অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: পঞ্চাশ




ফল: এটি জন্ম-মৃত্যুর চক্র (সংসার) থেকে চূড়ান্ত এবং চিরস্থায়ী পরিত্রাণ। মুক্ত আত্মা ব্রহ্মের সাথে একীভূত হয় এবং আর কখনো কোনো জাগতিক অভিজ্ঞতা বা কষ্টের সম্মুখীন হয় না।


জীবন্মুক্তি হলো এই জীবনে মোক্ষের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি। বিদেহ মুক্তি হলো দেহপতনের পর জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে চূড়ান্ত এবং চিরস্থায়ী বিলুপ্তি। একজন ব্যক্তি প্রথমে জীবন্মুক্তি লাভ করেন, এবং সেই জীবন শেষ হলে বিদেহ মুক্তি লাভ করেন—এটাই হলো অদ্বৈত বেদান্তের মতে মুক্তির প্রক্রিয়া।


জীবন্মুক্তি এবং বিদেহ মুক্তির ধারণাটি মূলত অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের সাথে সম্পর্কিত। এই মতবাদ অনুসারে, কেবল জীবন্মুক্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রেই বিদেহ মুক্তির ধারণাটি প্রযোজ্য। যে-ব্যক্তি জীবন্মুক্ত হননি, অর্থাৎ একজন সাধারণ মানুষ, তিনি মারা গেলে বিদেহ মুক্তি লাভ করেন না, বরং পুনরায় জন্ম-মৃত্যুর চক্রে (সংসার) ফিরে যান। এটি কেন হয়, তার ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো:


মুক্তির পূর্বশর্ত: জ্ঞান (ব্রহ্মজ্ঞান)। বেদান্ত অনুসারে, মুক্তির একমাত্র কারণ হলো জ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান। জ্ঞান ছাড়া কোনোভাবেই চূড়ান্ত মুক্তি সম্ভব নয়। আর জীবন্মুক্তি হলো সেই অবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তি জীবিত অবস্থাতেই এই জ্ঞান লাভ করেছেন—অর্থাৎ, তিনি বুঝেছেন যে, তিনি ব্রহ্মের থেকে অভিন্ন ("অহম ব্রহ্মাস্মি")। জ্ঞানলাভের এই ঘটনাই হলো জীবন্মুক্তি। এটি বন্ধন মুক্তির চাবিকাঠি। এই জ্ঞান লাভ করার অর্থ হলো, তাঁর অজ্ঞানতা (অবিদ্যা) এবং সঞ্চিত কর্মের বন্ধন চিরতরে কেটে গেছে। তাঁর শরীরে কেবল সেইটুকু কর্মফলই বাকি আছে, যা এই জীবনকে ধরে রেখেছে (প্রারব্ধ কর্ম)।


জীবন্মুক্তিহীন ব্যক্তির পরিণতি: যে-ব্যক্তি জীবন্মুক্ত নন, তিনি মারা গেলে—
অজ্ঞানতা (অবিদ্যা) বিদ্যমান: যেহেতু তিনি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেননি, তাঁর মধ্যে মুক্তির পথে প্রধান বাধা ‘অজ্ঞানতা’ থেকেই যায়।
কর্মফল বিদ্যমান: তাঁর সঞ্চিত কর্মের বিশাল ভাণ্ডার অক্ষত থাকে।
পুনর্জন্ম: এই অবশিষ্ট কর্মফল এবং অজ্ঞানতার কারণেই আত্মা দেহত্যাগের পর ব্রহ্মে লীন হতে পারে না। বরং, সে সেই কর্মফল ভোগের জন্য পুনরায় জন্ম (সংসারচক্রে) গ্রহণ করে। এই ব্যক্তিকে বিদেহ মুক্তিপ্রাপ্ত বলা যায় না।


