অবিদ্যা-বিদ্যা: ৪২




এই ত্রিস্তরীয় সাধনার জন্যই দরকার আচার্যের সান্নিধ্য। তাই মুণ্ডক উপনিষদ (১.২.১২) বলেন—যে ব্রহ্ম-জ্ঞান চায়, তাকে যেতে হবে সেই গুরুর কাছে, যিনি শাস্ত্রজ্ঞ (শ্রোত্রিয়) এবং ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত (ব্রহ্মনিষ্ঠ)। ব্রহ্মনিষ্ঠ আচার্য না হলে জ্ঞানপ্রদান অসম্ভব, কারণ যিনি নিজে আলোকিত নন, তিনি অন্যকে আলোকিত করতে পারেন না।


‘সমিত্পাণি’—অর্থাৎ হাতে সমিধ কাঠ—এর প্রতীকী অর্থ হলো নম্রতা, বিনয় ও আত্মসমর্পণ। সাধক যখন এইভাবে গুরুর কাছে আত্মসমর্পণ করেন, তখনই তাঁর মধ্যে জাগে ব্রহ্ম-জিজ্ঞাসার প্রকৃত যোগ্যতা।


উপনিষদের শিক্ষা স্পষ্ট—যজ্ঞ, দান, উপাসনা—এসব অনিত্য; কর্মের ফল ক্ষণস্থায়ী; নিত্য সত্য পাওয়া যায় কেবল আত্মবিচারে।


যে-সত্যসন্ধানী এভাবে পরীক্ষা করে, বিচার করে, ত্যাগ করে, এবং ব্রহ্মনিষ্ঠ আচার্যের শরণ নেয়, সে-ই জ্ঞানের পথের উপযুক্ত পথিক। তার সংকল্প তখন একটাই—“আমি আত্মজ্ঞান চাই, আর কিছুই চাই না।” সেই মুহূর্ত থেকেই তার অন্তরের যজ্ঞ শুরু হয়—যেখানে আগুন জ্বলে জ্ঞানের, আর অর্পিত হয় সব অজ্ঞান ও আসক্তি। এখানেই শুরু হয় মুক্তির প্রকৃত যাত্রা—বাহিরের নয়, অন্তরের।


তৃতীয়টি শমাদি-ষট্ক-সম্পত্তি (Śamādi-ṣaṭka Sampatti)। এটি ছয়টি গুণের সমষ্টি, যা মনকে শান্ত ও আত্মজ্ঞানোপযোগী করে তোলে।


প্রথম, শম (Śama)—মনসংযম; মনকে ইন্দ্রিয়বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে আত্মচিন্তায় স্থাপন।

দ্বিতীয়, দম (Dama)—ইন্দ্রিয়নিয়ন্ত্রণ; বাহ্যিক প্রলোভনের প্রতি সংযম।

তৃতীয়, উপরতি (Uparati)—অপ্রয়োজনীয় ক্রিয়াকলাপ ও কর্তব্যবোধ থেকে নিবৃত্তি, অন্তর্মুখতা।

চতুর্থ, তিতিক্ষা (Titikṣā)—সহিষ্ণুতা; সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, নিন্দা-প্রশংসায় সমবৃত থাকা।

পঞ্চম, শ্রদ্ধা (Śraddhā)—শাস্ত্র ও গুরুবাক্যে দৃঢ় বিশ্বাস।

ষষ্ঠ, সমাধান (Samādhāna)—মনকে একাগ্রভাবে আত্মচিন্তায় স্থির রাখা।


বিবেকচূড়ামণি গ্রন্থের শ্লোক ১৯ থেকে ২৫ পর্যন্ত অংশে আচার্য শঙ্করাচার্য মোক্ষ বা মুক্তির প্রয়োজনীয়তা এবং সাধন-চতুষ্টয়ের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। এই অংশটি মূলত একজন মুমুক্ষু (মুক্তির আকাঙ্ক্ষী) ব্যক্তির জন্য আত্ম-অনুসন্ধানের ভিত্তি তৈরি করে।


এই সাতটি শ্লোক পরপর মোক্ষ লাভের জন্য একজন সাধকের মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি এবং যোগ্যতার অপরিহার্যতা ব্যাখ্যা করে:


