অবিদ্যা-বিদ্যা: ১৭



তখন আত্মা নিজের স্বরূপে স্থিত—“অহম্ ব্রহ্মাস্মি” (বৃহদারণ্যক, ১.৪.১০), “সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম” (তৈত্তিরীয়, ২.১)। "অহম্ ব্রহ্মাস্মি" উক্তিটি মহাবাক্যগুলির মধ্যে অন্যতম, যা আত্মার পরম সত্তার সাথে ব্রহ্মের অভিন্নতা ঘোষণা করে। এর অর্থ হলো, আমিই ব্রহ্ম—অর্থাৎ, জীবাত্মা এবং পরমাত্মা অভিন্ন। আত্মা তখন উপলব্ধি করে যে, সে কেবল একটি সীমিত দেহ বা মন নয়, বরং সে অসীম, সর্বব্যাপী এবং চিরন্তন। "সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম" বাক্যটিও ব্রহ্মের স্বরূপ নির্দেশ করে; ব্রহ্ম সত্যস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ এবং অনন্তস্বরূপ। এই উপলব্ধির মাধ্যমে জীব তার সমস্ত ভ্রম ও মায়া থেকে মুক্ত হয়।


এই অবস্থায় জীব জানে—“আমি কখনও জন্মাইনি, কখনও মরবও না”—“অযং পুরুষো নাজায়তে, ন ম্রিয়তে, ন কদাচন” (কঠ, ২.১৮)। এই শ্লোকটি আত্মার অমরত্ব ও নিত্যত্বকে তুলে ধরে। আত্মা জন্ম ও মৃত্যুর চক্র থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এটি এমন এক সত্তা, যা সময়ের পরিধির বাইরে অবস্থান করে, তাই এর কোনো আদি বা অন্ত নেই। আত্মা দেহ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, কিন্তু সে নিজে অপরিবর্তনীয় ও অবিনশ্বর।


তাই গীতায়ও বলা হয়েছে—”ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্ / নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ। / অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরাণো / ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে” (গীতা, ২.২০) অর্থাৎ, আত্মা কখনও জন্মায় না এবং কখনও মৃত্যুবরণ করে না। এই শ্লোকটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে উপদেশ দেওয়ার সময় বলেছেন, যখন অর্জুন তার আত্মীয়দের হারানোর ভয়ে যুদ্ধ করতে দ্বিধা করছিলেন। কৃষ্ণ বোঝান যে, আত্মা অমর, এবং দেহের বিনাশ হলেও আত্মার বিনাশ হয় না। এটি কখনও পূর্বে ছিল না, এমন নয়; আবার এখন থেকে ভবিষ্যতে থাকবে না, এমনও নয়। এর অর্থ হলো, আত্মা চিরকাল ছিল এবং চিরকাল থাকবে; এর অস্তিত্ব কাল-নিরপেক্ষ। এটি জন্মরহিত (অজ), শাশ্বত (চিরন্তন), নিত্য (অপরিবর্তনীয়) এবং পুরাতন হলেও চিরনবীন। অর্থাৎ, আত্মা আদিকাল থেকে বিদ্যমান থাকলেও এর তেজ বা নতুনত্বে কোনো পরিবর্তন আসে না। এই শাশ্বত সত্তা দেহের বিনাশ হলেও অক্ষত থাকে। এই উপলব্ধিই মুক্তি বা মোক্ষের মূল ভিত্তি।


যখন প্রকৃত জ্ঞান বা "জ্ঞান" জাগ্রত হয়, তখন নতুন কর্মের সৃষ্টি হয় না। এর কারণ হলো, অজ্ঞানতার বশবর্তী হয়ে যে-সমস্ত কর্মফল বা "সংচিত কর্ম" পূর্বজন্মে বা এই জন্মে সঞ্চিত হয়েছে, জ্ঞান সেইগুলিকে দহন করে। যেমন আগুন কাঠকে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়, তেমনই জ্ঞান আমাদের কর্মফলের বোঝা হালকা করে। এই জ্ঞান কেবল আমাদের "প্রারব্ধ শরীর" বা বর্তমান দেহকে টিকিয়ে রাখার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই রাখে। এই প্রারব্ধ কর্মফলই আমাদের বর্তমান জন্ম ও জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে। যখন এই প্রারব্ধ ফুরিয়ে যায়, অর্থাৎ বর্তমান জীবনের কর্মফল ভোগ শেষ হয়, তখন এই শরীরও জীর্ণ হয়ে পড়ে এবং অবশেষে বিলীন হয়।


