অদ্বৈত ব্যবস্থা অস্তিত্বকে বাস্তবতার একটি শ্রেণীবিন্যাসে (Satyam Traya) সংগঠিত করে। এর সর্বোচ্চটা হলো পারমার্থিক সত্যম (Ultimate Reality), যা শাস্ত্র (Āgama) দ্বারা সংজ্ঞায়িত এবং পরম অভেদ (Abheda) দ্বারা চিহ্নিত, যেখানে একমাত্র ব্রহ্মই বাস্তব। এর নিচে হলো ব্যাবহারিক সত্যম (Transactional Reality), যা উপলব্ধি (Pratyakṣa) দ্বারা সংজ্ঞায়িত; এই স্তরে ভেদের আপাতদৃষ্টি জড়িত থাকে, কিন্তু কর্ম ও অভিজ্ঞতার জন্য বৈধ বলে বিবেচিত হয়। সর্বনিম্ন স্তর হলো প্রাতিভাসিক সত্যম (Apparent Reality), যা বিষয়গত ত্রুটি বা বিভ্রম দ্বারা সংজ্ঞায়িত এবং সম্পূর্ণরূপে মায়াময় ও ক্ষণস্থায়ী।
তৃতীয় অংশ: সমালোচনামূলক ন্যায্যতা এবং ধারণ বিশ্লেষণ
ব্যবহৃত পদ্ধতির জন্য সংহতকরণ, পরিশোধন এবং ধারণ-সংক্রান্ত প্রতিটি সিদ্ধান্তের বিস্তারিত ন্যায্যতা প্রয়োজন, বিশেষ করে জটিল অদ্বৈত ধারণার ক্ষেত্রে।
৩.১. সংহতকরণের ন্যায্যতা (Justification of Consolidation): অপ্রয়োজনীয় পুনরাবৃত্তি বাদ দিয়ে লেখাটাকে আরও পরিষ্কার, নির্ভুল ও শক্তিশালী করা হয়েছে। এই কাজটা করা হয়েছে দুই ধরনের কারণে—অর্থগত অতিব্যাপ্তি (Semantic Overlap):একই ধারণা বার বার বলা। কার্যগত অপ্রয়োজনীয়তা (Functional Redundancy): আগের প্রমাণকেই আবার সারসংক্ষেপ করে বলা।
ক) ব্রহ্মের অনন্যতা সম্পর্কিত সাধারণ দাবি: মূল লেখায় প্রথমে বলা হয়েছিল: “ব্রহ্ম অনন্য, দ্বিতীয় কেউ নেই।” কিন্তু ঠিক পরেই উপনিষদের মহাবাক্য এসেছে: “একই, দ্বিতীয়বিহীন” (Ekameva-advitīyam)। যেহেতু, শ্রুতি (উপনিষদ বাক্য)-ই সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব, তাই সাধারণ বর্ণনা রাখার দরকার ছিল না। ফলে “শুধু শ্রুতি-উক্তি রাখো, বাড়তি বর্ণনা বাদ দাও”—এতে পাঠ্য অধিক সরল ও শক্তিশালী হলো। উদাহরণস্বরূপ, ক্লাসে শিক্ষক বললেন—“আজকের পাঠ খুব গুরুত্বপূর্ণ।” তারপরই সরাসরি বই থেকে মূল উক্তি পড়লেন।—তাহলে আগের কথাটা কেবল ভূমিকা; মূল ওজন তো বইয়ের উক্তিতেই।
২) “অনন্ত” (Anantam)-এর পুনরাবৃত্তি: প্রথমে অনন্যতার প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল: ব্রহ্ম সীমাহীন। আবার পরে ব্রহ্মের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করার সময়ও বলা হলো: ব্রহ্ম স্থান, কাল, গুণ—সব সীমা ছাড়িয়ে যায়। দু-বার একই বিষয় এসেছে, আলাদা করে রাখার দরকার নেই। তাই দুটিকে একত্রিত করে করা হলো একটি পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা—“সত্যম্, জ্ঞানম্, অনন্তম্ ব্রহ্ম”। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি প্রথমে বলে—“নদীটা অনেক দীর্ঘ।” তারপর আবার বলে—“নদীটা শুরু থেকে শেষপর্যন্ত শেষ হয় না।”—দুটো আসলে একই কথা, তাই একত্র করে বলাই যথেষ্ট: “নদীটা অনন্ত দীর্ঘ।”