শ্লোক ১৯: মানবজন্মের দুর্লভতা

শঙ্কর বলেন, মনুষ্যজন্ম অত্যন্ত দুর্লভ (Rare) এবং তার মধ্যে মুমুক্ষুত্ব (মুক্তির আকাঙ্ক্ষা) লাভ করা তার চেয়েও দুর্লভ। আর সেই মুমুক্ষুত্ব-সহ মহাপুরুষের আশ্রয় (জ্ঞানী গুরুর সাহচর্য) লাভ করা আরও দুর্লভ।


শ্লোক ২০: মোক্ষলাভের সুযোগ

তিনি যুক্তি দেন যে, এই দুর্লভ মানবদেহ এবং শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করেও যদি কেউ আত্মজ্ঞানে (Self-realization) মোক্ষ লাভ না করে, তবে সে যেন নিজেই নিজের আত্মহত্যা করছে। তিনি বলেন, যে এই সুযোগ হাতছাড়া করে, তার চেয়ে বড় মূঢ় আর কেউ নেই।


শ্লোক ২১: অমৃতত্ব লাভের উপায়

শঙ্কর ঘোষণা করেন, বেদান্ত শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত হলো—জ্ঞানী মানুষ কখনোই কর্মের দ্বারা অমরত্ব (অমৃতত্ব) লাভ করতে পারে না, বরং একমাত্র বিবেক বা জ্ঞান দ্বারাই তা লাভ করা সম্ভব। এই শ্লোকটি জ্ঞান ও কর্মের বিরোধিতার (জ্ঞান-কর্ম বিরোধ) অদ্বৈতবাদী অবস্থানকে দৃঢ় করে।


জ্ঞান-কর্ম-বিরোধ (Jñāna-Karma-Virodha) অদ্বৈত বেদান্তের এক মৌলিক তত্ত্ব, যার দ্বারা শঙ্করাচার্য প্রমাণ করেছেন যে, মুক্তি বা মোক্ষ কেবল জ্ঞানের ফল, কর্মের নয়। কারণ জ্ঞান ও কর্ম—এই দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে চলে, এবং তাদের লক্ষ্য, প্রকৃতি ও ফল একে অপরের পরিপূর্ণ বিরোধী।


কর্ম সর্বদা দ্বৈততার উপর প্রতিষ্ঠিত। কর্ম করতে গেলে কর্তা, কর্ম ও ফল—এই তিনের ভেদ থাকা আবশ্যক। যে কাজ করছে, যে-কাজটি হচ্ছে, আর যে-ফল সে চায়—এই তিনের পার্থক্যই কর্মের ভিত্তি। অন্যদিকে, জ্ঞান প্রকাশ করে অদ্বৈত সত্য—যেখানে কোনো ভেদ নেই, কোনো কর্ম নেই, কোনো কর্তা নেই। যখন আত্মা উপলব্ধি হয়—“আমি কর্তা নই, আমি কর্মফলভোগী নই, আমি কেবল সাক্ষী”—তখনই বোঝা যায়, জ্ঞান ও কর্ম একই সঙ্গে থাকতে পারে না। তাই শঙ্করাচার্য তাঁর ভাষ্যে বলেন—“ন হি জ্ঞানের সন্নিধৌ কর্ম বিদ্যতে”—অর্থাৎ, যেখানে জ্ঞান উদয় হয়, সেখানে কর্মের স্থান থাকে না।


এই সূত্র জ্ঞান এবং কর্মের মধ্যকার মৌলিক বিরোধ (জ্ঞান-কর্ম বিরোধ) ব্যাখ্যা করে। এর মাধ্যমে অদ্বৈত বেদান্ত মোক্ষলাভের ক্ষেত্রে জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করে:


কর্মের ভিত্তি অজ্ঞান: কর্ম (বৈদিক আচার, যজ্ঞ, পুণ্যকর্ম) সর্বদা কর্তা (আমি), কর্ম এবং ফল—এই দ্বৈততার ওপর নির্ভরশীল। এই দ্বৈততার মূল কারণ হলো অজ্ঞান বা অবিদ্যা (আমি দেহ, আমি কর্তা—এই ভ্রান্ত বোধ)। যতক্ষণ অজ্ঞান থাকে, ততক্ষণই কর্মের প্রয়োজন হয়।


