মহাযান মানে হলো মহান যান, যার উদ্দেশ্য সকল জীবের মুক্তির জন্য সম্মিলিতভাবে জাগরণ লাভ করা। যোগাচার দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ চতুর্থ থেকে পঞ্চম শতাব্দীতে মহান আচার্য অসঙ্গ (Asaṅga) ও বসুবন্ধু (Vasubandhu)-র হাতে সংগঠিত হয়। তাঁরা মৈত্রেয়-নাথের (Maitreya) বাণীর ওপর ভিত্তি করে “যোগাচারভূমি শাস্ত্র”, “বিজ্ঞানমাত্রসিদ্ধি” ও “ত্রিস্বভবনির্দেশ”-এর মতো গ্রন্থে এই দর্শনের পূর্ণ রূপরেখা প্রতিষ্ঠা করেন।
যোগাচারের মূল প্রতিপাদ্য হলো—“চেতনা ব্যতীত কিছুই নেই”—বাহ্য বস্তু বলে যা মনে হয়, তা আসলে চেতনারই প্রক্ষেপণ। বসুবন্ধু তাঁর বিজ্ঞপ্তিমাত্রতাসিদ্ধি (Vijñaptimātratāsiddhi) গ্রন্থে বলেছেন—“বাহ্যবস্তুনিরাকৃতিরপেক্ষয়া বিজ্ঞানমাত্রমবশিষ্টম্”—অর্থাৎ, বাহ্য বস্তুর কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব নেই; কেবল (বি)জ্ঞান বা চেতনার প্রকাশই অবশিষ্ট থাকে। গ্রন্থের নামের অর্থ—"জ্ঞানই কেবল সত্য, এই মতের প্রতিষ্ঠা" বা "বিজ্ঞপ্তি (চেতনা/উপলব্ধি) মাত্রই সত্য, এর প্রমাণ”। আমরা বাইরে যা-কিছু দেখি বা অনুভব করি, তার সবই মনেরই প্রতিচ্ছবি বা জ্ঞানাকার (Mind-Form)—বিজ্ঞানেরই অভিব্যক্তি। এই গ্রন্থ যৌক্তিকভাবে প্রমাণ করে যে, বস্তু (Object) বলে যা প্রতীয়মান হয়, তা আসলে জ্ঞান (Consciousness) থেকে অভিন্ন এবং জ্ঞানের অতিরিক্ত বাহ্য বস্তু অসৎ (অস্তিত্বহীন)। এভাবে, যোগাচার দর্শনে বাস্তবতা ও জ্ঞানের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই; দেখা ও জানা, দৃষ্ট ও দ্রষ্টা—এই সবই এক অভিন্ন প্রক্রিয়া।
এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে যোগাচার মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের এক অসাধারণ কাঠামো নির্মাণ করে, যা পরিচিত অষ্টবিজ্ঞান তত্ত্ব (Eightfold Consciousness) নামে। এখানে বলা হয়েছে, চেতনা আটটি স্তরে বিভক্ত—পাঁচ ইন্দ্রিয়বিজ্ঞান (চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক), ষষ্ঠ মনোবিজ্ঞান (চিন্তা বা ধারণা), সপ্তম মনস্ (অহংকার, “আমি”-বোধের আসন), এবং অষ্টম আলয়-বিজ্ঞান (Ālaya-vijñāna), যা সমস্ত অভিজ্ঞতার বীজরূপে গভীরে (আলয়ে) সঞ্চিত থাকে। আলয়-বিজ্ঞান ধারণাটি যোগাচারের সবচেয়ে মৌলিক অবদান—এটি একধরনের “storehouse consciousness,” যেখানে অতীত কর্ম ও অভিজ্ঞতার সংস্কারসমূহ (saṃskāra) বীজ (bīja) আকারে জমা থাকে। এই বীজই ভবিষ্যৎ জন্ম, চিন্তা ও উপলব্ধির উৎস হয়ে আবার নতুন অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে। এভাবে জগৎ ও ব্যক্তির অবিচ্ছিন্ন চক্রাকার ধারা তথা সংসার চলতে থাকে।
