এই উপলব্ধি থেকেই পরবর্তী আচার্যগণ বলেছেন, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, কারণ তিনিই সেই “সৎ”, যা কখনও লোপ পায় না; তিনিই সেই “চিৎ”, যা সর্বজীবের হৃদয়ে প্রকাশমান; এবং তিনিই সেই “আনন্দ”, যা সব অনুসন্ধানের অন্তে অর্জিত হয়। সুতরাং, যা আছে, যা জানা যায়, যা অনুভূত হয়—সবই ব্রহ্মরূপ চৈতন্য। এই কারণেই উপনিষদ অবশেষে ঘোষণা করে—“চৈতন্যমেব কিলং সর্বম্”—সবই চৈতন্যমাত্র, সবই সেই এক ব্রহ্ম।
এসবের আত্মবিস্মৃতি থেকেই অহংকারের জন্ম—“আমি দেহ”, “আমি কর্তা”, “আমি ভোক্তা”—এই ভেদবুদ্ধিই জীববন্ধনের কারণ। অবিদ্যা কেবল ব্যক্তিগত চেতনায় নয়, মহাচৈতন্যের স্তরেও প্রকাশ পায়। যখন তা সমষ্টিগত রূপ নেয়, তখন তাকে বলে মায়া, যা ঈশ্বরাশ্রয়ী; যখন তা ব্যক্তিগত চেতনায় প্রতিফলিত হয়, তখন তা অবিদ্যা, যা জীবাশ্রয়ী। তাই বলা হয়—“মায়া ঈশ্বরাশ্রয়া, অবিদ্যা জীবাশ্রয়া” (শঙ্কর, ব্রহ্মসূত্রভাষ্য, ২.১.১৪-এর ভাবার্থ)। একই শক্তি যখন নিয়ন্ত্রিত, তখন সৃষ্টিশক্তি; আর যখন সীমাবদ্ধ, তখন বিভ্রম।
এই অবস্থায় মানুষ দ্বৈততায় আবদ্ধ হয়ে যায়। “আমি” ও “জগৎ”—এই দুইয়ের পার্থক্যই অবিদ্যার কার্য। ঈশ উপনিষদে বলা হয়েছে—“অবিদ্যায়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়ামৃতমশ্নুতে” (ঈশ উপনিষদ, মন্ত্র ১১)। এর অর্থ, যে-ব্যক্তি অবিদ্যা ও বিদ্যা—দুটিকেই জানে, সে অবিদ্যার দ্বারা মৃত্যু বা সংসারের চক্র অতিক্রম করে এবং বিদ্যার দ্বারা অমৃতত্ব লাভ করে। এখানে ‘অবিদ্যা’ মানে জগতের কার্যকর জ্ঞান—কর্ম, ধর্ম, কর্তব্য ইত্যাদি; আর ‘বিদ্যা’ মানে আত্মজ্ঞান, যা মুক্তির উপায়। এই দুইয়ের সমন্বয়ে জীবনের পূর্ণতা আসে: অবিদ্যা সংসার অতিক্রম করায়, আর বিদ্যা পরমপ্রাপ্তি ঘটায়।
ভগবদ্গীতায়ও একই ভাব বার বার এসেছে—অজ্ঞান বা অবিদ্যা পার হয়ে জ্ঞানের মাধ্যমে মুক্তি অর্জনের তত্ত্বটি গীতা সর্বত্র ব্যাখ্যা করেছে।
গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “যদি তুমি সকল পাপীদের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ পাপী হও, তবুও জ্ঞানের নৌকা দ্বারা সমস্ত পাপ পার হয়ে যাবে”—“অপি চেদসি পাপেভ্যঃ সর্বেভ্যঃ পাপকৃত্তমঃ, সর্বং জ্ঞানপ্লবেনৈব বৃজিনং সন্ত্রিষ্যসি” (গীতা, ৪.৩৬)। এখানে “সন্ত্রিষ্যসি”—অর্থাৎ পার হয়ে যাবে—ঈশ উপনিষদের “তীর্ত্বা” শব্দের সঙ্গে একই ভাব প্রকাশ করে। জ্ঞান এখানে নৌকা, যা অজ্ঞানরূপ মৃত্যুর সাগর পার করায়।
