অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: পঞ্চান্ন



মাধ্যমক বৌদ্ধধর্মে দ্বি-সত্য তত্ত্ব: মাধ্যমক দর্শন বাস্তবতার দুটি দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করে—সাংবৃত সত্য (Saṃvṛti-satya) এবং পরমার্থ সত্য (Paramārtha-satya)।

সাংবৃত সত্য হলো দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার জগৎ—যেখানে বস্তু, ব্যক্তি, কর্ম ও সম্পর্ক বিদ্যমান বলে মনে হয়। এটি সমাজিক, ভাষাগত ও মানসিক চুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত—অর্থাৎ, আমরা “বস্তু” ও “আমি”-এর ধারণা নিয়ে কাজ করি, যদিও এগুলির কোনো স্বতঃসিদ্ধ সারসত্তা নেই।

পরমার্থ সত্য হলো সেই উপলব্ধি, যেখানে দেখা যায় যে, সব সত্তাই অ-সারসত্তা (niḥsvabhāva)—কোনো কিছু নিজের মধ্যে স্বতন্ত্রভাবে বিদ্যমান নয়। এই উপলব্ধি অর্জনের পর সাংবৃত সত্যের বিভ্রান্তি বিলীন হয়, এবং মন স্থিত হয় শূন্যতার নিস্তরঙ্গ শান্তিতে।

ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে নাগার্জুন এমন এক দার্শনিক, যিনি “শূন্যতা” শব্দটিকে একেবারে নতুন আলোয় উন্মোচন করেন। তাঁর চিন্তায় শূন্যতা কোনো নৈরাশ্যবাদ বা নাস্তিত্ব নয়; বরং এটি এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে দ্বন্দ্ব, চরমপন্থা ও ধারণার সব সীমা অতিক্রম করে সত্যকে মধ্যপথে উপলব্ধ করা যায়। বুদ্ধের প্রতীত্যসমুত্পাদ তত্ত্বেরই নাগার্জুন ব্যাখ্যা করেন গভীরভাবে—দেখান, সব কিছুই নির্ভরশীল, সম্পর্ক-নির্ভর, এবং তাই নিজের মধ্যে কোনো স্বতঃসিদ্ধ সারবত্তা বহন করে না। এই “স্বভাব-শূন্যতা”-র উপলব্ধিই তাঁর “মধ্যমা প্রতিপদ” বা মধ্যপথের দর্শন।

শূন্যতা ও নৈরাশ্যবাদের ভুল ব্যাখ্যা: অনেকে মনে করেন নাগার্জুন “সব কিছু শূন্য” বলেছেন মানেই তিনি অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্য কখনও এমন ছিল না। তিনি বলেন, যে “শূন্যতা” বুঝতে পারে না, সে সেটিকেই “অস্তিত্বহীনতা” মনে করে; যে শূন্যতাকে অস্বীকার করে, সে বাস্তবকেও বিকৃত করে ফেলে। অতএব, শূন্যতা মানে “কিছু নেই” নয়; বরং মানে হলো—“কিছুই নিজের দ্বারা নেই।” এই দৃষ্টিতে শূন্যতা হলো নির্ভরতার নীতি, যেখানে প্রতিটি সত্তা অন্য কিছুর সঙ্গে সম্পর্কেই বিদ্যমান।

দুই সত্য—সাংবৃত ও পরমার্থ: নাগার্জুন সত্যকে দুটি স্তরে ব্যাখ্যা করেন—
(ক) সাংবৃত সত্য (Saṃvṛti-satya)—প্রচলিত, আপেক্ষিক, পার্থিব সত্য; এখানে আমরা ভাষা, চিন্তা, সম্পর্ক ও কার্যকারণ ব্যবহার করি।
(খ) পরমার্থ সত্য (Paramārtha-satya)—চূড়ান্ত সত্য, যা সমস্ত ধারণা ও সীমার অতীত।

