বিনাশ (উপহন্যাম্) করব।
এই শ্লোকটির মাধ্যমে গীতা ঈশ্বরকেও কর্মযোগী রূপে প্রতিষ্ঠা করে এবং লোকসংগ্রহের চূড়ান্ত গুরুত্ব তুলে ধরে।
ঈশ্বরের দৃষ্টান্ত: শ্রীকৃষ্ণ এখানে নিজের উদাহরণ দিয়ে অর্জুনকে বোঝান যে, যদিও ঈশ্বরের কোনো ফলের আকাঙ্ক্ষা নেই এবং তাঁর কোনো কর্তব্যও নেই, তবুও তিনি জগতের স্থিতিশীলতা (লোকসংগ্রহ) এবং শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কর্ম করেন।
কর্মের অনিবার্যতা: যদি স্বয়ং শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বা ঈশ্বর কর্ম করা ছেড়ে দেন, তবে জগতে কর্মের আদর্শ নষ্ট হবে। এর ফলে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে কর্তব্যচ্যুত হবে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা (বর্ণসঙ্কর) সৃষ্টি হবে, যা শেষ পর্যন্ত প্রজাদের বিনাশের কারণ হবে।
অনাসক্তির শিক্ষা: এই শ্লোকটি নির্দেশ করে যে, কর্ম করা অপরিহার্য। তবে সেই কর্ম হতে হবে অনাসক্ত এবং জগতের কল্যাণের উদ্দেশ্যে।
ঈশ্বরের ক্ষেত্রেও কর্মের উদ্দেশ্য কোনো ব্যক্তিগত ইচ্ছা নয়; এটি মহাজাগতিক কর্তব্য—যাতে সৃষ্টির নিয়ম ও শৃঙ্খলা অটুট থাকে। তাই লোকসংগ্রহ কেবল সামাজিক দায়িত্ব নয়, এটি ব্রহ্মের স্বয়ং-প্রকাশ, যেখানে কর্তা নয়, করুণাই কর্মের উৎস হয়ে ওঠে।
গীতায় (৩.২৫) শ্রীকৃষ্ণ আরও বলেন—“সক্তাঃ কর্মণ্যবিদ্বাংসো যথা কুর্বন্তি ভারত। কুর্যাদ্ বিদ্বাংস্তথাসক্তশ্চিকীর্ষুর্লোকসংগ্রহম্।।”—অর্থাৎ, অজ্ঞানী ব্যক্তি ফলের আসক্তিতে কর্ম করেন, কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তি ফলের প্রতি আসক্তি ত্যাগ করে লোকসংগ্রহের ইচ্ছায় কর্ম করেন।
“সক্তাঃ কর্মণ্যবিদ্বাংসো যথা কুর্বন্তি ভারত” অর্থ—হে ভারত (অর্জুন)! অজ্ঞানী ব্যক্তিরা (অবিদ্বাংসঃ) যেমন কর্মে আসক্ত হয়ে (সক্তাঃ) কর্ম করে থাকেন।
“কুৰ্যাদ্ বিদ্বাংস্তথাসক্তশ্চিকীর্ষুৰ্লোকসংগ্রহম্” অর্থ—জ্ঞানী ব্যক্তিও (বিদ্বান্) ঠিক তেমনই কর্ম করবেন, তবে তিনি অনাসক্ত (অসক্তঃ) থাকবেন, কারণ তাঁর উদ্দেশ্য হলো লোকসংগ্রহ (জগতের কল্যাণ) সাধন করা।
এই শ্লোকটি কর্মযোগ এবং লোকসংগ্রহের একটি চূড়ান্ত নীতি প্রতিষ্ঠা করে।
কর্মের রূপ নয়, উদ্দেশ্যই মূল: জ্ঞানী এবং অজ্ঞানী—উভয়ের বাহ্যিক কর্ম একই হতে পারে। কিন্তু দু-জনের মধ্যে পার্থক্য হলো তাদের অভ্যন্তরীণ প্রেরণা এবং উদ্দেশ্যে। অজ্ঞানী কর্ম করে ফলের আসক্তি থেকে, আর জ্ঞানী কর্ম করেন ফলের প্রতি অনাসক্ত থেকে।
