অবিদ্যা-বিদ্যা: ১০৮



অন্যদিকে, জৈন দর্শনে স্বসংবেদনকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে আপেক্ষিকভাবে, অনেকান্তবাদ (anekāntavāda) নীতির আলোকে। জৈন আচার্যগণ বলেন, আত্মা চেতনার স্বরূপ, তবে তার প্রকাশ নানা মাত্রায় ঘটে—জ্ঞান, দর্শন, সুখ, শক্তি—সবই তার গুণ। আত্মা নিজের অস্তিত্ব অনুভব করে, কিন্তু এই অনুভব কখনও চূড়ান্ত নয়, বরং আংশিক ও প্রসঙ্গনির্ভর। জৈন মতে, মুক্ত আত্মা চিরসচেতন, কিন্তু বন্ধনযুক্ত আত্মার চেতনা আবৃত। তাই স্বসংবেদন এখানে মুক্তির সঙ্গে যুক্ত—যখন আবরণ সরে যায়, তখন আত্মা নিজের প্রতি নিজের পূর্ণ চেতনা অর্জন করে।

অনেকান্তবাদ (anekāntavāda) জৈন দর্শনের এক মৌল নীতি, যা সত্য ও বাস্তবতার বহুমাত্রিক প্রকৃতি প্রকাশ করে। শব্দতত্ত্বে “অনেকান্ত” এসেছে aneka (অনেক) ও anta (দিক, প্রান্ত বা দৃষ্টিকোণ) শব্দ থেকে, আর vāda অর্থ নীতি বা প্রতিপাদন। সুতরাং অনেকান্তবাদ মানে এমন এক দর্শন, যা ঘোষণা করে যে, কোনো বস্তুর বা সত্যের একক, পরম, একমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি নেই; বরং প্রতিটি সত্যই বহু দৃষ্টিকোণ থেকে আংশিকভাবে প্রকাশিত। এই ধারণার ভিত রচনা করেন মহাবীর স্বামী, যিনি বলেছিলেন—“সত্যকে একদিকে দেখা মানে তাকে বিকৃত দেখা; সত্য সর্বদা বহু-পার্শ্বীয়।” এই নীতি কেবল একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং এটি এক নৈতিক দৃষ্টি—যা মানুষকে শেখায় সহিষ্ণুতা, বিনয় ও যুক্তিবোধের সংস্কার।

জৈন দর্শনের মতে, বাস্তবতা অনন্ত ও বহুরূপী। মানুষের জ্ঞান ও ভাষা সীমাবদ্ধ, তাই আমরা কোনো বস্তুকে তার সম্পূর্ণ রূপে ধরতে পারি না; আমরা কেবল তার একটি দিক উপলব্ধ করি। এই সীমাবদ্ধতা থেকেই সমস্ত তর্ক, দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধের উদ্ভব। এই কারণেই জৈন আচার্যরা বলেন, সত্যের কাছে পৌঁছোতে হলে বহু দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করতে হবে—এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গির নাম নয় (naya)। “নয়” মানে বিচারভঙ্গি বা দৃষ্টিকোণ। যেমন কোনো বস্তুকে চোখ দিয়ে দেখলে একরকম, যুক্তি দিয়ে বিচার করলে অন্যরকম; প্রত্যেক দৃষ্টি আংশিক হলেও, সব মিললে গঠিত হয় পূর্ণ জ্ঞান। এইভাবেই অনেকান্তবাদকে বলা হয় “নয়বাদ”—দৃষ্টিকোণনির্ভর জ্ঞানতত্ত্ব।