তার পরের শ্লোকে বলা হয়েছে, “যেমন প্রজ্জ্বলিত অগ্নি জ্বালানি ভস্ম করে দেয়, তেমনি জ্ঞানাগ্নি সমস্ত কর্ম ভস্ম করে দেয়”—“যথৈধাংসি সমিদ্ধো’গ্নির্ভস্মসাত্কুরুতে’র্জুন, জ্ঞানাগ্নিঃ সর্বকর্মাণি ভস্মসাত্কুরুতে তথা” (গীতা, ৪.৩৭)। এখানে “কর্ম” মানে অবিদ্যা-জাত বন্ধন, যা জ্ঞানের অগ্নিতে নাশ হয়। এইভাবে জ্ঞান অবিদ্যার কার্যকে সম্পূর্ণভাবে দগ্ধ করে মুক্তির পথ উন্মুক্ত করে।
গীতার পঞ্চম অধ্যায়ে বলা হয়েছে, “যাদের আত্মার অজ্ঞান জ্ঞানের দ্বারা নাশ হয়েছে, তাদের জ্ঞান সূর্যের মতো সেই পরম সত্যকে প্রকাশ করে”—“জ্ঞানেন তু তদাজ্ঞানং যেষাং নাশিতমাত্মনঃ, তেষামাদিত্যবজ্জ্ঞানং প্রকাশয়তি তৎপরম্” (গীতা, ৫.১৬)। এটি সরাসরি ঈশ উপনিষদের ভাবের প্রতিধ্বনি—অবিদ্যা নাশিত হলে বিদ্যা দ্বারা অমৃতস্বরূপ ব্রহ্ম প্রকাশিত হয়।
পরের শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “যাদের বুদ্ধি, আত্মা, নিত্যনিষ্ঠা ও পরমগতি সেই ব্রহ্মে একীভূত হয়েছে, এবং যাদের পাপ জ্ঞানে ধ্বংস হয়েছে—তারা আর পুনর্জন্মে ফিরে আসে না”—“তদ্বুদ্ধয়স্তদাত্মানস্তন্নিষ্ঠাস্তত্পরায়ণাঃ, গচ্ছন্ত্যপুনরাবৃত্তিং জ্ঞাননির্ধূতকল্মষাঃ” (গীতা, ৫.১৭)। এখানে “অপুনরাবৃত্তি”—অর্থাৎ পুনরায় আগমন নেই—অমৃতত্বেরই প্রতীক, ঈশ উপনিষদের “বিদ্যয়ামৃতমশ্নুতে”-এর ভাবেরই পুনরুক্তি।
একই তত্ত্ব সপ্তম অধ্যায়েও পুনরায় বলা হয়েছে—“আমার এই গুণময় মায়া দুষ্প্রাপ্য ও দুঃসাধ্য, কিন্তু যারা আমার আশ্রয় নেয়, তারা এই মায়া অতিক্রম করে”—“দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া, মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে” (গীতা, ৭.১৪)। এখানে “মায়ামেতাং তরন্তি”—অর্থাৎ মায়া বা অবিদ্যা অতিক্রম—ঈশ উপনিষদের “অবিদ্যায়া মৃত্যুং তীর্ত্বা”-এরই সমার্থক ভাব।
ঈশ উপনিষদ সংক্ষিপ্তভাবে যা বলেছিল—অবিদ্যা অতিক্রম করে বিদ্যার দ্বারা অমৃতত্ব অর্জন, গীতা সেটিকে জীবনের বাস্তব ও গতিশীল প্রেক্ষাপটে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছে। উভয়েই বলছে, অজ্ঞান মানুষকে বেঁধে রাখে, আর জ্ঞান তাকে মুক্ত করে। উপনিষদে এটি সূত্ররূপে বলা হয়েছে, গীতায় সেই সূত্র জীবন ও সাধনার ভাষায় প্রসারিত হয়েছে।
অর্থাৎ, উপনিষদ বলে—“অবিদ্যায়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়ামৃতমশ্নুতে”, আর গীতা বলে—“জ্ঞানপ্লবেনৈব সন্সারসাগরং তরিষ্যসি”। দুই পথ এক—জ্ঞানের আলোয় অজ্ঞান অতিক্রম করে আত্মাকে চিরমুক্ত ও অমৃত ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠা করা।
