“অসক্তিঃ অনভিষ্বঙ্গঃ পুত্রদারগৃহাদিষু:” অর্থ—অসক্তিঃ (Asaktiḥ): কোনো কিছুর প্রতি আসক্ত না হওয়া বা অনাসক্তি। অনভিষ্বঙ্গঃ (Anabhishvaṅgaḥ): গভীরভাবে জড়িয়ে না যাওয়া বা নিজেকে একান্তভাবে সেই বস্তুর সঙ্গে চিহ্নিত না করা। পুত্রদারগৃহাদিষু (Putradāragṛhādiṣu): বিশেষত পুত্র, স্ত্রী (দার), গৃহ ইত্যাদির প্রতি।
“নিত্যং চ সমচিত্তত্বম্ ইষ্টানিষ্টোপপত্তিষু” অর্থ—নিত্যং চ সমচিত্তত্বম্ (Nityaṁ ca samacittatvam): সর্বদা সমচিত্ত থাকা বা মনের সমতা বজায় রাখা। ইষ্টানিষ্টোপপত্তিষু (Iṣṭāniṣṭopapattiṣu): যা ইষ্ট (কাম্য, প্রিয়, শুভ) এবং যা অনিষ্ট (অকাম্য, অপ্রিয়, অশুভ) ফল, তা উপস্থিত হলে (প্রাপ্ত হলে)।
পুত্র, স্ত্রী, গৃহ এবং অন্যান্য বিষয়ে আসক্তি ও আসক্ত না হওয়া, এবং লাভ বা ক্ষতি (ইষ্ট ও অনিষ্ট) উভয় পরিস্থিতিতেই সর্বদা মানসিক সমতা বা অবিচল থাকা, এগুলোই জ্ঞানী বা জ্ঞানীর লক্ষণ। অর্থাৎ, অনিত্য বস্তুর প্রতি আসক্তি পরিত্যাগ করতে হবে, কারণ এগুলো পরিবর্তনশীল। এই শ্লোকটি প্রমাণ করে যে, জ্ঞান কেবল পুঁথিগত বিদ্যার নাম নয়, বরং এটি হলো আচরণের গুণাবলি এবং মানসিক স্থিতি।
বন্ধন থেকে মুক্তি: এই গুণটির মাধ্যমে জ্ঞানী ব্যক্তি জাগতিক বন্ধনের প্রধান উৎস—পরিবার, সম্পর্ক ও সম্পত্তি—থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেন। এখানে ত্যাগ মানে সম্পর্ক ছিন্ন করা নয়, বরং সেই সম্পর্ক বা বস্তুর প্রতি স্বার্থপর আসক্তি (মমতা) ত্যাগ করা।
সমত্ববুদ্ধি: চরম জ্ঞান লাভের জন্য মনকে অবশ্যই সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি এবং প্রিয়-অপ্রিয়—এই সমস্ত দ্বন্দ্বে অবিচলিত রাখতে হবে। এই সমচিত্তত্ব মোক্ষ লাভের জন্য অপরিহার্য, কারণ এটি প্রমাণ করে যে, ব্যক্তি জাগতিক দ্বৈততার ঊর্ধ্বে উঠেছেন।
অতএব, এই শ্লোকটি অনাসক্তি এবং সমতা—এই দুটিকে আত্মজ্ঞান বা মোক্ষলাভের পথে প্রধান যোগ্যতা হিসেবে চিহ্নিত করে।
“অব্যয়ম্ অনিত্যম্”—এক দার্শনিক মিশ্র বাক্য—যা সম্ভবত কোনো দার্শনিক গ্রন্থে বা টীকা-রূপে ব্যবহৃত হয়েছে, যেখানে লেখক এই দুই শব্দের পার্থক্য ব্যবহার করে এক বিশেষ ভাব প্রকাশ করেছেন—যা অব্যয় বলে মনে হয়, সেটিও অনিত্য। অদ্বৈত বেদান্তে, “অব্যয়” (আত্মা) একমাত্র সত্য; কিন্তু অবিদ্যা-র প্রভাবে জগৎও “অব্যয়সদৃশ” বলে মনে হয়, যদিও তা অনিত্য।
এভাবেই, কিছু দার্শনিক, বিশেষত গৌড়পাদাচার্য ও তাঁর অনুসারীরা, আপাত-অব্যয়ের মধ্যে অনিত্যতাকে দেখিয়েছেন—“অজম্ অনিদ্রাম্ অস্বপ্নাম্ অদ্বিতীয়াম্ চ তত্ত্বতঃ” (মাণ্ডূক্য কারিকা, ৩.৩৬), যার অর্থ—তাঁকে জন্মরহিত, নিদ্রাহীন, স্বপ্নহীন এবং পরমার্থত অদ্বিতীয় বলে জানবে।