তিনি বলেন—যে সাংবৃত সত্যকে পুরোপুরি অস্বীকার করে, সে ভ্রান্ত; কারণ আমাদের দৈনন্দিন জীবন এই স্তরের মধ্য দিয়েই চলে। কিন্তু যে সাংবৃত সত্যকেই পরম সত্য মনে করে, সে-ও ভ্রান্ত; কারণ এই স্তরের সমস্ত ধারণাই পরিবর্তনশীল ও আপেক্ষিক। সত্যকে বুঝতে হলে এই দুই স্তরের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে হয়—যেখানে আপেক্ষিকের ভেতর দিয়েই চূড়ান্ত ধরা দেয়।

মধ্যপথের মর্মার্থ: নাগার্জুন এই সমন্বয়ের পথকেই বলেন “মধ্যমা প্রতিপদ” (Madhyamā-pratipad)—অর্থাৎ দুই চরমপন্থার অতিক্রম। তিনি বলেন, এক প্রান্তে আছে অস্তিত্ববাদ (Everything is real), অন্য প্রান্তে আছে নাস্তিত্ববাদ (Nothing is real)। কিন্তু উভয়ই অসম্পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। সত্য কখনও “শুধু আছে” নয়, আবার “কিছুই নেই”, তা-ও নয়; সত্য হলো সম্পর্কের মধ্য দিয়ে নিরন্তর গতি, যা ধারণার সীমা ছাড়িয়ে নিজের মধ্যে উন্মুক্ত থাকে। এই দৃষ্টিতেই শূন্যতা হলো মধ্যপথ—না চরম অস্তিত্ব, না চরম অনস্তিত্ব; বরং এমন এক চেতনা, যা এ দুইয়েরও অতীত।

শূন্যতা ও প্রতীত্যসমুত্পাদ: নাগার্জুন শূন্যতাকে প্রতীত্যসমুত্পাদেরই অন্যরূপ বলে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি—“যা নির্ভর করে উৎপন্ন হয়, তাকেই আমরা শূন্য বলি; এই নির্ভরতার মধ্যেই মধ্যপথ নিহিত।” অর্থাৎ, যেহেতু সব কিছু পারস্পরিক নির্ভরশীল, তাই কোনো কিছুই নিজের দ্বারা স্বাধীনভাবে বিদ্যমান নয়। এই স্বতঃসিদ্ধতার অভাবই “শূন্যতা”—এবং সেই অভাবই সমস্ত অস্তিত্বকে এক পরম ঐক্যে যুক্ত করে।

চিন্তা ও ভাষার সীমা অতিক্রম: নাগার্জুনের দৃষ্টিতে, চিন্তা ও ভাষা সবসময় দ্বৈত—“এই না সেই”, “আছে না নেই”; কিন্তু সত্য এই দ্বৈততার অতীত। তিনি বলেন, “যেখানে চিন্তার গতি থেমে যায়, সেখানেই নির্বাণ।” অর্থাৎ, বোধ তখনই জন্মায়, যখন মন সমস্ত ধারণা, বিচার ও পার্থক্য থেকে মুক্ত হয়। এই মুক্ত চেতনা-অবস্থা-ই শূন্যতার প্রত্যক্ষ উপলব্ধি।

শূন্যতা ও করুণা—অস্তিত্বের ইতিবাচক অর্থ: শূন্যতা কোনো শীতল নৈরাশ্য নয়; এটি এক গভীর সহানুভূতির দৃষ্টিভঙ্গি (Karunā) জন্ম দেয়। যে বোঝে, সবই সম্পর্কনির্ভর, সে আর “আমি” ও “অন্য”-এর বিভাজনে আবদ্ধ থাকে না। ফলে তার মধ্যে স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেয় করুণা, সহমর্মিতা ও নৈতিক সাম্য। এইভাবে শূন্যতা কেবল দর্শন নয়, এটি এক জীবনপথ (way of being)—যেখানে জ্ঞান ও করুণা একীভূত হয়।

নাগার্জুনের শূন্যতা ও মধ্যপথের দর্শন আমাদের শেখায়—সত্য কোনো স্থির বিন্দু নয়, বরং এক নিরন্তর ভারসাম্য, এক সম্পর্কের গভীর অনন্ততা। যে সাংবৃত সত্যে বাঁচে, সে বাস্তবকে জানে; যে পরমার্থে স্থিত হয়, সে সত্যকে উপলব্ধি করে; কিন্তু যে উভয়কে একসঙ্গে দেখতে পারে, সে-ই মধ্যপথে পৌঁছে যায়—যেখানে সব দ্বন্দ্ব নিঃশেষ, সব প্রশ্ন নিঃশব্দ, এবং বাকি থাকে কেবল নীরব জ্ঞানের আলোকিত শান্তি।