বিদেহ মুক্তির অর্থ: বিদেহ মুক্তি হলো জীবন্মুক্তির স্বাভাবিক এবং অনিবার্য পরিণতি। যখন একজন জীবন্মুক্ত ব্যক্তি শরীর ত্যাগ করেন, তখন তাঁর আর কোনো সঞ্চিত কর্ম বা অজ্ঞানতা থাকে না, যা তাঁকে আবার জন্ম নিতে বাধ্য করবে। শরীরের পতনের সাথে সাথে তাঁর প্রারব্ধ কর্মও শেষ হয়ে যায়। ফলস্বরূপ, আত্মা আর কোনো দেহ গ্রহণ না করে ব্রহ্মে বিলীন হয়ে যায়। এই অবস্থাই হলো বিদেহ মুক্তি। সুতরাং, জীবন্মুক্তি হলো মুক্তির টিকিট, আর বিদেহ মুক্তি হলো সেই টিকিটে গন্তব্যে পৌঁছানো। টিকিট ছাড়া গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়।


জীবন্মুক্তি হলো জ্ঞানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে ঘটে যাওয়া মুক্তি। বিদেহমুক্তি হলো সেই জ্ঞানীর দেহত্যাগের পর সম্পূর্ণ ব্রহ্মলয়। অজ্ঞান ব্যক্তি জীবন্মুক্ত না হলে, মৃত্যুতেও মুক্তি পান না; তাঁকে পুনর্জন্ম নিতে হয়। সব বিদেহমুক্ত ব্যক্তি জীবন্মুক্ত ছিলেন, কিন্তু সব মৃত ব্যক্তি বিদেহমুক্ত হন না। মুক্তি আসে জ্ঞানে, মৃত্যুতে নয়।


মিথ্যাত্বের বিশ্লেষণ ব্রহ্মণের পরম বাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠা করে। জ্ঞানের উদয় অজ্ঞানতা ও দুঃখের শিকড় উপড়ে ফেলে। আত্মা ও ব্রহ্মণের ঐক্য উপলব্ধি মুক্তি প্রদান করে। অতএব, জ্ঞানের সমাপ্তি মানেই মুক্তি—জানার সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়া যায় যা চিরকাল ছিল—নিজেরই ব্রহ্মস্বরূপ। মিথ্যাত্বের উপলব্ধি জ্ঞানের দ্বার খোলে, আর ব্রহ্মজ্ঞান সেই দরজা দিয়ে নিয়ে যায় চিরন্তন মুক্তির আলোয়—যেখানে আর ভেদ নেই, ভয় নেই, বেঁধে রাখার কিছুই নেই।

মিথ্যাত্ব মতবাদ অদ্বৈত বেদান্তে ব্রহ্মণ ও জগতের মধ্যে এক অপরিহার্য সেতু। এটি বলে, জগৎ না পুরোপুরি সত্য, না পুরোপুরি মিথ্যা—বরং অনির্বচনীয় (anirvacanīya), অর্থাৎ শর্তসাপেক্ষভাবে বাস্তব। এই তত্ত্ব যুক্তি (anumāna) ও মহাজাগতিক অধ্যাস (adhyāsa)-এর মাধ্যমে প্রমাণ করে যে, ব্রহ্মণ ছাড়া অন্য সব কিছুই নির্ভরশীল ও তাই চূড়ান্তভাবে অবাস্তব (mithyā)। মিথ্যাত্বকে বোঝা ও উপলব্ধি করা মুক্তি (moksha)-র জন্য প্রয়োজনীয়, কারণ এটি মানুষকে জগতের আপাত বাস্তবতার আড়ালে থাকা একমাত্র সত্য—ব্রহ্মণ-এর দিকে নিয়ে যায়।

অদ্বৈত বেদান্ত (Advaita Vedānta) এবং মাধ্যমক বৌদ্ধধর্ম (Mādhyamika Buddhism)—ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে দুটি গভীর ও প্রভাবশালী দার্শনিক ঐতিহ্য। উভয় ধারাই এক মহৎ সাধনাগত লক্ষ্যকে সামনে রাখে: জগতের আপাত, শর্তাধীন (conditional) বাস্তবতা অতিক্রম করে চূড়ান্ত সত্যে পৌঁছানো—এবং দুঃখ (duḥkha) থেকে মুক্তি লাভ করা। কিন্তু “চূড়ান্ত সত্য” আসলে কী, এবং কীভাবে তা অর্জিত হয়—এই দুই প্রশ্নে অদ্বৈত বেদান্ত ও মাধ্যমক দর্শন সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে চলে গেছে।

