যখন আত্ম-অনুসন্ধানের যাত্রা চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছায়, তখন সাধক এমন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন, যেখানে “সৃষ্টি” বলেই কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না। যে-জগৎকে এতদিন বাস্তব বলে মনে হচ্ছিল—যেখানে স্রষ্টা, সৃষ্টি ও সৃষ্ট বস্তু এই তিনের ভেদ বজায় ছিল—তা একমুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যায়। এখানে প্রকাশ পায় অজাত-বাদ (Ajāta-vāda)—অদ্বৈত বেদান্তের সর্বোচ্চ দর্শন, যার সারমর্ম: “কিছুই কখনও জন্মায়নি।”
এই মতের প্রবর্তক গৌড়পাদাচার্য, যিনি মাণ্ডূক্য কারিকায় বলেছেন—
“নৈষা উৎপত্তির্নিরোধো ন বদ্ধো ন সাধকঃ।
ন মুমুক্ষুর্ন বৈ মুক্ত ইত্যেষা পরমার্থতা।।”
অর্থাৎ, “সৃষ্টি বা প্রলয়, বন্ধন বা মুক্তি, সাধনা বা সাধক—কিছুই আসলে সত্য নয়; এই-ই পরমার্থতত্ত্ব।” এটি মাণ্ডূক্য কারিকার চতুর্থ অধ্যায়ের (অলাতশান্তি প্রকরণ) দ্বিতীয় শ্লোক। শ্লোকটি পরমার্থ সত্য (Paramārthatā) বা অজাতবাদ (অজাতিবাদ) (অদ্বৈতের চরম জ্ঞান) বর্ণনা করে। এর মূল বক্তব্য হলো, পরম সত্যের দৃষ্টিতে কোনো দ্বৈততা বা পরিবর্তন নেই:
১. অ-সৃষ্টি (ন উৎপত্তির্): পরমার্থে কোনো সৃষ্টি (উৎপত্তি) বা বিনাশ (নিরোধঃ) নেই।
২. অ-বন্ধন (ন বদ্ধঃ): সেখানে কোনো বদ্ধ জীব নেই।
৩. অ-সাধন (ন সাধকঃ): কোনো সাধক বা সাধনকারী নেই।
৪. অ-মুক্তি (ন মুমুক্ষুর্ন বৈ মুক্তঃ): কোনো মুমুক্ষু (মুক্তির আকাঙ্ক্ষী) নেই, এবং কোনো মুক্ত ব্যক্তিও নেই।
সিদ্ধান্ত: এই সমস্ত ভেদাভেদ হলো কেবল ব্যাবহারিক সত্য বা মায়ার কারণে সৃষ্ট। কিন্তু পরমার্থ সত্যে (এষ পরমার্থতা) একমাত্র ব্রহ্ম বিদ্যমান। জন্ম, মৃত্যু, বন্ধন, মুক্তি—এই সমস্ত ধারণা ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পর বিলীন হয়ে যায়, কারণ ব্রহ্ম অনাদি ও অপরিবর্তনীয়।
এই অজাত-বোধে সব দ্বন্দ্ব—সৃষ্টি ও লয়, জাগ্রত ও নিদ্রা, জীব ও ঈশ্বর—সব মায়ার এক আপাত-প্রতিফলন বলে প্রতীয়মান হয়। যা আমরা “জগৎ” বলে অনুভব করি, তা আসলে অবিদ্যার প্রক্ষেপণ—চেতনার মধ্যেই এক ক্ষণস্থায়ী লেনদেন (vyavahāra)। যেমন ঘুমন্ত মানুষ স্বপ্নে রাজ্য, যুদ্ধ, প্রেম, দুঃখ সবই অনুভব করে, কিন্তু জেগে উঠে জানে—“কিছুই ঘটেনি,” তেমনি জ্ঞানী ব্যক্তি জেগে থাকেন চেতনার স্তরে, যেখানে জগতের জন্ম বা বিনাশ কোনো সত্য অর্থে ঘটে না।
