৮. অনুত্তম-আভিস্রেয়সী বা হিংসা-নিবৃত্তি তুষ্টি (Anuttam-ābhisreyasī or Hiṃsā-nivṛtti Tuṣṭi): মনে করা যে, বস্তু-লাভে হিংসা বা অপরের ক্ষতি হয়, তাই এই ধরনের কোনো প্রচেষ্টাই না করলে মুক্তিলাভ হবে।
এই আট প্রকার তুষ্টি সাধককে জাগতিক বা মানসিক আরামের মধ্যে আবদ্ধ রাখে, ফলে সে বিবেক জ্ঞান (পুরুষ ও প্রকৃতির পার্থক্য জ্ঞান) অর্জনের জন্য চূড়ান্ত প্রচেষ্টা থেকে বিরত হয়। এটিই হলো সাংখ্য দর্শনে তুষ্ট্যাভাসের ধারণা।
সাংখ্য মতে, এই তুষ্টিগুলি সাধকের অগ্রগতি থামিয়ে দিতে পারে, কারণ সেগুলি প্রকৃত মুক্তির (কৈবল্য) বদলে একপ্রকার মানসিক প্রশান্তি প্রদান করে। কৈবল্য বা মুক্তি তখনই ঘটে, যখন পুরুষ (চেতনা) প্রকৃতি (Prakṛti)-র সমস্ত গুণ থেকে সম্পূর্ণ পৃথকভাবে উপলব্ধ হয়। কিন্তু এই তুষ্টিগুলি এখনও প্রকৃতির গুণমিশ্র প্রক্রিয়া—সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ—এরই ফসল। ফলে এগুলি বিনাশী ও সীমিত। তুষ্ট্যাভাস এখানে সেই বিপদজনক বিন্দু, যেখানে পৌঁছে সাধক মনে করেন যে, তিনি গন্তব্যে পৌঁছেছেন, অথচ তিনি এখনও প্রকৃতির অধীন। এটি এক “আধ্যাত্মিক অহংকার”—মুক্তির ছায়া, কিন্তু মুক্তি নয়।
অদ্বৈত বেদান্তে এই ধারণাটি আরও সূক্ষ্ম স্তরে বিশ্লেষিত হয়েছে। এখানে তুষ্ট্যাভাস মানে হলো আত্মজ্ঞান-বিহীন তৃপ্তির প্রতিচ্ছবি—যে-তৃপ্তি জ্ঞানের ধারণা থেকে আসে, কিন্তু জ্ঞানের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি থেকে নয়। একজন অনুসন্ধানকারী শাস্ত্র অধ্যয়ন, গুরু-শ্রবণ বা চিন্তনের মাধ্যমে যখন ব্রহ্মতত্ত্বের ধারণাগত উপলব্ধি পায়, তখন তাঁর মন সাময়িকভাবে শান্ত হয়। সে মনে করে—“আমি ব্রহ্ম” বুঝে ফেলেছি। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত এই বোধ কেবল বুদ্ধিগত এবং অভ্যাসগত স্তরে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত তা সত্য জ্ঞান নয়—এটি তুষ্ট্যাভাস। এই ভ্রমময় তৃপ্তি হলো উপাধিজনিত—মনের, অহংকারের বা সূক্ষ্ম অবিদ্যার প্রতিফলন। তাই এই তৃপ্তি মুছে যায়, যখন গভীর ধ্যান বা নিদিধ্যাসনের মাধ্যমে ব্যক্তি প্রকৃত আত্ম-সাক্ষাৎকারে পৌঁছায়।
অদ্বৈত মতে প্রকৃত আত্মজ্ঞান (Ātma-Jñāna) অপরোক্ষ, অর্থাৎ সরাসরি অভিজ্ঞতাজাত, কোনো ধারণা নয়। তুষ্ট্যাভাস সেই পর্যায়, যেখানে ধারণাগত জ্ঞান ও আত্মানুভূতির মধ্যে ফারাক এখনও অবশিষ্ট। যেমন কেউ স্বপ্নে জলের পাত্র দেখে তৃষ্ণা নিবারণ হয়েছে বলে মনে করে, কিন্তু জেগে উঠে বুঝতে পারে যে, তা ছিল কেবল ভ্রম; তেমনি তুষ্ট্যাভাসের আনন্দও ব্রহ্মানন্দ নয়, বরং তার আভাস মাত্র।