এই দর্শনের আরও সূক্ষ্ম বিকাশ ঘটে সপ্তভঙ্গীনয় বা “সাত-বিচার” নীতিতে, যা অনেকান্তবাদের যুক্তিগত রূপ। “সপ্তভঙ্গী” মানে সাতটি সম্ভাব্য দৃষ্টিকোণ—অস্তি (আছে), নাস্তি (নেই), অস্তি-নাস্তি উভয় (একই সঙ্গে আছে ও নেই), অব্যক্ত (বলা যায় না), অস্তি-অব্যক্ত, নাস্তি-অব্যক্ত, এবং অস্তি-নাস্তি-অব্যক্ত। এই সাতটি বিচার একত্রে আমাদের শেখায় যে, কোনো বস্তুর বা সত্যের অস্তিত্ব এককভাবে নির্ধারণ করা যায় না; বরং তার অবস্থান ও পরিচয় নির্ভর করে দেশ (স্থান), কাল (সময়) ও ভাব (অবস্থা)—এই তিনের আপেক্ষিক যোগে।

উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক একটি সরল বস্তু—একটি মাটির ঘট বা কলস। প্রথম দৃষ্টিকোণে, কেউ যদি এখন ঘরে তাকিয়ে দেখে বলে—“ঘট আছে”—এটি অস্তি বিচার। কিন্তু একই ঘট যখন অন্য ঘরে সরিয়ে নেওয়া হয়, তখন যে-ঘরে এটি নেই, সেই ঘরের দৃষ্টিতে বলা যায়—“ঘট নেই”—এটি নাস্তি বিচার। আবার দার্শনিকভাবে, কেউ যদি চিন্তা করে—“ঘট আছে বললেও নেই”—তাহলে সে আসলে বলছে—ঘটের অস্তিত্ব কেবল নামমাত্র, কারণ এটি মাটির দ্বারা গঠিত; মাটিই চিরস্থায়ী, ঘটের স্বতন্ত্রতা কেবল নামরূপ—এটি অস্তি-নাস্তি বিচার।

এখন যদি কেউ এই প্রশ্নে বিভ্রান্ত হয়ে বলে—“এমন কথা স্পষ্টভাবে বলা যায় না, কারণ ঘটের অস্তিত্ব মাটির উপর নির্ভরশীল”—তবে সেটি অব্যক্ত বিচার। আবার বলা যায়—“ঘট আছে, কিন্তু এক অর্থে এটা বলা যায় না”—এটি অস্তি-অব্যক্ত। একইভাবে, “ঘট নেই, কিন্তু এক অর্থে এটা বলা যায় না”—এটি নাস্তি-অব্যক্ত। আর “ঘট আছে, নেই, এবং এক অর্থে এটা বলা যায় না”—এটি সপ্তম বিচার অস্তি-নাস্তি-অব্যক্ত।

এইভাবে দেখা যায়, একই ঘটকে সাতটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, এবং প্রত্যেক দৃষ্টিই কোনো না কোনো প্রেক্ষাপটে সত্য। এই নীতির গভীর তাৎপর্য হলো—সত্য কখনও স্থির নয়; তা সর্বদা শর্ত, প্রেক্ষাপট, ও দৃষ্টিভঙ্গি-নির্ভর।

আরও গভীর দার্শনিক উদাহরণ হিসেবে “আত্মা”কে নেওয়া যেতে পারে। জৈন দর্শন অনুযায়ী আত্মা অস্তি—কারণ তা চিরন্তন, চৈতন্যরূপ; কিন্তু একই সঙ্গে নাস্তি—কারণ তা শরীরের সঙ্গে এক নয়, দেহ চলে গেলেও আত্মা অব্যাহত। আবার বলা যায় অস্তি-নাস্তি—আত্মা এক অর্থে আছে, কিন্তু দেহের আকারে নয়; আর “অব্যক্ত”—কারণ আত্মাকে ইন্দ্রিয় দিয়ে নিরূপণ করা যায় না। এইভাবে প্রতিটি বিচার আত্মাকে নতুন এক দিক থেকে প্রকাশ করে, অথচ কেউই সম্পূর্ণ সত্য নয়।

