অদ্বৈত বেদান্তের মূল সূত্রটি প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্যে প্রায় একটি প্রতীকী ঘোষণার মতোই পরিচিত— “ব্রহ্ম সত্যম্ জগন্মিথ্যা; জীবো ব্রহ্মৈব ন অপরঃ” অর্থাৎ, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য; জগৎ মিথ্যা (অর্থাৎ আপেক্ষিক ও নামরূপমাত্র); এবং জীব বা আত্মা ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন নয়। এই বক্তব্যে অদ্বৈতের সারমর্ম নিহিত—অদ্বৈত মোক্ষতত্ত্ব অনুসারে, মুক্তি (মোক্ষ) তখনই সম্ভব, যখন ব্যক্তি আত্মা (Ātman) এবং বিশ্বচেতনা বা পরমসত্তা (Brahman)-এর অভিন্নতা প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধ হয়।
এই অভিন্নতা উপলব্ধির পথে প্রধান বাধা হলো অবিদ্যা (অজ্ঞান)—যে-অজ্ঞান আমাদেরকে বহুত্বে বিভ্রান্ত করে এবং জগৎকে পরম বাস্তব বলে ভ্রম সৃষ্টি করে। এই অবিদ্যাই মিথ্যা বিচার (mithyā-viveka)-এর কারণ, যার ফলে “আমি” ও “অন্য”, “ব্রহ্ম” ও “জগৎ”—এইসব দ্বৈত ভেদবুদ্ধি জন্ম নেয়। অদ্বৈতের মতে, যখন এই অজ্ঞান লয় পায়, তখনই আত্মা উপলব্ধি করে যে, সে চিরন্তন ব্রহ্মস্বরূপ—নিরাকার, অনন্ত, একমাত্র বাস্তব। এই উপলব্ধির মধ্য দিয়েই দুঃখের অবসান এবং মোক্ষের অভ্যুদয় ঘটে।
অন্যদিকে, জৈন দর্শনের ভিত্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটি দাঁড়িয়ে আছে অধিবিদ্যাগত বহুত্ববাদ (metaphysical pluralism)-এর উপর। জৈন মতে, বাস্তবতা এক, অপরিবর্তনীয় ব্রহ্মে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা বহুমুখী ও জটিল। বিশ্ব গঠিত স্বতন্ত্র, চিরন্তন সত্তাগুলির (দ্রব্য) দ্বারা—যেমন জীব (জীবিত সত্তা) এবং অজীব (জড় পদার্থ, ধর্ম, অধর্ম, আকাশ, কাল প্রভৃতি)। প্রত্যেক দ্রব্যের নিজস্ব ধর্ম আছে, এবং তারা কখনও বিনষ্ট হয় না, বরং ক্রমাগত পরিবর্তন (pariṇāma) ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে চলে।
অধিবিদ্যাগত বহুত্ববাদ (Metaphysical Pluralism) বলতে বোঝানো হয়—অস্তিত্ব বা বাস্তবতার চূড়ান্ত ভিত্তি এক নয়, বরং বহু। অর্থাৎ, জগতে যে যা রূপে প্রকাশিত, তা কোনো একক নীতির ছায়া নয়; বরং প্রত্যেকটি সত্তা, গুণ, ও সম্পর্ক নিজের স্বরূপে আংশিকভাবে সত্য।
এই ভাবনা ভারতীয় দর্শনে সর্বাধিক স্পষ্টভাবে দেখা যায় জৈন দর্শনের অনেকান্তবাদে (anekāntavāda)। এখানে বলা হয়—সত্যের অনেক দিক আছে, এবং প্রত্যেক দিক আংশিকভাবে সত্য। যেমন, একটি বস্তু একই সঙ্গে “অস্তি” (আছে) এবং “নাস্তি” (নেই) হতে পারে, কারণ সময়, স্থান, ও দৃষ্টিভঙ্গির ভেদে তার স্বরূপ পরিবর্তিত হয়। এইভাবে জৈন দর্শন ব্রহ্ম বা চূড়ান্ত বাস্তবতাকে একক বা নিরঙ্কুশ সত্তা হিসেবে নয়, বরং বহুসম্বন্ধীয় ও আপেক্ষিক সত্য হিসেবে দেখেছে।
অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে এটি একপ্রকার অধিবিদ্যাগত বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি, কিন্তু পরম ঐক্যের অস্বীকৃতি। বেদান্ত বলে—সব বহুত্বই অবিদ্যা বা মায়ার ফল; আসল সত্য এক ও অবিভাজ্য—“একমেবাদ্বিতীয়ম্” (ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৬.২.১)—“ব্রহ্ম এক, দ্বিতীয় নেই।” কিন্তু অনেকান্তবাদ বলে, বহুত্বই বাস্তবতার প্রকৃতি; জগৎ কোনো একক আদর্শের প্রতিবিম্ব নয়, বরং নানা দিক থেকে প্রকাশিত সত্যের বহুমুখ প্রতিচ্ছবি।
তবু, এই বহুত্ববাদ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা নয়—এটি বলে, প্রতিটি দৃষ্টিকোণ আংশিক হলেও পরস্পরনির্ভর। একে বলা যায় সহাবস্থার দর্শন—যেখানে বৈপরীত্য নয়, বরং পারস্পরিক পরিপূরকতা বাস্তবতার মূল সুর।
অধিবিদ্যাগত বহুত্ববাদের সৌন্দর্য এখানেই—এটি মানুষকে শেখায়, কোনো একক সত্যে আঁকড়ে না থেকে সমস্ত দৃষ্টিকোণকে সম্মান করতে। যেমন উপনিষদ বলে—“যো ভৈ ভূমা, তৎ সুখং; নাল্পে সুখমস্তি” (ছান্দোগ্য, ৭.২৩.১)—“যা বৃহৎ, তাতেই আনন্দ; ক্ষুদ্র বা সংকীর্ণে আনন্দ নেই।” বহুত্ববাদ এই “ভূমা” বা বিস্তারেরই দার্শনিক রূপ—যেখানে সকল সত্য, সকল দৃষ্টি, সকল সত্তা এক মহাসংগীতের ভিন্ন স্বর হয়ে একত্রে প্রতিধ্বনিত হয়।
এই বাস্তবতাবোধের সঙ্গে জৈন দর্শনের নৈতিক দর্শন গভীরভাবে যুক্ত। জৈন চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে অহিংসা (ahiṃsā)—অর্থাৎ, কোনো প্রকার সহিংসতা, আঘাত বা ক্ষতির বর্জন। কিন্তু জৈন আচার্যরা অহিংসাকে কেবল শারীরিক বা সামাজিক আচরণে সীমাবদ্ধ রাখেননি; তাঁরা একে বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক পর্যায়েও প্রসারিত করেছেন। এইভাবেই অনেকান্তবাদ (anekāntavāda) হয়ে ওঠে একপ্রকার বুদ্ধিবৃত্তিক অহিংসা—যেখানে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গিকেও সত্যের আংশিক প্রতিফলন হিসেবে সম্মান জানানো হয়। কারণ, কোনো একক দৃষ্টিভঙ্গি কখনও সম্পূর্ণ সত্য ধারণ করতে পারে না; প্রত্যেক মতই এক দিক থেকে সত্য, অন্য দিক থেকে সীমিত।
এখানেই অদ্বৈত ও জৈন দর্শনের কাঠামোগত পার্থক্য স্পষ্ট হয়। অদ্বৈতের সমগ্র দার্শনিক ভিত্তি এই বিশ্বাসে দাঁড়ানো—বহুত্ব এক মায়া, আর মুক্তি একত্বের জাগরণ। এখানে সংসার থেকে মুক্তি আসে বিভেদের ভ্রম দূর করে আত্মা ও ব্রহ্মের অখণ্ড ঐক্য উপলব্ধি করার মধ্য দিয়ে। জৈন দর্শন, ঠিক বিপরীতে, ঘোষণা করে—বহুত্বই বাস্তবতা, আর মুক্তি হলো সেই বাস্তবতার অন্তর্নিহিত নৈতিক নিয়ম (কর্ম-সিদ্ধান্ত) বোঝা ও পালন করা।
