অবিদ্যা-বিদ্যা: ৩৬


এখান থেকেই শুরু হয় অহংকার (Ahaṅkāra)—যা মিথ্যা আত্মবোধ। আত্মা, যা সর্বব্যাপী, নিজেকে সীমাবদ্ধ দেহ বলে ভুল করে। দেহের পরিবর্তনকে নিজের পরিবর্তন বলে মনে করে; মনোভাবকে নিজের ভাব বলে ধরে; ইন্দ্রিয়সুখকে নিজের সুখ মনে করে। এই ভুল ধারণাই অবিদ্যার জন্ম, এবং এখান থেকেই জন্ম নেয় জগৎ (Jagat)—কারণ জগৎ তো সেই দৃষ্টিকোণেই দেখা হয়, যেখানে “আমি” এবং “অন্য” এই বিভাজন তৈরি হয়েছে।

অধ্যাসই সমস্ত প্রপঞ্চের মূল কারণ। এটি ছাড়া না থাকে দেহবোধ, না থাকে কর্ম, না থাকে সুখ-দুঃখ। শঙ্কর এই ভ্রান্তিকে তুলনা করেন স্বপ্ন ও মরীচিকার সঙ্গে—যেমন মরুভূমিতে জল দেখা যায়, কিন্তু বাস্তবে তা নেই, তেমনি আত্মায় জগৎ দেখা যায় কিন্তু তা কখনও বাস্তবে ছিল না।

এভাবেই ব্রহ্ম, যা এক, অদ্বিতীয় ও চিরনির্বিকার, অবিদ্যার আচ্ছাদনে বিভক্ত ও বহু বলে প্রতীয়মান হয়। অধ্যাস-বাদ তাই শুধু তত্ত্ব নয়—এটাই অদ্বৈত বেদান্তের প্রাথমিক সূত্র, যার উপর পুরো দার্শনিক স্থাপত্য দাঁড়িয়ে আছে।

যখন জ্ঞান উদয় হয়—অর্থাৎ, আত্মা নিজের স্বরূপ চিনে ফেলে—তখন এই আরোপণ বা অধ্যাস নিজে থেকেই বিলীন হয়। দড়ির উপর সাপ দেখার মতো বিভ্রম যখন মুছে যায়, তখন শুধু দড়ি থাকে—তেমনি আত্মা জানে, “আমি কখনও দেহ ছিলাম না, আমি কখনও কর্তা ছিলাম না, আমি কেবল চিরচেতনা ব্রহ্ম।”

এই উপলব্ধিই অদ্বৈতের পরম প্রতিপাদ্য—যেখানে জগতের, অহংকারের, এমনকি মুক্তিরও আর কোনো প্রয়োজন থাকে না। কারণ তখন স্পষ্ট দেখা যায়—অধ্যাসই ছিল মায়া, আর মায়া বিলুপ্ত হলেই থাকে কেবল সেই এক—অচল, অদ্বিতীয়, চিদানন্দরূপ ব্রহ্ম।

অদ্বৈত বেদান্তে এই আত্মা-অনাত্মা-অধ্যাস‌ই মানব-অভিজ্ঞতার সবচেয়ে সূক্ষ্ম এবং মৌলিক ত্রুটি—যে-বিভ্রম থেকে সমগ্র সংসার, সুখ-দুঃখ, জন্ম-মৃত্যু ও মায়ার প্রবাহের উৎপত্তি।

শুদ্ধ সাক্ষী চৈতন্য (Sākṣī-Caitanya)—যিনি চিরন্তন, নিস্পৃহ, অপরিবর্তনীয় এবং সর্বব্যাপী—তাঁর প্রকৃতি হলো “দ্রষ্টা”, কখনও “দৃষ্ট” নয়। তিনি কেবলমাত্র আলো দেন, কিন্তু কখনও আলো দ্বারা স্পর্শিত হন না। অথচ এই চৈতন্য, অবিদ্যার প্রভাবে, যেন নিজের প্রতিবিম্বে জড়িয়ে পড়েন—বুদ্ধি, মন, চিত্তের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পড়েন। এই তিনটি মিলেই গঠিত অন্তঃকরণ (Antaḥkaraṇa)—এক সূক্ষ্ম যন্ত্র, যার দ্বারা জ্ঞান, স্মৃতি, ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়া ঘটে।

