অবিদ্যার প্রকৃতি: সূত্রটি স্পষ্ট করে যে, ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পর অবিদ্যা (অজ্ঞান) বাস্তবে কোথাও বিদ্যমান নয় (নাস্তি), কারণ ব্রহ্ম হলেন শুদ্ধ জ্ঞান বা চৈতন্য।
সিদ্ধান্ত: ব্রহ্ম যেহেতু এক ও অদ্বিতীয় (একম্ অদ্বিতীয়ম্)—অর্থাৎ, তাঁর থেকে ভিন্ন কোনো দ্বিতীয় বস্তু নেই—তাই অবিদ্যাও ব্রহ্মের বাইরে অন্য কোনো স্বতন্ত্র সত্য হতে পারে না। এটি প্রমাণ করে যে, অবিদ্যা কেবল ভ্রম বা প্রতীতি মাত্র।
যেমন আলো জ্বাললে আমরা বলি—“অন্ধকার চলে গেছে”, অথচ বাস্তবে অন্ধকার কোথাও যায় না, কেবল আলোর অভাবে তা প্রতীয়মান ছিল—তেমনি আত্মজ্ঞান উদিত হলে অবিদ্যা মুছে যায় না, বরং তার অসত্তা প্রকাশ পায়।
“অবিদ্যা নাস্তি তত্ত্বতো যদ্ ব্ৰহ্মা একম্ অদ্বিতীয়ম্”—বাক্যটির মূল দার্শনিক ভাবটি, অর্থাৎ পরমার্থিক দিক থেকে অবিদ্যার কোনো অস্তিত্ব নেই এবং ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়—এই দুটি সিদ্ধান্তই আদি শঙ্করাচার্য কর্তৃক রচিত বলে প্রচলিত ‘আত্মবোধ’ নামক গ্রন্থের কেন্দ্রীয় শিক্ষা।
আত্মবোধের কয়েকটি শ্লোকে এই ভাবটি নানাভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন: আত্মবোধের শুরুতেই বলা হয়েছে যে, মোক্ষলাভের একমাত্র সরাসরি কারণ হলো জ্ঞান (জ্ঞানমেব হি সাক্ষাৎ মোক্ষৈকসাধনম্)। অন্য শ্লোকে বলা হয়েছে, উপাধি দূর হলেই আত্মা ব্রহ্মে মিশে যায়, যেমন আকাশ ঘটে আবদ্ধ থাকলেও ঘট ভাঙলে তা মহাকাশের সাথে মিশে যায়। এতে বোঝা যায় যে, উপাধি (অবিদ্যা) বাস্তব নয়, কেবল প্রতীয়মান।
অদ্বৈত বেদান্তের চূড়ান্ত উপলব্ধি হলো—সব আরোপণ, সব অপবাদ, সব অনুসন্ধান শেষে যা অবশিষ্ট থাকে, তা একমাত্র চিরন্তন সত্য—ব্রহ্ম। সে সর্বদা জ্বলছে, সর্বদা মুক্ত, সর্বদা এক—অপরিবর্তনীয়, অবিকৃত, ও নিজ-প্রকাশমান চৈতন্যরূপে। এই উপলব্ধিই মুক্তি; যেখানে জানা বা জেনে ওঠা—সবই লীন হয়ে যায় ব্রহ্মের অখণ্ড সত্তায়।
সাধকের আত্ম-যাত্রা প্রকৃতপক্ষে এক দ্বিগুণ অগ্নিপরীক্ষা—কর্মের অগ্নি (Karma-Agni) ও জ্ঞানের অগ্নি (Jñāna-Agni)—এই দুই অগ্নির মধ্য দিয়েই আত্মার শুদ্ধি ও জাগরণ সম্পন্ন হয়। কর্মের অগ্নি জ্বালায় অহংকার, আসক্তি ও ইন্দ্রিয়-তৃষ্ণাকে; জ্ঞানের অগ্নি দগ্ধ করে অজ্ঞান ও মায়ার প্রক্ষেপণকে। এই দুইয়ের সমন্বয়ে জন্ম নেয় আত্ম-পরিশুদ্ধি ও আত্ম-প্রকাশ। এই যাত্রার দিশারী হলো সাধন-চতুষ্টয় (Sādhana-Catuṣṭaya)—অর্থাৎ চারটি মৌলিক যোগ্যতা, যা আত্ম-সন্ধানের ভূমিকে প্রস্তুত করে।
