২. উপাধি-অধ্যাস (Upādhi-Adhyāsa): এখানে উপাধি (Upādhi) মানে সীমাবদ্ধ সংযোজন বা conditioning—যেমন দেহ, ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি ইত্যাদি।
আত্মা এই উপাধিগুলির সঙ্গে অভিন্ন নয়, তবু মায়ার প্রভাবে মনে হয়—আত্মা যেন এই উপাধিগুলির মধ্যেই আবদ্ধ। যেমন স্বচ্ছ স্ফটিকের উপর লাল ফুল রাখলে স্ফটিক লাল দেখায়, কিন্তু আসলে তা লাল হয় না—তেমনি আত্মা দেহ বা মনের গুণ ধারণ করে বলে প্রতীয়মান হলেও, আসলে সে তাদের স্পর্শেও আসে না।
এই স্তরের অধ্যাস মানুষকে “ব্যক্তি” হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে—একটি নাম, একটি রূপ, একটি জীবনী, একটি সংস্কৃতি। অথচ আত্মা কখনও এই উপাধিগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। উপাধি কেবল প্রতিফলনের মাধ্যম; আত্মা সর্বদা তদতিরিক্ত।
৩. কোষ-অধ্যাস (Kośa-Adhyāsa): এই স্তরে বিভ্রম আরও সূক্ষ্ম।
আত্মা নিজের পাঁচটি আবরণ বা পঞ্চ-কোষ (Pañca-kośa)—অন্নময় (খাদ্যনির্ভর দেহ), প্রাণময় (প্রাণ-শক্তি), মনোময় (চিন্তা-অনুভূতি), বিজ্ঞানময় (বুদ্ধি), আনন্দময় (আনন্দের আভাস)—এই পাঁচ স্তরের মধ্যে নিজেকে চিনতে থাকে।
মানুষের প্রতিদিনের পরিচয় এই কোষগুলির সঙ্গেই গঠিত: “আমি ক্ষুধার্ত”—অন্নময়; “আমি জীবিত”—প্রাণময়; “আমি আনন্দিত”—আনন্দময়; “আমি ভাবছি”—মনোময়; “আমি বুঝেছি”—বিজ্ঞানময়।
কিন্তু অনুসন্ধানী ধীরে ধীরে দেখে, যা পরিবর্তনশীল, তা আত্মা নয়। এই ধ্যানেই “নেতি, নেতি” (এ নয়, ও নয়) পদ্ধতি আসে—যেখানে সাধক একে একে প্রতিটি কোষ পরিত্যাগ করে অবশেষে সেই অচঞ্চল চৈতন্যে পৌঁছান, যা সব কিছুর সাক্ষী।
৪. অহংকার-অধ্যাস (Ahaṅkāra-Adhyāsa): এটি অদ্বৈতের সবচেয়ে সূক্ষ্ম স্তর—মনের কেন্দ্রে গঠিত “আমি”-বোধের মিথ্যা স্থিতি।
অহং (Ahaṅkāra) হলো সেই ফিকশনাল কেন্দ্র, যা বলে—“আমার দেহ”, “আমার মন”, “আমার চিন্তা”, “আমার অভিজ্ঞতা।” এই “আমি”-বোধ আসলে কোনো স্বাধীন সত্তা নয়; এটি কেবল চিদাভাস (Cidābhāsa)—শুদ্ধ চৈতন্যের প্রতিবিম্ব, যা মনের আয়নায় প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন সূর্যের আলো জলে পড়ে সূর্যের প্রতিফলন তৈরি করে, তেমনি আত্মার চেতনা মনস্-বুদ্ধিতে প্রতিফলিত হয়ে অহংকার তৈরি করে। এই অহংই সমস্ত প্রপঞ্চের কেন্দ্র—সকল ভোগ, সকল ভয়, সকল কামনা এখানেই জমাট বাঁধে। অথচ এটি এক ছায়া মাত্র, যার কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব নেই।