আলয়-বিজ্ঞান (Ālaya-Vijñāna) বা “সংরক্ষক-চেতনা” বৌদ্ধ যোগাচার (Yogācāra) দর্শনের এক গভীরতম তত্ত্ব, যা ব্যাখ্যা করে—মানুষের সমস্ত অভিজ্ঞতা, কর্মফল ও চিন্তার ধারাবাহিকতা কীভাবে টিকে থাকে, যদিও কোনো স্থায়ী আত্মা (Ātman) নেই। এটি চেতনার এমন এক স্তর, যা দৃশ্যমান মন বা ইন্দ্রিয়চেতনার বাইরে অবস্থিত, কিন্তু তাদের সকলের ভিত্তি। “Ālaya” শব্দের অর্থ আশ্রয় বা গুদাম, আর “Vijñāna” মানে চেতনা বা জ্ঞান; সুতরাং Ālaya-Vijñāna হলো সেই গভীরতম চেতনা, যেখানে সমস্ত মানসিক ক্রিয়া, অভিজ্ঞতা ও কর্মের ফল বীজরূপে সঞ্চিত থাকে।
এই ধারণাটি প্রথম বিস্তারিতভাবে বিকশিত করেন যোগাচার দর্শনের দুই মহান আচার্য—অসঙ্গ (Asaṅga) ও বসুবন্ধু (Vasubandhu)। তাঁরা বলেন, মানুষের মন একক নয়, বরং বহুস্তরবিশিষ্ট। আমাদের সচেতন মন বা ইন্দ্রিয়চেতনা কেবল উপরিতল, তার নীচে আছে আলয়-বিজ্ঞান নামের এক গভীর মানসিক স্তর, যা প্রতিটি চিন্তা, অনুভূতি, আকাঙ্ক্ষা ও কর্মফলকে সঞ্চিত করে রাখে এবং উপযুক্ত পরিস্থিতিতে সেগুলো পুনরায় প্রকাশিত করে।
যোগাচার মতে, চেতনার আটটি স্তর (Aṣṭa Vijñāna) আছে—চক্ষু-বিজ্ঞান (দৃষ্টিচেতনা), শ্রোত্র-বিজ্ঞান (শ্রবণচেতনা), ঘ্রাণ-বিজ্ঞান (গন্ধচেতনা), জিহ্বা-বিজ্ঞান (স্বাদচেতনা), কায়-বিজ্ঞান (স্পর্শচেতনা), মনোবিজ্ঞান (চিন্তা বা ধারণা), মনস (অহং বা আত্মধারণা), এবং শেষত আলয়-বিজ্ঞান (সংরক্ষক চেতনা)। এই আলয়-বিজ্ঞানই সবচেয়ে গভীর ও মৌলিক স্তর—এটি অন্য সব চেতনার ভিত্তি, যেন এক বিশাল সাগর যার উপর ঢেউয়ের মতো ওঠে ইন্দ্রিয়চেতনার তরঙ্গ।
আলয়-বিজ্ঞানকে বোঝার মূল চাবিকাঠি হলো “বীজ তত্ত্ব” (Bīja-vāda)। প্রতিটি মানসিক ক্রিয়া বা অভিজ্ঞতা এক একটি বীজ (Bīja) সৃষ্টি করে, যা আলয়-বিজ্ঞানে সঞ্চিত হয়। এই বীজগুলো কখনো নষ্ট হয় না; তারা অবচেতনের গভীরে নিদ্রিত থাকে এবং উপযুক্ত কারণ-পরিস্থিতিতে আবার অঙ্কুরিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, রাগের চিন্তা রাগের বীজ সৃষ্টি করে, করুণার চিন্তা করুণার বীজ সৃষ্টি করে। এইভাবে আমাদের বর্তমান অভ্যাস, প্রবণতা ও ব্যক্তিত্ব আসলে অসংখ্য অতীত বীজের ফল—যেগুলি আলয়-বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে জমে আছে।
বৌদ্ধ অনাত্মবাদ (Anātma-vāda) বলে যে, কোনো স্থায়ী আত্মা নেই। কিন্তু যদি আত্মা না থাকে, তাহলে কর্মের ধারাবাহিকতা কীভাবে বজায় থাকে? যোগাচারীরা এর উত্তর দেন এইভাবে—আত্মা না থাকলেও আলয়-বিজ্ঞান আছে, যা এক নিরবচ্ছিন্ন মানসিক প্রবাহ (Citta-santāna)। এটি কোনো স্থির সত্তা নয়, বরং এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যা প্রতিটি জীবনের কর্মফল বহন করে পরবর্তী জীবনে নিয়ে যায়। এইভাবে আলয়-বিজ্ঞানই পুনর্জন্মের নীতির ব্যাখ্যা দেয়, আত্মা ছাড়াই কর্মের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে।