অজাত-বাদে ব্রহ্ম একমাত্র অচঞ্চল বাস্তব। ব্রহ্ম না কিছু সৃষ্টি করেন, না ধ্বংস করেন; না তিনি কোথাও গমন করেন, না ফিরে আসেন। সৃষ্টি কেবল এক আপাত-প্রতিফলন—চেতনার স্বপ্নে প্রতিভাসিত বহুত্ব। গৌড়পাদাচার্য একে তুলনা করেন “স্বপ্ন” ও “মায়া”-র সঙ্গে—“স্বপ্ন-মায়া-স্বরূপাণি জন্মানি ন হি সত্তয়ঃ” (গৌড়পাদ কারিকা—অলাতশান্তি প্রকরণ (চতুর্থ অধ্যায়), শ্লোক ৫৮), যার অর্থ: “জন্মসমূহ (সৃষ্টি) স্বপ্ন ও মায়ার মতো, (অভিজ্ঞতায় বাস্তব মনে হলেও) তারা কখনোই সৎ (বাস্তব) নয় (পরমার্থে অনস্তিত্বশীল)”।
এই শ্লোকটি অজাতিবাদ (নন-অরিজিনেশন) তত্ত্বকে শক্তিশালী করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। এটি দৃশ্যমান জগৎ এবং জীবের জন্মকে অসত্য প্রমাণের জন্য ব্যবহৃত হয়:
স্বপ্ন-মায়া-স্বরূপাণি জন্মানি: জীবের জন্ম এবং এই জগতের উৎপত্তিকে স্বপ্ন এবং মায়ার মতো বলে বর্ণনা করা হয়েছে। স্বপ্ন যেমন জেগে উঠলে মিথ্যা প্রমাণিত হয়, এবং মায়া যেমন ভ্রান্তি সৃষ্টি করে—এই জগৎও ঠিক তেমনই।
ন হি সত্তয়ঃ: এর মানে হলো—এই জন্ম বা সৃষ্টি সৎ নয় বা এদের বাস্তব অস্তিত্ব নেই।
সিদ্ধান্ত: এই শ্লোকটি প্রতিষ্ঠা করে যে, যদি জীব বা জগতের জন্মই সৎ বা বাস্তব না হয়, তবে তাদের বিনাশের প্রশ্নও ওঠে না। সব কিছুই একমাত্র সৎ ব্রহ্মের ওপর আরোপিত একটি ভ্রম মাত্র।
এই অবস্থায় জানা যায়, বন্ধন (bandha) ও মুক্তি (mokṣa)—দুটোই কেবল অবিদ্যার ধারণা। বন্ধন মানে অবিদ্যার সৃষ্টি, আর মুক্তি মানে সেই অবিদ্যার বিলোপ। কিন্তু যখন জানা যায়, অবিদ্যা নিজেই কল্পিত, তখন দেখা যায়—বন্ধন ও মুক্তি দুই-ই কল্পিত ছিল।
যে-আত্মা মুক্তি চায়, সে কখনও আবদ্ধ ছিল না; যে বন্ধন থেকে মুক্ত হতে চায়, সেই বন্ধনই ছিল ভুল পরিচয়। অদ্বৈতের ভাষায়—“অবিদ্যা সরে গেলে বোঝা যায়, সবসময়ই, একটিই সত্য ছিল—চির-স্বয়ং-প্রকাশ চিদানন্দরূপ ব্রহ্ম।” এই উপলব্ধিতে আর কোনো অর্জন নেই, কোনো ক্রিয়া নেই, কোনো গতি নেই; কারণ সব কিছু ইতিমধ্যেই ব্রহ্মে পরিণত।
যে-মুহূর্তে এই উপলব্ধি আসে, তখন সমগ্র মায়ার নাট্যমঞ্চ নিস্তব্ধ হয়ে যায়। সমস্ত নাম, রূপ, ধারণা, সময় ও কার্যকারণ—সব লীন হয় এক অদ্ভুত, নিঃশব্দ শান্তিতে। এই অবস্থাকে বলা হয় প্রপঞ্চ-উপশম (Prapancha-Upaśama)—অর্থাৎ, বহুতার পরম প্রশমন।
“প্রপঞ্চোপশমং শান্তং শিবমদ্বৈতমদ্বিতীয়ম্।” (মাণ্ডূক্য উপনিষদ, ৭)—যার অর্থ: “তাঁর মধ্যে প্রপঞ্চের (দৃশ্যমান জগতের) উপশম ঘটে; তিনি শান্ত, শুভ, অদ্বৈত এবং অদ্বিতীয়,” অর্থাৎ, যেখানে সমস্ত প্রপঞ্চ নিস্তব্ধ, যা শান্ত, যা কল্যাণময়, যা অদ্বিতীয়—সে-ই আত্মা, সে-ই ব্রহ্ম।