অদ্বৈতের মতে, এই চার স্তরই মায়ার বিভিন্ন পর্দা—একটি সরলে অপরটি নিজে থেকেই মিলিয়ে যায়। যখন সাধক আত্মা-অনাত্মা ভেদ করে বুঝতে পারেন, “আমি দেহ নই,” যখন তিনি উপাধি-কোষ-অহংকার অতিক্রম করে দেখেন, “আমি কোনো সীমা নই,” তখনই সমস্ত অধ্যাস ভেঙে পড়ে।
তখন জ্ঞান জেগে ওঠে এক স্বতঃপ্রকাশ স্বরূপে—“অহং ব্রহ্মাস্মি”—আমি সেই, যে কখনও আচ্ছন্ন হয়নি।
এই উপলব্ধিই অধ্যাসের চূড়ান্ত অপবাদ (Apavāda)—যেখানে সমস্ত আরোপ ও বিভ্রম স্বতঃ বিলীন হয়ে যায়, থাকে কেবল সেই এক, অদ্বিতীয়, সর্বব্যাপী চিদানন্দরূপ আত্মা।
অদ্বৈত বেদান্তে এই বিশ্লেষণটি আত্মা-অনুসন্ধানের অন্তঃস্থ সূক্ষ্মতম মানচিত্র—যেখানে প্রতিটি স্তরই এক একটি “বন্ধনের তরঙ্গ”, এবং প্রতিটি তরঙ্গই মায়ার দ্বৈত ক্রিয়ার ফলে উদ্ভূত হয়: আবরণ-দোষ (Āvaraṇa-Doṣa) ও বিক্ষেপ-দোষ (Vikṣepa-Doṣa)।
আবরণ-দোষ—আত্মার দীপ্তির আচ্ছাদন: “আবরণ” শব্দের অর্থ আড়াল বা আচ্ছাদন। এটি সেই শক্তি, যা আত্মার স্বরূপকে ঢেকে রাখে। যেমন ঘন মেঘ সূর্যের আলোকে চোখে পড়তে দেয় না, তেমনি অবিদ্যা আত্মার স্বয়ং-আলোক (Svayaṃ-Prakāśa) প্রকৃতিকে লুকিয়ে রাখে। আত্মা তখনও আলোকিত, কিন্তু সেই আলোর সাক্ষী হওয়ার ক্ষমতা মনের কাছে হারিয়ে যায়। ফল—মানুষ নিজের সীমাহীন সত্তাকে ভুলে গিয়ে দেহ-মন-ইন্দ্রিয়কেই “আমি” বলে মনে করে।
বিক্ষেপ-দোষ—মিথ্যা প্রতিফলনের সৃষ্টি: আবরণ ঘটলে তার পরিণতি হয় বিক্ষেপ (Vikṣepa)—অর্থাৎ, মনের কল্পনাশক্তি আত্মার উপর অনাত্মার ছায়া প্রক্ষেপণ করে। তখন জন্ম নেয় “আমি কর্তা”, “আমি ভোগী”, “আমি দুঃখী”, “আমি সুখী”—এই সমস্ত ভুল অভিজ্ঞতা। যেমন রজ্জু-সর্প-ন্যায়ে দড়িকে আড়াল করে সাপের প্রক্ষেপণ ঘটে, তেমনি আত্মাকে আড়াল করে জগতের প্রক্ষেপণ ঘটে। এই প্রক্ষেপণই সংসার, এই প্রক্ষেপণই দুঃখ।
আত্মা-অনাত্মা-বিবেক—আবরণের ভেদক জ্ঞান: এই বিভ্রম ভেদ করার একমাত্র পথ হলো Ātma-Anātma-Viveka—আত্মা ও অনাত্মার মধ্যে পার্থক্য-বোধের অনুশীলন। এটি “নেতি, নেতি”-র ধারাবাহিক প্রক্রিয়া—“আমি দেহ নই, আমি মন নই, আমি বুদ্ধিও নই।”
এই বিবেকের আলোয় ধীরে ধীরে আবরণ-নিবৃত্তি (Āvaraṇa-Nivṛtti) ঘটে—অর্থাৎ, আত্মার উপর পড়া অজ্ঞান-পর্দা সরে যায়। যখন এই আচ্ছাদন সম্পূর্ণ অপসৃত হয়, তখন আত্মা নিজেই নিজের স্বরূপে জ্বলে ওঠে—স্বরূপ-প্রকাশ (Svarūpa-Prakāśa)। তখন আর কোনো প্রক্ষেপণ সম্ভব নয়, কারণ বিক্ষেপের উৎস অজ্ঞানই তখন বিলুপ্ত।