তুলনামূলক বিশ্লেষণ:

অদ্বৈতের বাধ ও মাধ্যমকের দ্বি-সত্য তত্ত্ব—উভয়েই মানবচেতনার স্তরবিন্যাস ব্যাখ্যা করে, কিন্তু তাদের দার্শনিক উদ্দেশ্য ভিন্ন। অদ্বৈতের বাধ এক ঐক্যের দিকে গতি—জগত ও আত্মাকে ব্রহ্মে একীভূত করার প্রক্রিয়া। মাধ্যমকের দ্বি-সত্য এক শূন্যতার দিকে অন্তর্দৃষ্টি—সব সত্তাকে তাদের স্বতঃসিদ্ধতার অভাবে বিলীন করা।

অদ্বৈতে, প্রাত্যক্ষিক সত্য মিথ্যা নয়, বরং অসম্পূর্ণ; তাকে পরমার্থিক জ্ঞান দ্বারা অতিক্রম করতে হয়। মাধ্যমকে, সাংবৃত সত্য ভ্রান্ত নয়, বরং আপেক্ষিক; তাকে পরমার্থিক অন্তর্দৃষ্টির আলোয় অনির্দিষ্ট বলে বোঝা হয়।

অদ্বৈত শেষপর্যন্ত একটি ধনাত্মক সত্যে (ব্রহ্ম) পৌঁছায়—“অস্তিত্বই বাস্তব।” মাধ্যমক শেষপর্যন্ত সমস্ত ধারণাকে অতিক্রম করে—“অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব দুটোই আপাত।”

অদ্বৈতের বাধ ও মাধ্যমকের দ্বি-সত্য তত্ত্ব একই লক্ষ্যপথের দুটি ভিন্ন পদ্ধতি। একজন আপাত বাস্তবতাকে অতিক্রম করে একত্বে পৌঁছায়, অন্যজন আপাত সত্যের নির্ভরতাকে উদ্ঘাটন করে শূন্যতায় স্থিত হয়। অদ্বৈতের চূড়ান্ত উপলব্ধি—“সবই ব্রহ্ম।” মাধ্যমকের চূড়ান্ত উপলব্ধি—“সবই শূন্য।” কিন্তু উভয় পথেই চেতনা মুক্ত হয় ধারণা, দ্বৈততা ও সীমাবদ্ধতার বন্ধন থেকে। শেষপর্যন্ত যে-অবস্থায় পৌঁছানো যায়, তা বর্ণনাতীত, কারণ সেখানে ভাষা, চিন্তা ও যুক্তি—সব থেমে যায়। শুধু থেকে যায় এক নিস্তরঙ্গ, অনির্বচনীয় উপস্থিতি—যেখানে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের কোনো পার্থক্য নেই, শুধু নিঃশব্দ সত্য বিরাজমান।

মুক্তির প্রকৃতি ও অভিজ্ঞতার অন্তিম রূপ—ব্রহ্মনিষ্ঠা বনাম নির্বাণ:

অদ্বৈত বেদান্ত ও মাধ্যমক বৌদ্ধধর্ম উভয়েই মানবচেতনার চূড়ান্ত পরিণতি বা মুক্তির অবস্থাকে কেন্দ্র করে দার্শনিক অনুসন্ধান চালিয়েছে। দু-জনেরই লক্ষ্য—জন্ম, মৃত্যু, দুঃখ ও অজ্ঞতার চক্র থেকে মুক্তি। কিন্তু তারা মুক্তির প্রকৃতি, অভিজ্ঞতা এবং চেতনার চূড়ান্ত অবস্থাকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে। অদ্বৈতের মুক্তি ব্রহ্মনিষ্ঠা—চৈতন্যে প্রতিষ্ঠা; মাধ্যমকের মুক্তি নির্বাণ—শূন্যতার নিস্তরঙ্গ শান্তি।