অদ্বৈত যেখানে মুক্তির জন্য বিশ্বের মায়াময় চরিত্রকে অস্বীকার করে, জৈন দর্শন সেখানে বিশ্ব ও কর্মকে স্বীকার করে নেয় বাস্তবতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে। এখানকার আত্মা (জীব) পরমে বিলীন হয় না, বরং কর্ম-বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে নিজের স্বরূপে অবস্থান করে। তাই জৈনের মুক্তি হলো—স্বতন্ত্র আত্মার বিশুদ্ধ স্বরূপে প্রত্যাবর্তন, যেখানে জ্ঞান ও চেতনা অবাধ, কিন্তু অস্তিত্ব বহুত্বে রচিত।
অদ্বৈত বেদান্তের মুক্তি হলো চূড়ান্ত একত্বে লয়, জৈনের মুক্তি হলো চূড়ান্ত পারস্পরিক সহাবস্থানে স্থিতি। প্রথমটি “ব্রহ্মেই একমাত্র সত্য” বলে, দ্বিতীয়টি বলে—“সব সত্যই পরস্পরসম্পর্কে সত্য।” একদিকে অদ্বৈতের মায়া-মুক্ত নিস্তব্ধ লয়, অন্যদিকে জৈনের নীতিনির্ভর সজাগ বহুত্ব—দুটিই মানুষের অস্তিত্ববোধের দুই পরিপূর্ণ প্রান্তর, যেখানে একদিকে চূড়ান্ত অখণ্ডতা, আর অন্যদিকে চূড়ান্ত সহনশীলতা।
অদ্বৈত বেদান্ত এবং জৈন অনেকান্তবাদের পার্থক্য সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে তাদের সত্তাতাত্ত্বিক কাঠামোতে (ontological framework)—অর্থাৎ, তারা কীভাবে বাস্তবতার প্রকৃতি, পদার্থ, পরিবর্তন ও উপস্থিতিকে বোঝে। উভয় ঐতিহ্যই মুক্তির পথে এগিয়ে যেতে চায়, কিন্তু তাদের পথ দুটি মৌলিকভাবে আলাদা। অদ্বৈত বেদান্তের লক্ষ্য একত্বে আত্ম-ব্রহ্মের ঐক্য উপলব্ধি, আর জৈন অনেকান্তবাদের লক্ষ্য বহুত্বে সহাবস্থানের বোধ ও নৈতিক সামঞ্জস্যের জাগরণ।
অদ্বৈত বেদান্তে চূড়ান্ত সত্য বা পারমার্থিক সত্য (paramārthika satya) হলো ব্রহ্ম—যা অদ্বৈত, অনন্ত, অপরিবর্তনীয় এবং স্বয়ম্প্রকাশ বাস্তবতা। ব্রহ্মই আত্মা, এবং আত্মাই ব্রহ্ম—তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এই ভাবনাটি “জীবো ব্রহ্মৈব ন অপরঃ”—অর্থাৎ, “ব্যক্তি আত্মা ও পরমচেতনা অভিন্ন”—এই সংক্ষিপ্ত সূত্রে ধরা পড়ে। কিন্তু এখানেই জন্ম নেয় এক গভীর প্রশ্ন—যদি ব্রহ্ম একমাত্র সত্য হয়, তবে আমরা যে বহুমুখী জগত দেখি, তা কোথা থেকে আসে? অদ্বৈত এই প্রশ্নের উত্তর দেয় মায়া (māyā) ও বিবর্তবাদ (vivartavāda) ধারণার মাধ্যমে। জগৎ ব্রহ্মের কোনো প্রকৃত রূপান্তর নয়, বরং তার উপর আরোপিত এক অপার সত্যভাস (apparent transformation)—যেমন আলো-অন্ধকারে দড়িকে সাপ বলে ভুল করা হয়, কিন্তু সেই সাপ প্রকৃত নয়। তেমনি, জগতও ব্রহ্মের উপর আরোপিত এক বিভ্রম—যা অজ্ঞানতার কারণে সত্য বলে প্রতীয়মান হয়, কিন্তু চূড়ান্তভাবে মিথ্যা।