জ্ঞানের স্বরূপ: জ্ঞান এখানে আত্মা ও ব্রহ্মের অভেদ জ্ঞান বা আত্মোপলব্ধি। জ্ঞান হলো অজ্ঞানের বিনাশক।


আলো-অন্ধকারের উপমা: ঠিক যেমন আলো এলে অন্ধকার আর থাকতে পারে না (অন্ধকারের পৃথক অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়), তেমনই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হলে কর্মের ভিত্তি যে-অজ্ঞান, তা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়।


ফল: জ্ঞানীর কর্ম বন্ধন সৃষ্টি করে না। যদিও তাঁর শরীর কর্ম করে, কিন্তু তিনি নিজেকে কর্তা মনে করেন না। ফলে তাঁর কর্মের ফল তাঁকে স্পর্শ করে না।


এই উক্তিটি শঙ্করের সেই সিদ্ধান্তকে দৃঢ় করে যে, জ্ঞানই মোক্ষের একমাত্র সরাসরি কারণ, এবং কর্ম কেবল চিত্তশুদ্ধি করে জ্ঞানলাভের পথ প্রস্তুত করে।


বেদে কর্মের নির্দেশ (যজ্ঞ, দান, তপস্যা ইত্যাদি) দেওয়া হয়েছে গৃহস্থ ও ফলপ্রার্থী মানুষের জন্য। কর্মের ফল সর্বদা সীমাবদ্ধ ও অনিত্য—যজ্ঞ করলে স্বর্গলাভ হয়, কিন্তু সেই স্বর্গও ক্ষণস্থায়ী। উপনিষদ স্পষ্ট বলেছে—“নিত্যম্ অনিত্যেন ন লভ্যতে” (কঠোপনিষদ, ২.১.১০)—নিত্য (চিরন্তন বস্তু) অনিত্য বস্তু দ্বারা লাভ করা যায় না, অর্থাৎ, যা নিত্য, তা অনিত্য দ্বারা অর্জনীয় নয়। ব্রহ্ম নিত্য, কর্ম অনিত্য—অতএব, কর্ম দ্বারা ব্রহ্মলাভ অসম্ভব।


এই মন্ত্রটি যম (মৃত্যু-দেবতা) নচিকেতাকে তাঁর প্রদত্ত ব্রহ্মজ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন। এটি জ্ঞানযোগ এবং বৈরাগ্যের অপরিহার্যতা তুলে ধরে:


নিত্যম্ (Nityam): এখানে নিত্য বলতে পরমাত্মা বা ব্রহ্মকে বোঝানো হয়েছে, যা একমাত্র চিরন্তন সত্য। মোক্ষ বা মুক্তিকেও এই নিত্য ফলের অংশ হিসেবে ধরা হয়।

অনিত্যেন (Anityena): অনিত্য বলতে জাগতিক বস্তু, কর্ম বা কর্মফল (যেমন স্বর্গাদি লোক) বোঝানো হয়েছে, যা ক্ষণস্থায়ী ও বিনাশী।

ন লভ্যতে (Na Labhyate): লাভ করা যায় না।


এই উক্তির মাধ্যমে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, যা-কিছু অস্থায়ী (কর্ম বা তার ফল), তা কখনোই চিরন্তন (ব্রহ্ম বা মোক্ষ) ফল এনে দিতে পারে না। মোক্ষ বা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে হলে অবশ্যই অনিত্য বস্তুর প্রতি আসক্তি ত্যাগ করে নিত্য বস্তুর অনুসন্ধান করতে হবে। এই ধারণাটি অদ্বৈত বেদান্তে জ্ঞান-কর্ম বিরোধ এবং বৈরাগ্যের গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠা করে।


অন্যদিকে, কর্মের মূল উৎস হলো অবিদ্যা। মানুষ যখন নিজেকে দেহ-মনের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করে, তখনই বলে “আমি করি, আমি ভোগ করি।” এই কর্তা-ভাবই কর্মের জননী। যতক্ষণ এই ভাব টিকে থাকে, ততক্ষণ কর্মও টিকে থাকে। কর্মফল আসে, ফল নতুন ইচ্ছা জাগায়, ইচ্ছা নতুন কর্ম তৈরি করে—এই চক্রই সংসারবন্ধন।