এই জাগতিক চক্র থেকে মুক্তি লাভের মূলে রয়েছে "অবিদ্যা" এবং "বাসনা"-র বিলোপ। অবিদ্যা হলো অজ্ঞানতা, যা আমাদের আত্মস্বরূপ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দেয় এবং জগৎকে সত্য বলে বিশ্বাস করায়। বাসনা হলো বিভিন্ন জাগতিক বিষয়ের প্রতি আকাঙ্ক্ষা ও আকর্ষণ, যা কর্মের বীজ বপন করে। যখন অবিদ্যা এবং বাসনা সম্পূর্ণভাবে লুপ্ত হয়, তখন আর নতুন করে জন্মের কারণ থাকে না। অর্থাৎ, মানুষ জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্ত হয়। তাই, মুক্তি মানে কেবল শারীরিক মৃত্যু বা "দেহত্যাগ" নয়। মুক্তি হলো "অবিদ্যা-ত্যাগ" তথা অজ্ঞানতার নিবৃত্তি। যতক্ষণ পর্যন্ত অবিদ্যা বিদ্যমান থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত পুনর্জন্মের সম্ভাবনা থাকে।


জ্ঞানী ব্যক্তি জীবিত অবস্থাতেই মুক্ত হন, অর্থাৎ তিনি "জীবন্মুক্ত"। জীবন্মুক্ত ব্যক্তি জাগতিক কর্ম সম্পাদন করলেও তার মধ্যে কোন আসক্তি বা অহংকার থাকে না। তিনি জানেন যে, তিনি দেহ নন, মন নন, বরং শুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ। তার সকল কর্ম লোককল্যাণের জন্য হয় এবং তার কর্মফল তাকে বাঁধতে পারে না। যখন এই জীবন্মুক্ত ব্যক্তির প্রারব্ধ কর্মফল নিঃশেষ হয়ে যায়, তখন তার দেহত্যাগ হয় এবং তিনি ব্রহ্মে লীন বা একাত্ম হন—এই অবস্থাকে "বিদেহমুক্ত" বলা হয়। এটিই মানবজীবনের পরম লক্ষ্য—ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মতা লাভ।


কৈবল্য উপনিষদ এবং কঠ উপনিষদে এই মুক্তির ধারণাকে সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে: "যদা সর্বে প্রমুচ্যন্তে কামা, যে’স্য হৃদি শ্রিতাঃ, অথ মর্ত্যো’মৃতো ভবতি, অত্র ব্রহ্ম সমশ্নুতে।" এর অর্থ: যখন মানুষের হৃদয়ে বিদ্যমান সমস্ত কাম, অর্থাৎ জাগতিক আকাঙ্ক্ষাগুলি সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়, তখন সেই মর্ত্য-ব্যক্তি অমরত্ব লাভ করে এবং এই জগতেই ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হয়। এই শ্লোকটি জীবন্মুক্তির ধারণাকে স্পষ্ট করে, যেখানে দেহ ত্যাগ না করেই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ সম্ভব হয়।


আদি শঙ্করাচার্য তাঁর ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে (২.১.১৪) এই অদ্বৈত তত্ত্বকে আরও সুদৃঢ় করেছেন। তিনি বলেন: "জাগ্রৎস্বপ্নসুষুপ্তীনি ব্রহ্মণো বিকাররূপতয়াবিভান্তি; ব্রহ্ম তু একমেব, ন জন্ম, ন মৃত্যু, ন কর্ম, ন ফলা।"


এই উক্তির মাধ্যমে শঙ্কর বোঝাতে চেয়েছেন, আমাদের জাগ্রত অবস্থা, স্বপ্নাবস্থা এবং সুষুপ্তি বা গভীর নিদ্রার অবস্থা—এই সবগুলিই ব্রহ্মের বিকার বা প্রকাশ মাত্র। ব্রহ্ম নিজে এই সকল অবস্থা থেকে ভিন্ন এবং একমাত্র সত্য। ব্রহ্মের কোন জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, কর্ম নেই এবং কর্মফলও নেই। ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয়, নিরাকার ও নির্গুণ। আমাদের এই ত্রিবিধ অবস্থা, যা আমরা আমাদের অস্তিত্বের অংশ মনে করি, তা আসলে মায়ার আবরণ। যখন এই মায়ার আবরণ অপসারিত হয়, তখনই আমরা ব্রহ্মের এই অদ্বিতীয় এবং অপরিবর্তনীয় স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারি।