এই শ্লোকটি ব্রহ্মের (তুরীয় আত্মা) স্বরূপ বর্ণনা করে এবং অদ্বৈত জ্ঞানকে প্রতিষ্ঠা করে। এটি মূলত জীবের তিনটি সাধারণ অবস্থাকে অস্বীকার করে ব্রহ্মের নিত্যতা প্রমাণ করে:
অজম্ (Ajam): তিনি জন্মনিরহিত। এর অর্থ হলো তাঁর সৃষ্টি নেই, অর্থাৎ, তিনি পরিবর্তনশীল নন। এটি অদ্বৈত বেদান্তের অজাতিবাদ-এর মূলভাবকে সমর্থন করে।
অনিদ্রাম্ (Anidrām): তিনি নিদ্রাহীন। এই 'নিদ্রা' বলতে সুষুপ্তি বা গভীর নিদ্রার অবস্থাকে বোঝায়। তিনি সুষুপ্তি অবস্থার অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত।
অস্বপ্নাম্ (Asvapnām): তিনি স্বপ্নহীন। এই 'স্বপ্ন' বলতে স্বপ্নাবস্থা এবং জাগ্রত অবস্থা—উভয়কেই বোঝানো হয়। তিনি এই দুটি অবস্থার ভ্রম বা দ্বৈততা থেকে মুক্ত।
অদ্বিতীয়াম্ চ তত্ত্বতঃ (Advitiyām ca tattvataḥ): এবং, তিনি পরমার্থত বা চূড়ান্ত সত্যে অদ্বিতীয়। অর্থাৎ, তাঁর থেকে ভিন্ন কোনো দ্বিতীয় সত্তা নেই।
এই শ্লোকটি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে যে, মোক্ষ হলো সেই তুরীয় অবস্থা, যা জন্ম-মৃত্যুর ঊর্ধ্বে এবং জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তির ভ্রান্তি থেকে মুক্ত।
সাধন-চতুষ্টয়ের দ্বিতীয়টি ইহ-অমুত্র-ফল-ভোগ-বিরাগ (Iha-amutra Phala-bhoga Virāga)। এর অর্থ—ইহলোকে (এই পৃথিবীতে) ও অমুত্রলোকে (স্বর্গাদি স্থানে) কর্মফল ভোগের প্রতি সম্পূর্ণ অনাসক্তি।
বৈরাগ্য মানে জগৎ-ত্যাগ নয়; বরং জাগতিক ফলভোগের প্রতি আকর্ষণহীনতা। গীতায় বলা হয়েছে—“অনিত্যমসুখং লোকমিমং প্রাপ্য ভজস্ব মাম্” (গীতা, ৯.৩৩)। অর্থাৎ, “এই অনিত্য (ক্ষণস্থায়ী) এবং অসুখময় (দুঃখপূর্ণ) লোকে (জগতে) জন্ম নিয়ে আমাকে ভজনা করো (আমার উপাসনা করো)।”
এই শ্লোকটি মোক্ষ বা মুক্তির জন্য ভক্তিযোগের গুরুত্ব এবং জাগতিক জীবনের প্রকৃতি বর্ণনা করে:
জগতের স্বরূপ: শ্রীকৃষ্ণ জাগতিক জীবনকে দুটি বিশেষণে বর্ণনা করেছেন: অনিত্যম্ (Anityam): ক্ষণস্থায়ী, বিনাশী বা পরিবর্তনশীল। অসুখম্ (Asukham): দুঃখপূর্ণ বা যেখানে স্থায়ী সুখ নেই।
জীবের কর্তব্য: যেহেতু এই মানবজীবন ক্ষণস্থায়ী এবং দুঃখময়, তাই এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। এই জীবন লাভ করে (ইমং প্রাপ্য), মানুষকে সেই পরম সত্তার (মাম্) ভজনা বা উপাসনা করতে হবে (ভজস্ব)।