কিন্তু জ্ঞান এই চক্রকে ছিন্ন করে। জ্ঞান এখানে বুদ্ধিবৃত্তি নয়, আত্ম-সাক্ষাৎকার—“অহং ব্রহ্মাস্মি” (বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ১.৪.১০) অর্থাৎ, আমিই ব্রহ্ম—এই অভিজ্ঞতা। জ্ঞান উদয় মানে অবিদ্যা বিলুপ্তি। যেমন সূর্য উঠলে অন্ধকার থাকে না, তেমনি আত্মজ্ঞান উদিত হলে কর্তা-ভাব ও ফল-লোভ মুছে যায়। জ্ঞানী জানেন—“আমি না কর্তা, না ভোক্তা; আমি কেবল চৈতন্য।” তখন তাঁর জন্য কোনো “করণীয়” অবশিষ্ট থাকে না, কারণ যা অর্জন করতে চেয়েছিলেন—সেই আত্মাই তিনি নিজে।


এই জ্ঞান-কর্ম বিরোধের ভিত্তি বহু শাস্ত্রে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। “নায়ম্ আত্মা প্রবচনেন লভ্যঃ, ন মেডয়ান্, ন বহুনা শ্রুতেন” (কঠোপনিষদ, ১.২.২৩ এবং মুণ্ডক উপনিষদ, ৩.২.৩—এই দুটি উপনিষদেই মন্ত্রটি সামান্য পরিবর্তিত রূপে প্রায় একই বক্তব্য নিয়ে পুনরাবৃত্ত হয়েছে।), অর্থাৎ—এই আত্মাকে বক্তৃতা বা শাস্ত্রের আলোচনার মাধ্যমে লাভ করা যায় না, মেধাশক্তির দ্বারাও লাভ করা যায় না, কিংবা বহু-শাস্ত্র শ্রবণের দ্বারাও লাভ করা যায় না।


এই মন্ত্রটি ব্রহ্মজ্ঞান বা আত্মোপলব্ধি লাভের জন্য প্রচলিত জাগতিক পদ্ধতিগুলোর সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে এবং অভ্যন্তরীণ অনুভূতির গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠা করে:


প্রবচনেন (Pravacanena): বক্তৃতা বা শাস্ত্রের আলোচনা (অর্থাৎ, কেবল বাইরের উপদেশ বা পঠন-পাঠন) দ্বারা জ্ঞানকে ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু কেবল ব্যাখ্যা শুনে আত্মাকে উপলব্ধি করা যায় না।

মেধয়া (Medhayā): মেধাশক্তি বা তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। আত্মা কোনো যুক্তি বা বৌদ্ধিক বিচারের বিষয় নয়, যা কেবল বুদ্ধি দিয়ে সমাধান করা যাবে।

বহুনা শ্রুতেন (Bahunā Śrutena): বহু শাস্ত্র শ্রবণের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান। কেবল প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করে বা বহু শাস্ত্র মুখস্থ করে আত্মাকে জানা যায় না।


মুণ্ডক উপনিষদ (৩.২.৩) অনুযায়ী, মন্ত্রটির পরের অংশটি—যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্যস্তস্যৈষ আত্মা বিবৃণুতে তনূং স্বাম্। অর্থাৎ, আত্মাকে কেবল সেই ব্যক্তিই লাভ করতে পারেন, যাকে আত্মা নিজে নির্বাচন করেন (বা যিনি আত্মাকে আন্তরিকভাবে কামনা করেন)। অর্থাৎ, আত্মা-লাভ হয় কৃপা, তীব্র আকাঙ্ক্ষা (মুমুক্ষুত্ব) এবং নিবিড় ধ্যানের মাধ্যমে, বাহ্যিক কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ের দ্বারা নয়। এটি বোঝায় যে, শাস্ত্র-অধ্যয়ন একটি প্রস্তুতি মাত্র, কিন্তু চূড়ান্ত উপলব্ধি ঘটে সাক্ষাৎ অনুভূতির মাধ্যমে।