তুষ্ট্যাভাস হলো সাধকের যাত্রার এক বিপজ্জনক, কিন্তু অনিবার্য পর্যায়—যেখানে মন শান্ত, কিন্তু চেতনা এখনও অবিদ্যার পর্দার ভেতরে। এটি একপ্রকার আত্ম-প্রবঞ্চনা, যা বলে—“আমি জানি”—কিন্তু জানাটাই এখনো অহং-এর মাধ্যমে জানা, আত্মার মাধ্যমে নয়। তুষ্ট্যাভাস থেকে মুক্তি তখনই ঘটে, যখন ব্যক্তি সেই সাময়িক শান্তিকেও অতিক্রম করে—যখন সে বুঝতে পারে, “যে জানে, সে-ই ‘আমি’—সেই ‘আমি’-ই আসলে জানারও অতীত।” তখন জ্ঞাতা, জ্ঞান, ও জ্ঞেয়ের ত্রিবিধ বিভাজন বিলীন হয়ে যায়, এবং থাকে কেবল আত্মা—চির-আলোকিত, অদ্বিতীয় চেতনা।
তুষ্ট্যাভাস হলো মুক্তির পূর্ববর্তী বিভ্রম—এক “মুক্তির ছায়া”, যেখানে সাধক তৃপ্তির ভ্রমে আবদ্ধ থাকে। প্রকৃত তুষ্টি আসে কেবল তখনই, যখন সমস্ত আভাস বিলীন হয়, এবং আত্মা নিজেকে চিনে বলে—“নাহং কর্তা, নাহং ভোক্তা, অহম্ ব্রহ্মাস্মি।” সেই মুহূর্তে সমস্ত তুষ্ট্যাভাস লীন হয়ে যায় চিদানন্দ-স্বরূপ ব্রহ্মে।
এই ব্যাখ্যা অবিদ্যাকে এক মহাজাগতিক রূপ দেয়—মূল-অবিদ্যা (Mūlāvidyā), যা মায়া নামেই পরিচিত। এই মায়া ব্রহ্মের শক্তি (Śakti), ঈশ্বরের অধীন এবং সর্বজনীন (Samasṭi-level)। যখন সেই একই মায়া সীমিত বুদ্ধিতে প্রতিফলিত হয়, তখন সেটিই জীবের অবিদ্যা (Vyasti-Avidyā)। অর্থাৎ, মায়া ও অবিদ্যা একই শক্তির দুটি দিক—একটি সমষ্টিগত, অন্যটি ব্যক্তিগত।
সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি: মায়া ও অবিদ্যা এক শক্তির দুই রূপ
অদ্বৈতের পরিণত ব্যাখ্যায় দেখা যায়, এই দুই মতের মধ্যে কোনো প্রকৃত বিরোধ নেই; তারা এক সত্যকে দুই দিক থেকে দেখছে। ঈশ্বরের দৃষ্টিতে মায়া, জীবের দৃষ্টিতে অবিদ্যা—এই দুই নাম এক শক্তির দুই রূপ। ব্রহ্মচেতনা সর্বত্র এক; পার্থক্য কেবল প্রতিফলনের সীমায়। যেমন এক সূর্যের আলো অসংখ্য জলে প্রতিফলিত হয়ে অনেক সূর্যের আভাস দেয়—আসলে আলো এক, কিন্তু প্রতিবিম্ব বহু।
তেমনি ব্রহ্মচেতনা সর্বজনীন; যখন তা সমষ্টিগত অবিদ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পায়, তখন তাকে বলা হয় মায়া—ঈশ্বররূপ শক্তি; আর যখন সেই একই চেতনা ব্যক্তিগত অবিদ্যার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়, তখন সেটি হয় জীব। এভাবেই মায়া ও অবিদ্যার ঐক্য বোঝায় যে, অসীম চেতনা কখনও সত্যিকারভাবে বিভক্ত হয় না—শুধু প্রতিফলনের সীমা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা দেখা যায়।