চিত্তসন্তান (Citta-santāna) বৌদ্ধ দর্শনের এক গভীর তত্ত্ব, যার মাধ্যমে “মন” বা “চেতনা”-কে স্থায়ী কোনো সত্তা নয়, বরং এক নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ হিসেবে বোঝানো হয়। “চিত্ত” (Citta) মানে মন বা চেতনা, আর “সন্তান” (Santāna) মানে ধারাবাহিকতা, প্রবাহ, বা স্রোত। অর্থাৎ, চিত্তসন্তান বোঝায়—চেতনা কোনো স্থির বস্তু নয়, এটি এক চিরপ্রবাহমান স্রোত, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে নতুন চেতনার উদ্ভব হয়, কিন্তু সেই নতুন মুহূর্তটি পূর্ববর্তী মুহূর্তের প্রভাবে গঠিত।
এই তত্ত্ব বৌদ্ধ মনোবিজ্ঞানের কেন্দ্রে অবস্থান করে। বুদ্ধ আত্মার স্থায়ী অস্তিত্ব (Ātman) অস্বীকার করেছিলেন; কিন্তু প্রশ্ন উঠেছিল—যদি আত্মা না থাকে, তাহলে কর্মফল (Karma) ও পুনর্জন্ম (Rebirth) কীভাবে সম্ভব? যোগাচার ও অন্যান্য বৌদ্ধ শাখাগুলি এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল “চিত্তসন্তান”-এর মাধ্যমে। তারা বলেন, আত্মা নেই, কিন্তু এক চেতনা-প্রবাহ (Stream of Consciousness) আছে, যা এক জন্ম থেকে অন্য জন্মে কর্মফল বহন করে নিয়ে যায়।
এই চেতনা-প্রবাহকে বোঝার জন্য প্রথমে বুঝতে হয় বৌদ্ধ “ক্ষণিকবাদ” (Kṣaṇikavāda) তত্ত্ব। বৌদ্ধ দর্শনের মতে, প্রতিটি চিন্তা, অনুভূতি বা সচেতনতা মাত্র একক্ষণ স্থায়ী; এটি জন্মায়, জ্বলে ওঠে, তারপর বিলীন হয়। কিন্তু বিলয় মানে শূন্যতা নয়—পরের মুহূর্তের চেতনা আগের মুহূর্তের প্রভাবে জন্ম নেয়, যেন এক অবিরাম তরঙ্গের ধারা। এইভাবে চেতনার মুহূর্তগুলো যুক্ত হয়ে তৈরি করে এক “মন”-এর ধারাবাহিকতা—যা আসলে কোনো স্থায়ী সত্তা নয়, বরং পরম্পরাগত প্রক্রিয়া।
এই চেতনার প্রবাহকেই বলা হয় চিত্তসন্তান। এটি আত্মা নয়, কিন্তু আত্মার মতোই ধারাবাহিকতার বোধ দেয়। যেমন নদীর জল প্রতিমুহূর্তে নতুন, তবু নদীকে আমরা এক সত্তা মনে করি; তেমনি চেতনা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হলেও আমরা তাকে এক “আমি” হিসেবে অনুভব করি। এই “আমি”-বোধ আসলে চেতনার ধারাবাহিকতার ফল, কোনো স্থির আত্মার নয়।