যখন এই অন্তঃকরণে চৈতন্যের প্রতিফলন ঘটে, তখনই দেখা যায় এক মায়াবী সংমিশ্রণ—চেতনা ও মন যেন একীভূত। সেই প্রতিফলিত চেতনা-ই “আমি ভাবি”, “আমি দেখি”, “আমি সুখী”, “আমি দুঃখী”—এই সমস্ত অভিজ্ঞতার উৎস। অথচ বাস্তবে, আত্মা কোনোদিনই এই ক্রিয়ার অংশীদার নয়; সে কেবল সাক্ষী। তবু ভুল আরোপণের ফলে, আত্মা—যা চিরউজ্জ্বল, সে নিজেকে আচ্ছন্ন বলে মনে করে; যা অপরিবর্তনীয়, সে পরিবর্তনের স্রোতে গতি পায় বলে অনুভব করে; যা সীমাহীন, সে দেহের সীমানায় নিজেকে আবদ্ধ মনে করে।

এই ভুলটি নিছক জ্ঞানের অভাব নয়—এটি এক ইতিবাচক বিকৃতি, এক সক্রিয় “বিপর্যয়” (Viparyaya)—যেখানে সত্য উলটোভাবে ধরা পড়ে। অদ্বৈত ভাষায়, এই বিপর্যয়ের উৎস হলো অবিদ্যা (Avidyā), যার দুটি শক্তি ক্রিয়াশীল থাকে—আবরণ (Āvaraṇa) ও বিক্ষেপ (Vikṣepa)।

আবরণ-শক্তি আত্মার সত্য স্বরূপকে আড়াল করে, যেন সূর্যকে মেঘ ঢেকে দেয়। তখন চেতনা যেন নিজের দীপ্তি হারিয়ে ফেলে।

বিক্ষেপ-শক্তি সেই আচ্ছাদিত আত্মার উপর অনাত্মার ছায়া প্রক্ষেপণ করে—যেন মেঘের আকার সূর্যের আলোয় অন্যরকম ছায়া তৈরি করে। এর ফলে আত্মা দেহ-মন-ইন্দ্রিয়ের গুণাবলিকে নিজের বলে মনে করে।

এই দুই শক্তি মিলে তৈরি করে মায়া (Māyā)—অজ্ঞানতার অভিনব রূপ, যেখানে অসীম আত্মা নিজেকে সীমিত জীব বলে অভিনয় করে। আত্মা কখনও সত্যিই জড় হয় না, যেমন সাদা কাপড়ে নীল আকাশের প্রতিবিম্ব দেখা গেলেও কাপড় আসলে নীল হয় না—তবু দর্শকের দৃষ্টিভ্রমে নীল বলেই মনে হয়।

অদ্বৈতের দৃষ্টিতে, এই অধ্যাসই সকল দুঃখ (duḥkha), সংসার (saṃsāra), ও বন্ধন (bandha)-এর একমাত্র কারণ। কারণ যতক্ষণ আত্মা নিজেকে অনাত্মার সঙ্গে অভিন্ন মনে করে, ততক্ষণ জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতির চক্রে ঘুরতে হয়।

অতএব, মুক্তি (mokṣa) মানে কোনো নতুন কিছু অর্জন নয়; এটি কোনো স্থানান্তর বা অবস্থার পরিবর্তনও নয়। মুক্তি মানে কেবল এই ভুল আরোপণ বা অধ্যাসের প্রত্যাহার (Apavāda)।

যখন জ্ঞানী ব্যক্তি অন্তরে উপলব্ধি করেন—“আমি কখনও দেহ ছিলাম না, আমি কখনও মন ছিলাম না, আমি কখনও কর্মফল-ভোগী ছিলাম না,” তখন সমস্ত অধ্যাস স্বতঃবিলীন হয়। আত্মা তখন নিজের শুদ্ধ চৈতন্য-রূপেই স্থিত হয়—অখণ্ড, নির্লিপ্ত, আনন্দময়।

এই অবস্থায় “আমি” শব্দটির মানেই পালটে যায়। আগে “আমি” ছিল দেহ, মন, ইন্দ্রিয়ের সমষ্টি; এখন “আমি” মানে চিরন্তন সাক্ষী, যার উপস্থিতিতেই সব কিছু প্রকাশিত, অথচ যিনি নিজে কিছুতেই জড়ান না।