৩) তিন ভেদ (Tri-Bheda) অস্বীকৃতির পরের সারসংক্ষেপ: তিন ভেদ (সজাতীয়, বিজাতীয়, স্বগত) বিশদভাবে খণ্ডন করা হয়েছে। তারপর আবার আলাদা অনুচ্ছেদে বলা হলো: “তাহলে ব্রহ্ম একক, অবিভাজ্য, অ-বিভেদযুক্ত।” কিন্তু এটা তো আগের যুক্তি থেকেই স্পষ্ট—নতুন কিছু যোগ করেনি। তাই এই বাড়তি সারসংক্ষেপ বাদ দেওয়া হলো। এতে পাঠক বাধ্য হবেন প্রযুক্তিগত শব্দ ও প্রমাণ বুঝতে—যা আসলে বেশি শিক্ষণীয়। উদাহরণস্বরূপ, গণিতের প্রমাণে প্রতিটি ধাপ দেখিয়ে শেষে আবার আলাদা করে লিখে দেওয়া—“তাহলে প্রমাণিত হলো ২+২=৪।” এটা আসলে অপ্রয়োজনীয়, কারণ প্রমাণের ধাপগুলো পড়লেই বোঝা যায়।
মোট কথা, ব্রহ্ম অনন্যতা—সাধারণ দাবি বাদ, কেবল শ্রুতি বাক্য (Ekameva-advitīyam) রাখা হলো। অনন্ত—একই ধারণা দুই বার আসায় একত্র করে দেওয়া হলো—“সত্যম্ জ্ঞানম্ অনন্তম্।” তিন ভেদ-পরবর্তী সারসংক্ষেপ—বাদ দেওয়া হলো, কারণ আগের বিশ্লেষণই যথেষ্ট প্রমাণ ছিল। ফলে লেখাটি হলো—সংক্ষিপ্ত, অপ্রয়োজনীয় পুনরাবৃত্তি-মুক্ত, এবং দর্শনের আসল শক্তি আরও স্পষ্টভাবে ধরা গেল।
৩.২. প্রয়োজনীয় ধারণের বিশ্লেষণ: অদ্বৈতিক তত্ত্ববিদ্যার স্তম্ভ: ভেদের পদ্ধতিগত অস্বীকৃতি, যা ত্রি-ভেদ-নিরাকরণম্ নামে পরিচিত, সম্পূর্ণভাবে ধরে রাখা হয়েছিল, কারণ এটি পরম অদ্বৈততার প্রতি তিনটি দার্শনিকভাবে স্বতন্ত্র চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে। Ekameva-advitīyam বিবৃতিটি প্রাথমিকভাবে ব্রহ্মের বাহ্যিক অনন্যতাকে নিশ্চিত করে (কোন সমকক্ষ নেই)। তবে, এই বিবৃতিটি একা অভ্যন্তরীণ জটিলতার সম্ভাবনাকে বাতিল করে না, যা ব্রহ্মকে একটি সমষ্টি বা জটিল পদার্থ হিসাবে ধারণার সুযোগ দেয়।
পদ্ধতিগত অস্বীকৃতি অদ্বৈততার সংজ্ঞাটিকে বাহ্যিক অনন্যতা থেকে অভ্যন্তরীণ সরলতায় সরিয়ে এই সমস্যার সমাধান করে। সজাতীয়-ভেদ একই শ্রেণীর সত্তাগুলির মধ্যে পার্থক্যগুলি পরিচালনা করে (একাধিক পরম বাস্তবতা বাতিল করে)। বিজাতীয়-ভেদ ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে পার্থক্যগুলি পরিচালনা করে (একটি স্বাধীন বাহ্যিক বাস্তবতা, যেমন অ-আত্মা, বাতিল করে)। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা—স্বগত-ভেদ অভ্যন্তরীণ ভিন্নতাকে অস্বীকার করে, দাবি করে যে, ব্রহ্ম অংশ বা পৃথকযোগ্য গুণাবলী দ্বারা গঠিত নয়। অন্তর্নিহিত ভেদের এই অস্বীকৃতি ব্রহ্মকে নির্গুণ (গুণবিহীন এবং অ-যৌগিক) হিসেবে নিশ্চিত করে, যার ফলে ব্রহ্মের একটি নিছক জটিল পদার্থ বা সমষ্টি হিসাবে ব্যাখ্যা প্রতিরোধ করা হয়।
