অবিদ্যা-বিদ্যা: ২৯



দেহ দৃশ্য, কারণ তা পরিবর্তিত হয়; ইন্দ্রিয় দৃশ্য, কারণ তারা কর্ম করে, কিন্তু চেতনা নয়; মন দৃশ্য, কারণ তার ভাব ওঠে-নামে। অথচ এক চেতনা আছে, যা এই সব পরিবর্তনকে দেখে, কিন্তু নিজে অপরিবর্তনীয়—সেই চেতনা আত্মা।

বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৩.৪.২)-এর ভাষ্যে পাচ্ছি—“দ্রষ্টা দ্রশ্যাদনন্যঃ, শ্রোতা শ্রবণাদনন্যঃ”—দ্রষ্টা দেখা-বস্তুর (দৃশ্যের) থেকে ভিন্ন; শ্রোতা শোনার ক্রিয়া (শ্রবণ) থেকে ভিন্ন।

দ্বা সুপর্ণা: জীবাত্মা ও পরমাত্মার রূপক—'দ্বা সুপর্ণা' (Dvā Suparṇā) হলো হিন্দু দর্শনের, বিশেষত ঋগ্‌বেদ (১.১৬৪.২০), মুণ্ডক উপনিষদ (৩.১.১-৩.১.২) এবং শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (৪.৬-৪.৭)-এ বর্ণিত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রূপক, যা জীবাত্মা (ব্যক্তিগত আত্মা) এবং পরমাত্মা (ব্রহ্ম/ঈশ্বর)-এর সম্পর্ক বর্ণনা করে। মন্ত্রটি—

দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া
সমানং বৃক্ষং পরিষস্বজাতে।
তয়োরন্যঃ পিপ্পলং স্বাদ্বত্ত্য-
নশ্নন্নন্যো অভিচাকশীতি।।
(ঋগ্‌বেদ (১.১৬৪.২০), মুণ্ডক উপনিষদ (৩.১.১) এবং শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (৪.৬))

অন্বয়: সযুজা (সর্বদা একসাথে, পরস্পর ঘনিষ্ঠ); সখায়া (একই রকম); দ্বা সুপর্ণা (সুন্দর পালকযুক্ত দুটি পাখি—একটি জীবাত্মা এবং অন্যটি পরমাত্মা); সমানং বৃক্ষম্‌ (একই গাছকে [অর্থাৎ, শরীরকে]); পরিষস্বজাতে (পরস্পর আলিঙ্গন বা আশ্রয় করে আছে); তয়োঃ (তাদের [জীবাত্মা এবং পরমাত্মা] মধ্যে); অন্যঃ (একটি (জীবাত্মা]); স্বাদু পিপ্পলম্ (মিষ্টি/পাকা ফল [অর্থাৎ, ভালো ও মন্দ কাজের ফল]); অত্তি (খাচ্ছে [ভোগ করছে]); অন্যঃ (অপরটি [পরমাত্মা]); অনশ্নন্‌ (কিছুই না খেয়ে [অর্থাৎ, কিছুই করছে না]); অভিচাকশীতি ([ফল] খাওয়ার বদলে দেখছে দর্শকের মতো)।

সরলার্থ: সুন্দর পালকযুক্ত একই রকম দেখতে দুটি পাখি সবসময় একই গাছে থাকে। তাদের মধ্যে একটি পাখি সুমিষ্ট ফল খাচ্ছে এবং অন্যটি কিছু না খেয়ে কেবল দেখছে।

ব্যাখ্যা: উপনিষদ জীবাত্মা ও পরমাত্মার সম্পর্ক বোঝাতে এক গভীর ও কাব্যময় উপমা দিয়েছেন—দুটি পাখির দৃষ্টান্তে। এই মন্ত্রটিকে অদ্বৈত বেদান্তে আত্ম-জ্ঞান ও অনাসক্তির অন্যতম ভিত্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