অবিদ্যা তাই অস্তিত্বের এক সীমান্ত। এখানে চেতনা নিজেকে জানে, আবার জানেও না, জ্ঞান ও অজ্ঞান একে অপরের ছায়ায় মিশে যায়। যেমন চাঁদের চারপাশে আলোর আভা—চাঁদেরই আলো, তবু মূল আলোককে আড়াল করে—অবিদ্যাও তেমনই। চৈতন্য থেকেই জন্ম নেয়, কিন্তু সেই চৈতন্যকেই আচ্ছন্ন করে রাখে।
যখন জ্ঞান উদিত হয়, অবিদ্যা লয় পায়। তখন আর আবরণ নেই, বিভ্রম নেই, দ্বৈত নেই—শুধু থাকে স্বপ্রকাশ চৈতন্য। মাণ্ডুক্য কারিকায় (৩.৩১) গৌড়পাদ বলেন—“চৈতন্যমেব কিলং সর্বম্”—এই সমগ্র জগৎ চৈতন্যমাত্র। শঙ্কর সেটির টীকায় যোগ করেন—“চৈতন্যমেব হি বাস্তবম্, অন্যত্ সর্বম্ মিথ্যা”—চৈতন্যই একমাত্র বাস্তব, বাকিগুলি কেবল প্রতিভাস।
অবিদ্যা তাই সেই সূক্ষ্ম গোধূলি, যেখানে সীমাহীন চৈতন্য প্রথম সীমার আভাস পায়; জ্ঞানোদয় সেই সূর্যোদয়, যা সেই সীমাকে মুছে দেয়। অবিদ্যা অবধি জগৎ থাকে, অবিদ্যা বিলুপ্ত হলে জগৎও লয় পায়—যেমন স্বপ্ন জাগরণের সঙ্গে মিলিয়ে যায়। কিন্তু যে-চেতনা স্বপ্নও দেখে, জাগরণও জানে—সে অবিনাশী ব্রহ্ম। সেই চেতনা-স্বরূপই সব কিছুর ভিত্তি, প্রকাশ ও পরিণতি। সবই তার মধ্যেই, এবং সে সব কিছুর মধ্যেই।
অতএব, ব্রহ্ম একমাত্র সত্য; অবিদ্যা সেই সূক্ষ্ম ছায়া, যা অনন্তের মধ্যে সীমাবদ্ধতার ইঙ্গিত আনে; মায়া সেই ছায়ার নৃত্য, যেখানে চেতনা নিজেকে জগত হিসেবে প্রকাশ করে; আর জ্ঞান সেই প্রভাত, যেখানে ব্রহ্ম নিজের প্রতিচ্ছবিকে চিনে ফেলে, এবং ঘোষণা করে—“চৈতন্যমেব ইদং সর্বম্ / চৈতন্যমেব খলু ইদং সর্বম্ / চৈতন্যমেব কিলং সর্বম্” (মূল উৎস: গৌড়পাদকারিকা, ৩.৩১ (অদ্বৈতপ্রকারণ), শঙ্করীয় সমর্থন: ব্রহ্মসূত্রভাষ্য, ২.১.১৪ ও উপদেশসাহস্রী)—সবই চৈতন্য, সবই আমি।
অবিদ্যা যখন নিজের ছায়া বিস্তার করে, তখন তার প্রকাশ কেবল এক ব্যক্তির মনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; তার একটি মহাজাগতিক ও একটি ব্যক্তিগত স্তর রয়েছে। ঋষিরা এই দুই স্তরকে মূলাবিদ্যা ও তূলাবিদ্যা নামে পৃথক করেছেন। মূলাবিদ্যা হলো অজ্ঞানতার মূল—যে অনাদি অবিদ্যা থেকে সমগ্র জগতের প্রকৃতি উদ্ভূত। এটি মহাজাগতিক স্তরে বিদ্যমান, ঈশ্বরের মায়াশক্তি হিসেবেই প্রকাশিত। আর তূলাবিদ্যা হলো সেই মূল অজ্ঞানতার ব্যক্তিগত প্রতিফলন, প্রতিটি জীবের অন্তঃকরণে সীমাবদ্ধ রূপ। যেমন এক বৃহৎ সূর্যের আলো বহু আয়নায় প্রতিফলিত হলে প্রতিটি আয়না ‘নিজের সীমা অনুযায়ী’ আলোকরশ্মিকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে, তেমনি মূলাবিদ্যা সেই একক আলো, আর তূলাবিদ্যা তার প্রতিফলন—যার দ্বারা প্রতিটি জীবের চেতনা আংশিকভাবে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। উদাহরণটি সূর্যের তাপ দিয়েও দেওয়া যায়; সেক্ষেত্রে তাপ মূলাবিদ্যা, আর তূলাবিদ্যা তার বিস্তার। সীমাটাই বড়ো কথা; যার সীমা যেমন, তার গায়ে প্রতিফলন তেমন।