এই শ্লোকটি কেবল ভক্তিযোগের উপদেশই নয়, এটি একটি দার্শনিক আহ্বান—জীবাত্মাকে তার ক্ষণস্থায়ীতা উপলব্ধি করে, অনিত্য বস্তু ছেড়ে নিত্য ও শাশ্বত সত্যের (ব্রহ্ম/ঈশ্বর) দিকে মনোনিবেশ করতে বলা হয়েছে।
সাধক যাতে বুঝতে পারেন—কোনো ইন্দ্রিয়ভোগই স্থায়ী নয়; তাই প্রকৃত সুখের পথ কেবল আত্মজ্ঞানেই। বৈরাগ্য-বোধের পরিণতি—যখন সাধক দেখেন যে, ইন্দ্রিয়সুখ ক্ষণস্থায়ী ও অপূর্ণ, তখন তাঁর মন স্বয়ং বৈরাগ্যে স্থিত হয়। মুণ্ডক উপনিষদে (১.২.১২) বলা হয়েছে—
পরীক্ষ্য লোকান্ কর্মচিতান্ ব্রাহ্মণো
নির্বেদমায়ান্নাস্ত্যকৃতঃ কৃতেন।
তদ্বিজ্ঞানার্থং স গুরুমেবাভিগচ্ছেৎ
সমিৎপাণিঃ শ্ৰোত্ৰিয়ং ব্রহ্মনিষ্ঠম্।।
অন্বয়: কর্মচিতান্ (কর্মের দ্বারা অর্থাৎ যাগযজ্ঞের দ্বারা লব্ধ); লোকান্ (লোকসকলকে); পরীক্ষ্য (পরীক্ষা করে); ব্রাহ্মণঃ (ব্রাহ্মণ যিনি ব্রহ্মজিজ্ঞাসু); নির্বেদম্ (বৈরাগ্য); আয়াৎ (অভ্যাস করবেন); [যেহেতু] কৃতেন (কর্মের দ্বারা); অকৃতঃ (অকৃত অর্থাৎ নিত্যবস্তু); ন অস্তি (হয় না; লাভ হয় না); তৎ (সেই নিত্যবস্তু); বিজ্ঞানার্থম্ (জানবার জন্য); সঃ (তিনি); সমিৎপাণিঃ (সমিধ কাঠ হাতে নিয়ে); শ্রোত্রিয়ম্ (বেদজ্ঞ); ব্রহ্মনিষ্ঠম্ গুরুম্ (ব্রহ্মনিষ্ঠ গুরুর কাছে); এব অভিগচ্ছেৎ (যান)।
আনুষ্ঠানিক উপাসনাদির ফল যে ক্ষণস্থায়ী, একথা ব্রহ্মজিজ্ঞাসু জানেন। তাই এই জাতীয় অনুষ্ঠান তাঁকে আর আকর্ষণ করে না। তিনি বুঝে গেছেন—যা নিত্য, তা অনিত্য-ক্রিয়াকর্মের দ্বারা কখনও পাওয়া যায় না। যজ্ঞ, দান, তীর্থ, পূজা, প্রার্থনা—এসবের ফল সীমাবদ্ধ, সময়সাপেক্ষ এবং ক্ষয়িষ্ণু; কিন্তু আত্মা অনাদি, অনন্ত, অপরিবর্তনীয়। তাই তিনি সেই আত্মাকে লাভের জন্য বাহ্যিক ক্রিয়া নয়, অন্তর্মুখী জ্ঞানই অনুসন্ধান করেন। এই উপলব্ধির কারণেই তিনি ব্রহ্মনিষ্ঠ আচার্যের অনুসন্ধান করেন, কারণ আত্মার জ্ঞান একমাত্র জীবন্ত গুরুর (‘সদ্গুরু’ অর্থে) কৃপায়ই জাগ্রত হয়। নম্রতার প্রতীক হিসেবে তিনি সমিধ কাঠ (যজ্ঞ বা হোমের জন্য ব্যবহৃত পবিত্র কাঠ) হাতে নিয়ে, বিনম্র চিত্তে সেই আচার্যের নিকট উপস্থিত হন।
‘পরীক্ষ্য’ কথাটির অর্থ হলো—পরীক্ষা করা, বিচার করা, বিবেচনা করা। উপনিষদ বলেন—“পরীক্ষ্য লোকান্ কর্মচিতান্।” এখানে নির্দেশ হচ্ছে, সাধককে নিজের অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করতে হবে, নিত্য-অনিত্য বিচার করতে হবে। ‘কর্মচিতান্’ মানে কর্ম দ্বারা সৃষ্ট বস্তু, আর ‘অকৃতঃ’ মানে যা কখনও সৃষ্টি হয়নি—যেমন আত্মা। আত্মা অনাদি, তার উৎপত্তি বা বিনাশ নেই; তাই উপনিষদ বলছেন—যজ্ঞাদি অনিত্য কর্মের দ্বারা (কৃতেন) অকৃত, অর্থাৎ নিত্য আত্মাকে পাওয়া যায় না।