একই বৃক্ষের উপর দুটি পাখি বসে আছে—‘দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া’ কথাটার অর্থেই লুকিয়ে আছে দার্শনিক সত্যটি। ‘দ্বা’ মানে দুই, কিন্তু এ দুই সংখ্যাগত ভেদ নয়; ‘সুপর্ণা’ মানে সুন্দর পাখা—অর্থাৎ, দুই সত্তাই একই চেতনার দুই প্রকাশ। তারা ‘সযুজা’, অর্থাৎ একত্রে যুক্ত, আর ‘সখায়া’, অর্থাৎ ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাদের আবাস একই—‘সমানং বৃক্ষং’। বৃক্ষ এখানে দেহ বা প্রকৃতি, যা পাঁচভূত, প্রাকৃতিক উপাদান ও সংস্কার দ্বারা গঠিত।

এক পাখি গাছের ফল খাচ্ছে—সে জীবাত্মা। তার মুখে কখনো মিষ্ট ফল, কখনো তেতো; অর্থাৎ, সে সুখ-দুঃখ, সাফল্য-ব্যর্থতা, লাভ-ক্ষতি—এই দ্বৈত অভিজ্ঞতার স্বাদ নিচ্ছে। অন্য পাখিটি কেবল দেখছে, কোনো ফল খাচ্ছে না; সে পরমাত্মা—সাক্ষী-চেতনা, সর্বব্যাপী ও অচঞ্চল। সে কেবল উপস্থিত, কিন্তু কোনো ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না।

অন্যদিকে পরমাত্মা অচঞ্চল। তিনি ‘অভিচাকশীতি’—কেবল দেখেন, কিন্তু কিছু করেন না। এই ‘দেখা’ কোনো ক্রিয়া নয়, এটি অস্তিত্বের নিজস্ব আলোক। যেমন সূর্য কেবল আলো দেয়, কিন্তু আলোকিত করা তার স্বভাব; তেমনি পরমাত্মা কেবল সাক্ষী, তাঁর সাক্ষীভাবই সর্বকর্মের পটভূমি।

শঙ্করাচার্য তাঁর মুণ্ডক উপনিষদ ভাষ্যে এই মন্ত্রের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন—জীব ও ঈশ্বর আসলে এক আত্মা, কিন্তু অজ্ঞতার দ্বারা পৃথক বলে প্রতীয়মান হয়। যেমন সূর্যের প্রতিফলন জলে কাঁপে, অথচ আকাশের সূর্য অচঞ্চল থাকে, তেমনি দেহ-মন-প্রত্যয়ের জলে প্রতিফলিত আত্মাই জীব, আর প্রতিফলনের ঊর্ধ্বে যিনি আছেন, তিনিই পরমাত্মা। জীবের আন্দোলন ও অস্থিরতা আসলে প্রতিফলনের কম্পন, সূর্যের নয়।

জীবাত্মা যতদিন কর্মের ফলের ভোগে লিপ্ত, ততদিন সে ফলভক্ষণকারী পাখির মতো দুঃখে জড়িত। কিন্তু যখন জ্ঞান উদয় হয়, তখন সে নিজেকে সেই অপর পাখি বলে চেনে—যে কিছু খায় না, কেবল দেখে। এই জ্ঞানই মুক্তি, কারণ তখন ভোগী ও দ্রষ্টা এক হয়ে যায়। তখন জীব জানে—“আমি সেই পরম চেতনা, আমি ফলভোগী নই, আমি সাক্ষীমাত্র।”

এই দৃষ্টান্তের অন্তর্নিহিত শিক্ষা অনাসক্তি। জীবের বন্ধন আসে আসক্তি থেকে—ফলভোগের লালসা থেকে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন (৩.২৭)—“অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে”—যে নিজেকে কর্তা ভাবে, সে অজ্ঞানী। আত্মা কিছুই করে না, কিন্তু তার উপস্থিতিতেই সব ক্রিয়া ঘটে।