এই মন্ত্র আত্মার চতুর্থ অবস্থা (তুরীয়) বর্ণনা করে, যা চরম সত্য ব্রহ্মের স্বরূপ। এই বাক্যাংশ তুরীয়ের পাঁচটি প্রধান লক্ষণ বা গুণাবলীকে বর্ণনা করে, যা অদ্বৈত বেদান্তের চূড়ান্ত লক্ষ্য:
১. প্রপঞ্চোপশমম্ (Prapañcopaśamam): প্রপঞ্চ (দৃশ্যমান জগৎ, দ্বৈততা, বা বহুত্বের বিস্তার) যার মধ্যে সম্পূর্ণভাবে উপশমিত বা বিলীন হয়ে গেছে। এটিই ব্রহ্মের সঙ্গে একত্ব।
২. শান্তম্ (Śāntam): তিনি শান্ত, অর্থাৎ সকল প্রকার উদ্বেগ, চঞ্চলতা ও দুঃখ থেকে মুক্ত।
৩. শিবম্ (Śivam): তিনি শুভ বা মঙ্গলময়।
৪. অদ্বৈতম্ (Advaitam): তিনি অদ্বৈত, অর্থাৎ দুই বা বহুর ধারণা থেকে মুক্ত; তাঁর মধ্যে কোনো ভেদ নেই।
৫. অদ্বিতীয়ম্ (Advitīyam): তিনি অদ্বিতীয়, অর্থাৎ তাঁর সমকক্ষ বা দ্বিতীয় কোনো সত্তা নেই।
এই মন্ত্রের মাধ্যমে উপনিষদ ঘোষণা করে যে, একমাত্র এই তুরীয় অবস্থাটিই হলো পরমাত্মা, যাকে জানতে পারলে জীব মুক্ত হয়।
এখানে অনুসন্ধানকারী বুঝতে পারেন—যে তত্ত্ব, প্রমাণ, যুক্তি, এবং দর্শন এতদিন তাকে পথ দেখিয়েছিল, সেগুলো কেবল সিঁড়ির ধাপমাত্র। এখন সেই সিঁড়িরও প্রয়োজন ফুরিয়েছে, কারণ তিনি পৌঁছে গেছেন নিজের চূড়ান্ত গন্তব্যে। জগৎ তাঁর কাছে এখন গন্ধর্বনগর (Gandharva-Nagara)—মেঘের শহরের মতো, সুন্দর কিন্তু অসার, প্রতিফলিত কিন্তু অনস্তিত্বশীল, উপস্থিত কিন্তু অদৃশ্য। সব কিছু এখন নিঃশব্দে স্থির, সমস্ত ধারণা বিলীন, এবং অবশিষ্ট থাকে কেবল এক চিরস্থায়ী নীরবতা—যা ব্রহ্ম নিজেই।
এই চূড়ান্ত অভিজ্ঞতায় ব্রহ্ম কেবল সত্য নয়—ব্রহ্মই নীরবতা (Mauna)। যেখানে বাক থেমে যায়, চিন্তা থেমে যায়, প্রমাণ ও তর্ক থেমে যায়—সেখানে যে নিঃশব্দ চেতনা অবশিষ্ট থাকে, তাকেই উপনিষদ বলে—“যেন মনা আপ্রান্নমনুতে, যেনাহুর্মনোমতং।” (কেন উপনিষদ ১.৬) এর অর্থ হলো: "যা মন দ্বারা মনন করে না, কিন্তু যার দ্বারা মনকে মনন করে বলে মনে করা হয়, (তাকে ব্রহ্ম বলে জানবে)।" অর্থাৎ, যাতে মন পৌঁছাতে পারে না, কিন্তু যার দ্বারাই মন চিন্তা করতে পারে—সে-ই আত্মা, সে-ই ব্রহ্ম, সে-ই নীরব অনন্ত।
এই উপনিষদটি শুরুই হয় সেই প্রশ্ন দিয়ে যে, মন, প্রাণ ও বাক্ কীসের শক্তিতে কাজ করে। মন্ত্রগুলো একে একে সেই শক্তির উৎস হিসেবে ব্রহ্মকে নির্দেশ করে। এই শ্লোকটি ব্রহ্মের স্বরূপ এবং মন-সহ সমস্ত ইন্দ্রিয়ের ঊর্ধ্বে তাঁর অবস্থান বর্ণনা করে:
ইন্দ্রিয়ের অতীত: ব্রহ্মকে সাধারণ মন বা জ্ঞানের মাধ্যমে উপলব্ধি বা ধারণা করা যায় না। তিনি মনের ধারণার বিষয় নন।
মনের চালক: ব্রহ্মই সেই পরম চৈতন্য বা শক্তি, যার দ্বারা মন তার মনন বা চিন্তা করার ক্ষমতা লাভ করে। মন নিজে স্বয়ং প্রকাশিত নয়, বরং ব্রহ্মের জ্যোতিতেই সে আলোকিত হয়।
নেতি নেতি: উপনিষদ এখানেও ব্রহ্মকে নেতিবাচকভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। সেই ব্রহ্মকে জানবে, যাকে লোকে মনের বিষয় বলে পূজা করে না, বরং যিনি মনকে পরিচালিত করেন।
অদ্বৈত সিদ্ধান্ত: এই মন্ত্রটি অদ্বৈত বেদান্তের সেই তত্ত্বকে সমর্থন করে যে, ব্রহ্ম হলেন দ্রষ্টা বা সাক্ষী মাত্র, তিনি দৃশ্যমান মন বা মনের কার্যকলাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন। মন-সহ সব উপাধির অতীত সেই চৈতন্যকেই জানতে হয়।
এই চূড়ান্ত নীরব উপলব্ধির পর শুরু হয় অদ্বৈত দর্শনের তৃতীয় ও সূক্ষ্মতম পর্ব—অধ্যাস-বাদ (Adhyāsa-vāda)। এখানে মায়া, অবিদ্যা, ও জগতের উদ্ভব সব ব্যাখ্যা পায় এক মৌলিক মনস্তাত্ত্বিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আচার্য শঙ্কর তাঁর ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যের সূচনাতেই এই উক্তিটির মাধ্যমে অধ্যাস (Adhyasa) বা অধ্যারোপের (Superimposition/Error) একটি সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিয়েছেন, যা তাঁর সমগ্র অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের ভিত্তি।
শঙ্করাচার্য তাঁর ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্য শুরু করেন ছোট্ট একটি একক সংজ্ঞা দিয়ে—“অধ্যাসঃ নাম স্মৃতিরূপঃ পরত্র পূর্বদৃষ্টাভাসঃ।” (ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য—উপোদ্ঘাত (ভূমিকা)) অর্থাৎ, “অধ্যাস হলো এমন এক ভ্রম, যেখানে পূর্বে দেখা বা অভিজ্ঞ কোনো বস্তুর রূপ বা গুণ অন্য কোনো জায়গায় আরোপিত হয়।”
এই সংজ্ঞার মাধ্যমে শঙ্কর ভ্রান্তির (Error) প্রকৃতি ব্যাখ্যা করেছেন, যা থেকে পুরো জগৎকে ভ্রম বলে প্রমাণ করা যায়:
অধ্যাসঃ নাম (Adhyāsaḥ nāma): অধ্যাস বলতে বোঝায়…
স্মৃতিরূপঃ (Smṛtirūpaḥ): যা স্মৃতি-স্বরূপ। অর্থাৎ, পূর্বের অভিজ্ঞতা বা স্মৃতি থেকে যে-সংস্কার মনে থাকে, তার ভিত্তিতে এই ভ্রম সৃষ্টি হয়।
পরত্র (Paratra): যা অন্য কোনো বস্তুতে (আশ্রয়বস্তুতে) স্থাপিত হয়। যেমন, দড়ি দেখে সাপের ভ্রম হলে, দড়ি হলো আশ্রয়বস্তু।
