৫. ষড়ায়তন (Ṣaḍāyatana—Six Sense Bases): মন-দেহের সমন্বয়ের পর বিকশিত হয় ষড়ায়তন, অর্থাৎ ছয়টি ইন্দ্রিয়ভিত্তি—চক্ষু (দৃষ্টি), কর্ণ (শ্রবণ), ঘ্রাণ (গন্ধ), জিহ্বা (রসনা), কায় (স্পর্শ), ও মন (মনন)। এই ছয়টি ক্ষেত্রের মাধ্যমে চেতনা বহির্জগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। এগুলি দৃষ্টিপথ তৈরি করে—যেখান দিয়ে “অভিজ্ঞতা” জগতে প্রবেশ করে।
৬. স্পর্শ (Sparśa—Contact): যখন ইন্দ্রিয় (যেমন চোখ), ইন্দ্রিয়বস্তু (যেমন দৃশ্য), ও চেতনা—এই তিন মিলিত হয়, তখন হয় স্পর্শ। এই “স্পর্শ” মানে কেবল শারীরিক স্পর্শ নয়, বরং মানসিক যোগাযোগ—বাহ্যিক বিশ্বের সঙ্গে চেতনার সংঘাত। স্পর্শই সব অনুভূতির মূল কারণ। যখন মন কোনো বস্তুর সঙ্গে “স্পর্শ” করে, তখনই আনন্দ, দুঃখ বা নিরপেক্ষ বোধ জাগে।
৭. বেদনা (Vedanā—Feeling): স্পর্শ থেকে জন্ম নেয় বেদনা, অর্থাৎ অনুভূতি। বেদনা স্বয়ং-নিরপেক্ষ, অর্থাৎ—অনুভূতি নিজে কোনো ভালো বা খারাপ নয়; তা নির্ভর করে আমরা সেটিকে কীভাবে গ্রহণ করছি, তার ওপর। বৌদ্ধ দর্শনে “বেদনা (vedanā)” বলতে বোঝায়, যে-অভিজ্ঞতা স্পর্শ থেকে জন্ম নেয়—যখন ইন্দ্রিয় (যেমন চোখ) কোনো বস্তুর (যেমন দৃশ্য) সঙ্গে চেতনার সংযোগে আসে, তখন যে-অনুভবটি হয়, সেটাই বেদনা। এই বেদনা তিন রকম—সুখবেদনা (আনন্দদায়ক অনুভূতি), দুঃখবেদনা (কষ্টদায়ক অনুভূতি), উদাসীনবেদনা (না সুখ, না দুঃখ)। এদের মধ্যে কোনোটি নিজে “পাপ” বা “পুণ্য” নয়, “অবস্থা” নয়, “কর্ম” নয়—অর্থাৎ, বেদনা নিজে নৈতিক বা মানসিক রঙে রঞ্জিত নয়। এটি কেবল “অভিজ্ঞতার প্রতিক্রিয়া” মাত্র।
বৌদ্ধ জ্ঞানতত্ত্বে, বেদনা মানে কেবল অভিজ্ঞতার অনুভূতি, তা কোনো মূল্যায়ন বা বিচার নয়। তুমি যখন কিছু অনুভব করো—গরম, ঠান্ডা, প্রশংসা, অপমান, বৃষ্টি, সুর—এই “অনুভব” মুহূর্তে কোনো আসক্তি বা বিতৃষ্ণা নেই; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মন যখন বলে, “এটা ভালো, আমি চাই,” বা “এটা খারাপ, আমি ঘৃণা করি”—তখনই জন্ম নেয় তৃষ্ণা (craving)। অর্থাৎ, বেদনা হচ্ছে কেবল “অভিজ্ঞতার কাঁচা ডেটা”; তৃষ্ণা হচ্ছে সেই ডেটার ওপর “মানসিক মন্তব্য”।