অনাসক্ত হওয়া মানে পালিয়ে যাওয়া নয়; বরং কর্মের মাঝেই স্থির থাকা। স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়—“অনাসক্তি হলো প্রচণ্ড কর্মব্যস্ততার মধ্যেও নিবিড় বিশ্রাম।” অর্থাৎ, আপনি কাজ করছেন, কিন্তু ফলের চিন্তা আপনাকে বিচলিত করছে না, কারণ আপনি জানেন—আপনি যন্ত্র নন, যন্ত্রীও নন; আপনি সাক্ষী, ঈশ্বরের ইচ্ছাই সমস্ত ক্রিয়ার চালিকা।

উপনিষদীয় সত্য এই—দুটি পাখি আসলে এক সত্তা। তাদের মধ্যে বাহ্য আচরণের পার্থক্য আছে, কিন্তু স্বরূপে তারা অভিন্ন। এক সত্তা যখন দেহ-মন-ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে পড়ে, তখন সে জীব; আর যখন সে নিজেকে চৈতন্যরূপে জানে, তখন সে পরমাত্মা। শ্রীরামকৃষ্ণ এই সত্যটি বলেছেন সহজভাবে—“জীবাত্মা হচ্ছে কাঁচা আমি, পরমাত্মা পাকা আমি।”

এখানে, এক বৃক্ষের দুটি পাখি মানে দুই আলাদা সত্তা নয়, বরং আত্মার দুই অবস্থা—অবিদ্যার ফলে বদ্ধ অবস্থা এবং বিদ্যার ফলে মুক্ত অবস্থা। জীব যখন নিজ পরম সঙ্গীকে—অন্তরস্থিত সাক্ষী আত্মাকে—চিনে ফেলে, তখন তার দুঃখ ও দাসত্ব মুছে যায়, সে বুঝতে পারে—“আমি কখনও ভোগী ছিলাম না; আমি চিরকাল সেই অচঞ্চল সাক্ষী।”

এই উপলব্ধিই অদ্বৈতের পরম সার্থকতা—যেখানে ভোগী ও দ্রষ্টা, জীব ও ঈশ্বর, দুটি পাখি মিলে যায় এক চেতনার নিস্তরঙ্গ আকাশে।

সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্লোঽ-
নীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ।
জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশমস্য
মহিমানমিতি বীতশোকঃ।।
(মুণ্ডক উপনিষদ (৩.১.২) এবং শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ (৪.৭))

অন্বয়: পুরুষঃ (জীবাত্মা [জীব]); সমানে বৃক্ষে ([পরমাত্মার সঙ্গে] একই গাছের উপর [শরীর]); নিমগ্নঃ (ডুবে রয়েছে এই অজ্ঞানতায়—সে (জীবাত্মা) হচ্ছে শরীর]); অনীশয়া (নিজের দেবত্ব সম্পর্কে সচেতন না হয়ে, অসহায় ভেবে); মুহ্যমানঃ (অজ্ঞানতার মোহে আচ্ছন্ন/অভিভূত); শোচতি ([এবং] শোক করে); [কিন্তু সেই একই জীবাত্মা]; যদা (যখন); জুষ্টম্‌ ([যোগিগণের দ্বারা] সেবিত হয়ে বা অনুকূল অবস্থায় (আধ্যাত্মিক সাধনার দ্বারা]); অন্যম্ ঈশম্ (দেহ ব্যতীত পরমাত্মাকে [ঈশ্বরকে] বা [সকল উপাধি) বর্জিত হয়ে পরমেশ্বর [রূপে পরমাত্মাকে]); পশ্যতি (দেখে); অস্য (এই/তাঁর [পরমাত্মার]); ইতি ([সে] লাভ করে); মহিমানম্‌ (মহিমান্বিত স্বরূপকে); [তদা (তখন)]; বীতশোকঃ ([এই জগতের] শোকদুঃখ থেকে মুক্ত বা [তখন সে] সব দুঃখের পারে চলে যায়)।