উদ্দেশ্যে মিল, পদ্ধতিতে ভিন্নতা। দুটি দর্শনের লক্ষ্য একই হলেও তাদের পথ সম্পূর্ণ আলাদা। অদ্বৈত বেদান্ত বলে, চূড়ান্ত সত্য একটিই—ব্রহ্ম (Brahman)। এই ব্রহ্ম সর্বব্যাপী, চিরন্তন ও স্বয়ংস্থিত। দৃশ্যমান জগত কেবল তার আপাত প্রকাশ, মায়াময় প্রতিফলন। মানুষ যখন জ্ঞানের মাধ্যমে উপলব্ধি করে যে, তার আত্মা ব্রহ্মন ছাড়া কিছু নয়, তখন সে মুক্তি (moksha) লাভ করে।

অন্যদিকে, মাধ্যমক বৌদ্ধধর্ম, বিশেষ করে নাগার্জুনের দর্শন, একেবারে বিপরীত পথে যায়। এটি বলে, কোনো কিছুরই নিজস্ব বা স্বতন্ত্র সত্তা (svabhāva) নেই। সমস্ত সত্তা পরস্পরের উপর নির্ভরশীল—এই ধারণাই “নির্ভরশীল উদ্‌ভব” (pratītya-samutpāda)। তাই “শূন্যতা” (śūnyatā) হলো চূড়ান্ত সত্য। এর মানে কিছুই স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্বশীল নয়—সবই আপেক্ষিক।

তুলনামূলক দর্শনে প্রায়ই অদ্বৈত বেদান্ত ও মাধ্যমক শূন্যতাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন শঙ্কর (Śaṅkara) ও নাগার্জুন (Nāgārjuna) পরস্পরের সঙ্গে এক গভীর দর্শনীয় সংলাপে যুক্ত হয়েছেন। এই সংলাপ প্রকাশ করে তাঁদের চূড়ান্ত বাস্তবতা সংক্রান্ত ধারণার মৌলিক পার্থক্য—যেখানে উভয়ের লক্ষ্য এক, কিন্তু তাঁদের সত্তা ও সত্যের ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

অদ্বৈত বেদান্ত—একে “সত্তা-ভিত্তিক অদ্বৈতবাদ” বলা যেতে পারে। এটি বিশ্বাস করে, চূড়ান্ত সত্য হলো একটি ইতিবাচক সত্তা—ব্রহ্ম। এই ব্রহ্ম একমাত্র বাস্তব; অন্য সব কিছু তার প্রতিফলন বা নির্ভরশীল প্রকাশ মাত্র। দৃশ্যমান জগৎ সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়, আবার পুরোপুরি সত্যও নয়—এটি অনির্বচনীয় (anirvacanīya), অর্থাৎ সাময়িকভাবে বাস্তব কিন্তু চূড়ান্ত সত্য নয়। মুক্তি আসে এই ব্রহ্মজ্ঞান লাভের মাধ্যমে—যখন আত্মা উপলব্ধি করে “আমি ব্রহ্ম” (Aham Brahmāsmi)।

অন্যদিকে, মাধ্যমক শূন্যতা “অ-সত্তা-ভিত্তিক অদ্বৈতবাদ”-এর পথ নেয়। এটি কোনো একক, স্থায়ী সত্তাকে স্বীকার করে না। শূন্যতা মানে অস্তিত্বহীনতা নয়, বরং সব কিছুর নির্ভরশীল প্রকৃতি। কিছুই নিজে নিজে টিকে থাকে না, সব কিছুই সম্পর্কের মাধ্যমে বিদ্যমান। “শূন্যতা” নিজেও কোনো বস্তু নয়, বরং সমস্ত স্বতন্ত্র ধারণার নাকচ। মুক্তি এখানে আসে প্রজ্ঞা (prajñā)—অর্থাৎ শূন্যতার সত্য উপলব্ধির মাধ্যমে।