বিম্ব-প্রতিবিম্ব-বাদ—আত্মা, মন ও জীবের সূক্ষ্ম সম্পর্ক: এই অবস্থাকে বেদান্ত বিম্ব-প্রতিবিম্ব-বাদে (Bimba-Pratibimba-vāda) ব্যাখ্যা করে—এক অনুপম দৃষ্টান্তে, যা মায়া-বিনির্মিত অভিজ্ঞতার পুরো কাঠামো উন্মোচন করে।
বিম্ব (Bimba)—আত্মা বা পরব্রহ্ম। তিনি সূর্যের মতো—চিরআলোকিত, স্বয়ংপ্রকাশ, অবিকৃত।
দর্পণ (Mirror)—বুদ্ধি বা চিত্ত (Buddhi)। এটি প্রতিফলন-মাধ্যম। তার স্বচ্ছতা বা মলিনতাই নির্ধারণ করে চেতনার প্রতিফলনের স্বচ্ছতা।
প্রতিবিম্ব (Pratibimba)—চিদাভাস (Cidābhāsa)—অর্থাৎ, আত্মার আলো বুদ্ধিতে প্রতিফলিত হয়ে যে-সচেতনতা সৃষ্টি করে, তাকেই আমরা “জীব” বলে চিনি।
যেমন সূর্য এক, কিন্তু শত শত জলে তার প্রতিফলন দেখা যায়—সূর্য নিজে অপরিবর্তিত থেকেও যেন অসংখ্য সূর্যরূপে প্রতীয়মান হয়—তেমনি আত্মা এক, কিন্তু অসংখ্য মনের প্রতিফলনে বহু-জীব বলে প্রতীয়মান।
চিত্ত-শুদ্ধি ও প্রতিফলনের বিশুদ্ধতা: যখন বুদ্ধি-দর্পণ স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ (Citta-Śuddhi) থাকে—অর্থাৎ, মোহ, আসক্তি, ক্রোধ, অহংকারের বিকৃতি থেকে মুক্ত—তখন প্রতিফলন স্পষ্ট হয়। তখন জীব নিজের উৎস-আত্মাকে উপলব্ধি করতে পারে, কারণ প্রতিবিম্ব ও বিম্বের মধ্যে কোনো বিকৃতি থাকে না।
কিন্তু যখন দর্পণ মলিন—অর্থাৎ মন অবিদ্যা ও তৃষ্ণায় আচ্ছন্ন—তখন প্রতিফলনও বিকৃত, কম্পমান, অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়। তখন আত্মা যেন দূরের কোনো সত্তা, এবং জীব নিজেকে সীমিত দেহ–মন বলে অনুভব করে।
ধ্যান ও জ্ঞান—প্রতিফলন থেকে উৎসে প্রত্যাবর্তন: ধ্যান (Dhyāna) ও জ্ঞান (Jñāna) এই বিকৃত প্রতিফলনকে নির্মল করে। ধ্যান চিত্তকে প্রশমিত করে; জ্ঞান বিভ্রমকে বিনষ্ট করে।
অনুসন্ধানী ধীরে ধীরে উপলব্ধি করেন—প্রতিফলন কখনও আলাদা নয়; দর্পণ ও প্রতিবিম্ব উভয়ই আপাত। বাস্তব হলো কেবল সেই সূর্য—আত্মা। যখন এই উপলব্ধি পরিণত হয়, তখন জীব জানে—“প্রতিবিম্ব নই আমি, বিম্বই আমি।”
এই জ্ঞানই আত্মানুভূতি (Ātma-Anubhūti)—যেখানে জীব-ব্রহ্ম-অভেদ প্রকাশিত হয়। তখন বুদ্ধি-দর্পণের প্রয়োজনই আর থাকে না, কারণ আলোক নিজেই নিজেকে জানে।
চূড়ান্ত ফল—এক ও অদ্বিতীয় আত্মা: যখন সমস্ত আবরণ সরে যায় ও প্রতিফলনের বিভ্রম বিলীন হয়, তখন যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো একমাত্র আত্মা—চিরন্তন, অবিকৃত, স্বয়ংজ্যোতির্ময় চেতনা (Svayam-Jyotir-Ātman)। এটি না কর্তা, না ভোক্তা; না দেহ, না মন; না প্রতিবিম্ব, না প্রতিবিম্বর দর্শক।