সরলার্থ: জীবাত্মা পরমাত্মার সঙ্গে একই গাছে (অর্থাৎ, একই দেহে) থাকলেও জীবাত্মা তার নিজ স্বরূপ সম্পর্কে অজ্ঞ। এই কারণে তাকে নানা দুঃখ ভোগ করতে হয়। কিন্তু যখন তার স্বরূপজ্ঞান হয়, তখন সে সুখদুঃখের পারে চলে যায় এবং নিজ মহিমা উপলব্ধি করে।

ব্যাখ্যা: উপনিষদের এই অংশে “পুরুষ” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এক বিশেষ অর্থে—এখানে তা ব্রহ্ম বা সর্বব্যাপী চৈতন নয়, বরং জীবাত্মা বা ব্যক্তিসত্তা। উপনিষদ বলছেন, জীবাত্মা ও পরমাত্মা একই বৃক্ষে অবস্থান করছে; কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। শঙ্করাচার্য এই প্রসঙ্গে এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত দিয়েছেন—জীবাত্মা যেন এক “অলাবু” (লাউ), যা বিশাল সমুদ্রের জলে ভাসছে। তরঙ্গের আঘাতে তা কখনো উপরে উঠে আসে, কখনো নিচে নেমে যায়, কখনো একদিকে, কখনো অন্যদিকে ভেসে বেড়ায়। জলতরঙ্গের গতি যেমন লাউটির স্থিতি নির্ধারণ করে, তেমনি সংসারের ঢেউ জীবাত্মাকে দুলিয়ে রাখে—সুখে সে উপরে উঠে, দুঃখে নিমজ্জিত হয়।

এই দৃষ্টান্তে সমুদ্র জীবন বা সংসারের প্রতীক, তরঙ্গ হলো কর্মফল ও বাসনা, আর অলাবু জীবাত্মা—যে নিজের স্থিতি হারিয়ে কর্মের তাড়নায় দুলে যায়। জীবাত্মা নিজের স্বরূপ ভুলে এই পরিবর্তনের ভেতরেই বেঁচে থাকে। কখনো সে মনে করে, “আমি সুখী,” কখনো “আমি দুঃখী।” এই ওঠা-নামাই তার সংসারচক্র। শঙ্করাচার্য বলেন, এই দোলায়নের কারণ হলো “অনীশয়া”—অর্থাৎ, জীবের নিজস্ব শক্তিহীনতা। জীব নিজেকে ঈশ্বর বলে জানে না; নিজের দেবত্ব সে বিস্মৃত হয়েছে।

অবিদ্যার আচ্ছাদনে ঢাকা পড়ে সে নিজেকে দেহ-মন বলে মনে করছে। তাই সে ভাবে—“আমি অক্ষম, আমি অপদার্থ, আমি দীন।” এই দীনভাবই তাকে ভেতরে ভেতরে ভেঙে দেয়। শঙ্কর বলেন, এই অবস্থা একপ্রকার আত্মহত্যা; কারণ এতে আত্মার সম্ভাবনা নষ্ট হয়। যে নিজেকে অসহায় ভাবে, সে চিরকাল দুঃখভোগী; কিন্তু এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব। যখন জীব সত্যনিষ্ঠা, পবিত্রতা, সংযম ও আত্মচিন্তায় মগ্ন হয়, তখন তার অন্তরে একমুহূর্ত আসে—যা উপনিষদে বলা হয়েছে “যদা” শব্দে—অর্থাৎ সেই মোড়ফেরার ক্ষণ।

যখন মন শুদ্ধ হয়, তখন জীব দেখতে পায়—“পশ্যতি”—সে নিজের অন্তরে ঈশ্বরকে দেখে, “অন্যম্ ঈশম্।” এখানে “অন্যম্” মানে অন্য কোনো সত্তা নয়, বরং নিজের সত্তারই অন্য দিক। যে-আমি একসময় ভোগী ছিলাম, এখন আমি সেই সাক্ষী। সে উপলব্ধি করে—যিনি আগে অদৃশ্য বলে মনে হতেন, তিনিই আমার নিজের চেতনার গভীরে প্রকাশিত। এই উপলব্ধি হলো ঈশ্বরদর্শন, যা বাহ্যদৃষ্টি নয়, অন্তর্দৃষ্টি।