সাধন-চতুষ্টয় (Sādhana-Catuṣṭaya) অদ্বৈত বেদান্তে মুক্তিলাভের পূর্বশর্ত। এটি ব্রহ্মজ্ঞান অর্জনের জন্য চারটি অপরিহার্য গুণ বা প্রস্তুতির সমষ্টি। আদি শঙ্করাচার্য তাঁর ব্রহ্মসূত্রভাষ্য, বিবেকচূড়ামণি, আত্মবোধ, ও উপদেশসাহস্রী প্রভৃতি গ্রন্থে বলেছেন—যিনি এই চারটি গুণে সম্পন্ন, তিনিই ব্রহ্মজিজ্ঞাসার যোগ্য।
প্রথমটি নিত্যানিত্য-বস্তু-বিবেক (Nitya-anitya Vastu Viveka)। এটি সেই জ্ঞান, যা দ্বারা সাধক বুঝতে পারেন—কোন বস্তু নিত্য (চিরন্তন) আর কোন বস্তু অনিত্য (ক্ষণস্থায়ী)। নিত্য বস্তু হলো ব্রহ্ম—যা অপরিবর্তনীয়, অবিকৃত, সর্বব্যাপী। অনিত্য হলো জগৎ—যা পরিবর্তনশীল, উদয় ও লয়ে আবদ্ধ।
অদ্বৈত বেদান্তের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় সারসংক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত সূত্র “ব্রহ্ম সত্যম্, জগৎ মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ”, যার অর্থ: "ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা, জীব ব্রহ্ম ভিন্ন অন্য কিছু নয়", হলো অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের মূল সিদ্ধান্তকে তিনটি বাক্যে প্রকাশ-করা একটি প্রখ্যাত সূত্র।
এই তিনটি অংশই অদ্বৈত বেদান্তের মূলস্তম্ভ:
ব্রহ্ম সত্যম্: একমাত্র ব্রহ্মই পরমার্থিক বা চূড়ান্ত সত্য, কারণ তিনি নিত্য ও অপরিবর্তনীয়।
জগৎ মিথ্যা: এই দৃশ্যমান জগৎ পরিবর্তনশীল এবং অনিত্য; তাই এটি চরম সত্য নয়। ব্রহ্মজ্ঞানে এটি বিলীন হয়ে যায়।
জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ: জীবাত্মা ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন নয় (নাপরঃ), সে স্বয়ং ব্রহ্মই। জীবাত্মার এই ভিন্নতা কেবল মায়া বা উপাধিজনিত ভ্রম।
ব্রহ্মই একমাত্র সত্য; জগৎ প্রতীতিমাত্র। এই উপলব্ধি না হলে সাধনা কেবল বাহ্যিক থাকে, অন্তর্মুখ হয় না। বিবেকই সেই শক্তি, যা চিরস্থায়ী ও অচিরস্থায়ী, সত্য ও মিথ্যা, বাস্তব ও অবাস্তবের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে। এই দুই শব্দ—অব্যয় ও অনিত্য—গীতায় দুটি বিপরীত ধারণা প্রকাশ করতে ব্যবহৃত হয়েছে, এবং অদ্বৈত বেদান্তের আলোচনায় এই দুই শব্দের মধ্যকার পার্থক্য গভীরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
“অব্যয়” (Avyaya)—নাশহীন, অপরিবর্তনীয়: অব্যয় শব্দের অর্থ—যা ক্ষয়, বিকৃতি বা রূপান্তর-এর অধীন নয়। গীতায় এই শব্দটি আত্মা বা পরম পুরুষের বৈশিষ্ট্য হিসেবে এসেছে। যেমন—
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।।