৩.৩. অভাবের (অস্তিত্ব-না-থাকা) যৌক্তিক কাঠামো: অদ্বৈত দর্শন অনেকসময় ন্যায়-দর্শনের যুক্তি (Nyāya logic) ব্যবহার করে। সেখানে অভাব বা “কোনো কিছুর না-থাকা” বোঝাতে কয়েক রকম ধারণা আছে। এর মধ্যে দুটো খুব গুরুত্বপূর্ণ—পারস্পরিক অভাব (Anyonyābhāvaḥ): দুটো জিনিস একে অপরের মধ্যে নেই। উত্তরকালীন অভাব (Prāg-uttara-kālīna-abhāvaḥ): কিছু জিনিস সময়ের আগে ছিল না, আবার পরে থাকবে না।
ক) পারস্পরিক অভাব (Anyonyābhāvaḥ) মানে: এক জিনিস আরেক জিনিস নয়। যেমন: ঘড়ি টেবিল নয়, টেবিল ঘড়ি নয়। এইভাবে আলাদা আলাদা জিনিসগুলোকে চিহ্নিত করা যায়। অদ্বৈত বলে—এই ধরনের “ভিন্নতা” বা “অন্যতা” আসলে মায়ার মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু পরম সত্য স্তরে (Paramārthika Satya) ব্রহ্ম ছাড়া কিছু নেই। তাহলে “অন্যতা”র এই যুক্তি শেষপর্যন্ত দ্রবীভূত হয়ে যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, স্বপ্নে আমরা দেখি: হাতি, গাছ, নদী—সব আলাদা। কিন্তু জাগ্রত হলে বোঝা যায়—সবই কেবল স্বপ্ন। অদ্বৈতও বলে—জগতে ভিন্নতা মায়ার খেলা, আসল সত্যে কেবল ব্রহ্ম।
খ) উত্তরকালীন অভাব (Prāg-uttara-kālīna-abhāvaḥ) মানে: কোনো একটি বস্তু আগে ছিল না, পরে থাকবে না। যেমন: একটা ঘর বানানোর আগে ঘর ছিল না (প্রাগভাব), আর ভেঙে গেলে ঘর থাকবে না (প্রধ্বংসাভাব)। অদ্বৈত বলে—ব্রহ্ম চিরন্তন, তার কোনো উৎপত্তি বা বিনাশ নেই। যা সময়ের সঙ্গে তৈরি হয় ও নষ্ট হয় (যেমন ঘর, শরীর, জগৎ)—সব অস্থায়ী। তাই জন্ম-মৃত্যুর ধারায় যা পড়ে, সেটাই মায়া। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বরফ আগে ছিল না, পরে গলে গেল—অতএব তা অস্থায়ী। কিন্তু জল (মূল উপাদান) একভাবে থাকে। অদ্বৈত একইভাবে বলে—জগত নশ্বর, কিন্তু ব্রহ্ম নিত্য।
অদ্বৈত এসব যুক্তি ব্যবহার করে প্রমাণ করতে চায় না যে, “পার্থক্য সত্যিই আছে।” বরং দেখাতে চায়—যুক্তি যত শক্ত হোক, যতই পার্থক্য বা অস্থায়ীতার নিয়ম দাঁড় করানো হোক, ব্রহ্মের ক্ষেত্রে এগুলো চলবে না। কারণ ব্রহ্ম—একক, নিত্য, অবিভাজ্য। যা আলাদা আলাদা বা অস্থায়ী বলে মনে হয়, সবই কেবল মায়া।
সহজ ভাষায়,
Anyonyābhāvaḥ (পারস্পরিক অভাব): জিনিসগুলো আলাদা আলাদা মনে হয় (যেমন বই ≠ টেবিল)। অদ্বৈত বলে, এগুলো আসলে মায়া।
Prāg-uttara-kālīna-abhāvaḥ (আগে/পরে অভাব): জিনিস জন্মায় ও নষ্ট হয় (যেমন ঘর, শরীর)। অদ্বৈত বলে, আসল সত্যে (ব্রহ্ম) জন্ম-মৃত্যু নেই।
অদ্বৈতের শিক্ষা: পার্থক্য আর অস্থায়ীতার সব ব্যাখ্যা মায়ার খেলা। আসল সত্যে শুধু একটাই ব্রহ্ম।
৩.৪. উপস্থিতির প্রক্রিয়া—মায়া এবং বিষয়গততা: মায়াকে সাধারণত বোঝানো হয় ঈশ্বরের এক শক্তি (Īśvara-śakti) হিসেবে, যা মহাবিশ্বকে নাম-রূপে (nāma-rūpa) প্রকাশ করে। মানে, মায়াই সব কিছুকে “অনেক” বা “বহু” বলে দেখায়। উদাহরণস্বরূপ, যেমন প্রজেক্টর মেশিন একটিই, কিন্তু স্ক্রিনে অনেক ছবি দেখা যায়।