সপ্তভঙ্গী-নয় এই শিক্ষা দেয় যে, জগৎ ও সত্য একরৈখিক নয়; এটি বহুমাত্রিক। আমাদের মতভেদ ও সংঘাতের কারণ এই যে, আমরা প্রত্যেকে সত্যের কেবল একটি দিক দেখি এবং সেটাকেই সর্বশেষ রূপ বলে মনে করি। কিন্তু জৈন দর্শনের মতে, সত্য সর্বদা সমন্বিত—যেমন একটি পর্বতের পাদদেশ থেকে দেখা দৃশ্য এবং শৃঙ্গ থেকে দেখা দৃশ্য ভিন্ন হলেও, উভয়ই একই পর্বতের বাস্তবতার অংশ। তাই সপ্তভঙ্গী-নয় কেবল যুক্তির রীতি নয়, এটি সত্য ও সহিষ্ণুতার পথ—যেখানে প্রত্যেক দৃষ্টিকোণকে মর্যাদা দেওয়া হয়, কারণ প্রত্যেকটি কোনো-না-কোনো দিক থেকে সত্য।

এই বিশ্লেষণের ভাষাগত রূপ হলো সিয়াদ্বাদ (syādvāda), যেখানে “সিয়াৎ” শব্দের অর্থ—“এক দিক থেকে বলা যায়” বা “সম্ভবত”। এটি এমন এক ভাষাতাত্ত্বিক শৃঙ্খলা, যেখানে প্রত্যেক বক্তব্যের আগে বক্তা বিনয়ের সঙ্গে স্বীকার করেন যে, তাঁর জ্ঞান আংশিক। যেমন বলা যায়—“সিয়াৎ ঘটঃ অস্তি”—“এক দিক থেকে বলা যায় ঘড়া আছে”; কারণ অন্য কোনো প্রেক্ষিতে সেই ঘড়া না-ও থাকতে পারে। এইভাবেই সিয়াদ্বাদ ভাষায় ও চিন্তায় অহংকারহীনতা প্রতিষ্ঠা করে—কেউই পরম সত্যের অধিকারী নয়, সকলেই সত্যের পথিক।

এছাড়া অভিপ্রায়বাদ (abhiprāyavāda) নামক নীতিও অনেকান্তবাদের সঙ্গে যুক্ত। এর অর্থ হলো—কোনো বক্তব্যের সত্যতা তার অভিপ্রায় বা প্রেক্ষাপটের উপর নির্ভর করে। একটি বাক্য ভিন্ন প্রেক্ষিতে ভিন্ন অর্থ ধারণ করতে পারে, তাই অর্থ সর্বদা পরিস্থিতিনির্ভর। এইভাবে জৈন দর্শন ভাষা, চিন্তা ও অভিজ্ঞতার আপেক্ষিকতা মেনে নিয়েও সত্যের প্রতি এক মৌলিক আস্থা বজায় রাখে—যা বলা যায় “অন্তর্ভুক্তিমূলক বাস্তববাদ”।

অভিপ্রায়বাদ (Abhiprāyavāda) জৈন দর্শনের এক সূক্ষ্ম দার্শনিক নীতি, যা অনেকান্তবাদ ও সিয়াদ্বাদের স্বাভাবিক পরিণতি। “অভিপ্রায়” শব্দটি এসেছে abhi (দিকে, প্রতি) ও prāya (উদ্দেশ্য, মানে, ইঙ্গিত) ধাতু থেকে। এর আক্ষরিক অর্থ—‘যে-অর্থটি উদ্দেশ্য হিসেবে নিহিত’, অর্থাৎ বাক্য বা বক্তব্যের গভীর অন্তর্নিহিত ভাব। সুতরাং অভিপ্রায়বাদ হলো এমন এক তত্ত্ব, যা বলে—কোনো বাক্য বা বক্তব্যের সত্যতা ও অর্থ নির্ভর করে তার অভিপ্রায় বা উদ্দেশ্য বা প্রেক্ষাপটের উপর।

জৈন দার্শনিকেরা দেখেছিলেন, মানুষ প্রায়ই একে অপরের কথা ভুল বোঝে, কারণ তারা ভাষার আক্ষরিক অর্থে আটকে যায় এবং বক্তার উদ্দেশ্য উপলব্ধি করে না। তাই অভিপ্রায়বাদ বলে, “বাক্যকে তার উচ্চারণের প্রেক্ষাপটে বিচার করতে হবে”—বক্তা কী পরিস্থিতিতে, কী উদ্দেশ্যে এবং কোন মানসিক অবস্থায় কথা বলেছেন, সেটিই আসল সত্যের মানদণ্ড। এইভাবে অভিপ্রায়বাদ ভাষাতত্ত্ব ও নৈতিকতার সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে—এটি কেবল শব্দের অর্থ নয়, বরং অর্থের অর্থ নিয়ে কাজ করে।

উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, কেউ বলল—“সব কিছুই মায়া।” আক্ষরিক অর্থে এটি দার্শনিকভাবে ভুলও মনে হতে পারে, কারণ জৈন দর্শনে জগৎ সম্পূর্ণ অবাস্তব নয়; কিন্তু যদি বক্তার অভিপ্রায় হয়—“জগতের ভোগবিলাসে আসক্ত হওয়া উচিত নয়,” তবে বক্তব্যটি নৈতিক অর্থে সত্য। এইভাবেই অভিপ্রায়বাদ শেখায়—কোনো বক্তব্যকে বিচ্ছিন্নভাবে নয়, বরং উদ্দেশ্য ও অবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে বুঝতে হবে।

এই নীতির মাধ্যমে জৈন দার্শনিকেরা একপ্রকার “সন্দর্ভ-বাস্তববাদ” (contextual realism) প্রবর্তন করেছিলেন—যেখানে সত্য এক নয়, বরং সম্পর্কনির্ভর। এক প্রেক্ষিতে কোনো বাক্য সত্য, অন্য প্রেক্ষিতে তার অর্থ পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন—“বৃষ্টি হচ্ছে”—এই বাক্যটি সত্য তখনই, যখন বক্তার অবস্থান সেই স্থানে, সেই সময়ে। অন্য স্থান বা সময়ে তা মিথ্যা হতে পারে। সুতরাং বক্তব্যের সত্যতা “অভিপ্রায়” তথা প্রেক্ষাপটের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত।

অভিপ্রায়বাদের নৈতিক দিকও গভীর। এটি সহিষ্ণুতা শেখায়, কারণ অন্যের বক্তব্যের পেছনে থাকা অভিপ্রায় বোঝা মানে তার দৃষ্টিকোণকে স্বীকার করা। যেমন, কোনো ধর্মশাস্ত্রের বাণী, কোনো দার্শনিক তর্ক, এমনকি কোনো দৈনন্দিন কথোপকথন—সব ক্ষেত্রেই অভিপ্রায় না বুঝলে অর্থ বিকৃত হয়। এই কারণেই জৈন দার্শনিক হেমচন্দ্রাচার্য বলেছেন—“অর্থো নৈকান্তিকঃ”—অর্থ কখনও একমাত্রিক নয়; প্রত্যেক বক্তব্য তার উদ্দেশ্য দ্বারা নির্ধারিত।

অতএব, অভিপ্রায়বাদ হলো সেই দৃষ্টি, যা ভাষাকে মনস্তাত্ত্বিক ও নৈতিক গভীরতায় স্থাপন করে। এটি কেবল যুক্তি নয়, বরং সহানুভূতির একটি দর্শন—যা শেখায় যে, মানুষকে বুঝতে হলে তার কথার আক্ষরিক রূপ নয়, তার অন্তর্নিহিত অর্থ শুনতে হবে। এই নীতিই অনেকান্তবাদের প্রাণ—কারণ সত্য কেবল উচ্চারিত শব্দে নয়, বরং উদ্দেশ্যের আলোয় প্রতিফলিত হয়।