অদ্বৈত বেদান্তে মুক্তি—ব্রহ্মনিষ্ঠা ও আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠা; অদ্বৈত মতে, মুক্তি কোনো ভবিষ্যৎ অর্জন নয়, বরং এক উপলব্ধি—নিজের প্রকৃত স্বরূপকে চেনা। মুক্তি (মোক্ষ) মানে অবিদ্যার অবসান, অর্থাৎ, সেই অজ্ঞতা দূর হওয়া, যা আত্মাকে ব্রহ্ম থেকে পৃথক বলে মনে করায়। যখন এই অবিদ্যা দূর হয়, তখন চেতনা উপলব্ধি করে—“আমি শরীর বা মন নই, আমি সেই চৈতন্য, যা সব কিছুর সাক্ষী।” এই অবস্থাই ব্রহ্মনিষ্ঠা—যেখানে ব্যক্তি-চেতনা ব্রহ্মচেতনায় অবিচ্ছিন্নভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকে। এটি কোনো অভিজ্ঞতার বিষয় নয়; বরং অভিজ্ঞতার অন্তরালের মৌলিক অবস্থান। এই অবস্থায় “আমি”, “তুমি”, “এই”, “ওই”—সব সীমারেখা মুছে যায়। চেতনা আর কোনো বস্তুকে আলাদা করে দেখে না, কারণ জানা, জানন, ও জাননীয়—এই তিনের পার্থক্যই অবিদ্যা থেকে উদ্ভূত। এখানে জ্ঞানের অর্থ হলো চেতনার নিজের মধ্যেই নিজের প্রকাশ।

শঙ্করাচার্য বলেন, “যিনি জানেন, ‘আমি ব্রহ্ম’, তাঁর জন্য জগৎ আর কোনো বন্ধন নয়; তিনি সর্বত্র নিজেকে দেখেন এবং আনন্দেই প্রতিষ্ঠিত থাকেন।” এই অবস্থায় চেতনা নিস্তরঙ্গ, কিন্তু নিস্তব্ধ নয়—এটি পরম অস্তিত্ব, জ্ঞানের পরিপূর্ণ আলো, এবং আনন্দের অখণ্ড স্রোত। তাই ব্রহ্মনিষ্ঠা মানে নিষ্ক্রিয় শূন্যতা নয়; বরং চেতনার পূর্ণতা—যেখানে আর কোনো অভাব, আকাঙ্ক্ষা, বা ভয় থাকে না।

মাধ্যমক বৌদ্ধধর্মে মুক্তি—নির্বাণ ও শূন্যতার প্রশান্তি: মাধ্যমক মতে, মুক্তি মানে কোনো চিরন্তন সত্তায় প্রতিষ্ঠা নয়, বরং সব সত্তার অনস্তিত্বে শান্তি—অর্থাৎ নির্বাণ। নির্বাণ মানে নিছক বিলুপ্তি নয়; এটি এক অন্তর্দৃষ্টি, যেখানে সমস্ত ধারণাগত দ্বৈততা—অস্তিত্ব/অনস্তিত্ব, সুখ/দুঃখ, আত্ম/অন্য—সম্পূর্ণরূপে বিলীন। এখানে চেতনা কোনো নির্দিষ্ট কেন্দ্র বা বিষয়কে ধারণ করে না; কারণ “আমি” ও “জগৎ” উভয়ই অনাত্মক, সম্পর্কনির্ভর প্রতীতি।

নাগার্জুন নির্বাণকে সংজ্ঞায়িত করেন—“নির্বাণ ও সংসার একই; পার্থক্য কেবল অজ্ঞতায়।” অর্থাৎ, যখন কেউ জগৎকে স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলে ধরে, তখন সে সংসারে আবদ্ধ। কিন্তু যখন সে বোঝে—সব কিছুই নির্ভরশীল ও অস্থায়ী—তখনই মুক্তি। নির্বাণ কোনো “অস্তিত্ব” নয়, আবার “নাস্তিত্ব”ও নয়; এটি এমন এক নিস্তরঙ্গ অবস্থা, যেখানে সমস্ত ধারণার গতি থেমে যায়, কিন্তু সচেতনতা মুছে যায় না—বরং তা স্বচ্ছ, নির্জন ও অনাবদ্ধ রূপে জেগে থাকে। অর্থাৎ, নির্বাণ এক নির্ভার শূন্যতা—যেখানে চেতনা কোনো কিছু ধারণ করে না, আবার নিজেও কোনো ধারণের অংশ হয় না। এটি চেতনার স্বাভাবিক প্রশান্তি—যেখানে বেঁচে থাকা মানেই অতিক্রম করা।