এই উপলব্ধিই অদ্বৈত মুক্তির অন্তিম রূপ—যেখানে আত্মা নিজের স্বরূপে অবিচল থাকে, কোনো আরোপণ ছাড়াই। সেই মুহূর্তে সত্যিই বোঝা যায়—অধ্যাসই ছিল একমাত্র মায়া, আর মায়া মুছে গেলে থাকে কেবল এক, অদ্বিতীয়, চিদানন্দরূপ আত্মা—যিনি সর্বকালের, সর্বস্থানের, সর্বসত্তারও পরম সাক্ষী।

রজ্জু-সর্প-ন্যায় (Rajjū-Sarpanyāya)—অর্থাৎ “দড়ি ও সাপ”-এর দৃষ্টান্ত—অদ্বৈত বেদান্তে অধ্যাস-তত্ত্বের সবচেয়ে স্পষ্ট, সহজ, এবং গভীর প্রকাশ। এটি এমন এক দৃষ্টান্ত, যেখানে মায়া ও জ্ঞানের পুরো নাট্যটি একমুহূর্তে উন্মোচিত হয়ে যায়।

গোধূলির ম্লান আলোয় কেউ মাটিতে পড়ে-থাকা একটি দড়িকে দেখে ভুল করে ভাবে, “ওটা সাপ!” মুহূর্তে ভয় জন্ম নেয়—হৃৎস্পন্দন বাড়ে, দেহ কেঁপে ওঠে, কেউবা চিৎকার করে পিছু হটে। কিন্তু বাস্তবে সেখানে সাপ নেই—কেবল দড়ি আছে। তবু “সাপ”-এর অভিজ্ঞতা, “ভয়”-এর অনুভব, “পিছু হটার” প্রতিক্রিয়া—সবই বাস্তবের মতো প্রতীয়মান হয়। এই দ্বন্দ্বময় অবস্থাই অনির্বচনীয়তা (Anirvacanīyatva)—যেখানে অভিজ্ঞতাটি সম্পূর্ণ সত্যও নয়, আবার সম্পূর্ণ মিথ্যাও নয়।

এই ভ্রমের দুটি মৌলিক ধাপ আছে—আবরণ (Āvaraṇa) ও বিক্ষেপ (Vikṣepa)।

প্রথমে আবরণ-শক্তি দড়ির প্রকৃত স্বরূপকে আচ্ছন্ন করে—অর্থাৎ, যা আছে, তা দেখা যায় না।

তারপর বিক্ষেপ-শক্তি মনের সংস্কার ও কল্পনা দিয়ে সেই আচ্ছাদনের উপর একটি “সাপ”-এর রূপ প্রক্ষেপণ করে।

এই দুই মিলেই জন্ম নেয় বিভ্রম—যা মনের নিজের অন্ধকার ও স্মৃতির মিশ্র ফল।

শঙ্করাচার্যের মতে, সমগ্র জগৎ এই “দড়ি-সাপ”-এর মতোই। আত্মা এখানে দড়ি—চিরন্তন, অপরিবর্তনীয়, সর্বব্যাপী, সত্য। জগৎ হলো সেই কল্পিত সাপ—অবিদ্যার প্রক্ষেপণ, নাম-রূপের (Nāma-Rūpa) প্রতিচ্ছবি। অবিদ্যা প্রথমে আত্মার স্বয়ং-আলোক (Svarūpa-Prakāśa) আচ্ছন্ন করে রাখে—এটাই আবরণ-শক্তি। তারপর সেই আচ্ছাদনের উপর নানা নাম, রূপ, কার্যকারণ ও ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন ফেলে—এটাই বিক্ষেপ-শক্তি।

ফলে আত্মা, যা সীমাহীন, নিজেকে সীমিত দেহ-মন বলে অভিজ্ঞতা করে। যেমন কেউ আলো না পেয়ে দড়িকে সাপ মনে করে, তেমনি মানুষ চেতনার অভাবে ব্রহ্মকে জগৎ বলে ভুল করে। এই ভুলই অধ্যাস (Adhyāsa)—অর্থাৎ, আত্মার উপর অনাত্মার আরোপণ।