অদ্বৈত বেদান্তের পথ হলো জ্ঞান ও স্বীকৃতির পথ। এটি বলে, জগৎ মায়াময় হলেও তার পেছনে একটিই বাস্তব সত্তা আছে—ব্রহ্ম। ব্রহ্মনই চিরন্তন সত্য, যা না সৃষ্টি হয়, না বিলীন হয়। মাধ্যমক দর্শন নেতিকরণের পথ নেয়—এটি একে একে সমস্ত ধারণাগত গঠন ভেঙে দেয়। এটি বলে, কোনো কিছুরই স্বভাবসিদ্ধ সত্তা নেই, তাই চূড়ান্ত সত্য হলো সব কিছুর শূন্যতা।

অদ্বৈত যেখানে বলে “সবই ব্রহ্ম”, মাধ্যমক বলে “সবই শূন্য”—কিন্তু উভয়েই দুঃখ ও মায়ার ঊর্ধ্বে যেতে শেখায়।

অদ্বৈত বেদান্ত চূড়ান্ত বাস্তবতাকে “এক সত্তা”—ব্রহ্ম হিসেবে স্থাপন করে; মাধ্যমক বৌদ্ধধর্ম চূড়ান্ত বাস্তবতাকে “অসত্তা”—শূন্যতা হিসেবে ব্যাখ্যা করে। অদ্বৈত বলে, চূড়ান্ত সত্য আছে—এটি ব্রহ্মন। মাধ্যমক বলে, চূড়ান্ত সত্য বলতে কিছু নেই—সবই নির্ভরশীল, তাই শূন্য। অদ্বৈত মুক্তির পথ দেখায় ব্রহ্মজ্ঞান দ্বারা; মাধ্যমক মুক্তির পথ দেখায় প্রজ্ঞা, অর্থাৎ শূন্যতার উপলব্ধির মাধ্যমে। তবু উভয় দর্শনের মর্ম এক জায়গায় এসে মেলে—দুঃখ, অজ্ঞানতা ও আসক্তি থেকে চূড়ান্ত মুক্তি লাভই তাদের অভিন্ন লক্ষ্য।

সহজ ভাষায়, অদ্বৈত বলে—“সবই ব্রহ্ম, ব্রহ্ম ছাড়া কিছুই নেই।” মাধ্যমক বলে—“সবই শূন্য, কোনো কিছুর নিজস্ব সত্তা নেই।” একটি পথ অস্তিত্বের ঐক্য শেখায়, অন্যটি শেখায় অস্তিত্বের শূন্যতা। কিন্তু উভয়ই মানুষকে শেখায়—বাস্তবের ভেতরে লুকিয়ে-থাকা মায়া চিনে মুক্তি পাওয়া।

বাস্তবতার সত্তাতত্ত্ব—ব্রহ্ম (অস্তিত্ব) বনাম শূন্যতা (অ-সারসত্তা): অদ্বৈত বেদান্ত ও মাধ্যমক বৌদ্ধ দর্শনের মধ্যে সবচেয়ে গভীর দার্শনিক পার্থক্য নিহিত রয়েছে বাস্তবতার স্বরূপ সম্পর্কিত তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। উভয়ই মানবচেতনা ও অভিজ্ঞতার সীমা অতিক্রম করে চূড়ান্ত সত্য অন্বেষণ করে, কিন্তু তাদের নির্ণয় সম্পূর্ণ বিপরীত পথে পৌঁছায়—একজন চূড়ান্ত অস্তিত্বে, অন্যজন অস্তিত্বের অনস্তিত্বে।

অদ্বৈত বেদান্ত—চূড়ান্ত বাস্তবতা হিসাবে ব্রহ্ম: অদ্বৈত বেদান্তের মূলভিত্তি হলো অদ্বৈত, অর্থাৎ একত্ব বা অখণ্ড সত্যের ধারণা। এর মতে, একটিই মাত্র চূড়ান্ত বাস্তবতা আছে, যা ব্রহ্ম নামে পরিচিত। এই ব্রহ্মই সব কিছুর মূল, সব জ্ঞানের উৎস এবং সব অস্তিত্বের ভিত্তি। ব্রহ্মকে শাশ্বত, অপরিবর্তনীয়, এবং অদ্বিতীয় বলা হয়। এটি স্থান, কাল ও কার্য-কারণতার বাইরে—অর্থাৎ কোনো প্রাকৃতিক নিয়ম, পরিবর্তন বা সীমাবদ্ধতার অধীন নয়। ব্রহ্ম নিজে চৈতন্যরূপ—এটি কোনো বস্তুর মতো জানা যায় না, কারণ জানার প্রক্রিয়াই এর মধ্যে নিহিত। এটি সেই আলোক, যার দ্বারা সব কিছু প্রকাশিত হয়, কিন্তু যা নিজে কোনো কিছুর দ্বারা আলোকিত নয়।

