অবিদ্যা-বিদ্যা: ১০৩



নাগার্জুন এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর মূল উক্তি দ্বারা—“যঃ প্রতীত্যসমুত্পাদঃ শূন্যতাং তাং প্রাচক্ষ্মহে।” (Mūla-Mādhyamika-Kārikā, 24.18) অর্থাৎ, “যা-কিছু পারস্পরিক নির্ভরতার দ্বারা উৎপন্ন, তাকেই আমরা শূন্য বলি।” এখানে ‘প্রতীত্যসমুত্পাদ’ (Pratītya-samutpāda) মানে “নির্ভর-উদ্‌ভব”—যেমন আগুন না হলে ধোঁয়া হয় না, বীজ না হলে গাছ হয় না, দৃষ্টিশক্তি না হলে দেখা হয় না। প্রতিটি বস্তু বা অভিজ্ঞতা অন্য কিছুর উপর নির্ভর করে। এইভাবে জগৎ হলো এক অবিরাম সম্পর্কের জাল (network of interdependence)—যেখানে কিছুই আলাদা নয়, কিন্তু কিছুই স্থায়ীও নয়।

এই নির্ভরতার কারণেই একে বলা হয় সম্পর্কগত শূন্যতা (Relational Emptiness)। “শূন্যতা” এখানে কোনো “শূন্য গহ্বর” বা “অস্তিত্বহীনতা” নয়; বরং বোঝায়—কোনো কিছুর মধ্যে “নিজস্ব স্বভাব (Intrinsic essence)” নেই। যে-চেয়ারটি আপনি দেখছেন, তা কাঠ, কারিগরের শ্রম, রং, আকৃতি, আলো, দৃষ্টিশক্তি, চিন্তা—এইসবের পারস্পরিক সম্পর্কের ফল। এই উপাদানগুলোর কোনো একটিও স্বাধীনভাবে “চেয়ার” নয়, কিন্তু সম্পর্কের মধ্যে মিলেই “চেয়ার”-এর প্রতীতি গঠিত হয়।

এই তত্ত্বের দার্শনিক তাৎপর্য হলো—কোনো কিছুই নিজের মধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, বরং অন্য কিছুর সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমেই তা অর্থপূর্ণ হয়। সুতরাং, “শূন্যতা” মানে অস্তিত্বের অনুপস্থিতি নয়, বরং অস্তিত্বের পারস্পরিকতা। নাগার্জুন এইভাবে “অস্তিত্ব” ও “নাস্তিত্ব”—দুটিকেই অতিক্রম করেন; তাঁর মতে জগৎ না সম্পূর্ণ “আছে”, না সম্পূর্ণ “নেই”, বরং “সম্পর্কের মাধ্যমে প্রকাশমান”—এটাই সম্পর্কগত শূন্যতা।

আধুনিক ভাষায় বলা যায়, নাগার্জুন এখানে একধরনের relational ontology-এর কথা বলছেন—যেখানে বাস্তবতার মূল একক (unit) কোনো “বস্তু” নয়, বরং “সম্পর্ক”। এই কারণে, শূন্যতা, নির্ভরতা আর সম্পর্কতা—এই তিনটি শব্দ মধ্যমক দর্শনে একই মর্ম প্রকাশ করে।

অর্থাৎ, যখন বলা হয় “সব কিছু শূন্য,” তার মানে “সব কিছুই একে অপরের সঙ্গে যুক্ত”—কোনো কিছুই আলাদা নয়, একমাত্র সম্পর্কই চিরন্তন। এ কারণেই মধ্যমক দর্শনের এই ধারণাকে বলা হয় Relational Emptiness, বা “সম্পর্কের মধ্যেই বাস্তবতার শূন্যতা”—যেখানে শূন্যতা মানে মুছে যাওয়া নয়, বরং অস্তিত্বের পারস্পরিক জাগরণ (co-arising of all things)।