যখন বুদ্ধ বলেন “বেদনা স্বয়ং-নিরপেক্ষ”, তিনি বোঝান—অনুভূতি নিজে কোনো সমস্যা নয়; সমস্যা হলো আমরা সেই অনুভূতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করি, কীভাবে আঁকড়ে ধরি। যেমন: তুমি এক কাপ গরম চা খেলে—তার উষ্ণতা একটি “বেদনা” (অনুভূতি)। এটি নিজে ভালো বা খারাপ নয়। কিন্তু যদি মন বলে, “এই উষ্ণতা দারুণ! আমি আরও চাই!”—তখন জন্ম নেয় তৃষ্ণা। আর যদি মন বলে, “উফ্, খুব গরম, আমি সহ্য করতে পারছি না!”—তখন জন্ম নেয় বিরাগ (বিতৃষ্ণা)। কিন্তু যদি তুমি কেবল দেখো, অনুভব করো, আর কিছুই ধরে না রাখো, তাহলে বেদনা স্বয়ং-নিরপেক্ষ—অর্থাৎ, শুধু একটি ঘটমান অভিজ্ঞতা, কোনো মানসিক আসক্তি নয়। বেদনা স্বয়ং-নিরপেক্ষ হলেও আমরা এর প্রতি আকৃষ্ট বা বিতৃষ্ণ হয়ে পড়ি। এই আসক্তিই পরবর্তী ধাপের জন্ম দেয়।
৮. তৃষ্ণা (Tṛṣṇā—Craving): বেদনার পরপরই আসে তৃষ্ণা—অর্থাৎ আকাঙ্ক্ষা, লালসা, তীব্র ইচ্ছা। সুখকর অভিজ্ঞতা ধরে রাখতে এবং দুঃখকর অভিজ্ঞতা এড়িয়ে যেতে চাওয়াই তৃষ্ণা। এটি হলো সংসারের কেন্দ্রীয় শক্তি। তৃষ্ণা তিন প্রকার—কামতৃষ্ণা (ইন্দ্রিয়সুখের জন্য আকাঙ্ক্ষা), ভবতৃষ্ণা (অস্তিত্বের জন্য আকাঙ্ক্ষা), বিভবতৃষ্ণা (অস্তিত্বনাশের আকাঙ্ক্ষা)। তৃষ্ণাই জীবকে পুনর্জন্মের বন্ধনে আবদ্ধ রাখে।
কামতৃষ্ণা (Kāma-Tṛṣṇā)—ইন্দ্রিয়সুখের জন্য আকাঙ্ক্ষা অর্থ: ‘কাম’ মানে ইন্দ্রিয়ভোগ, এবং ‘তৃষ্ণা’ মানে আকাঙ্ক্ষা বা লালসা। অর্থাৎ, কামতৃষ্ণা হলো ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সুখভোগের আকাঙ্ক্ষা—চোখে সুন্দর দেখা, কানে মিষ্টি শোনা, জিহ্বায় স্বাদ পাওয়া, দেহে স্পর্শ অনুভব করা ইত্যাদি। এটি মানুষের প্রাকৃতিক প্রবণতা—ইন্দ্রিয়সুখের অন্বেষণ। কিন্তু এই অন্বেষণ অনন্ত; যে-সুখ একবার অনুভব হয়, তা মিলিয়ে যায়, আর তার জায়গায় আবার নতুন সুখের আকাঙ্ক্ষা জন্ম নেয়। ফলে মন কখনও শান্ত হয় না।
কামতৃষ্ণা আমাদের বর্তমান জগতে বাঁধা রাখে। যতক্ষণ পর্যন্ত মন আনন্দের পেছনে দৌড়াচ্ছে ও বেদনা এড়াতে চাইছে, ততক্ষণ পর্যন্ত দুঃখচক্র চলতেই থাকবে। যেমন “আমি চাই এটা”, “আমাকে ওটা পেতে হবেই”, “আমার এই জিনিসটা ছাড়া শান্তি নেই”—এইসব চিন্তা কামতৃষ্ণার প্রকাশ।
ভবতৃষ্ণা (Bhava-Tṛṣṇā)—অস্তিত্বের জন্য আকাঙ্ক্ষা অর্থ: ‘ভব’ মানে অস্তিত্ব বা থাকা, আর ‘তৃষ্ণা’ মানে আকাঙ্ক্ষা। অর্থাৎ, ভবতৃষ্ণা হলো “আমি থাকতে চাই”, “আমি হতে চাই”, “আমি টিকে থাকতে চাই”—এই গভীর অস্তিত্বপিপাসা। এটি এমন এক আকাঙ্ক্ষা, যা শুধু ইন্দ্রিয়সুখ নয়, বরং “আমি” নামে এক কেন্দ্রের টিকে থাকার ইচ্ছা। আমরা চাই—আমার পরিচয়, নাম, স্থান, ভাবমূর্তি, বুদ্ধি, ক্ষমতা, বা আত্মা যেন টিকে থাকে।