“অপার সত্যভাস (apparent transformation)” অদ্বৈত বেদান্তের এক গভীর ও সূক্ষ্ম ধারণা, যা বাস্তবতা, জগৎ ও চেতনার পারস্পরিক সম্পর্ককে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এর মূলে আছে প্রশ্ন—যদি ব্রহ্মই একমাত্র সত্য হয়, তবে আমরা যে বহুরূপী, পরিবর্তনশীল জগৎ দেখি, তা কোথা থেকে এল? এই প্রশ্নের উত্তরে শঙ্করাচার্য প্রস্তাব করেন বিবর্তবাদ (Vivarta-vāda)—অর্থাৎ, জগৎ ব্রহ্মের কোনো বাস্তব পরিবর্তন নয়, বরং তার উপর এক অপার সত্যভাস, এক আপাত প্রকাশ বা বিভ্রম।
এই ধারণা বোঝার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষার ব্যাখ্যা প্রয়োজন। ব্রহ্ম (Brahman) হলো অদ্বৈত দর্শনে একমাত্র পরম সত্য—অসীম, চিরন্তন, নির্গুণ (যার কোনো গুণ বা সীমা নেই) এবং স্বয়ম্প্রকাশ (যে নিজেই নিজের মাধ্যমে জানা যায়)। ব্রহ্ম কখনও পরিবর্তিত হয় না; তা সর্বাবস্থায় একই থাকে। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখি—জগতের সৃষ্টি, পরিবর্তন, বিনাশ, সুখ-দুঃখ, কারণ-কার্য, বহুবিধ বস্তু ও জীবজগৎ। যদি এই পরিবর্তনকে আমরা “বাস্তব পরিবর্তন” (real transformation) হিসেবে স্বীকার করি, তাহলে ব্রহ্মের অপরিবর্তনীয়তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
এই সমস্যার সমাধানে অদ্বৈত বলে—এই জগৎ মায়া (Māyā) নামক এক অজ্ঞাত শক্তির মাধ্যমে ব্রহ্মের উপর আরোপিত। মায়া শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘মাপা’, ‘রূপ দেওয়া’ বা ‘যা বাস্তবকে অন্যভাবে দেখায়’। এটি কোনো বাস্তব সত্তা নয়, বরং অবিদ্যা (Avidyā) বা অজ্ঞানতার প্রকাশ। অবিদ্যা চেতনার প্রকৃত রূপকে আড়াল করে, যেমন কুয়াশা সূর্যের আলো ঢেকে দেয়। ফলে ব্রহ্ম, যা আসলে নিরাকার ও অপরিবর্তনীয়, আমাদের চেতনার বিকারে “বহুরূপী বিশ্ব” হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
এই প্রতীয়মানতাকেই বলা হয় অপার সত্যভাস (Apparent Transformation)—একটি এমন রূপান্তর, যা দেখা যায় কিন্তু বাস্তবে ঘটে না। শঙ্করাচার্য এই অবস্থাকে বোঝাতে দিয়েছেন বিখ্যাত উদাহরণ—দড়ি ও সাপের উপমা। অন্ধকারে কেউ দড়িকে সাপ ভেবে ভয় পায়। এখানে দড়ি অপরিবর্তিত থাকে, কিন্তু অজ্ঞানতার কারণে মনে হয়, “এটা সাপ।” পরে আলো জ্বালালে দেখা যায়, সেটি আসলে দড়ি। সাপ কোনোদিনই বাস্তবে ছিল না, তবু অন্ধকারের বিভ্রমে সেটি অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এইভাবে জগৎও কোনো বাস্তব সৃষ্টি নয়—এটি কেবল চেতনার উপর মায়ার ছায়ায় প্রতীয়মান এক রূপ, যা জ্ঞানের আলোয় বিলীন হয়ে যায়।