কাশ্মীর শৈব দর্শনের চৈতন্যময় আভাস (Caitanyamaya Ābhāsa) তত্ত্ব ভারতীয় অদ্বৈত চিন্তার এক বিরল ও গভীর শিখর, যেখানে “অদ্বৈত” মানে কোনো নিষ্ক্রিয় শূন্যতা নয়, বরং সচেতন, আনন্দময়, ও সৃষ্টিশীল একত্ব (Positive Experiential Monism)। এই দর্শনের মূল অভিপ্রায়—চেতনা কেবল জানে না, সে নিজেই জানন, জানা, ও জানিত তিনের একাত্ম প্রকাশ।

উৎপলদেব ও অভিনবগুপ্ত উভয়েই বলেন—“শিবই চেতনা (চিৎ / Cit)”—যিনি নিজের মধ্যেই পূর্ণ, অপরের দ্বারা নির্ধারিত নন। তিনি কোনো বাহ্য বস্তু নন, বরং সমস্ত জ্ঞানের ভিত্তি। চেতনা এখানে “প্রকাশ (Prakāśa)”—অর্থাৎ, যা নিজেই নিজের দীপ্তিতে সবকিছু প্রকাশ করে। কিন্তু এই প্রকাশ কেবল একমুখী নয়; চেতনা নিজের প্রতি সচেতন, অর্থাৎ তার মধ্যে আছে বিমর্শ (Vimarśa)—নিজের স্বরূপ জানার অন্তর্দৃষ্টি।

অভিনবগুপ্তের তন্ত্রালোক-এর বিখ্যাত শ্লোকটি—

“শক্তিঃ শিবস্যাভিন্না হি স্বাত্মানং ব্যজ্যতে যদা।
তদা বিসৃজ্যতে বিশ্বং কালিকায়াঃ স্ফুরত্তয়া।।” (তন্ত্রলোক, ১.৮১)

এই একটি শ্লোকই যেন কাশ্মীর শৈব দর্শনের সমগ্র সৃষ্টিতত্ত্বকে সংহত করেছে। এর প্রতিটি পদ দর্শনের এক-একটি স্তম্ভ, যার মধ্যে শিব-শক্তি-চেতনা-জগৎ-মুক্তির সম্পূর্ণ সূত্র লুকিয়ে আছে।

শক্তিঃ (Śaktiḥ)—অর্থাৎ শক্তি, শিবের সেই দিক, যা সক্রিয়, সৃষ্টিশীল, ও প্রকাশমুখী। শিব কেবল চেতনার নীরব দ্যোতনা হলে শক্তিই সেই চেতনার গতিশীল রূপ, যার দ্বারা চেতনা নিজেকে প্রকাশ করে। শক্তি মানে তাই সম্ভাবনা নয়, স্বপ্রকাশ।

শিবস্য (Śivasya)—শিবের, অর্থাৎ পরম চৈতন্যের। কাশ্মীর শৈব মতে, শিব মানে সেই চৈতন্য, যা সর্বত্র বিরাজমান—নির্গুণ হয়েও সকল গুণের আধার। তাঁর থেকেই শক্তি অবিচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত।

অভিন্না (Abhinnā)—অভিন্ন, অর্থাৎ ভিন্ন নয়। এখানে বলা হয়েছে, শক্তি শিব থেকে পৃথক নয়। শিব ও শক্তি দুটি আলাদা বাস্তবতা নয়; তারা একে অপরের প্রতিচ্ছবি, যেমন আগুন ও তার জ্বলন। শিব হলেন স্থির চেতনা, আর শক্তি সেই চেতনার স্পন্দন।

হি (Hi)—“নিশ্চয়ই” বা “কারণ”—এটি দর্শনের নিশ্চয়তা প্রকাশ করছে। শক্তি শিব থেকে আলাদা নয়, কারণ দু-জন এক চেতনার দু-দিক।

স্বাত্মানম্ (Svātmānam)—নিজের আত্মাকে, নিজের স্বরূপকে। শিবের শক্তি যখন নিজের আত্মস্বরূপকে প্রকাশ করে, তখন চেতনার অভ্যন্তরীণ সম্ভাবনা রূপ পায়। এটি “আত্ম-উন্মোচন” (Self-revelation)।

ব্যজ্যতে (Vyajyate)—প্রকাশিত হয়। এটি প্রকাশের মুহূর্ত, যেখানে নিঃস্তব্ধ চেতনা প্রথম উচ্ছ্বসিত হয় নিজের মধ্যে। এই প্রকাশই চেতনার আভাস—শিবের নিজের মধ্যেই নিজেকে জানার গতি।