যোগাচার দর্শনে চিত্তসন্তান আরও সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে। তারা বলে, চেতনার এই ধারাবাহিকতার গভীরে আছে আলয়-বিজ্ঞান (Ālaya-vijñāna)—যা একপ্রকার চেতনার গুদাম বা সংরক্ষণাগার। সমস্ত কর্ম, অভিজ্ঞতা ও চিন্তার বীজ এই আলয়-বিজ্ঞানে জমা থাকে। চিত্তসন্তান হলো এই বীজগুলির প্রবাহ, আর আলয়-বিজ্ঞান হলো তাদের আশ্রয়। এইভাবে বোঝানো হয়—অতীতের অভিজ্ঞতা বর্তমানকে গঠন করে, আর বর্তমানের কর্ম ভবিষ্যতের বীজ বপন করে; সব মিলিয়ে চেতনার এক অবিরাম ধারা চলতে থাকে।
চিত্তসন্তান তত্ত্ব আধুনিক মনোবিজ্ঞানের চিন্তাধারার সঙ্গেও এক গভীর সামঞ্জস্যে যুক্ত, যেন দুই ভিন্ন যুগ ও সংস্কৃতির মধ্যে প্রবাহিত এক অভিন্ন চেতনার নদী। বৌদ্ধ দর্শনের “চিত্তসন্তান” শব্দটির অর্থই হলো “চিত্তের ধারাবাহিকতা” বা “চেতনার স্রোত”—এটি বলে, মন বা চেতনা কোনো স্থির বা অপরিবর্তনীয় সত্তা নয়, বরং এক নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ, যা প্রতিক্ষণে জন্ম নিচ্ছে, ক্ষয় হচ্ছে, এবং পরবর্তী চেতনার ভিত্তি হয়ে উঠছে। এইভাবে চেতনার মুহূর্তগুলো একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গঠন করে এক মানসিক ধারাবাহিকতা—যাকে আমরা ভুল করে “আমি” বলে মনে করি। এখানে কোনো স্থায়ী আত্মা নেই, তবু অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতা টিকে থাকে, যেমন নদীর জল প্রতিক্ষণে নতুন হলেও নদীকে আমরা এক অবিচ্ছিন্ন সত্তা হিসেবে দেখি।
উনবিংশ শতকে পাশ্চাত্যের মনোবিজ্ঞানে উইলিয়াম জেমস (William James) ঠিক এই কথাটিই বলেছিলেন অন্য ভাষায়। তিনি মন বা চেতনার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে ঘোষণা করেন—“Consciousness is a stream, not a thing.” তাঁর ভাষায়, “Consciousness does not appear to itself chopped up in bits; it is nothing jointed; it flows.” অর্থাৎ, চেতনা কোনো স্থির বস্তুর মতো নয়, যা অংশে বিভক্ত; এটি এক অনবরত প্রবাহ, এক চলমান স্রোত। তিনি এই প্রবাহকেই বলেন “Stream of Consciousness”, যার অর্থ—মানুষের মন একটানা চলমান অভিজ্ঞতার ধারা, যেখানে চিন্তা, অনুভূতি, স্মৃতি, ও ইচ্ছা পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে একটি জীবন্ত সচেতন স্রোত তৈরি করে।
বৌদ্ধ চিত্তসন্তান তত্ত্ব ও জেমসের “Stream of Consciousness” একই দিক নির্দেশ করে—চেতনা কোনো দৃঢ় সত্তা নয়, বরং মুহূর্তে মুহূর্তে নবায়িত এক জীবন্ত প্রক্রিয়া। উভয়ই স্বীকার করে, আমাদের “আমি”-বোধ বা ব্যক্তিত্ব কোনো স্থির কেন্দ্র নয়, বরং এক ধারাবাহিক সচেতনতার প্রতিফলন। এই কারণে, জেমসের মনোবৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণকে প্রাচীন বৌদ্ধ তত্ত্বের এক আধুনিক বৈজ্ঞানিক রূপ বলা যায়।