ভামতী বলে—অবিদ্যা জীবের মধ্যে;
বিবরণ বলে—অবিদ্যা ব্রহ্মের মধ্যে;
অদ্বৈত বলে—অবিদ্যা এই দুইয়ের কোনোটিতেই নেই; এর অস্তিত্ব কেবল প্রতীতি (Pratīti) বা আপাত-উপলব্ধি। (মুক্তি তাই নতুন কোনো কিছু অর্জন করা নয়, বরং অবিদ্যার ভ্রম বা মিথ্যা প্রতীতি দূর করা মাত্র।)
যখন জ্ঞানের উদয় হয়, তখন বোঝা যায়—অবিদ্যা কোনো স্বাধীন সত্তা নয়; এটি ছিল কেবল চেতনার ভুল প্রতিফলন, যেমন স্বপ্নে-দেখা জগৎ জেগে উঠলে মিলিয়ে যায়। তখন অবিদ্যা, মায়া, ঈশ্বর, জীব—সব ভেদ বিলীন হয়ে প্রকাশিত হয় সেই এক ব্রহ্ম, যিনি কখনও অজ্ঞ ছিলেন না, যিনি কখনও আলোকিত হন না, কারণ তিনিই চির-আলোকিত (Svayam-Prakāśa) চেতনা—যার উপস্থিতিতেই “অবিদ্যা” শব্দটি উচ্চারণযোগ্য হয়, কিন্তু যিনি নিজে অবিদ্যার স্পর্শেও অনাহত।
অদ্বৈত বেদান্ত যখন বলে—“অবিদ্যা কোথাও নয়, কেবল অবিদ্যার প্রতীতি-মাত্র”—তখন এই বাক্যের মধ্যে অবিদ্যার গভীরতম দার্শনিক বিশ্লেষণ নিহিত থাকে। এখানে “অবিদ্যা” বলতে বোঝানো হয়েছে এমন এক ভ্রম, যা বাস্তবে কখনও ছিল না, কিন্তু দেখা যায় বলে মনে হয়। এটি ঠিক যেমন গোধূলির আলোয় দড়িকে সাপ বলে ভুল করা—যেখানে সাপকে দেখা যায়, কিন্তু তা বাস্তবে নেই।
প্রথমত, “অবিদ্যা কোথাও নয়” (Avidyā Na Kvacit Asti), এই কথাটি বোঝায় যে, অবিদ্যা কোনো বাস্তব বা স্বতন্ত্র সত্তা নয়। এটি না ব্রহ্মে আছে, না জীবের মধ্যে আছে, না জগতে আছে। ব্রহ্মে থাকতে পারে না, কারণ ব্রহ্ম চিরজ্যোতিঃস্বরূপ, স্বপ্রকাশ, সর্বজ্ঞ, অবিকৃত—তাঁর মধ্যে অজ্ঞান বা আচ্ছাদন থাকা সম্ভব নয়। জীবের মধ্যে থাকতে পারে না, কারণ জীব আসলে ব্রহ্মেরই প্রতিবিম্ব; জীবের মধ্যে যে-অজ্ঞান দেখা যায়, তা তার প্রকৃত সত্তার অংশ নয়, কেবল প্রতিফলনের সীমাবদ্ধতা। আর জগতে থাকতে পারে না, কারণ জগৎ নিজেই অবিদ্যার প্রকাশ—তাহলে অবিদ্যা জগতে থাকবে কীভাবে? সুতরাং অবিদ্যা কোনো নির্দিষ্ট আশ্রয়ে অবস্থিত নয়। এই জন্যই একে বলা হয় আশ্রয়-অনুপপন্ন—অর্থাৎ, যার কোনো স্থিতিস্থান নেই, কিন্তু প্রতীতিতে আছে।
দ্বিতীয়ত, “কেবল অবিদ্যার প্রতীতি-মাত্র” (Kevalam Avidyā-Pratīti-Mātra)—এই কথাটি বোঝায় যে, অবিদ্যা বাস্তব নয়, কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখা যায়। “প্রতীতি” মানে অভিজ্ঞতা বা প্রতীয়মানতা—যা দেখা যায়, কিন্তু যার কোনো স্থায়ী অস্তিত্ব নেই। যেমন কেউ মাটিতে দড়ি দেখে সাপ মনে করে। এখন প্রশ্ন হলো, সেই “সাপ” কোথায়? দড়িতে নয়, কারণ সেখানে দড়িই আছে; বাইরে নয়, কারণ কেউ সেখানে সত্যিকারের সাপ রাখেনি; মনের মধ্যেও পুরোপুরি নয়, কারণ ভয় ও প্রতিক্রিয়া তো দৃষ্টির বস্তুটিকে কেন্দ্র করে জন্ম নিচ্ছে। তাহলে সাপ আছে কোথায়? উত্তর হলো—সাপ প্রতীতিমাত্র, দেখা যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু কোনো বাস্তব অস্তিত্ব তার নেই। তেমনি অবিদ্যাও কোথাও নেই, কিন্তু দেখা যায়—“আমি দেহ”, “আমি কর্তা”, “আমি ভোগী”, “আমি জানি না”—এসব ভুল অভিজ্ঞতা অবিদ্যার প্রকাশ। অবিদ্যা ধরা যায় না, আবার অস্বীকারও করা যায় না, কারণ তা অভিজ্ঞতার মধ্যে উপস্থিত। তাই একে বলা হয় অনির্বচনীয়—অর্থাৎ, না সত্য, না অসত্য; কেবল প্রতীয়মান।
তৃতীয়ত, এই ধারণার দার্শনিক তাৎপর্য হলো—অবিদ্যা কোনো সত্য সত্তা নয়, কিন্তু যতক্ষণ জ্ঞান-প্রকাশ হয়নি, ততক্ষণ তা অভিজ্ঞতায় সত্যের মতোই প্রতীয়মান হয়। এটি সম্পূর্ণ অসত্য নয়, কারণ অভিজ্ঞতা-জগতে তা কার্যকর; আবার সত্যও নয়, কারণ জ্ঞান উদয় হলে তা মিলিয়ে যায়। তাই অবিদ্যা মিথ্যা নয়, সত্যও নয়—এটি অনির্বচনীয় প্রতীতি-মাত্র। যেমন স্বপ্নে কেউ রাজা হয়, যুদ্ধ করে, সুখ-দুঃখ ভোগ করে; সবই তখন সত্য বলে মনে হয়, কিন্তু জেগে উঠে দেখা যায়, কিছুই ঘটেনি। স্বপ্নের অভিজ্ঞতা প্রতীতিমাত্র, অস্তিত্ব নয়। ঠিক তেমনি অবিদ্যা, জগৎ, বন্ধন—সবই প্রতীতি, বাস্তব নয়। যখন জ্ঞান উদয় হয়, তখন বোঝা যায়, এগুলো কখনও ছিল না; কেবল মনে হয়েছিল।
এই ধারণা থেকেই অদ্বৈতের চূড়ান্ত তত্ত্ব—অজাতবাদ (Ajātavāda)—উদ্ভূত হয়। যখন জানা যায় যে, অবিদ্যা কোনোদিনই বাস্তব ছিল না, তখন সৃষ্টি, বন্ধন, মুক্তি—সবই আপাত-ধারণা বলে প্রকাশ পায়। তখন দেখা যায়, কিছুই কখনও জন্মায়নি, কিছুই কখনও বিলীনও হয়নি; কেবল প্রতীতির এক আচ্ছাদন ছিল, যা জ্ঞানের আলোয় মিলিয়ে গেছে।
অতএব, “অবিদ্যা কোথাও নয়, কেবল অবিদ্যার প্রতীতি-মাত্র”—এই কথার অর্থ হলো, অবিদ্যা কোনো বাস্তব শক্তি বা পদার্থ নয়; এটি কেবল চেতনার এক ভুল প্রতিফলন, যা জ্ঞানের অভাবে সত্য বলে মনে হয়, কিন্তু জ্ঞান উদয় হলে নিজের অস্থির ছায়ার মতো মিলিয়ে যায়। যেমন আলো এলে অন্ধকার থাকে না, তেমনি আত্মজ্ঞান উদয় হলে অবিদ্যা নিজেই লীন হয়ে যায়—কারণ অবিদ্যা কখনও সত্য ছিলই না, ছিল কেবল তার (সত্যের) প্রতীতি।