আদি আচার্য উমাস্বাতি তাঁর তত্ত্বার্থসূত্র-এ “অর্থন্যথাত্বাৎ সত্ত্বন্যথাত্বাৎ” এই গভীর সূত্রটি উচ্চারণ করে এমন এক দর্শনের জন্ম দিয়েছিলেন, যেখানে বাস্তবতার কোনো একান্ত, অপরিবর্তনীয় রূপ নেই। এর অর্থ—কোনো বস্তুর অর্থ (অর্থাৎ ধারণাগত মানে) ও তার সত্তা (অর্থাৎ অস্তিত্ব) উভয়ই নির্দিষ্ট শর্ত, অবস্থা ও প্রেক্ষাপটের উপর নির্ভরশীল। এক প্রেক্ষিতে যা সত্য, অন্য প্রেক্ষিতে তা ভিন্ন হয়ে যায়; তাই একরৈখিক, স্থির ও পরম সিদ্ধান্তের ধারণা সর্বদা অসম্পূর্ণ। উমাস্বাতির এই বক্তব্য জৈন দর্শনের বহুমাত্রিকতা বা অনেকান্তবাদ-এর মূল সূত্র, যা সত্যকে কখনও একমাত্রিক ভাবে বিচার করতে দেয় না।

জৈন চিন্তাধারায় বলা হয়, কোনো বস্তুর সম্পূর্ণ সত্য কখনও একক দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা যায় না। প্রতিটি বস্তুর অসংখ্য গুণ ও অবস্থা থাকে, যা নির্দিষ্ট শর্তে প্রকাশিত হয়। যেমন, একদিকে একটি মাটির পাত্র “মাটি” রূপে চিরন্তন, আবার “পাত্র” রূপে তা পরিবর্তনশীল; ভেঙে গেলে সেটি আর পাত্র নয়, কিন্তু তার উপাদান বা মাটি থেকে যায়। সুতরাং “পাত্র আছে” এই উক্তি একটি নির্দিষ্ট সময়-প্রেক্ষিতে সত্য, “পাত্র নেই” অন্য প্রেক্ষিতে সমান সত্য। সত্য কখনও পরম নয়, বরং পরিস্থিতিনির্ভর—এই সাপেক্ষতার দর্শনই উমাস্বাতির “অর্থন্যথাত্বাৎ সত্ত্বন্যথাত্বাৎ”-এর হৃদয়।

এই সূত্র থেকেই বিকশিত হয়েছে অনেকান্তবাদ—অর্থাৎ “সত্য অনেক দিক থেকে প্রকাশিত”, এবং তার যৌক্তিক রূপ স্যাদ্বাদ বা “শর্তসাপেক্ষ বচনতত্ত্ব”। এখানে প্রত্যেক উক্তি “স্যাৎ”—অর্থাৎ “কোনো শর্তে সত্য” বলে বিবেচিত হয়। “ঘট আছে”—স্যাৎ, কারণ এটি নির্দিষ্ট স্থানে ও সময়ে বিদ্যমান; “ঘট নেই”—স্যাৎ, কারণ ভবিষ্যতে তা ভেঙে যাবে বা অন্যত্র অনুপস্থিত; আবার “ঘট আছে-নেই উভয়”—স্যাৎ, কারণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উভয়ই প্রযোজ্য। এইভাবে জৈন যুক্তিবিদ্যা সাতস্তর বিশ্লেষণে (সপ্তভঙ্গী ন্যায়) প্রতিটি সত্যকে বহুস্তরীয় করে তোলে।

“স্যাৎ”—এই একটিমাত্র শব্দেই জৈন দর্শনের সমগ্র দর্শন ও নৈতিকতার শ্বাসপ্রশ্বাস লুকিয়ে আছে। সংস্কৃত মূল “স্যাৎ” অর্থাৎ “সম্ভবত”, “নির্দিষ্ট শর্তে”, বা “এক প্রেক্ষিতে সত্য”—এই শব্দটি উচ্চারণ করেই জৈন আচার্যগণ মানুষের চিন্তার পরম একমাত্রিকতা ভেঙে দিয়েছিলেন। তাঁরা দেখিয়েছিলেন, বাস্তবতা কখনও কোনো এক স্থির রূপে ধরা যায় না; তার প্রতিটি দিক, প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি দৃষ্টিকোণ—আলাদা আলাদা সত্যের আলোয় আলোকিত। তাই কোনো বক্তব্য নিঃশর্ত সত্য নয়; তা কেবল নির্দিষ্ট অবস্থায় সত্য হতে পারে—এই সাপেক্ষতার বোধই “স্যাৎ”-এর আত্মা।