যদা (Yadā)—যখন। তদা (Tadā)—তখন। এই দুই শব্দ প্রকাশ করে চেতনার গতিশীল সময়চক্র: কখন চেতনা নিজের স্বরূপে জাগে, তখনই সৃষ্টি শুরু হয়।

বিসৃজ্যতে (Visṛjyate)—সৃষ্টি হয়, নির্গত হয়। এখানে সৃষ্টি মানে কোনো নতুন বস্তু উৎপত্তি নয়, বরং প্রকাশ (Prakāśa)—যেখানে চেতনা নিজেকে অসংখ্য রূপে প্রকাশ করে, নিজের আনন্দে নিজেকে “জগৎ” রূপে দেখে।

বিশ্বম্ (Viśvam)—জগৎ, মহাবিশ্ব। এই জগৎ চেতনার বাইরে নয়; এটি চেতনার আয়না, তার স্বপ্রকাশের অবিরাম ছন্দ। তাই জগৎ মায়া নয়—চেতনারই রূপান্তর।

কালিকায়াঃ (Kālikāyāḥ)—কালিকার, অর্থাৎ সেই সর্বশক্তিময় দেবী, যিনি সময়, গতি ও চেতনার নৃত্যের প্রতীক। কাশ্মীর শৈব দর্শনে কালিকা মানে “শক্তির চূড়ান্ত প্রকাশ”, সেই অবস্থায় যেখানে চেতনা সময় ও রূপ উভয়কেই অতিক্রম করে নিজের আনন্দে নৃত্য করে।

স্ফুরত্তয়া (Sphurattayā)—স্ফুরণ বা প্রদীপ্তি দ্বারা। “স্ফুরণ” মানে চেতনার অভ্যন্তরীণ কম্পন, সেই জীবন্ত দীপ্তি যার দ্বারা নিস্তব্ধ চেতনা জেগে ওঠে, স্পন্দিত হয়, ও নিজেকে উপলব্ধি করে।

অতএব, শ্লোকটির অর্থ দাঁড়ায়—যখন শিবের শক্তি, যা তাঁর থেকে অবিচ্ছিন্ন, নিজের আত্মস্বরূপকে প্রকাশ করে, তখনই কালিকার স্ফুরণে এই জগৎ প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ, শক্তি (দেবী) হলেন নিশ্চয়ই শিবের থেকে অভিন্ন, যখন সেই শক্তি নিজের আত্মাকে প্রকাশ করেন, তখনই কালিকাদেবীর স্পন্দনের মাধ্যমে এই জগৎ সৃষ্টি হয়।

এখানে “সৃষ্টি” কোনো বাহ্যিক কর্ম নয়, বরং চেতনার অভ্যন্তরীণ আত্ম-আবিষ্কার। শিবের স্থিত চেতনা শক্তির স্পন্দনে নৃত্যময় হয়ে ওঠে, আর সেই নৃত্যই বিশ্বরূপ। তাই অভিনবগুপ্ত বলেন, সৃষ্টি মানে চেতনার আনন্দময় তাণ্ডব (Ānanda-tāṇḍava)—যেখানে “আমি” ও “বিশ্ব” এক হয়ে যায়, যেখানে মায়া নয়, চেতনার স্বপ্রকাশই সত্য।

প্রথম চরণটি কাশ্মীর শৈবদর্শনের মূলনীতি—শিব ও শক্তি অভেদ (একত্ব)—পুনরায় প্রতিষ্ঠা করে। শক্তি শিবের থেকে আলাদা কোনো সত্তা নয়, বরং শিবের নিজেরই ক্ষমতা বা সক্রিয় দিক। 'স্বাত্মানম্ ব্যজ্যতে' (নিজের আত্মাকে প্রকাশ করে) এই অংশটি শিবের সেই স্ব-প্রতিফলন (বিমর্শ—Vimarśa) শক্তিকে বোঝায়। শিব যখন তার প্রকাশ (আলো) দ্বারা নিজেকে বিমর্শ (আত্ম-সচেতনতা) করেন, তখনই সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়।