ন, এনম্, ছিন্দন্তি, শস্ত্রাণি, ন, এনম্, দহতি, পাবকঃ,
ন, চ, এনম্, ক্লেদয়ন্তি, আপঃ, ন, শোষয়তি, মারুতঃ।। (গীতা, ২.২৩-২.২৪)
গীতার এই দুটি শ্লোক আত্মা (পুরুষ) এবং দেহ (প্রকৃতি বা জড় পদার্থ)-এর মধ্যকার মৌলিক পার্থক্যকে প্রতিষ্ঠিত করে। এই ব্যাখ্যা অদ্বৈত বেদান্তের ব্রহ্মতত্ত্বের সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত, যেখানে আত্মাকে ব্রহ্মস্বরূপ বলা হয়েছে।
আত্মার বিনাশহীনতা (২.২৩): প্রথম শ্লোকটি আত্মার বিনাশহীনতাকে নেতিবাচকভাবে প্রমাণ করে, যা বস্তু জগতের ক্ষমতার ঊর্ধ্বে। আত্মা সম্পূর্ণভাবে জড় উপাদান বা প্রাকৃতিক শক্তি দ্বারা সৃষ্ট বিনাশ থেকে মুক্ত। অর্থাৎ, কোনো বস্তুগত উপায় আত্মাকে ধ্বংস করতে পারে না।
এখানে অস্ত্র হচ্ছে পৃথিবীর প্রতীক, অস্ত্র আত্মাকে ছেদন করতে পারে না। অগ্নি আত্মাকে দগ্ধ বা দহন করতে পারে না। জল আত্মাকে ভিজিয়ে বা আর্দ্র করতে পারে না। বায়ু আত্মাকে শুষ্ক বা শোষণ করতে পারে না।
যেহেতু আত্মা এই চারটি প্রধান প্রাকৃতিক উপাদানের কোনোটির দ্বারাই প্রভাবিত হয় না, তাই এটি প্রমাণ করে যে, আত্মা জড় প্রকৃতিজাত নয়, বরং এটি প্রকৃতির ঊর্ধ্বে অবস্থিত একটি বিশুদ্ধ, অপরিবর্তনীয় চৈতন্য।
আত্মার নিত্যতা ও শাশ্বত গুণাবলী (২.২৪): দ্বিতীয় শ্লোকটি সরাসরি আত্মার গুণাবলি ঘোষণা করে, যা তার ত্রিকালাতীত অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করে। আত্মা অচ্ছেদ্য (ছেদন করা যায় না), অদাহ্য (দহন করা যায় না), অক্লেদ্য (আর্দ্র করা যায় না) এবং অশোষ্যও (শুষ্ক করা যায় না)। এই গুণগুলি তাকে নিত্য করে তুলেছে।
আত্মা নিত্য (যার জন্ম, মৃত্যু, শুরু বা শেষ নেই) এবং সর্বগত (সর্বব্যাপী বা স্থানের দ্বারা সীমিত নয়)। এই দুটি গুণ নির্দেশ করে যে, আত্মা কোনো নির্দিষ্ট কাল বা স্থানে আবদ্ধ নয়। আত্মা স্থাণু (স্থির), অচল (অপরিবর্তনীয়) এবং সনাতন (শাশ্বত)। এর কোনো প্রকার গতি বা ক্ষয় নেই। এটি সবসময় একই অবস্থায় থাকে।
শ্রীকৃষ্ণ এই শ্লোকগুলির মাধ্যমে অর্জুনকে যে-জ্ঞান দেন, তা হলো—
শোকের মূল কারণ হলো দেহের প্রতি আসক্তি এবং আত্মার বিনাশের ভয়। যেহেতু আত্মা অবিনশ্বর, তাই এই ভয় ভিত্তিহীন। এই জ্ঞান অর্জনের পর জ্ঞানী ব্যক্তি বুঝতে পারেন যে, তিনি কেবল সাক্ষী মাত্র; তাঁর কোনো কাজই আত্মাকে প্রভাবিত করে না। এই বোধ কর্মফলের আসক্তি থেকে মুক্তি এনে দেয়।
আবার গীতার ১৫.১৬ শ্লোকে বলা হয়েছে—
দ্বাবিমৌ পুরুষৌ লোকে ক্ষরশ্চাক্ষর এব চ।
ক্ষরঃ সর্বাণি ভূতানি কুটস্থোহক্ষর উচ্যতে।।