উপনিষদে আরও বলা হয়েছে—“জুষ্টম্ ঈশম্”—অর্থাৎ, যে-ঈশ্বর যোগিগণের আরাধ্য, যিনি বহুজন পূজিত, সেই ঈশ্বরকেই এখন জীব নিজের অন্তরে অনুভব করে। সে বুঝতে পারে, আগে যে-নিজেকে সীমাবদ্ধ মানুষ বলে ভাবত, সে আসলে চিরন্তন দেবতা। কোনো বাস্তব রূপান্তর ঘটে না; সে আগেও চৈতন্যময় ছিল, এখন কেবল তা জেনে ফেলেছে। যেমন সূর্য মেঘে ঢাকা পড়লে সূর্য নিঃশেষ হয় না, তেমনি অবিদ্যায়-ঢাকা আত্মা কখনও নিঃশেষ হয় না—মেঘ সরে গেলে আলো ফুটে ওঠে।

এই উপলব্ধির পর জীব দেখে—“অস্য মহিমানম্”—এই সমগ্র বিশ্ব, যা একসময় তার কাছে পৃথক ও বহিরাগত মনে হত, এখন তার নিজের মহিমার রূপ। সে দেখে, “আমি ও এই জগৎ আলাদা নই; এই বহিরজগৎ আমার চেতনারই বিকাশ।” তখন সুখ-দুঃখের ভেদ মুছে যায়; সে হয়ে ওঠে “বীতশোকঃ”—যে শোকহীন, এমনকি আনন্দেরও অতীত। কারণ আনন্দ-দুঃখ উভয়ই পরিবর্তনশীল, কিন্তু সে এখন স্থিত অপরিবর্তনীয় চেতনার তলে। এ অবস্থাকেই বলা হয় প্রকৃত মুক্তি।

এভাবে উপনিষদ আমাদের শেখান—জীব ও ঈশ্বর এক বৃক্ষে, অর্থাৎ একই দেহে অবস্থান করছেন। জীব ভোগী পাখি, ঈশ্বর সাক্ষী পাখি। জীব সুখ-দুঃখ ভোগ করে, কারণ সে দেহ ও মনকে নিজের বলে মনে করে; ঈশ্বর নির্লিপ্ত, কারণ তিনি জানেন—তিনি দেহ নন, কেবল চেতনা। তবে এই ভিন্নতা চূড়ান্ত নয়। যেমন একই নদীতে এক প্রান্তে ঘূর্ণি, অন্য প্রান্তে প্রশান্ত জল, তেমনি একই চেতনার এক অংশ অজ্ঞতায় নিমগ্ন জীব, অন্য অংশ জ্ঞানে মুক্ত পরমাত্মা।

এ-ই উপনিষদীয় দর্শনের মূল বাণী—পরিবর্তন আসতে হবে চেতনার স্তরে। গুরুর আশ্রয়, স্বাধ্যায়, ধ্যান, তপস্যা, এবং নিত্য-অনিত্য বিচার—এ সবই সেই পরিবর্তনের পথ। চিত্ত যখন নির্মল হয়, তখনই সেই চেতনার পর্দা সরতে থাকে। তখন জীব উপলব্ধি করে—“আমি ভিন্ন নই; আমি সেই পরম চেতনা।”

এই উপলব্ধি ঘটলে, জীব আর বাহ্যিক পরিবর্তনে প্রভাবিত হয় না। সে জানে, সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, মৃত্যু-জন্ম—সবই তরঙ্গ, আর আমি সেই অচঞ্চল সাগর। তখন সে পরম শান্তিতে স্থিত হয়, জ্ঞানের মধ্যেই লীন হয়, এবং নিজের চিরন্তন স্বরূপে—“নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত”—ব্রহ্মরূপে জেগে থাকে।