সৃষ্টি শুরু হয় কালিকার স্ফুরণের (Kālikāyāḥ Sphurattayā) মাধ্যমে। এখানে 'কালিকা' কোনো পৌরাণিক দেবতা বা দেবী নয়, বরং এটি হলো কাল-শক্তির চূড়ান্ত রূপ বা বিমর্শের প্রদীপ্তি (Sphurattā)। স্ফুরণ হলো সেই প্রথম কম্পন বা স্পন্দন, যা নিষ্ক্রিয় শিবকে সক্রিয় করে এবং জগৎকে প্রকাশ করে। কালিকা-শক্তিই সময়ের প্রবাহ (কাল) এবং স্থান তৈরি করে। কালিকাই হলেন সমস্ত সৃষ্টির প্রথম ও আদিম গতি, যা জগৎকে শিবের অসীম চেতনা থেকে প্রকাশ করে। জগৎ সৃষ্টি কোনো বাহ্যিক ঘটনা নয়, বরং এটি শিবের অভিন্ন শক্তি কালিকার আত্ম-প্রকাশের স্পন্দন, যা অসীম চৈতন্যকে সসীম রূপে মূর্ত করে।

এইভাবে একটি ছোট্ট শ্লোক থেকেই ফুটে ওঠে সমগ্র কাশ্মীর শৈব দর্শনের প্রাণবাণী—চেতনা নিজেই শিব, শক্তিই তাঁর আনন্দরূপ প্রকাশ, আর বিশ্ব সেই আনন্দেরই ছায়া।

“আভাস (Ābhāsa)” মানে কোনো মায়াময় প্রতিচ্ছবি নয়, বরং চেতনার স্বপ্রকাশ (Self-manifestation)। যেমন সূর্য আলো দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে, তেমনি শিবচেতনা নিজের শক্তির (Śakti) মাধ্যমে নিজেকে অসংখ্য রূপে প্রকাশ করে। এই আভাসই জগৎ—এক অপরিমেয় চৈতন্যরূপ নৃত্য, যেখানে প্রত্যেক রূপই চেতনারই দ্যোতনা।

এই প্রকাশের প্রক্রিয়াকে কাশ্মীর শৈব দর্শন ব্যাখ্যা করে তিন শক্তির সমন্বয়ে—ইচ্ছাশক্তি (Icchā-śakti), জ্ঞানশক্তি (Jñāna-śakti), ও ক্রিয়াশক্তি (Kriyā-śakti)।

ইচ্ছাশক্তি হলো চেতনার প্রথম স্পন্দন, নিজের আনন্দে নিজেকে প্রকাশ করার অভ্যন্তরীণ প্রেরণা।

জ্ঞানশক্তি হলো সেই ইচ্ছার সচেতন উপলব্ধি, যেখানে চেতনা নিজের সম্ভাবনাকে জানে।

ক্রিয়াশক্তি হলো সেই উপলব্ধ ইচ্ছার কার্যকর প্রকাশ—অর্থাৎ, চেতনা যখন নিজের রূপ ধারণ করে, তখন সৃষ্টি ঘটে।

এই তিন শক্তি কোনো পৃথক সত্তা নয়; তারা এক অবিচ্ছিন্ন গতি—চেতনার “আমি আছি” থেকে “আমি জানি” এবং “আমি প্রকাশিত হই” পর্যন্ত। এই গতি বা স্পন্দ (Spanda)-ই শিবের জীবন্ত সত্তা।

অভিনবগুপ্ত বলেন, এই সৃষ্টি কোনো ভ্রান্তি নয়, কোনো “মায়া”-র ছলনা নয়; এটি চেতনার আনন্দময় প্রকাশ, “আনন্দতাণ্ডব (Ānanda-tāṇḍava)”—যেখানে চেতনা নিজেরই ছন্দে নৃত্য করছে, নিজের মধ্যেই নিজের আনন্দ উপভোগ করছে। এই নৃত্যই জগৎ, এই জগৎই শিবের শরীর, এই শরীরই চেতনার খেলা।