অদ্বৈত বেদান্তের ভাষায়—“বিম্ব-প্রতিবিম্ব-ভেদে যা সত্য নয়, তা-ই মোক্ষের অভিজ্ঞতা।” অর্থাৎ, মুক্তির মানে কোনো “নতুন” কিছু অর্জন নয়, বরং সেই চেতনার স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়া—যা সর্বদা ছিল, কিন্তু মায়ার আবরণে ঢাকা পড়েছিল।
এই উপলব্ধিই সমস্ত অধ্যাসের সমাপ্তি, সমস্ত বিক্ষেপের বিলয়, এবং সমস্ত দ্বৈততার অন্ত। তখন থাকে কেবল এক—নির্বিকার চিদানন্দ ব্রহ্ম, যিনি নিজেই আলো, যিনি নিজেই সাক্ষী, যিনি নিজেই চিরমুক্ত।
শঙ্করাচার্যের “অধ্যারোপ-অপবাদ” (Adhyāropa-Apavāda) পদ্ধতি অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের অন্যতম মৌলিক শিক্ষণকৌশল। এটি কেবল যুক্তিতত্ত্বের কোনো বিশ্লেষণ নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক অনুশীলন—একটি অন্তর্মুখী সিঁড়ি, যা ভুলকে ব্যবহার করেই সত্যে পৌঁছাতে শেখায়। এই পদ্ধতির দ্বারা শঙ্কর দেখাতে চেয়েছেন, সত্যকে বোঝার জন্য প্রথমে আপাত-ভুল ধারণাটিকেও গ্রহণ করতে হয়, তারপর ধীরে ধীরে সেই ধারণাটিকে অতিক্রম করতে হয়।
প্রথম ধাপ হলো অধ্যারোপ। ‘অধ্যারোপ’ মানে “উপর আরোপ করা”—অর্থাৎ, সত্য আত্মার উপর শিক্ষার সুবিধার্থে এমন কিছু গুণ বা ধারণা আরোপ করা, যা আসলে তার নয়। যেমন, সীমিত মানবমন নিরাকার, নির্গুণ, চৈতন্য-স্বরূপ ব্রহ্মকে অবিলম্বে ধারণ করতে পারে না। তাই শিক্ষক প্রথমে বলেন—“ব্রহ্মই জগতের স্রষ্টা”, “ব্রহ্মই সর্বজ্ঞ”, “ব্রহ্মই সর্বশক্তিমান।” এই সমস্ত বক্তব্য আপাত সত্য; এগুলি ব্যাবহারিক (ব্যাবহারিক সত্য, vyāvahārika satya) স্তরের কথা। কিন্তু এদের উদ্দেশ্য হলো মনের মধ্যে একটি ধারণাগত সেতু তৈরি করা, যেন শিক্ষার্থী অনন্ত ও নিরাকার সত্যের দিকে মনোনিবেশ করতে পারে। যেমন একটি শিশু প্রথমে সূর্যের চিত্র দেখে সূর্য শিখে, পরে বাস্তব সূর্যের অর্থ বোঝে—তেমনি, “সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্ম” ধারণাটিও কেবল শিক্ষার প্রাথমিক সোপান।
এই পর্যায়ে ব্রহ্মকে সগুণ (গুণযুক্ত), সর্বব্যাপী ঈশ্বররূপে উপস্থাপন করা হয়। এই ‘অধ্যারোপিত ঈশ্বর’-ভাব মনের প্রস্তুতি ঘটায়। ব্রহ্ম এখানে মানব-চেতনার সীমায় এসে এক কার্যকর প্রতীক হয়ে ওঠেন—একধরনের “শিক্ষণযোগ্য বাস্তবতা”, যা ধীরে ধীরে পারমার্থিক সত্যের দিকে নিয়ে যায়।