কিন্তু যখন বাধক-জ্ঞান (Bādhaka-Jñāna)—অর্থাৎ মিথ্যা-জ্ঞানকে নিবারণকারী জ্ঞান-এর উদয় হয়, তখনই ভ্রমের অবসান ঘটে। যেমন কেউ আলো জ্বালিয়ে দেখে, “এ তো দড়ি, সাপ নয়!”, তখন আর কোনো ভয় থাকে না; তেমনই যখন আত্মজ্ঞান উদিত হয়—“অহম্ ব্রহ্মাস্মি” (“আমি-ই ব্রহ্ম”)—তখন জগতের, মৃত্যুর, দুঃখের সব ভয় নিজে থেকেই বিলীন হয়।

এই দৃষ্টান্তে সাপকে আলাদা করে “নষ্ট” করতে হয় না, কারণ সাপ কখনও ছিলই না। অর্থাৎ, অবিদ্যাকে ধ্বংস করতে হয় না—তার মিথ্যাতা জানলেই সে লুপ্ত হয়। অন্ধকারকে আলো “নষ্ট” করে না; কেবল আলোর উপস্থিতিতে অন্ধকার নিজে থেকেই অদৃশ্য হয়। তেমনি আত্মজ্ঞান অবিদ্যাকে “দমন” করে না—তার অনস্তিত্ব প্রকাশ করে।

এই অবস্থাকেই শঙ্করাচার্য “বাধ-ব্যবহার (Bādha-Vyavahāra)” বলেন—যেখানে মিথ্যা জ্ঞান সত্য জ্ঞানের দ্বারা নিরপেক্ষ (sublated) হয়। যেমন মিথ্যা “সাপ” জ্ঞান সত্য “দড়ি” জ্ঞানে বিলীন হয়, তেমনি মিথ্যা “জগৎ”-জ্ঞান সত্য “ব্রহ্ম”-জ্ঞানে বিলীন হয়।

অতএব, এই রজ্জু-সর্প-ন্যায় আমাদের শেখায়—জগতের অভিজ্ঞতা যেমন দড়ি-সাপের ভয়ের মতোই অনির্বচনীয়: অভিজ্ঞতায় সত্য, কিন্তু তত্ত্বে মিথ্যা। আর মুক্তি মানে সেই ভয়ের অবসান—যখন জানা যায়, “যা ভয়ঙ্কর বলে মনে হচ্ছিল, তা কখনও ছিলই না।”

সেই মুহূর্তে জীব জানে—“নাহম্ দেহঃ, নাহম্ কর্তা, নাহম্ সুখী দুঃখী; অহম্ ব্রহ্মাস্মি।” অর্থাৎ, আমি দেহ নই, কর্তা নই, সুখী বা দুঃখী নই; আমি ব্রহ্ম—যা অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের চূড়ান্ত স্বানুভূতির (Self-realization) একটি সংহত প্রকাশ।

এই বাক্যটি কোনো একটি একক প্রাচীন উপনিষদ বা গীতার মন্ত্র নয়। এটি আদি শঙ্করাচার্যের রচিত অথবা তাঁর নামে প্রচলিত বিভিন্ন প্রকরণ গ্রন্থ (প্রাথমিক দার্শনিক গ্রন্থাবলি) এবং স্তোত্র বা ভজন-এর মূলভাব বা সারসংক্ষেপ। বিশেষ করে শঙ্করাচার্যের আত্মবোধ বা দশশ্লোকী-তে এই ভাবটি প্রবলভাবে প্রকাশ পায়।

উক্তিটি মূলত "অহং ব্রহ্মাস্মি" (আমিই ব্রহ্ম)—এই মহাবাক্যের ভিত্তিতে গঠিত। এর মাধ্যমে সাধক মন ও দেহের সাথে তাঁর ভ্রান্ত সংযোগকে (অধ্যাস) অস্বীকার করেন এবং তাঁর প্রকৃত স্বরূপ ঘোষণা করেন।

এই বাক্যটি তিনটি ধাপে ব্রহ্মজ্ঞানের পথ নির্দেশ করে:

অনাত্ম আত্ম-অস্বীকৃতি (De-identification):
নাহম্ দেহঃ (Nāham dehaḥ): আমি এই স্থূল দেহ নই। (দেহকে উপাধি রূপে ত্যাগ)
নাহম্ কর্তা (Nāham kartā): আমি এই কর্মের কর্তা নই। (কর্মের অহংকার ত্যাগ; প্রকৃতিই কর্তা—গীতা)

মনের অস্বীকার (Rejection of Mental Attributes):
নাহম্ সুখী দুঃখী (Nāham sukhī duḥkhī): আমি সুখ-দুঃখ অনুভবকারী মন বা বুদ্ধি নই। (মন ও বুদ্ধি হলো দৃশ্য; আত্মা দ্রষ্টা)

চূড়ান্ত উপলব্ধি (Final Declaration):
অহম্ ব্রহ্মাস্মি (Aham Brahmāsmi): আমিই ব্রহ্ম। (এই উপলব্ধি হলো সকল দ্বৈতভাবের অবসান এবং আত্মস্বরূপে স্থিতি)।

এই বাক্যটি একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকে প্রকাশ করে—মোক্ষ হলো দেহ, মন ও বুদ্ধির উপাধিকে অস্বীকার করে নিজের বিশুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্মের সঙ্গে একত্ব উপলব্ধি করা। আমাদের উদাহরণে, জ্ঞানের আলোয় সাপ, ভয়, ও অন্ধকার—সব একসাথে মিলিয়ে যায়। থাকে কেবল আত্মার সত্য দড়ি—চিরস্থায়ী, নির্লিপ্ত, স্বপ্রকাশ চেতনা।

অদ্বৈত বেদান্তের অধ্যাস-তত্ত্ব (Adhyāsa-tattva) এক গভীর স্তরবিন্যাসযুক্ত চেতনা-বিশ্লেষণ, যেখানে বিভ্রম বা ভ্রান্তি একটিমাত্র স্তরে সীমাবদ্ধ নয়—বরং এক বিভ্রম আরেক বিভ্রমের উপর দাঁড়িয়ে থাকে, যেন মায়ার বহুস্তরবিশিষ্ট জাল, যার প্রতিটি স্তরেই আত্মা ক্রমশ নিজের প্রকৃতি ভুলে যায়। এই স্তরগুলির প্রতিটি মানুষের অভিজ্ঞতার একেকটি মাত্রা ব্যাখ্যা করে, এবং মুক্তির পথে অনুসন্ধানীর কাজ হলো এই স্তরগুলিকে একে একে চিনে ফেলা, ভেদ করা, এবং অবশেষে তাদের সকলের অন্তরালে থাকা চিরসাক্ষী আত্মাকে উপলব্ধি করা।

১. আত্মা-অনাত্মা-অধ্যাস (Ātma-Anātma-Adhyāsa): এটি মূল বা প্রাথমিক অধ্যাস, যেখান থেকেই সমগ্র জগৎ-অভিজ্ঞতার ভিত্তি তৈরি হয়। এখানে আত্মার (Ātman) গুণাবলী অনাত্মার (দেহ-মন-ইন্দ্রিয়) উপর আরোপিত হয়, এবং অনাত্মার গুণাবলী আত্মার উপর।

আত্মা—যিনি চিরন্তন, চৈতন্যময় ও অপরিবর্তনীয়—তাঁর অস্তিত্ব (সত্তা) ও চেতনা (চিত্‌) দেহের সঙ্গে মিশে যায়। ফলে মনে হয় দেহই সচেতন, দেহই “বেঁচে আছে”।

অন্যদিকে, দেহের পরিবর্তন, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লান্তি ইত্যাদি আত্মার উপর আরোপিত হয়। তখন আত্মা বলে, “আমি ক্ষুধার্ত”, “আমি অসুস্থ”, “আমি মরি”—যদিও সে কখনও এই পরিবর্তনের অংশ নয়।

এই স্তরের ফলেই জন্ম নেয় মৌলিক ভ্রান্তি—“আমি দেহ”, “আমি মন”, “আমি কর্তা”, “আমি ভোগী।” এই ভ্রান্তিই সংসারের সূচনা বিন্দু, এবং এখান থেকেই অহং, কর্ম ও বন্ধনের চক্র শুরু হয়।