এই ভবতৃষ্ণা অহংবোধের কেন্দ্রীয় রূপ—আমরা “আমি আছি” এই ধারণা আঁকড়ে থাকি, এবং সেই “আমি”-কে স্থায়ী মনে করে সমস্ত দুঃখের উৎস তৈরি করি। বুদ্ধ বলেছিলেন, “যতক্ষণ ভবতৃষ্ণা অবশিষ্ট থাকে, ততক্ষণ জন্ম ও মৃত্যু চলতেই থাকবে।” যেমন, “আমি অমর হতে চাই”, “আমি এই সাফল্য চিরকাল ধরে রাখতে চাই”, অথবা, ধর্মীয় দৃষ্টিতে—“আমি স্বর্গে চিরকাল থাকতে চাই”—এগুলো ভবতৃষ্ণার প্রকাশ।
বিভবতৃষ্ণা (Vibhava-Tṛṣṇā)—অস্তিত্বনাশের আকাঙ্ক্ষা অর্থ: ‘বিভব’ মানে অস্তিত্বের অবসান, আর ‘তৃষ্ণা’ মানে আকাঙ্ক্ষা। অর্থাৎ, বিভবতৃষ্ণা হলো “আমি নষ্ট হতে চাই”, “আমি বিলীন হতে চাই”, অথবা “সব কিছু ধ্বংস হোক”—এই প্রবণতা। এটি এক বিপরীতমুখী তৃষ্ণা—অস্তিত্বের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে অস্তিত্ব থেকে মুক্তি পাবার আকাঙ্ক্ষা, কিন্তু মুক্তির এই ইচ্ছে গঠিত—জ্ঞান দ্বারা নয়, বরং অস্তিত্ব মুছে ফেলার ইচ্ছে দ্বারা। এটি কখনও হতাশা, অবসাদ, বা অস্তিত্বঘৃণা হিসেবে প্রকাশ পায়।
বুদ্ধ এটিকে “বিপরীত ভ্রান্তি” হিসেবে দেখিয়েছেন—এটিও এক প্রকার তৃষ্ণা, কারণ এটিও “আমি”-কে কেন্দ্র করে। যে বলে, “আমি বিলীন হতে চাই”, সে-ও “আমি”-র ধারণায় আবদ্ধ। অতএব, কামতৃষ্ণা যেমন জগতে ধরে রাখে, বিভবতৃষ্ণা তেমনি ধ্বংসের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে আরেক বন্ধন সৃষ্টি করে। যেমন, “আমি কিছুই হতে চাই না”, “সব শেষ হয়ে যাক”, “আমি বিলীন হয়ে যাই”—এই মানসিক প্রবণতাই বিভবতৃষ্ণা।
ত্রিতৃষ্ণার পারস্পরিক সম্পর্ক: এই তিন তৃষ্ণা—কামতৃষ্ণা আমাদের জগতে টেনে রাখে (ইন্দ্রিয়বদ্ধতা), ভবতৃষ্ণা আমাদের অস্তিত্বে স্থিত রাখে (অহংবদ্ধতা), বিভবতৃষ্ণা আমাদের অস্তিত্বনাশের ভ্রান্ত কামনায় আবদ্ধ করে (নৈরাশ্যবদ্ধতা)। তিনটিই অবিদ্যা থেকে উৎপন্ন, এবং দুঃখচক্রকে টিকিয়ে রাখে। যতক্ষণ তৃষ্ণা আছে, ততক্ষণ জন্ম আছে; তৃষ্ণা নিঃশেষ হলেই জন্ম-মৃত্যু-দুঃখের অবসান—এটাই নির্বাণ।
৯. উপাদান (Upādāna—Clinging): তৃষ্ণা যখন দৃঢ় হয়, তখন তা পরিণত হয় উপাদান-এ—আসক্তি বা আঁকড়ে ধরা। এটি হলো সেই মানসিক অভ্যাস, যা “আমার”, “আমি”, “আমার ধারণা”—এইভাবে আত্ম-ধারণাকে দৃঢ় করে তোলে। এখানেই “অহং”-এর গঠন ঘটে। উপাদানই দুঃখের দৃঢ় ভিত্তি—যতক্ষণ পর্যন্ত কিছু আঁকড়ে ধরা আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত মুক্তি অসম্ভব।
১০. ভাব (Bhava—Becoming): উপাদান থেকে জন্ম নেয় ভাব—অর্থাৎ অস্তিত্বের প্রবাহ বা “হওয়া”-র শক্তি। এটি কর্মের দ্বারা সৃষ্ট সেই ধারাবাহিকতা, যা ভবিষ্যৎ জন্মের কারণ। ভাবই পুনর্জন্মের মানসিক বীজ; এখানেই “কর্মফল”-এর কার্য-কারণতত্ত্ব কাজ করে। অস্তিত্বের ইচ্ছাই নতুন অস্তিত্বের জন্ম দেয়।