অদ্বৈত এই বিভ্রমের তত্ত্ব বোঝাতে আরেকটি শব্দ ব্যবহার করে—বিবর্ত (Vivarta), যার অর্থ “অপরিবর্তিত থেকে আপাত রূপান্তর।” এটি পরিণাম (Pariṇāma)-এর বিপরীতে। পরিণাম হলো বাস্তব পরিবর্তন—যেমন দুধ জমে দই হয়, সেখানে আসল পদার্থ বদলে যায়। কিন্তু বিবর্তে পদার্থ অপরিবর্তিত থাকে, কেবল তার প্রতীয়মান রূপ বদলে যায়—যেমন মরুভূমিতে সূর্যের প্রতিফলনে জল দেখা যায়, অথচ জল নেই।
এভাবে, “অপার সত্যভাস” অদ্বৈতের এক মৌল ধারণা, যা বলে—বিশ্ব বাস্তব নয়, তবে অভিজ্ঞতাগতভাবে সত্য। অর্থাৎ, এটি মিথ্যা (Mithyā)—না একেবারে সত্য, না একেবারে মিথ্যা; যেমন স্বপ্নে-দেখা জগৎ জাগরণের আলোয় বিলীন হয়, তবু স্বপ্ন চলাকালীন তা সম্পূর্ণ বাস্তব বলে মনে হয়। জগৎও তেমনই—অজ্ঞান অবস্থায় সত্য বলে মনে হয়, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞানে জানা যায় যে, সবই সেই এক চেতনার প্রকাশ।
এই ধারণা কেবল তত্ত্ব নয়, বরং মুক্তির পথের ইঙ্গিতও বটে। “অপার সত্যভাস” আমাদের শেখায়—দৃষ্টির ভুলেই দুঃখের জন্ম, আর জ্ঞানের আলোয় সেই ভুল মিলিয়ে যায়। সত্যের উপলব্ধি মানে কোনো নতুন জগৎ অর্জন নয়, বরং পুরনো বিভ্রমের অবসান। যখন মায়ার আচ্ছাদন সরে যায়, তখন প্রকাশ পায় সেই এক অখণ্ড চেতনা, যে নিজেই দড়ি, নিজেই আলো, নিজেই দর্শক। সেই মুহূর্তেই মায়ার অপার সত্যভাস লয়ে যায় ব্রহ্মের নিখিল নীরবতায়।
অ্যারিস্টটলের Metaphysics (গ্রিক: ta meta ta physika) পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে এমন এক গ্রন্থ, যেখানে মানুষ প্রথমবারের মতো “অস্তিত্ব” (Being)-এর নিজস্ব বিজ্ঞান গঠন করেছিল। শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো—“যা Physics-এর পরে আসে”। এই নামটি আসলে অ্যারিস্টটল নিজে দেননি; তাঁর মৃত্যুর প্রায় তিন শতাব্দী পরে, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে, তাঁর রচনাগুলি সংকলন করেন দার্শনিক অ্যান্ড্রনিকাস অব রোডস (Andronicus of Rhodes)। তিনি Physics বা প্রকৃতিবিদ্যার গ্রন্থগুলির পর এই অস্তিত্ব-সংক্রান্ত লেখাগুলি সাজিয়ে রাখেন এবং গ্রিক ভাষায় বলেন ta meta ta physika—অর্থাৎ “ফিজিক্সের পরে থাকা প্রবন্ধসমূহ”।
কালের সঙ্গে সঙ্গে “meta” শব্দটির অর্থ পরিবর্তিত হয়ে “beyond” বা “অতিক্রম” অর্থে গৃহীত হয়; ফলে Metaphysics বলতে বোঝানো হতে থাকে “প্রকৃতির ঊর্ধ্বে থাকা” বা “অস্তিত্বের গভীরতর স্তর” নিয়ে অনুসন্ধান। এভাবেই একটি গ্রন্থ-সংকলনের নাম ধীরে ধীরে পাশ্চাত্য দর্শনের এক কেন্দ্রীয় পরিভাষা হয়ে ওঠে, যা আজও ব্যবহৃত হয় “অস্তিত্বতত্ত্ব” বা “Ontology”-এর সমার্থক হিসাবে।