অনাসক্তির বাধ্যবাধকতা: জ্ঞানী ব্যক্তি কর্ম করেন মূলত জগতের কল্যাণের (লোকসংগ্রহ) জন্য এবং আদর্শ স্থাপনের জন্য। তিনি ফলের প্রতি আসক্ত না হয়েও কর্ম করেন, যাতে সাধারণ মানুষ (যারা জ্ঞানী ব্যক্তিকে অনুসরণ করে) কাজ করা বন্ধ না করে দেয়।
শ্রেষ্ঠের দায়িত্ব: জ্ঞানী ব্যক্তি তাঁর জ্ঞান দ্বারা উপলব্ধি করেন যে, তিনি কর্তা নন (প্রকৃতিই কর্তা), কিন্তু তিনি লোকশিক্ষার জন্য কর্ম করতে বাধ্য।
এই শ্লোকটি নিশ্চিত করে যে, মোক্ষ লাভকারী ব্যক্তি নিষ্ক্রিয় হন না, বরং তিনি জগতের কল্যাণের জন্য নিষ্কামভাবে কর্ম করে যান। এখানে অনাসক্ত কর্ম-সম্পাদন করার শিক্ষাই আসল শিক্ষা। জ্ঞানী জানেন—কর্ম প্রকৃতির গুণের দ্বারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে, কিন্তু তিনি সেই কর্মকে অহংকারে গ্রহণ করেন না; বরং তা ব্রহ্মচেতনারই প্রকাশ হিসেবে প্রত্যক্ষ করেন। তাঁর কর্ম ঈশ্বরের ইচ্ছার ধারক, ব্যক্তিগত প্রেরণার নয়।
অদ্বৈত দৃষ্টিকোণ থেকে, লোকসংগ্রহ হলো জীবন্মুক্ত অবস্থার স্বাভাবিক পরিণতি। জ্ঞানীর নিজের মুক্তি সম্পূর্ণ, তবু তাঁর দেহ প্রারব্ধ কর্মের ফলে কিছুদিন চলতে থাকে। সেই দেহধারণের অর্থই তিনি দেন—লোকসংগ্রহ। তাঁর কর্ম তখন সমাজে শৃঙ্খলা, শান্তি ও সাধনার অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে। এটি কোনো কর্তব্যবোধজনিত শ্রম নয়, বরং এক স্বতঃস্ফূর্ত করুণা—যেমন পদ্ম জলে থেকেও জলে ভিজে না, তেমনি জ্ঞানী কর্মে থেকেও কর্মে আবদ্ধ হন না। তাঁর কর্ম হয় আলোকিত কর্ম (Ārādhita-Karma)—যেখানে কর্তা নেই, ফলের আকাঙ্ক্ষা নেই, কেবল চেতনার নিঃস্বার্থ অভিব্যক্তি।
Ārādhita-Karma (আরাধিত কর্ম) অদ্বৈত বেদান্তের একটি গভীর ধারণা, যা জীবন্মুক্ত পুরুষের—অর্থাৎ আত্মজ্ঞানী, মুক্ত সত্তার—কর্মের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে। এই কর্ম জাগতিক বন্ধন সৃষ্টি করে না, কারণ তা আর কর্তা-অহংকার বা ফল-আকাঙ্ক্ষার দ্বারা চালিত নয়। বরং এটি চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ—এক প্রকার “দেহধারী নীরবতা”, যেখানে কর্ম ঘটে, অথচ কর্তা নেই।