যখন জ্ঞানের উদয় ঘটে, তখন অধ্যাস—অর্থাৎ অজ্ঞানজনিত ভ্রান্ত আরোপণ—নিজে থেকেই ভেঙে পড়ে। এখানে “অস্বীকার” (নিরাকরণ) মানে কোনো কিছুকে ধ্বংস করা নয়, বরং আলোকসজ্জা, অর্থাৎ প্রকাশ। যেমন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার মিলিয়ে যায় না, বরং অন্ধকার যে কেবল আলোর অনুপস্থিতি ছিল, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তেমনি আত্মজ্ঞান উদিত হলে অবিদ্যা কোনো বাস্তব সত্তা হিসেবে ধ্বংস হয় না—বরং প্রকাশ পায় যে, সেটি কখনোই সত্য ছিল না।
এই অবস্থাকে বলা হয় আবরণ-ভঙ্গ (Āvaraṇa-Bhaṅga)—অজ্ঞান-আবরণের ভাঙন। এটি সেই মুহূর্ত, যখন জ্ঞানের আলো চেতনার প্রকৃত স্বরূপকে উদ্ভাসিত করে। আত্মা তখন নিজস্ব দীপ্তিতে, আত্ম-প্রকাশ (Ātma-Prakāśa) রূপে, নিজেকে প্রতিফলিত করে—যেখানে আর কোনো দ্বিতীয় কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
এই জ্ঞান কেবল মানসিক ধারণা বা তর্ক নয়; এটি এক অপরোক্ষ অভিজ্ঞতা (Aparokṣa-Anubhūti)—যা প্রত্যক্ষ উপলব্ধির সমান। তখন জ্ঞাতা (Knower), জ্ঞান (Knowledge), ও জ্ঞেয় (Known)—এই তিনের ভেদ সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়। আত্মা তখন সাক্ষী নয়, কারণ সাক্ষী হওয়া মানেই অন্য কিছু থাকা—যার সাক্ষী আত্মা হচ্ছে। বরং আত্মা তখন নিজেই নিজের মধ্যে অবস্থিত, নিজের চৈতন্যেই স্থিত। এই অভিজ্ঞতাই “অহম্ ব্রহ্মাস্মি”—“আমিই ব্রহ্ম”—এই বাক্যের বাস্তব রূপ, যা আর কেবল চিন্তার বিষয় নয়, বরং অস্তিত্বের সত্য হয়ে ওঠে।
এই স্তরে পৌঁছে আর কোনো “অজ্ঞান অপসারণ”-এর প্রয়োজন থাকে না, কারণ তখন স্পষ্ট দেখা যায়—অজ্ঞান কখনও প্রকৃতভাবে ছিলই না।
“অবিদ্যা নাস্তি তত্ত্বতো যদ্ ব্ৰহ্মা একম্ অদ্বিতীয়ম্।” এর অর্থ হলো: “পরমার্থত বা তত্ত্বত অবিদ্যা বলে কিছু নেই, যেহেতু ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়।” অর্থাৎ, অবিদ্যা সত্যস্বরূপে কখনোই ছিল না; একমাত্র ব্রহ্মই সর্বদা সত্য।
এই উক্তিটি কোনো একটি একক প্রাচীন মন্ত্র বা শ্লোক নয়, বরং এটি হলো অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকে সংক্ষেপে প্রকাশ করা একটি দার্শনিক সূত্র বা প্রবচন। এটি আচার্য শঙ্কর ও তাঁর অনুগামীরা তাঁদের ভাষ্য এবং টীকাগুলিতে মায়া বা অবিদ্যার প্রকৃতি বোঝাতে ব্যবহার করেছেন।
'তত্ত্বতঃ' (Tattvato): এটি বোঝায় পরমার্থিক দৃষ্টিকোণ বা চূড়ান্ত সত্যের দিক থেকে। অদ্বৈত-মতে, দুটি সত্য রয়েছে—ব্যাবহারিক (যা জগৎকে সত্য মনে করে) এবং পারমার্থিক (যা কেবল ব্রহ্মকে সত্য মনে করে)। এই সূত্রটি পারমার্থিক সত্যের কথা বলছে।