সকাম কর্ম করলে আমরা যা ফল পাই, তা সাময়িক; তাই উপনিষদ নির্দেশ দিচ্ছে—ফলভোগের আগে বিবেচনা করো, এই ফল কি স্থায়ী? নিজেকে প্রশ্ন করো: “এই কর্মের দ্বারা কি মনের স্থায়ী শান্তি মিলবে? আমি কি এর দ্বারা মোক্ষলাভ করব?” যখন এই প্রশ্ন সত্যভাবে করা হয়, তখন মনের মধ্যে এক স্বাভাবিক বৈরাগ্য জন্মায়। উপনিষদ সেই অবস্থাকে বলে—‘নির্বেদম্ আয়াৎ’—অর্থাৎ অনাসক্তি, যেখানে ভোগের আকর্ষণ মুছে যায়।
কঠ উপনিষদের নচিকেতার কাহিনি এই সত্যের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। যম নচিকেতাকে নানা ভোগ-বিলাসের প্রস্তাব দিয়ে প্রলুব্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নচিকেতা নিজের মনে প্রশ্ন করলেন—“এই সব বস্তু কি আমাকে মুক্তি দিতে পারবে? বা মনের শান্তি দিতে পারবে?” যখন তিনি জানলেন—না, তা কখনও পারে না, তখন তিনি তৎক্ষণাৎ সব প্রত্যাখ্যান করলেন। এভাবেই বৈরাগ্য জন্মায়—যখন মানুষ সত্যিই বোঝে যে, সুখের কোনো বাহ্য উৎস নেই।
এই একই চেতনা দেখা যায় শ্রী রামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের কথোপকথনে। একদিন শ্রী রামকৃষ্ণ স্বামীজিকে অষ্টসিদ্ধি দিতে চান। স্বামীজির প্রশ্ন—“এই দ্বারা কি আত্মজ্ঞান বা মোক্ষলাভ হবে?” রামকৃষ্ণ বললেন—“না।” স্বামীজি উত্তর দিলেন—“তবে ওসব আমার প্রয়োজন নেই।” এভাবেই আত্মজ্ঞানপথে সত্যসন্ধানী হন নির্মোহ ও আপসহীন। যেমন তিনি জানতেন, একসঙ্গে দুই কূল ধরা যায় না—একূল ও ওকূল রক্ষা করতে গেলে দু-কূলই ভেসে যায়। তাই মুক্তির জন্য চাই আপসহীন তীব্র আকাঙ্ক্ষা—“আমি আত্মজ্ঞান চাই, আর কিছুই চাই না। এই দেহের যা হয় হোক, আমি সত্যকে জানবই।”
অষ্টসিদ্ধি (Aṣṭa Siddhi) হলো হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মে বর্ণিত আট প্রকার অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা বা যোগিক শক্তি। যোগশাস্ত্র অনুযায়ী, দীর্ঘ ও গভীর যোগসাধনার মাধ্যমে সাধক এই শক্তিগুলি লাভ করতে পারেন। এই শক্তিগুলি সাধারণত দৈহিক বা জাগতিক নিয়ম লঙ্ঘন করে অলৌকিক কাজ করার ক্ষমতা প্রদান করে।
অষ্টসিদ্ধি আটটি প্রধান অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে গঠিত। এই ক্ষমতাগুলিকে সাধারণত নিম্নলিখিতভাবে বর্ণনা করা হয়:
১. অণিমা (Aṇimā): এই সিদ্ধি লাভ করলে সাধক তার শরীরকে ক্ষুদ্রতম কণায় পরিণত করতে পারেন বা তাঁর নিজেকে অত্যন্ত ছোটো করে ফেলতে পারেন (যেমন, পরমাণুর মতো ছোটো)।