“দ্বাবিমৌ পুরুষৌ লোকে ক্ষরশ্চাক্ষর এব চ” অর্থ—জগতে এই দুই প্রকার পুরুষ (সত্তা) বিদ্যমান—ক্ষর (বিনাশী বা পরিবর্তনশীল) এবং অক্ষর (অবিনাশী বা অপরিবর্তনশীল)।
“ক্ষরঃ সর্বাণি ভূতানি কূটস্থোহক্ষর উচ্যতে” অর্থ—ক্ষর হলেন সমস্ত ভূত (সকল জীব ও বস্তু), অর্থাৎ যা-কিছু পরিবর্তনশীল বা বিনাশশীল। অক্ষর হলেন কূটস্থ (স্থির, অপরিবর্তনশীল, মায়ার সাক্ষী), অর্থাৎ যিনি সকল পরিবর্তনের মধ্যেও স্থির থাকেন।
এই শ্লোকটি তিনটি প্রধান সত্তাকে বোঝার ভিত্তি তৈরি করে, যা পরের শ্লোকগুলিতে (বিশেষত ১৫.১৭-তে) সম্পূর্ণ হয়:
ক্ষর পুরুষ (Kṣara Puruṣa): ইনি হলেন ব্যক্তিগত জীবাত্মা, যা উপাধিযুক্ত (দেহ, মন, বুদ্ধি দ্বারা সীমিত) এবং এই কারণে পরিবর্তনশীল ও বিনাশী। এই ক্ষর পুরুষই হলেন সেই ভোগী সত্তা, যা জন্ম, মৃত্যু ও পরিবর্তনশীল জগতের অধীন।
অক্ষর পুরুষ (Akṣara Puruṣa): ইনি হলেন সেই অপরিবর্তনশীল সত্তা বা মায়ার সাক্ষী। ইনি প্রকৃতির গুণাবলি দ্বারা প্রভাবিত হন না, কিন্তু প্রকৃতির ওপর অধিষ্ঠান করেন। ইনি কূটস্থ (অটল ও স্থির) এবং সব পরিবর্তনের সাক্ষী।
পুরুষোত্তম: গীতা এর পরের শ্লোকে (১৫.১৭) এই দুই পুরুষের ঊর্ধ্বে পুরুষোত্তম নামে তৃতীয় এক সত্তার কথা বলে, যিনি ক্ষর ও অক্ষর—উভয়কেই ধারণ করেন এবং যিনিই পরমাত্মা বা ঈশ্বর।
এই শ্লোকটি সাংখ্য ও বেদান্তের তত্ত্বকে একীভূত করে বোঝায় যে, জগতের সমস্ত দৃশ্যমান ও ভোগী সত্তা পরিবর্তনশীল (ক্ষর), কিন্তু তার মধ্যে যে অপরিবর্তনীয় দ্রষ্টা রয়েছে (অক্ষর), তিনিও চরম সত্য নন—চরম সত্য হলো পুরুষোত্তম।
উত্তমঃ পুরুষস্ত্বন্যঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃত।
যো লোকত্রয়মাবিশ্য বিভর্ত্যব্যয় ঈশ্বরঃ।। (গীতা, ১৫.১৭)
“উত্তমঃ পুরুষঃ তু অন্যঃ পরমাত্মা ইত্যুদাহৃতঃ” অর্থ—ক্ষর (বিনাশী) এবং অক্ষর (অবিনাশী) পুরুষ থেকে উত্তম পুরুষ (বা শ্রেষ্ঠ পুরুষ) হলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাঁকেই পরমাত্মা বলে বর্ণনা করা হয়।
“যঃ লোকত্রয়ম্ আবিশ্য বিভর্তি অব্যয়ঃ ঈশ্বরঃ” অর্থ—তিনি সেই সত্তা, যিনি ত্রিভুবনে (লোকত্রয়ম্) প্রবেশ করে (আবিশ্য) ধারণ/পালন (বিভর্তি) করেন। তিনি অব্যয় (অক্ষয়, অবিনাশী) এবং ঈশ্বর (সকলের প্রভু)।
এই শ্লোকটি অদ্বৈত বেদান্ত এবং ভক্তিযোগের ঈশ্বরতত্ত্বের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে, তিনটি স্তরকে স্পষ্ট করে:
ক্ষর পুরুষ (নশ্বর): সমস্ত দেহযুক্ত জীব।
অক্ষর পুরুষ (অবিনাশী): সাক্ষীস্বরূপ আত্মা (কূটস্থ)।
উত্তম পুরুষ (পুরুষোত্তম): ইনি ক্ষর ও অক্ষর—উভয়ের ঊর্ধ্বে অবস্থিত। ইনিই হলেন পরমাত্মা এবং ঈশ্বর।