অদ্বৈত দৃষ্টিতে, কর্ম তিন প্রকার—সঞ্চিত (Saṃcita), প্রারব্ধ (Prārabdha), এবং আগামী (Āgāmī)। আত্মজ্ঞান উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চিত ও আগামী কর্ম জ্ঞানাগ্নিতে ভস্মীভূত হয়, কেবল প্রারব্ধ কর্ম দেহপতন পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে। এই অবস্থায় জীবন্মুক্ত পুরুষ কর্ম করেন, কিন্তু তাঁর কর্ম আর বন্ধন সৃষ্টির কারণ হয় না। কারণ তাঁর অন্তরে কোনো কর্তৃত্ব (Kartutva) নেই, কোনো আকাঙ্ক্ষা (Kāma) নেই। তাঁর কর্ম তখন Ārādhita-Karma—“আলোকিত কর্ম” বা “আরাধনারূপ কর্ম”—যা আর কোনো ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য বহন করে না।
দর্শনের বিভিন্ন ধারায় কর্তৃত্বের ধারণাটি ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে:
অদ্বৈত বেদান্তে কর্তৃত্বকে বন্ধনের মূল কারণ হিসেবে দেখা হয়।
মিথ্যা আরোপণ: অদ্বৈত-মতে, ব্রহ্ম বা আত্মা হলেন শুদ্ধ চৈতন্য এবং সাক্ষী (দ্রষ্টা), তিনি কর্তা নন। জীব যখন অজ্ঞান বা অবিদ্যার কারণে দেহ, মন, এবং বুদ্ধির (উপাধি) সঙ্গে নিজেকে এক বলে ভ্রম করে, তখন সে নিজেকে কর্তা বলে মনে করে। এই ভ্রান্ত ধারণাই হলো কর্তৃত্ব।
মুক্তি: মোক্ষলাভের অর্থ হলো, এই কর্তৃত্বের অহংকার (আমি কর্তা) ত্যাগ করা। জ্ঞানী ব্যক্তি সমস্ত কর্ম করেও এই ভাবটি রাখেন যে, "আমি কিছুই করছি না" (নৈব কিঞ্চিৎ করমি) (গীতা, ৫.৮), কারণ তিনি জানেন যে কর্মগুলি প্রকৃতির গুণ (প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ) (গীতা, ৩.২৭) দ্বারা সম্পন্ন হচ্ছে।
সাংখ্য দর্শন মতে, পুরুষ (আত্মা) হলেন নিষ্ক্রিয় দ্রষ্টা, এবং সমস্ত কার্যকলাপ প্রকৃতি (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ গুণ)-র দ্বারা সম্পন্ন হয়। জীব ভুল করে যখন প্রকৃতির কর্মকে নিজের বলে মনে করে, তখনই কর্তৃত্বের জন্ম হয়।
ন্যায়-বৈশেষিক মতে, আত্মাই হলো প্রকৃত কর্তা। আত্মা ইচ্ছাশক্তি ও বুদ্ধির সাহায্যে কর্ম করে।
আধ্যাত্মিক দর্শনে কর্তৃত্ব হলো অহংকারজনিত ভুল বা অজ্ঞান-এর ফল, যা জীবকে কর্মফলের বন্ধনে আবদ্ধ করে। আরাধিত কর্মের মূল তাৎপর্য হলো—কর্মকেই ঈশ্বরার্পণ করা। এই কর্মের লক্ষ্য কোনো ফললাভ নয়, বরং চেতনার স্বাভাবিক অভিব্যক্তি। মুক্ত পুরুষের জন্য কর্ম কোনো উপায় নয়; এটি চেতনার অন্তর্গত স্পন্দন। যেমন ফুল ফোটে, নদী বয়ে যায়, সূর্য আলোক দেয়—তেমনই জ্ঞানী ব্যক্তি কর্ম করেন, কিন্তু তাঁর কর্মে কোনো কর্তা বা ভোগী নেই। তিনি জানেন—“প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্মাণি সর্বশঃ” (গীতা, ৩.২৭)—অর্থাৎ, সমস্ত কর্ম (কর্মাণি সর্বশঃ) প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতির গুণসমূহ (গুণৈঃ) দ্বারাই সম্পাদিত হচ্ছে (ক্রিয়মাণানি)। ফলে, তিনি আর “আমি করি” বলে ভাবেন না; তিনি দেখেন—কর্ম হচ্ছে, কিন্তু কর্মীর অস্তিত্ব নেই।