জ্ঞান, কর্ম এবং মুক্তির এই নিবিড় সম্পর্ক ভারতীয় দর্শনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। উপনিষদ এবং শঙ্করাচার্যের ব্যাখ্যার মাধ্যমে এটি স্পষ্ট হয় যে, প্রকৃত জ্ঞান কেবল আমাদের ব্যক্তিগত উন্নতি সাধন করে না, বরং আমাদের অস্তিত্বের গভীরতম সত্যের দিকে পরিচালিত করে। অজ্ঞানতা ও বাসনার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ব্রহ্মস্বরূপে বিলীন হওয়াই মানবজীবনের চরম সার্থকতা। এই পথ সাধনা, আত্মানুসন্ধান এবং জ্ঞানার্জনের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয়, যা মানুষকে জীবনের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করে এক অনন্ত ও শাশ্বত সত্তার সাথে একীভূত করে।


“ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে”—এই কথাটি কেবল এক আধ্যাত্মিক সান্ত্বনা নয়, এটি সমগ্র বেদান্ত দর্শনের এক গভীর ভিত্তি। ভগবদ্‌গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে (শ্লোক ২০) কৃষ্ণ আত্মার প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মানুষের সবচেয়ে প্রাচীন ভয় ‘মৃত্যুভয়’-এর মূলে প্রহার করেছেন। তিনি বলছেন, “ন জন্ম ন মৃত্যু, ন পুনরাবর্তন”—আত্মা না জন্মে, না মরে, না আবার নতুন করে আসে; কারণ সে কখনও দেহ ছিল না, তাই দেহের মতো নষ্টও হয় না।


গীতার মূল শ্লোকটি—
“ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্

নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।

অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো

ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।” (গীতা ২.২০)


অর্থাৎ, আত্মা কখনও জন্ম নেয় না, কখনও মরে না; সে অজ (অজন্ম), নিত্য (চিরস্থায়ী), শাশ্বত (অপরিবর্তনীয়), পুরাতন (চিরপ্রাচীন)। শরীর নিহত হলেও আত্মা নিহত হয় না।


এখানে ‘ন হন্যতে’ (না নিহত হয়) কথাটি বেদান্তে আত্মার অবিনাশিতা (অক্ষয়ত্ব) বোঝায়, আর ‘হন্যমানে শরীরে’ (শরীর নিহত হলে) অংশটি নির্দেশ করে—শরীর নশ্বর, কিন্তু আত্মা অনশ্বর। এই কথাটি কেবল কাব্যিক উপদেশ নয়; এটি আত্মা ও অনাত্মার পার্থক্যের দর্শনীয় বিশ্লেষণ।


আত্মা কখনো জন্ম নেয় না (অজঃ): বেদান্তে “জন্ম” মানে কোনো কিছুর অনুপস্থিত অবস্থা থেকে উপস্থিত হওয়া। কিন্তু আত্মা কখনও অনুপস্থিত থাকে না; সে সর্বদা চেতনা হিসেবে বর্তমান। তাই তাকে সৃষ্টি করা যায় না, জন্মও হয় না। কঠোপনিষদে বলা হয়েছে—“ন জায়তে ম্রিয়তে বা বিপশ্চিত্‌” (১.২.১৮)—জ্ঞানী আত্মা জন্মে না, মরে না।


শঙ্কর ব্যাখ্যা করেছেন, আত্মা “অজ”, কারণ সে কোনো কারণের উৎপাদন নয়; সে নিজেই সব কারণের অধিষ্ঠান। সৃষ্টি-লয় তার উপর প্রতিভাসিত হয়, কিন্তু আত্মা অপরিবর্তিত থাকে।


আত্মা কখনও মরে না (অমৃতঃ): মৃত্যু হলো দেহের রূপান্তর। দেহ পঞ্চভূতের সংযোগে গঠিত, তাই তার বিচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু আত্মা সেই চেতনা, যা সেই পাঁচ ভৌতিক উপাদানের সাক্ষী; সে উপাদান নয়, তাই তার নাশও হয় না। তৈত্তিরীয় উপনিষদ (২.৭) বলে—“আনন্দো ব্রহ্মেত্যবিজানাত”—আত্মাই আনন্দ, অমরত্বের রূপ।


গীতায়ই পরে কৃষ্ণ বলেন—“অবিনাশি তু তদ্বিদ্ধি য়েন সর্বমিদং ততম্।” (গীতা, ২.১৭) অর্থাৎ, যে-চেতনা সর্বত্র বিদ্যমান, তাকে অবিনাশী জানো। আত্মা কখনও নষ্ট হয় না, কারণ সে নিজে কোনো ফলের অধীন নয়, বরং ফলদাতা।


শরীর মরে, আত্মা মরে না: এই পার্থক্যটি বোঝাতে গীতা (২.২২)-এ কৃষ্ণ উপমা দেন—

“বাসাংসি জীর্ণানি য়থা বিহায়

নবানি গৃহ্ণাতি নরোঽপরাণি।

তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা—

ন্যন্যানি সংয়াতি নবানি দেহী।।”