এই শ্লোকটি ঈশ্বরের সক্রিয় ভূমিকা প্রতিষ্ঠা করে—তিনি কেবল সাক্ষী নন, বরং সমগ্র সৃষ্টিতে প্রবেশ করে তাকে ধারণ ও পরিচালনা করেন। তাঁর গুণাবলি হলো—তিনি অব্যয় (নিত্য) এবং ঈশ্বর (নিয়ন্তা), যার দ্বারা তাঁর পরমত্ব ও সৃষ্টির সাথে সংযোগ—উভয়ই প্রমাণিত হয়।
“অনিত্য” (Anitya)—ক্ষণস্থায়ী, পরিবর্তনশীল: ‘অনিত্য’ শব্দটি গীতায় দেহ, জগৎ, কর্মফল এবং ভোগবস্তু ইত্যাদির জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, যা সময়ের অধীন। যেমন—
অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত।
অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিদেবনা।। (গীতা, ২.২৮)
“অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত” অর্থ—হে ভারত (অর্জুন), সমস্ত প্রাণী বা বস্তু অব্যক্ত (অপ্রকাশিত) অবস্থা থেকে উৎপন্ন হয় (আদি), ব্যক্ত (প্রকাশিত) অবস্থায় থাকে (মধ্য)।
“অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিদেবনা” অর্থ—এবং তারা পুনরায় অব্যক্ত অবস্থাতেই বিলীন হয়ে যায় (নিধনানি)। অতএব, এই বিষয়ে আর শোক করার কী আছে? (তত্র কা পরিদেবনা)
এই শ্লোকটি সৃষ্টির চক্রাকার প্রকৃতি এবং জগতের অনিত্যতা ব্যাখ্যা করে:
অনাদি-অন্তের অবিনাশিত্ব: সৃষ্টির আগে এবং বিনাশের পরে সমস্ত বস্তুই অব্যক্ত (অপ্রকাশিত) রূপে থাকে। অব্যক্ত অবস্থা হলো মায়া বা প্রকৃতির সূক্ষ্ম অবস্থা।
মধ্যের প্রতীয়মানতা: আমাদের দেখা এবং অনুভব করা সমস্ত কিছুই কেবল মাঝখানের ব্যক্ত বা প্রকাশিত অবস্থা।
শোকের ভিত্তিহীনতা: শ্রীকৃষ্ণ বোঝান যে, বস্তুগুলো আদিতেও ছিল না (অব্যক্ত ছিল) এবং অন্তেও থাকবে না (অব্যক্ত হয়ে যাবে)। সুতরাং, যা ক্ষণিকের জন্য প্রকাশিত হয়ে আবার তার মূল অবস্থায় ফিরে যায়, তার বিনাশ নিয়ে শোক করা অজ্ঞতা মাত্র।
এই জ্ঞান জীবের শোক দূর করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, কারণ এটি প্রমাণ করে যে, জন্ম ও মৃত্যু হলো কেবল রূপের পরিবর্তন মাত্র, কোনো চরম বিনাশ নয়।
সমস্ত দৃশ্যমান জগৎ অনিত্য—গীতায় তেমনই বলা হয়েছে—
অসক্তিরনভিষ্বঙ্গঃ পুত্রদারগৃহাদিষু।
নিত্যং চ সমচিত্তত্বমিষ্টানিষ্টোপপত্তিষু।। (গীতা, ১৩.১০)
এই শ্লোকটি ত্রয়োদশ অধ্যায় (ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞ-বিভাগ যোগ)-এর অংশ। এখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে জ্ঞান বলতে কী বোঝায়, সেই বাইশটি উপাদানের (বা গুণাবলির) তালিকা দিচ্ছেন, যার মধ্যে এই শ্লোকটি দুটি গুণকে নির্দেশ করে।