দ্বিতীয়ত, এই কর্মে কর্তা নেই, তবু কর্ম থেমে যায় না। যেমন, গীতায় বলা হয়েছে—
নৈব কিঞ্চিৎ করোমি ইতি যুক্তো মন্যেত তত্ত্ববিত্।
পশ্যন্ শৃণ্বন্ স্পৃশন্ জিঘ্রন্ অশ্বন্ গচ্ছন্ স্বপন্ শ্বসন্।।
প্রলপন্ বিসৃজন্ গৃহ্নন্ উন্মীষন্ নিমীষন্ অপি বা।
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেষু বর্তন্তে ইতি ধারয়ন্।। (গীতা, ৫.৮-৫.৯)
“নৈব কিঞ্চিত্ করমি ইতি যুক্তো মন্যেত তত্ত্ববিত্” অর্থ—তত্ত্বজ্ঞানী (তত্ত্ববিত্) বা জ্ঞানী ব্যক্তি, যোগযুক্ত (যুক্তো) হয়ে, সর্বদা এই রূপ মনে করেন (মন্যেত) যে, “আমি কিছুই করছি না” (নৈব কিঞ্চিত্ করমি ইতি)।
পশ্যন্...শ্বসন্: যদিও তিনি দেখছেন, শুনছেন, স্পর্শ করছেন, গন্ধ নিচ্ছেন, খাচ্ছেন, যাচ্ছেন, ঘুমাচ্ছেন বা নিঃশ্বাস নিচ্ছেন।
প্রলপন্...ধারয়ন্: এমনকি তিনি কথা বলছেন, ত্যাগ করছেন, গ্রহণ করছেন, চোখ খুলছেন বা বন্ধ করছেন—এই সমস্ত কাজ করার সময়েও।
“ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেষু বর্তন্তে ইতি ধারয়ন্” অর্থ—(তিনি মনে করেন যে) ইন্দ্রিয়গুলিই ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহের মধ্যে বিচরণ করছে (বর্তন্তে)।
তত্ত্ববিত্—যিনি সত্য উপলব্ধি করেছেন—তিনি জানেন যে, দেখছেন, শুনছেন, চলছেন, নিঃশ্বাস নিচ্ছেন—তবু কিছুই করছেন না। কারণ কর্ম হয় দেহ-মনের স্তরে, কিন্তু আত্মা কেবল সাক্ষী (Sākṣī)। তাঁর কর্মে তাই কোনো অহংকার বা ফল-প্রত্যাশা নেই। এই শ্লোকটি কর্তৃত্বের অহংকার ত্যাগ (Kartṛtva) নীতির চূড়ান্ত রূপ। এটি জীবন্মুক্ত ব্যক্তির মানসিক অবস্থাকে নির্দেশ করে—
কর্তৃত্বের বিলোপ: তত্ত্বজ্ঞানী জানেন যে, তিনি (আত্মা) হলেন নিষ্ক্রিয় সাক্ষী বা চৈতন্যস্বরূপ। দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়সমূহের যাবতীয় কাজ প্রকৃতির গুণের দ্বারা সম্পন্ন হচ্ছে।
মুক্তির ভিত্তি: এই কর্তৃত্বের অহংকার (আমি কর্তা) না থাকার কারণেই, জ্ঞানী ব্যক্তি কর্ম করেও সেই কর্মের শুভ-অশুভ ফলে লিপ্ত হন না (কুর্বন্নপি ন লিপ্যতে)। ফলস্বরূপ, তাঁর জন্য নতুন কোনো বন্ধন বা কর্মফল সঞ্চিত হয় না।