অর্থাৎ, যেমন মানুষ পুরোনো বস্ত্র ফেলে নতুন পরে, তেমনি আত্মা পুরনো দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহ গ্রহণ করে। এখানে দেহ কেবল পোশাকের মতো—পরিবর্তনশীল, ক্ষয়যোগ্য; কিন্তু আত্মা সেই অদল-বদলের সাক্ষী, অপরিবর্তনীয়।


শঙ্করাচার্য এই ভাষ্যে বলেন—“দেহবিপর্যয়ে আপ্যায়িত্বাভাভাভ্যাম্ আত্মনঃ ন কোনো বিকারঃ।” অর্থাৎ, দেহের বৃদ্ধি বা ক্ষয়ে আত্মার কোনো পরিবর্তন ঘটে না।


আত্মা সর্বদা নিত্য ও শাশ্বত (নিত্যঃ শাশ্বতঃ): আত্মা কালাতীত; কাল নিজে আত্মার প্রতীতি-মাত্র। যেমন আলোয় (আলো দ্বারা সৃষ্ট প্রতিফলনে) কালোচিহ্নের ছায়া পড়ে, কিন্তু আলো নিজে কখনও পুরোনো বা নতুন হয় না—তেমনি আত্মা কালের সাক্ষী। মুন্ডক উপনিষদ (২.২.১১) বলে—“ন তস্য প্রাণো নাপানঃ”—আত্মার কোনো আগমন বা নির্গমন নেই। সে স্থির, নিত্য।


আত্মা কেবল সাক্ষী (সাক্ষিচেতা): দেহ জন্মায়, বাড়ে, বুড়ো হয়, মরে—কিন্তু “আমি” ভাব, যে স্থির থাকে, সেটিই আত্মা। বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৩.২৩) বলে—“এষ ত আত্মা সার্বান্ ভূতান্ অভিপশ্যতি নান্যাৎ পশ্যতি।” অর্থাৎ, আত্মাই সকলকে দেখে, আত্মাকে আর কেউ দেখে না।


এই কারণেই গীতা (২.৩০)-এ কৃষ্ণ আবার বলেন—“দেহিনং নিত্যমবধ্যং”—দেহধারী আত্মা অবধ্য, অবিনশ্বর।


‘ন হন্যতে’ মানে—আত্মা কর্মেরও অতীত: বেদান্তে বলা হয়েছে, কর্মফল কেবল সেই জীবের জন্য, যে নিজেকে কর্তা ভাবে। কিন্তু আত্মা কর্তা নয়—সে সাক্ষী। তাই তাকে হত্যা, ক্ষতি, লাভ—কিছুই স্পর্শ করতে পারে না।


“অহং ব্রহ্মাস্মি”—এই জ্ঞানই প্রমাণ করে আত্মার অবিনাশিতা। যিনি জানেন “আমি চিরন্তন চেতনা”—তাঁর কাছে মৃত্যু কেবল রূপান্তর, নাশ নয়।


যেমন ঘুমন্ত মানুষ স্বপ্নে নিজের মৃত্যু দেখে ভয় পায়, কিন্তু জাগরণের পরে বুঝতে পারে—“আমি তো মরিনি।”—তেমনি আত্মা দেহের মৃত্যু দেখে, কিন্তু নিজে অক্ষত থাকে। দেহের বিনাশ তার কাছে কেবল এক দৃশ্য, নিজেকে সে কখনও মৃত বলে অনুভব করে না।


“ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে”—এই শ্লোকের বেদান্তীয় অর্থ হলো—দেহ, মন, ইন্দ্রিয় সবই পরিবর্তনশীল; আত্মা একমাত্র অপরিবর্তনীয় সত্য। যেমন দড়ির উপর সাপ দেখা যায় কিন্তু দড়ি বদলায় না, তেমনি দেহ মরে কিন্তু আত্মা টিকে থাকে।


এই সত্য জানাই মুক্তির সূচনা। যিনি জানেন—“আমি দেহ নই, আমি জন্ম-মৃত্যুর অতীত চৈতন্য”—তাঁর কাছে মৃত্যু কেবল এক ঘুমের মতো। এই কারণেই গীতার ঘোষণা—“অজো নিত্যঃ শাশ্বতো’যং পুরাণো, ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।” অর্থাৎ, আত্মা অনাদি, অবিনাশী, অজ, চিরন্তন—দেহের মৃত্যু তার উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না; সে ব্রহ্মরূপেই অবিচল থাকে—চিরজাগ্রত, চিরপ্রকাশমান চেতনা হিসেবে।