যম্ এব এষ বৃণুতে: এই আত্মাকে কেবল সেই ব্যক্তিই লাভ করতে পারেন, যাকে আত্মা নিজে নির্বাচন করেন (অর্থাৎ, যাকে আত্মা কৃপা করেন) বা যে-সাধক আন্তরিকভাবে আত্মাকে লাভ করার সংকল্প করেন।

তেন লভ্যঃ: তার দ্বারাই আত্মাকে লাভ করা যায়।

তস্য এষ আত্মা বিবৃণুতে তনূং স্বাম্: তাঁর কাছেই এই আত্মা তাঁর নিজের স্বরূপ প্রকাশ করেন।


এই মন্ত্রের মাধ্যমে উপনিষদ প্রতিষ্ঠা করে যে, আত্মজ্ঞান লাভের জন্য মেধা বা শাস্ত্রের পাণ্ডিত্য যথেষ্ট নয়। জ্ঞান লাভের জন্য প্রয়োজন—

কৃপা: আত্মার কৃপা বা অনুগ্রহ, যা আসে সাধকের তীব্র ব্যাকুলতা ও আন্তরিকতার মাধ্যমে।

আত্মাভিলাষ: এটি সেই সাধকই লাভ করতে পারেন, যিনি আত্মাকেই একমাত্র কাম্য বস্তু হিসেবে স্থির করেছেন এবং এই কামনার তীব্রতায় আর কোনো জাগতিক আকাঙ্ক্ষা রাখেন না (মুমুক্ষুত্ব)।

সাক্ষাৎকার: চূড়ান্ত উপলব্ধিটি কোনো তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া নয়, বরং আত্মার স্বয়ং প্রকাশ বা সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে ঘটে।


অর্থাৎ, আত্মাকে লাভের প্রকৃত উপায় হলো সকল বাহ্যিক অবলম্বন ছেড়ে অন্তঃকরণকে শুদ্ধ করা এবং তীব্র ব্যাকুলতার সঙ্গে আত্মার উপলব্ধির জন্য প্রতীক্ষা করা। আত্মা বক্তৃতা, পাণ্ডিত্য বা অধ্যয়নে লাভ হয় না; তিনি লাভ হন কেবল তাঁর দ্বারা, যাঁর মধ্যে আত্মা নিজে প্রকাশিত হন।


গীতা বলে—

য়থৈধাংসি সমিদ্ধোঽগ্নির্ভস্মসাত্কুরুতেঽর্জুন।

জ্ঞানাগ্নিঃ সর্বকর্মাণি ভস্মসাত্কুরুতে তথা।। (ভগবদ্গীতা, ৪.৩৭)

অর্থাৎ, যেমন প্রজ্বলিত অগ্নি কাঠসমূহকে ভস্মীভূত করে, তেমনই জ্ঞানরূপ অগ্নি মানুষের সমস্ত কর্মকে ভস্মীভূত করে দেয়।


এই সূত্রটি জ্ঞানযোগের চরম ক্ষমতা তুলে ধরে। জ্ঞানাগ্নি দ্বারা কর্ম দগ্ধ হওয়ার অর্থ হলো:

অজ্ঞানের বিনাশ: কর্মের মূলে থাকে অজ্ঞান বা কর্তৃত্বের অহংকার। ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হলে এই অজ্ঞান দূর হয়।

বন্ধনমুক্তি: জ্ঞান অগ্নি দ্বারা কর্ম দগ্ধ হলে, সেই কর্মের ফল বা সংস্কার আর বন্ধন সৃষ্টি করতে পারে না।

জীবন্মুক্ত অবস্থা: এর দ্বারা জ্ঞানী ব্যক্তি জীবন্মুক্ত অবস্থায় স্থিত হন, কারণ তাঁর পুরাতন সঞ্চিত কর্ম (যা ফল দেওয়ার জন্য অপেক্ষায় ছিল) এবং সঞ্চীয়মান কর্ম (যা বর্তমানে নতুনভাবে অর্জিত হচ্ছিল)—তা জ্ঞান দ্বারা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।


তাই, এই বাক্যটি হলো অদ্বৈত বেদান্তের সেই সিদ্ধান্ত, যা প্রতিষ্ঠা করে যে, মোক্ষলাভে কর্মের কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই; জ্ঞানই একমাত্র মোক্ষ লাভের কারণ।