তৃতীয়ত, ফলের আকাঙ্ক্ষার অনুপস্থিতিই এই কর্মকে আলোকিত করে তোলে। তিনি কর্ম করেন, কিন্তু ফলের প্রতি আসক্ত হন না—“ন লিপ্যতে”—তাঁর কর্ম তাঁকে স্পর্শ করে না। গীতা (৪.১৮) এই অবস্থাকেই বলে “অকর্মণি কর্ম”—যেখানে কর্মের মধ্যেও অকর্মের নীরবতা বিদ্যমান। এই কর্ম কেবল লোকসংগ্রহার্থে—অর্থাৎ, জগতের মঙ্গল, সমাজের স্থিতিশীলতা, ও অন্যদের জন্য আদর্শ স্থাপন করার উদ্দেশ্যে সম্পন্ন হয়।
চতুর্থত, আরাধিত কর্ম হলো চেতনার নিঃস্বার্থ প্রকাশ। মুক্ত পুরুষের কর্ম তাঁর অন্তর্গত ব্রহ্মচেতনার তরঙ্গ। এটি প্রেরণা বা বাধ্যবাধকতা থেকে নয়, বরং স্বতঃস্ফূর্ত করুণার (Karuṇā) থেকে জন্ম নেয়। যেমন সূর্য নিজের আলোক ছড়ায় ফলের প্রত্যাশা ছাড়াই, তেমনি জ্ঞানী কর্ম করেন কেবল স্বরূপের দীপ্তিতে—সেই আলোর মধ্যে আর কোনো ছায়া নেই।
বেদান্তে, বিশেষত অদ্বৈত বেদান্তে, করুণা (Compassion) কোনো সাধারণ আবেগ বা দয়ার অনুভূতি নয়; এটি চেতনার এক মহিমাময় বিকাশ, জ্ঞান (Jñāna)-এর স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। করুণা এখানে নৈতিকতার সীমা ছাড়িয়ে আত্মসিদ্ধ জ্ঞানের এক প্রাকৃতিক ফল, কারণ প্রকৃত করুণা তখনই উদ্ভূত হয়, যখন দ্বৈতবোধ লীন হয়ে যায় এবং সমস্ত সত্তায় এক চৈতন্যের প্রকাশ দেখা যায়।
প্রথমত, করুণার উৎস নিহিত আছে অভেদ জ্ঞান (Oneness)-এ। অদ্বৈত বেদান্তের মূল সিদ্ধান্ত হলো—“ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, জগৎ মিথ্যা, জীব ব্রহ্মভিন্ন অন্য কিছু নয়” (Brahma satyam jaganmithyā, jīvo brahmaiva nāparaḥ)। যখন সাধক উপলব্ধি করেন যে, আত্মা সর্বত্র এক—একই চৈতন্য প্রত্যেক জীবের মধ্যে প্রতিফলিত—তখন “আমি” ও “তুমি”-র বিভেদ বিলীন হয়। তখন অন্যের দুঃখ তাঁর নিজের দুঃখের মতোই অনুভূত হয়; পরোপকার বা সহানুভূতি তখন আর বাহ্যিক কর্তব্য নয়, বরং স্বয়ং-অনুভূতি (Self-feeling)—যেমন এক শরীরের এক অঙ্গ অন্য অঙ্গের যন্ত্রণা অনুভব করে। এই করুণা তাই কৃত্রিম নয়, এটি জ্ঞানোদয়ের অন্তর্গত ফল।
শাস্ত্রে এর সমর্থন বহুবার পাওয়া যায়। ভগবদ্গীতার (১২.১৩) একাদশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে—
অদ্বেষ্টা সর্বভূতানাং মৈত্রঃ করুণ এব চ।
নির্মমো নিরহঙ্কারঃ সমদুঃখসুখঃ ক্ষমী।।
অর্থাৎ, যে-ভক্ত সমস্ত প্রাণীর প্রতি দ্বেষহীন হন, বন্ধুভাবাপন্ন এবং করুণাময় হন; যিনি মমতাশূন্য (‘আমার’-ভাব নেই যাঁর মধ্যে) এবং অহঙ্কারবিহীন (‘আমি’-ভাব নেই যাঁর মধ্যে); যিনি সুখ ও দুঃখে সমদর্শী এবং সহনশীল (ক্ষমাশীল)—তিনিই শ্রেষ্ঠ ভক্ত।