১১. জাতি (Jāti—Birth): ভাবের ফলেই ঘটে জাতি—অর্থাৎ জন্ম। এটি শুধু শারীরিক জন্ম নয়; প্রতিটি মুহূর্তে মন নতুনভাবে জন্ম নেয়, প্রতিটি আসক্তি নতুনভাবে আমাদের অস্তিত্ব নির্মাণ করে। এই “জন্ম” এক অন্তহীন প্রক্রিয়া—যতক্ষণ তৃষ্ণা ও উপাদান অবশিষ্ট থাকে।
১২. জরা-মরণ (Jarā-Maraṇa—Decay and Death): জন্মের পর অনিবার্যভাবে আসে জরা (বৃদ্ধি) ও মরণ (মৃত্যু)—এবং এর সঙ্গে সঙ্গে আসে শোক, দুঃখ, ব্যথা, বিলাপ, হতাশা। এইভাবেই সংসারের চক্র সম্পূর্ণ হয়—অবিদ্যা থেকে শুরু হয়ে মৃত্যুতে গিয়ে আবার নতুন অবিদ্যায় ফিরে আসে।
মুক্তির পথ: প্রতীত্যসমুত্পাদের বিপরীত প্রবাহ, যেমন এই কারণশৃঙ্খলা দুঃখের সৃষ্টি করে, তেমনি এর বিপরীত প্রবাহই মুক্তির পথ। যদি অবিদ্যা দূর হয়—সংস্কার বিলুপ্ত হয়—বিজ্ঞান শান্ত হয়—নামরূপ ক্ষয় হয়—ষড়ায়তন, স্পর্শ, বেদনা, তৃষ্ণা, উপাদান, ভাব, জাতি, জরা-মরণ—সবই একে একে লুপ্ত হয়। এই প্রক্রিয়ার নামই নির্বাণ—অর্থাৎ, “নির্ভর-উৎপত্তির শৃঙ্খলা ছিন্ন হওয়া”, যেখানে আর কিছু শর্তসাপেক্ষে উদ্ভূত হয় না।
প্রতীত্যসমুত্পাদ আসলে এক জীবন্ত জ্ঞানের বৃত্ত: অবিদ্যা দুঃখের কারণ, কিন্তু সেই বোধই মুক্তির দরজা। যে জানে, সব কিছু পরস্পরনির্ভর ও অনিত্য, সে আর কিছু আঁকড়ে থাকে না—তখন তৃষ্ণা মরে যায়, অহং বিলীন হয়, আর মন স্থির হয় শূন্যতার নিস্তরঙ্গ শান্তিতে। বুদ্ধ “প্রতীত্যসমুত্পাদ”-কে প্রায়ই বারোটি নিদান (dvādaśa-nidāna) বা কারণ-শৃঙ্খলার আকারে ব্যাখ্যা করেছেন, যা দুঃখের উৎপত্তি ও নিবারণের প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করে। তিনি এই উপলব্ধিকেই বলেছিলেন—“যে প্রতীত্যসমুত্পাদ দেখে, সে ধর্ম দেখে; আর যে ধর্ম দেখে, সে বুদ্ধকেই দেখে।” এই কারণচক্র দেখায়—দুঃখ কোনো বাহ্যিক শাস্তি নয়; এটি অজ্ঞতা থেকে উৎপন্ন এক অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়া, যা পরস্পর নির্ভরতার মাধ্যমে গঠিত।
দার্শনিক তাৎপর্য:
১. অনাত্মবাদ (No-Self Doctrine): বুদ্ধের শিক্ষা—কোনো চিরন্তন আত্মা নেই। আমরা প্রতিদিন “আমি”, “আমার”, “আমাকে” ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করি, যেন আমাদের ভেতরে এক স্থায়ী কেন্দ্র আছে, যে দেখে, জানে, সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু প্রতীত্যসমুত্পাদের আলোকে দেখা যায়—এই তথাকথিত “আমি” আসলে একটানা প্রবাহিত সম্পর্কের ফলাফল, যেখানে মন, দেহ, অনুভূতি, চিন্তা, স্মৃতি ও চেতনা—সব একে অপরের ওপর নির্ভর করে কাজ করে। অর্থাৎ, “আমি” কোনো স্থায়ী সত্তা নয়; এটি একটি অভ্যাসগত সংযোজন (habitual aggregation)—যাকে বুদ্ধ pañcaskandha (পঞ্চস্কন্ধ) বা “পাঁচ উপাদান”-এর সমষ্টি বলেছেন।