তাই কাশ্মীর শৈব তত্ত্বে “আভাস” মানে বিভ্রম নয়, বরং চেতনার লীলাময় আত্ম-উন্মোচন। চেতনা যখন নিজের দীপ্তিতে নিজেকে দেখছে, তখনই জগৎ প্রতীয়মান হচ্ছে। মুক্তি এখানে কোনো বিলোপ নয়; বরং চেতনার এই দীপ্ত আত্মদর্শনে স্থিত হওয়া—যেখানে জানা যায়, “শিবোহম্” (শিব অহম্)—আমিই সেই শিবচেতনা।

এইভাবে “চৈতন্যময় আভাস” দর্শন শূন্যবাদকে পরিণত করে পূর্ণতায় (Pūrṇatā)—যেখানে চেতনা ও সৃষ্টি, শিব ও শক্তি, জ্ঞান ও কর্ম—সব মিলেমিশে হয়ে যায় এক অনন্ত “চিদানন্দরূপ (Cid-ānanda-rūpa)” সত্য। এটি এমন এক দর্শন, যেখানে মায়া নয়, বরং প্রকাশই সত্য; মৃত্যু নয়, বরং নৃত্যই চূড়ান্ত; আর মুক্তি মানে চেতনার নিজের দীপ্তি উপলব্ধি করে বলা—“নাহং দেহঃ, নাহং মনঃ, শিবোহম্”—আমি শিব, আমি চেতনা নিজেই।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে চেতনা (Śiva) কেবল এক নীরব সত্তা নয়; এটি স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীনতা (Svātantrya)—চেতনা নিজের আনন্দে নিজেকে প্রকাশ করে, আবার নিজেই নিজের মধ্যে লয় পায়। তাই এখানে মুক্তি মানে জগৎ থেকে সরে যাওয়া নয়, বরং জগতের মধ্যেই নিজের চেতনার ঐক্য উপলব্ধি করা। এই উপলব্ধিই “শিবোহম্” (Śivoham)—“আমিই সেই শিবচেতনা।”

তিনটি ধারার তুলনা করলে দেখা যায়—যোগাচার বলে জগৎ হলো চেতনার প্রতিফলন (reflection), মধ্যমক বলে জগৎ ও চেতনা উভয়ই শূন্য (emptiness), আর কাশ্মীর শৈব বলে জগৎ হলো চেতনার আনন্দময় প্রকাশ (play of consciousness)। যোগাচারে জগৎ অবশেষে চেতনার ভেতর লীন হয়, মধ্যমকে সমস্ত ভেদ-অভেদ লুপ্ত হয়ে যায় শূন্যতায়, আর কাশ্মীর শৈবে সেই শূন্যতা পরিণত হয় পূর্ণতায়—শূন্য-পূর্ণ চৈতন্যে (Śūnya-Pūrṇatā)।

তাই যোগাচারের দর্শনকে বলা যায় “বোধের দর্শন,” মধ্যমককে “অস্বভাবতার দর্শন,” আর কাশ্মীর শৈবকে “আনন্দচেতনার দর্শন।” তিনটি পথেই দেখা, জানা ও হওয়া—এই তিন ক্রিয়া শেষ পর্যন্ত একীভূত হয়; পার্থক্য শুধু তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে: যোগাচার চেতনার অভ্যন্তরে মায়াময় প্রতিফলন দেখে, মধ্যমক সেই প্রতিফলনকেই শূন্য বলে ঘোষণা করে, আর কাশ্মীর শৈব সেই শূন্যতাকেই আনন্দে পরিণত করে—চেতনার স্বপ্রকাশ, মহাজাগতিক নৃত্য, ও মুক্তির ঐক্যতত্ত্বে।

আদি শঙ্করাচার্যের ছয়টি শ্লোকের একটি অদ্বৈতবাদী স্তোত্র “নির্বাণ ষট্কম্” (Nirvāṇa Ṣaṭkam) বা 'আত্মষট্কম' (Atmā Ṣaṭkam) অদ্বৈত বেদান্তের এক অনুপম স্তোত্র, যার প্রথম শ্লোকই—

মনোবুদ্ধ্যহংকারচিত্তানি নাহং
ন চ শ্রোত্রজিহ্বে ন চ ঘ্রাণনেত্রে।
ন চ ব্যোম ভূমির্ন তেজো ন বায়ুঃ
চিদানন্দরূপঃ শিবোহম্ শিবোহম্।।