পূর্বদৃষ্টাভাসঃ (Pūrvadṛṣṭābhāsaḥ): যা পূর্বে দেখা বস্তুর আভাস বা প্রতিভাত রূপ।
সম্পূর্ণ ভাবার্থ: অধ্যাস হলো একটি স্মৃতি-স্বরূপ (পূর্ব-অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভরশীল) ভ্রম, যা অন্য কোনো বস্তুর ওপর পূর্বে দেখা কোনো বস্তুর প্রতিভাস মাত্র।
এটি নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করে:
ভ্রান্তির উদাহরণ: দড়িকে সাপ মনে করা, ঝিনুকে রুপার ভ্রম হওয়া, বা চলমান কাষ্ঠখণ্ডকে আগুনের চক্র মনে করার মতো ভ্রমগুলি হলো অধ্যাস।
জগতের অধ্যাস: শঙ্কর এই যুক্তি দেন যে, ঠিক একইভাবে, শুদ্ধ ব্রহ্ম (আশ্রয়বস্তু) হলেন একমাত্র সত্য, কিন্তু অজ্ঞান বা অবিদ্যা-র কারণে আমরা সেই ব্রহ্মের ওপর দ্বৈত জগৎ এবং কর্তৃত্ব-কে অধ্যাস (ভ্রম) করি।
মুক্তি: যখন এই অধ্যাস দূর হয়, তখন ভ্রমের বস্তু (জগৎ) বিলীন হয়ে যায় এবং একমাত্র আশ্রয়বস্তু (ব্রহ্ম) অবশিষ্ট থাকে। এটিই হলো মোক্ষ।
এই সংজ্ঞা যত ছোটো, তার দার্শনিক ব্যাপ্তি তত গভীর। “স্মৃতিরূপ” মানে, এটি কোনো নতুন সৃষ্টি নয়, বরং পূর্বের অভিজ্ঞতার প্রতিচ্ছবি; “পরত্র”—অন্যত্র, মানে ভুল স্থানে; “পূর্বদৃষ্টাভাস”—পূর্বে দেখা বস্তুর মায়াময় প্রতিভাস। সহজ ভাষায়, অধ্যাস হলো ভুল আরোপণ—যেখানে “যা নেই”, সেখানে “তা আছে” বলে মনে হয়।
যেমন অন্ধকারে দড়িকে দেখে কেউ সাপ মনে করে—এটাই অধ্যাসের সহজ উদাহরণ। এখানে “সাপ”-এর স্মৃতি “দড়ি”-র উপর আরোপিত হয়েছে। বাস্তবে দড়িই আছে, কিন্তু ভুল চিন্তার কারণে “সাপ” দেখা যায়। তেমনি আত্মা, যা চিরচৈতন্য ও অবিনশ্বর, তার উপর দেহ, মন, ইন্দ্রিয়ের গুণ আরোপিত হয়—এবং, আমরা বলি, “আমি দেহ”, “আমি মন”, “আমি সুখী”, “আমি দুঃখী”।
অদ্বৈত দর্শনের দৃষ্টিতে, অবিদ্যা (Avidyā) বা অজ্ঞান প্রকৃতপক্ষে এই অধ্যাসই। এটি কোনো বস্তু নয়, কোনো স্বাধীন শক্তিও নয়; এটি জ্ঞানের বিকৃতি, ভুল অভিসন্ধান (misattribution)। আত্মা ও অনাত্মার মধ্যে যে-মিশ্রণ ঘটে—অর্থাৎ, চেতনা ও জড়ের সংমিশ্রণ—সেই বিভ্রমের নামই অধ্যাস।
শঙ্কর বলেন, এই মিথ্যা মিশ্রণই সব প্রপঞ্চের বীজ। আত্মার গুণ—সৎ (অস্তিত্ব), চিত্ (চেতনা) ও আনন্দ (আত্মসুখ)—ভুলক্রমে দেহ ও মনের উপর আরোপিত হয়; আবার অনাত্মার গুণাবলি—জন্ম, মৃত্যু, পরিবর্তন, ক্ষুধা, সুখ, দুঃখ—মিথ্যাভাবে আত্মার উপর স্থানান্তরিত হয়। এই উভয়মুখী আরোপণেই সৃষ্টি হয় সেই মৌলিক ভ্রান্তি—“অহং (আমি)”—যা নিজেকে এক সীমাবদ্ধ ব্যক্তিসত্তা হিসেবে চিনতে শুরু করে।