দ্বিতীয় ধাপ হলো অপবাদ বা অপনোদন। যখন অনুসন্ধানী ধীরে ধীরে মনের অস্থিরতা দূর করে ফেলতে পারে, চিত্ত-শুদ্ধি (citta-śuddhi) লাভ করে, এবং “সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্ম” ধারণার সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করতে শুরু করে, তখন শিক্ষক পূর্বে আরোপিত ধারণাটিকেই প্রত্যাহার করেন। এখন বলা হয়—“ব্রহ্ম কার্যকারণাতীত”, “ব্রহ্ম গুণনির্বিশেষ”, “ব্রহ্ম নিরাকার।” অর্থাৎ, যা একসময় শিক্ষার জন্য আরোপ করা হয়েছিল, সেটিই এখন অতিক্রম করতে হবে। এই প্রত্যাহারই অপবাদ—জ্ঞানের জন্য অস্বীকার।
অপবাদ মানে ভুল ধ্বংস করা নয়; বরং ভুলটিকে চিনে ফেলা। যেমন ঘরে আলো জ্বালালে দড়িকে আর সাপ বলে মনে হয় না, তেমনি জ্ঞানের আলোয় পূর্ববর্তী আরোপিত ধারণার মিথ্যাতা নিজেই প্রকাশ পায়। এইভাবে অপবাদ ‘নেতি, নেতি’ (“এ নয়, ও নয়”) প্রক্রিয়ায় চলে—এক এক করে সমস্ত সীমিত ধারণাকে পরিত্যাগ করা হয়। শঙ্কর বলেন, অপবাদের লক্ষ্য হলো, মনকে ধীরে ধীরে ধারণা থেকে ধারণাতীতের দিকে নিয়ে যাওয়া।
অদ্বৈতের এই পদ্ধতি তাই অবিদ্যা থেকে বিদ্যার দিকে এক শিক্ষামূলক যাত্রা। প্রথমে অবিদ্যার স্তরে সত্যকে বোঝাতে কিছু প্রতীক ও গুণ আরোপ করতে হয়, কারণ মন সরাসরি নিরাকার সত্য ধরতে পারে না। পরে, যখন মনের যোগ্যতা বৃদ্ধি পায়, তখন সেই প্রতীকগুলিকেই ভেঙে দিতে হয়, যেন মন ধারণা থেকে মুক্ত হয়ে সত্যে স্থিত হতে পারে।
“তত্ত্বানুশাসনায়াম্ অধ্যারোপ-অপবাদাভ্যাম্ নৈতদ্ দোষায়” হলো অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের একটি মূল পদ্ধতি বা নীতি। এর অর্থ হলো: “তত্ত্বজ্ঞান শেখানোর জন্য অধ্যারোপ এবং অপবাদ—এই দুটি পদ্ধতি দোষের নয়।”—অর্থাৎ, শাস্ত্রে যদি প্রথমে আরোপ ও পরে অপবাদ দেখা যায়, তাতে কোনো দোষ নেই, কারণ সেটিই শিক্ষার স্বাভাবিক ক্রম।
এই বাক্যটি কোনো একক প্রাচীন মন্ত্র নয়। এটি অদ্বৈত বেদান্তের শিক্ষণ পদ্ধতিকে সংক্ষিপ্তভাবে প্রকাশ করে একটি দার্শনিক সূত্র বা প্রবচন। এই নীতিটি আদি শঙ্করাচার্যের পরবর্তীকালে রচিত বিভিন্ন প্রকরণ গ্রন্থ (যেমন বিদ্যারণ্যের পঞ্চদশী) এবং ভাষ্যের টীকা-তে অত্যন্ত প্রচলিত।
এই উক্তিটি প্রায়শই ব্যবহৃত হয় যখন প্রশ্ন ওঠে—ব্রহ্ম যদি একমাত্র সত্য হন, তবে বেদেরা কেন সৃষ্টি বা বহুত্বের কথা বলে? এর উত্তরে বলা হয়, শিক্ষাদানের সুবিধার জন্য এই পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। অদ্বৈত বেদান্ত প্রথমে ব্রহ্মের ওপর জগৎ, ঈশ্বর এবং জীব-এর মতো দ্বৈত ধারণাগুলিকে আরোপ করে (সৃষ্টিতত্ত্বের বর্ণনা দিয়ে), যাতে সীমিত বুদ্ধিবিশিষ্ট শিষ্যরা ব্রহ্মকে প্রাথমিকভাবে বুঝতে পারে।