২. মহিমা (Mahimā): এই ক্ষমতার মাধ্যমে সাধক তার শরীরকে ইচ্ছামতো বৃহৎ বা অত্যন্ত বিশাল করে তুলতে পারেন (যেমন,পর্বতের মতো বিশাল)।
৩. লঘিমা (Laghimā): এই সিদ্ধির সাহায্যে সাধক তার শরীরকে অত্যন্ত হালকা করে ফেলতে পারেন, এমনকি বাতাসের চেয়েও হালকা করতে পারেন। এর ফলে তিনি শূন্যে ভাসতে বা উড়তে পারেন।
৪. প্রাপ্তি (Prāpti): এই সিদ্ধি দ্বারা সাধক যে-কোনো স্থানে—তা যত দূরেই হোক না কেন—যে-কোনো বস্তুকে স্পর্শ করতে বা তাৎক্ষণিকভাবে লাভ করতে পারেন।
৫. প্রাকাম্য (Prākāmya): এটি হলো ইচ্ছাপূরণের ক্ষমতা। এই সিদ্ধি দ্বারা সাধক তাঁর যে-কোনো ইচ্ছা পূরণ করতে পারেন এবং অন্যের মনে প্রবেশ করতে পারেন।
৬. ঈশিত্ব (Īśitva): এই ক্ষমতা দ্বারা সাধক প্রকৃতি ও পঞ্চভূতের ওপর কর্তৃত্ব লাভ করেন এবং অন্যের মন ও দেহকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এক অর্থে, এটি হলো ঈশ্বরের মতো ক্ষমতা।
৭. বশিত্ব (Vaśitva): এই সিদ্ধি দ্বারা সাধক সকল জীবকে (মানুষ, পশু, প্রকৃতি) এবং ইন্দ্রিয়গুলিকে সম্পূর্ণভাবে বশীভূত বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
৮. কামাবসায়িতা (Kāmāvasāyitā): এটি হলো সকল প্রকার কামনা এবং জাগতিক আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্তি বা সংকল্পের চূড়ান্ত সিদ্ধি। এটি সাধককে তাঁর ঈপ্সিত বস্তুকে চূড়ান্তভাবে জয় করার এবং সেই বস্তু থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করার ক্ষমতা দেয়।
যোগ দর্শনে, বিশেষত পতঞ্জলির যোগসূত্রে, এই সিদ্ধিগুলিকে বিভূতির (অলৌকিক ক্ষমতা) অংশ হিসেবে দেখা হয়। যদিও এই শক্তিগুলি সাধনার মাধ্যমে অর্জিত হয়, তবে যোগীরা সতর্ক করে দেন যে, এই অলৌকিক শক্তিগুলিতে আসক্ত হওয়া উচিত নয়। এই আসক্তি মোক্ষ বা কৈবল্য লাভের পথে বাধা সৃষ্টি করে, কারণ চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো এই জাগতিক ক্ষমতাগুলিকেও অতিক্রম করে বিশুদ্ধ চৈতন্যে স্থিত হওয়া।
উপনিষদ বার বার বলছেন—নিত্য-অনিত্য বিচার করতে হবে, যুক্তি ও ধ্যান দ্বারা মনকে নির্মল করতে হবে। এই বিচার ও অনুশীলনের তিন ধাপ হলো—শ্রবণ, মনন, ও নিদিধ্যাসন। শ্রবণ মানে গুরু বা শাস্ত্র থেকে পরমতত্ত্বের বাণী শোনা—যেমন মহাবাক্য “তত্ত্বমসি”—“তুমি সেই ব্রহ্ম।” মনন মানে সেই বাক্যের অর্থ নিয়ে যুক্তি ও আত্মবিচারে চিন্তা করা, সন্দেহ দূর করা। নিদিধ্যাসন মানে সেই তত্ত্বে স্থিত ধ্যান—যতক্ষণ না শোনা ও চিন্তা অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়, আর “আমি” ও “ব্রহ্ম”—এই দুইয়ের ভেদ বিলীন হয়।