এই অনাত্মবোধ মানে আত্মাকে অস্বীকার করা নয়, বরং বোঝা যে, আমরা যা “আত্মা” বলে জানি, তা আসলে শর্তসাপেক্ষ জটিল প্রক্রিয়া, যার কোনো স্থায়ী বা স্বতন্ত্র “স্বরূপ” নেই। এখানে “আমি”-বোধের পরিবর্তে দেখা যায়—এক নিরবচ্ছিন্ন, নন-সেন্ট্রিক প্রবাহ, যা নিজের মধ্যে থেকেই প্রতি মুহূর্তে উদ্ভূত ও বিলীন হয়। এই উপলব্ধিই অহং-এর অবসান এবং মুক্তির সূচনা।
পঞ্চস্কন্ধ (Pañcaskandha) বা পাঁচ স্কন্ধ বৌদ্ধ দর্শনের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। এটি মানুষ বা “ব্যক্তি” (pudgala)-র প্রকৃত গঠন বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। বুদ্ধ বলেছেন—আমরা যা “আমি”, “আমার”, “নিজস্ব সত্তা” বলে জানি, তা আসলে কোনো চিরস্থায়ী আত্মা নয়; বরং পাঁচটি পরিবর্তনশীল উপাদানের সমষ্টি, যেগুলো একসঙ্গে মিলে “অহং”-এর ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করে।
“পুদ্গল” (Pudgala) বা “ব্যক্তি” ধারণাটি বৌদ্ধ দর্শনের একটি সূক্ষ্ম এবং প্রায়শই বিতর্কিত ধারণা, বিশেষ করে অনাত্মবাদ (no-self doctrine) বোঝার ক্ষেত্রে। “পুদ্গল” (Pudgala) শব্দটি সংস্কৃত “পুৎ” (শুদ্ধ করা) এবং “গল” (গ্রহণ করা) ধাতু থেকে এসেছে, অর্থাৎ “যে গ্রহণ করে এবং পরিশুদ্ধ হয়” কিংবা “ব্যক্তি বা ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার ধারক”। বৌদ্ধ দর্শনে “পুদ্গল” বলতে বোঝায়—একটি আপাত বা নামমাত্র “ব্যক্তি”, যাঁকে কর্ম (কর্মফল), পুনর্জন্ম, ও অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতার ধারক বলে মনে হয়, কিন্তু যিনি আসলে কোনো চিরস্থায়ী আত্মা নন।
অনাত্মবাদের প্রেক্ষাপটে পুদ্গল: বুদ্ধ স্পষ্টভাবে বলেছেন—“আত্মা (ātman)” বলে কোনো চিরন্তন সত্তা নেই। তবে তিনি কখনও বলেননি যে, “ব্যক্তি নেই”। তিনি শুধু বলেন—“ব্যক্তি” (পুদ্গল) স্বতন্ত্র আত্মা নয়, বরং পঞ্চস্কন্ধের এক সাময়িক সমন্বয়। অর্থাৎ—পুদ্গল আত্মা নয়, বরং পঞ্চস্কন্ধের পারস্পরিক নির্ভরতার সমষ্টিগত প্রকাশ। যেমন একটি রথ চাকা, অক্ষ, চৌকাঠ, দণ্ড ইত্যাদি অংশের সমষ্টি; তেমনি “ব্যক্তি” হলো মন, দেহ, চেতনা, অনুভূতি ইত্যাদির সাময়িক সংযোগ। অংশগুলো নেই তো রথ নেই; অংশগুলো বদলে গেলে রথ বদলে যায়। এই উপমা থেকেই বোঝা যায়—“ব্যক্তি” বা “পুদ্গল” কোনো স্থির সত্তা নয়, বরং শর্তসাপেক্ষ ক্রিয়ার প্রক্ষেপণ।