ঈশ্বরের অন্তর্গত যে সমষ্টিগত অবিদ্যা, তাকেই বলা হয় মায়া। শঙ্করাচার্য গীতাভাষ্যে (৭.১৪) স্পষ্টভাবে বলেছেন, “মায়া-নাম মহেশ্বরশক্তি”—অর্থাৎ মায়া ঈশ্বরের অধীন শক্তি, স্বাধীন নয়। উপনিষদেও এই ধারণা পূর্বে প্রতিষ্ঠিত—“মায়াং তু প্রকৃতিম্ বিদ্যান্, মায়িনং তু মহেশ্বরম্” (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ, ৪.১০), অর্থাৎ প্রকৃতিকে বা জগতের কার্যশক্তিকে ‘মায়া’ জেনো, এবং যিনি সেই মায়ার নিয়ন্তা, তিনি মহেশ্বর। গীতায়ও বলা হয়েছে, “দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া, মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে” (গীতা, ৭.১৪)—এই মায়া ঈশ্বরের, এবং কেবল তাঁর আশ্রয় গ্রহণ করেই তা অতিক্রম করা যায়। তাই মায়া কোনো বিশৃঙ্খল বিভ্রম নয়; এটি ঈশ্বরের ইচ্ছাশক্তির অধীন এক সুবিন্যস্ত বিশ্বব্যবস্থা। ঈশ্বর এর নিয়ন্তা, কিন্তু তিনি তাতে আবদ্ধ নন—যেমন যাদুকর নিজের যাদুর প্রভাবে বিভ্রান্ত হন না, কেবল দর্শকরাই তাতে মোহগ্রস্ত হয়।
অবিদ্যা হলো ব্যষ্টিগত অজ্ঞানতা—জীবের নিজস্ব সীমিত চেতনার ছায়া। এটি ব্যক্তিগত অন্তঃকরণে জন্ম নেয়, এবং এর প্রকৃতি অস্থির ও কষ্টদায়ক। মায়া ঈশ্বরের শক্তি, তাই নিয়ন্ত্রিত; অবিদ্যা জীবের দুর্বলতা, তাই বিশৃঙ্খল। অবিদ্যা জীবকে তার প্রকৃত আত্মস্বরূপ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, তাকে দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে এক করে ফেলে। ফলে সে দেহের আনন্দ-বেদনা, মনোবৃত্তি ও অহংকারকেই নিজের বলে মেনে নেয়। এই অর্থেই অদ্বৈত ব্যাখ্যায় বলা হয়—“মায়া ঈশ্বরাশ্রয়া, অবিদ্যা জীবাশ্রয়া।” যদিও এই নির্দিষ্ট বাক্যবন্ধটি শঙ্করের গ্রন্থে হুবহু পাওয়া যায় না, তাঁর ভাষ্য ও উপদেশসাহস্রীতে এর ভাব সুস্পষ্ট। ব্রহ্মসূত্রভাষ্য-এর উপক্রমণিকা (অধ্যাসভাষ্য)-তেও তিনি এই পার্থক্যের ভিত্তি স্থাপন করেন—অবিদ্যা বা অধ্যাস জীবের মানসিক বিভ্রম; আর মায়া ঈশ্বরের অধীন শক্তি, যিনি তার দ্বারা জগতকে প্রকট করেন কিন্তু নিজে অনাহত থাকেন।