ব্রহ্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে অদ্বৈত দর্শন তিনটি মৌলিক গুণ বা পরিচয় ব্যবহার করে: সৎ, চিৎ, আনন্দ:
সৎ অর্থ চিরন্তন অস্তিত্ব—যা কখনও ধ্বংস হয় না।
চিৎ অর্থ বিশুদ্ধ চেতনা—যা সর্বপ্রকার অভিজ্ঞতার উৎস।
আনন্দ অর্থ পরম শান্তি ও পরিতৃপ্তি—যা অবিভাজ্য চৈতন্যের অন্তর্লীন রূপ।

শঙ্করাচার্যের মতে, “ব্রহ্ম সত্যম্, জগন্মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ”—ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, জগৎ কেবল আপাত প্রতীতি (মিথ্যা), এবং আত্মা (জীব) ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কিছু নয়। অদ্বৈত বেদান্তে মুক্তি (মোক্ষ) মানে কোনো অর্জন নয়, বরং স্বরূপ-অনুভব—নিজের প্রকৃত সত্তা উপলব্ধি করা। অবিদ্যা (অজ্ঞতা) দূর হলে জ্ঞান প্রকাশিত হয়, এবং তখন ব্যক্তি আত্মাকে বুঝতে পারে—বুঝতে পারে যে, সে আসলে ব্রহ্মই। এই উপলব্ধি চূড়ান্ত মুক্তি।

মাধ্যমক বৌদ্ধধর্ম—চূড়ান্ত বাস্তবতা হিসাবে শূন্যতা: মাধ্যমক দর্শনের মূল প্রবর্তক নাগার্জুন চূড়ান্ত বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করেছেন শূন্যতা (śūnyatā) ধারণার মাধ্যমে। কিন্তু এখানে “শূন্যতা” মানে নিছক কিছুই নয়—এটি অস্বতঃসিদ্ধতা বা অ-সারসত্তা (niḥsvabhāva)। নাগার্জুন বলেন, “যে-বস্তু নির্ভর করে উৎপন্ন হয়, তাকেই আমরা শূন্য বলি; এই নির্ভরতাই মধ্যপথ।” অর্থাৎ, কোনো জিনিস নিজের মধ্যে স্বতন্ত্র সার বা চিরন্তন অস্তিত্ব বহন করে না; সবই পরস্পর নির্ভরতার ফলে উদ্ভূত হয়। এটি “প্রতীত্যসমুত্পাদ”-এর মূল শিক্ষা—সব কিছু একে অপরের কারণে বিদ্যমান, কোনো কিছুর স্বাধীন বা স্বতঃসিদ্ধ অস্তিত্ব নেই।

এইভাবে, মাধ্যমক চূড়ান্ত বাস্তবতাকে কোনো ধনাত্মক সত্তা হিসেবে নয়, বরং সব সত্তার অ-সারত্বের উপলব্ধি হিসেবে ব্যাখ্যা করে। শূন্যতা কোনো “নাস্তিত্ব” নয়; এটি এমন এক উপলব্ধি, যা অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব উভয়কেই অতিক্রম করে। এই দৃষ্টিতে মুক্তি হলো “প্রজ্ঞা”—এমন এক জ্ঞান, যা সমস্ত ধারণাগত দ্বৈততাকে বিলুপ্ত করে দেয়। যখন মানুষ বুঝতে পারে যে, কোনো কিছুরই নিজস্ব স্থায়ী স্বরূপ নেই, তখন বন্ধন বিলীন হয়, এবং সেই অবস্থাই নির্বাণ বা মুক্তি।