এই ভাবনাকে আরও গভীর স্তরে বিশ্লেষণ করেছেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড (Sigmund Freud) ও কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং (Carl Gustav Jung)। তাঁরা চেতনার নীচে আরেক বিশাল স্তরের সন্ধান পান, যাকে তাঁরা নাম দেন “অবচেতন” (Unconscious)। ফ্রয়েড মানুষের মানসিক গঠনকে তিন ভাগে ভাগ করেন—সচেতন (Conscious), অর্ধচেতন (Subconscious), এবং অবচেতন (Unconscious)। এই অবচেতন স্তরেই, তাঁর মতে, লুকিয়ে থাকে দমিত ইচ্ছা, স্মৃতি, কামনা ও প্রবৃত্তি, যা আমাদের আচরণ, চিন্তা ও আবেগকে নীরবে নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা সচেতনভাবে তাদের সম্পর্কে জানি না, তবু তারা আমাদের জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে।
ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্বে মানুষের চেতনা এক ত্রিস্তরবিশিষ্ট গঠনরূপে উদ্ভাসিত—সচেতন, অর্ধচেতন (বা প্রাকচেতন), এবং অবচেতন। এই ত্রিবিভাজন আসলে মানুষের মানসিক জীবনের বহুমাত্রিক প্রকৃতিকে অনুধাবনের এক গভীর প্রচেষ্টা। ফ্রয়েড মনে করেছিলেন, মানবমন কোনো একরৈখিক, স্বচ্ছ ও যুক্তিনির্ভর প্রক্রিয়া নয়; বরং এটি এক জটিল স্তরবিন্যাসিত সত্তা, যেখানে প্রতিটি স্তর নিজস্ব গতি ও শক্তির দ্বারা অন্য স্তরগুলিকে প্রভাবিত করে।
সচেতন স্তরটি (conscious mind) হলো মনের সেই অংশ, যা আমাদের জাগ্রত অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র—এখানে আমাদের চিন্তা, অনুভূতি, সিদ্ধান্ত, উপলব্ধি ও সংবেদন সক্রিয়ভাবে ক্রিয়াশীল। আমরা যখন কোনো ঘটনা সম্পর্কে ভাবি, কোনো কাজ করি বা কথোপকথনে যুক্ত হই, তখন আমাদের মানসিক ক্রিয়াকলাপ এই সচেতন স্তরে সম্পন্ন হয়। কিন্তু এই স্তর আসলে হিমশৈলের শীর্ষভাগের মতো—দৃষ্টিগোচর, অথচ ক্ষুদ্র; এর নীচে লুকিয়ে আছে সেই অদৃশ্য স্তরসমূহ, যা আমাদের চিন্তা ও আচরণকে পরোক্ষে নিয়ন্ত্রণ করে।
এই নিম্নস্তরীয় ক্ষেত্রের প্রথম অংশ হলো অর্ধচেতন বা প্রাকচেতন (subconscious/preconscious)। এখানে থাকে স্মৃতি, অভিজ্ঞতা ও ধারণাসমূহ, যা সচেতন মন থেকে সাময়িকভাবে সরে গিয়েছে, কিন্তু সম্পূর্ণ বিলুপ্ত নয়। কোনো ইঙ্গিত, সংযোগ বা ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে এগুলি পুনরায় সচেতন মনে ফিরে আসতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা কোনো ব্যক্তির নাম মুহূর্তে মনে করতে না পারলেও কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মনে পড়ে গেলে, সেটিই অর্ধচেতনের কার্যক্রমের একটি নিদর্শন। এই স্তরটি সচেতন ও অবচেতনের মধ্যে এক সেতুর কাজ করে, যেখানে মানসিক তথ্যসমূহ অবাধে চলাচল করতে পারে।