ঋষিরা এই সম্পর্ক বোঝাতে আয়নার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। এক সূর্যের আলো নানা আয়নায় প্রতিফলিত হলে প্রতিটি আয়নায় আলোর রূপ আলাদা দেখায়; কিন্তু সূর্য এক। মূলাবিদ্যা সেই এক সূর্যালোক, তূলাবিদ্যা তার প্রতিফলন। জীব সেই প্রতিফলনের মধ্যেই বাস করে, ভেবে নেয়, সেটিই প্রকৃত আলো। কিন্তু যখন জ্ঞানের আয়না পরিষ্কার হয়, প্রতিফলিত আলোকরশ্মি মূল সূর্যের সঙ্গে মিলিত হয়—তখন জীব উপলব্ধি করে, “আমি প্রতিফলন নই, মূল আলোকেরই অংশ।”
অবিদ্যার এই ব্যক্তিগত স্তর থেকেই জন্ম নেয় অধ্যাস—ভুল আরোপণ। শঙ্করাচার্য তাঁর ব্রহ্মসূত্রভাষ্য-এর সূচনাতেই বলেছেন, “স্মৃত্যনুভয়োঃ সংসর্গঃ অধ্যাসঃ”—অধ্যাস হলো স্মৃত (যা জানা) ও অনুভূত (যা বর্তমানে অভিজ্ঞ) বস্তুর গুণাবলীর পারস্পরিক স্থানান্তর। এই মিশ্রণেই সমস্ত বিভ্রমের সূচনা। আত্মা, যা শুদ্ধ, নির্লিপ্ত ও স্বপ্রকাশ চেতনা, অবিদ্যার কারণে অনাত্ম—দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, অহংকার—এর গুণাবলী নিজের বলে মানে। তখন দেহের জন্ম, ক্ষয়, ক্ষুধা, দুঃখ আত্মার বলে প্রতীয়মান হয়, আর আত্মার অস্তিত্ব ও চেতনা দেহের বলে মনে হয়। এই ভুলের ফলেই “আমি দেহ,” “আমি সুখী,” “আমি দুঃখী,” “আমি কর্তা,” “আমি ভোক্তা”—এই মিথ্যা ধারণাগুলি জন্ম নেয়।
এই ভুল আরোপণ থেকেই কর্তা-ভোক্তা ভাব, সুখ-দুঃখ, জন্ম-মৃত্যুর চক্র শুরু হয়। অবিদ্যা আত্মাকে জাগতিক পরিচয়ে আবদ্ধ করে রাখে, যেমন ঘুমন্ত মানুষ স্বপ্নে কখনো রাজা, কখনো ভিক্ষুক হয়ে ওঠে, অথচ জাগরণের পর বোঝে সে কিছুই ছিল না। তেমনি আত্মা অবিদ্যার ঘুমে নিজেকে দেহ মনে করে, অসংখ্য জন্ম-মৃত্যুর খেলায় আবদ্ধ থাকে।
অদ্বৈতের দৃষ্টিতে অধ্যাসই সমস্ত বন্ধনের সূচনা—এটি অবিদ্যার প্রথম বিকৃতি। যতক্ষণ এই আরোপণ অক্ষুণ্ণ থাকে, ততক্ষণ আত্মা ও অনাত্মার সীমা মিশে থাকে। জ্ঞানলাভের অর্থ এই মিশ্রণ ভাঙা—নিজের প্রকৃত চেতনা-স্বরূপকে দেহ-মন-অহংকারের আরোপণ থেকে পৃথক করা। গীতায় বলা হয়েছে, “যদা তে মোহকলিলং বুদ্ধির্ব্যতিতরিষ্যতি, তদা গন্তাসি নির্বেদং শ্রোতব্যস্য শ্রুতস্য চ” (গীতা, ২.৫২)—যখন মোহের কুয়াশা কেটে যায়, তখন জ্ঞানী উপলব্ধি করে, যা সে শুনেছে ও জানত, তারও অতীত এক সত্য আছে। সেই সত্যই ব্রহ্ম, যা চিরন্তন, অখণ্ড ও স্বয়ংপ্রকাশ।
যখন এই পৃথকীকরণ ঘটে, তখন অবিদ্যা লয় পায়। আত্মা তখন আর প্রতিফলন নয়, মূল আলোক। সে জানে—“নাহং দেহঃ, নাহং কর্তা, নাহং সুখী দুঃখী; অহম্ ব্রহ্মাস্মি।” তখনই জ্ঞানের পূর্ণতা ঘটে, মায়া ও অবিদ্যার সকল ছায়া মিলিয়ে যায়, এবং চেতনা নিজেকে তার চিরন্তন অবিকৃত আলোকরূপে প্রত্যক্ষ করে।