অদ্বৈতের ব্রহ্মনিষ্ঠা ও মাধ্যমকের নির্বাণ—উভয়ই মুক্তির চূড়ান্ত রূপ, কিন্তু তাদের গন্তব্যের প্রকৃতি ভিন্ন। অদ্বৈতের মুক্তি হলো অস্তিত্বে স্থিতি—চেতনার স্বরূপে নিজের অনন্ত পরিচয় উপলব্ধি করা। মাধ্যমকের মুক্তি হলো অ-অস্তিত্বে প্রশান্তি—সব ধারণা ও নির্ভরতার বিলোপে শান্তিতে স্থিত হওয়া।

অদ্বৈত বলে, মুক্তি হ্যাঁ-বোধক—“আমি ব্রহ্ম।” মাধ্যমক বলে, মুক্তি কোনো নৈরাশ্যবাদের পরিণতি নয়, কিন্তু না-বোধক বোধের মাধ্যমে উপলব্ধ—“আমি কিছুই নই।”

অদ্বৈতের পরম সত্য চেতনা নিজেই, আর মাধ্যমকের পরম সত্য হলো চেতনার শূন্যতা—যেখানে কোনো “নিজ” নেই, কিন্তু নিঃসীম স্বচ্ছতা আছে।

তবে উভয়েরই লক্ষ্য এক: বন্ধন থেকে মুক্তি, দ্বৈততার অন্ত এবং এমন এক নীরব অভিজ্ঞতা, যেখানে ভাষা ও ভাবনা থেমে যায়।

অদ্বৈতের ব্রহ্মনিষ্ঠা এবং মাধ্যমকের নির্বাণ—দুটি আলাদা ভাষা, কিন্তু একই দিকনির্দেশ। অদ্বৈত বলে, সত্য চেতনায় স্থিত হও; মাধ্যমক বলে, চেতনার সব ধারণা থেকে মুক্ত হও। একপথ বলে, “আমি চিরন্তন”, অন্যপথ বলে, “চিরন্তন বলে কিছুই নেই।” কিন্তু দু-পথই শেষপর্যন্ত মানুষকে শেখায়—মুক্তি কোনো স্থান নয়, কোনো সত্তা নয়, কোনো সময়ও নয়; এটি এক চেতনার নীরব প্রসার, যেখানে না ‘জানা’ থাকে, না থাকে ‘জানার প্রয়োজন’—শুধু এক স্বতঃসিদ্ধ, নিঃশব্দ শান্তি বিরাজ করে।

চূড়ান্ত ঐক্য ও নিস্তরঙ্গতার দর্শন—ব্রহ্মানন্দ বনাম শূন্যতার আনন্দ: অদ্বৈত বেদান্ত ও মাধ্যমক বৌদ্ধধর্ম উভয়েই মানবচেতনার অন্তিম সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলে—কিন্তু তাদের ভাষা, দৃষ্টিকোণ ও অভিজ্ঞতার প্রকৃতি একেবারেই ভিন্ন। অদ্বৈত যেখানে পরম আনন্দ বা ব্রহ্মানন্দ-এর মাধ্যমে মুক্তির অবস্থাকে বর্ণনা করে, মাধ্যমক সেখানে পরম শান্তি বা শূন্যতার আনন্দহীন আনন্দ—অর্থাৎ নিস্তরঙ্গ প্রশান্তি—রূপে চূড়ান্ত অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করে। তবুও, উভয় দর্শনের লক্ষ্য একই—এমন এক অবস্থা, যেখানে সমস্ত দ্বৈততা, বোধ, ও ভাষা বিলীন হয়ে যায়।