মায়া ও মানসিক প্রক্রিয়া (Buddhi-vṛtti): এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ নতুন দিক যোগ করা হয়েছে—মায়াকে শুধু বাইরের শক্তি হিসেবে ধরা হয়নি, বরং বলা হয়েছে: মায়া আমাদের মন-ইন্দ্রিয় (Buddhi)-র ভেতরের পরিবর্তনের মাধ্যমেও কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যখন আয়নায় তাকাই, কখনো মনে হয় শরীর মোটা, কখনো চিকন—আসলে ছবিটা যেমন আছে তেমনই, কিন্তু মন-বুদ্ধির প্রক্রিয়া আমাদের দেখার ধরনকে পালটে দেয়।
বহুত্বের প্রকৃত উৎস: এর মানে, “বহু জিনিস” শুধু বাইরের প্রক্ষেপণ নয়, বরং আমাদের মন-ইন্দ্রিয়ও বহুত্বকে তৈরি ও বজায় রাখে। তাই জগৎ শুধু বাইরে নেই, আমাদের চেতনার ভেতরেও তৈরি হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, স্বপ্নের মধ্যে আমরা আলাদা মানুষ, জায়গা, ঘটনা দেখি। এসব “বাইরে” নেই—মন নিজেই এগুলো তৈরি করে। অদ্বৈত বলে, জাগতিক জগৎও অনেকটা এর মতো—মায়া আর বুদ্ধি একসাথে বহুত্ব দেখায়।
মুক্তির পথের ইঙ্গিত: যদি জগতের বহুত্ব কেবল বাইরের প্রক্ষেপণ হত, তবে মুক্তি পেতে শুধু “বাহিরকে অস্বীকার” করাই যথেষ্ট হতো। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো—আমাদের মন-ইন্দ্রিয় ভেতরে বিভাজন চাপিয়ে দিচ্ছে। তাই মুক্তির জন্য দরকার মন নিয়ন্ত্রণ ও বুদ্ধির বিশুদ্ধতা। দৃষ্টান্তস্বরূপ, একজন লোক চোখে লাল চশমা পরে আছে, তাই সব কিছু লাল দেখছে। বাস্তবে বাইরের জগত লাল নয়—চশমাটাই রং লাগাচ্ছে। ঠিক তেমনই, মন-বুদ্ধি বিভাজনের চশমা পরে জগৎকে “বহু” করে দেখায়।
সংক্ষেপে, মায়া শুধু বাইরের শক্তি নয়—এটা আমাদের মন-ইন্দ্রিয়র ভেতর দিয়েও কাজ করে। বহুত্ব শুধু বাইরের জগতে নেই, আমাদের বুদ্ধির প্রক্রিয়াই বহুত্বকে গড়ে তোলে। জগতের টিকে থাকা মানে কেবল বাইরের কারণ নয়—আমাদের ভেতরের জ্ঞানপ্রক্রিয়াও দায়ী। তাই মুক্তি (মোক্ষ) মানে শুধু বাইরের দুনিয়াকে মিথ্যা বলা নয়, বরং মনের বিভাজন অতিক্রম করা। এককথায়, জগৎ = বাইরের মায়া + ভেতরের বুদ্ধি—দুটো মিলে বহুত্বকে স্থায়ী করে। মুক্তি পেতে হলে ভেতরের বিভাজন (মন-ইন্দ্রিয়ের খেলা) অতিক্রম করতে হবে।
৩.৫. জ্ঞানতত্ত্ব—শাস্ত্র এবং উপলব্ধির সমন্বয়: অদ্বৈত বেদান্ত বলে—ব্রহ্মই একমাত্র পরম সত্য। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে: তাহলে আমরা যে আনন্দ-দুঃখ, নৈতিক ফলাফল, সুখ-দুঃখে-ভরা জগত দেখি, সেটা কী?
আগম (শাস্ত্র) আর প্রত্যক্ষ (অভিজ্ঞতা): আগম/শাস্ত্র (যেমন উপনিষদ) বার বার বলে: ব্রহ্ম অবিভাজ্য, একমাত্র সত্য। প্রত্যক্ষ/অভিজ্ঞতা—আমরা দেখি: ভেদ আছে, দুঃখ আছে, সুখ আছে, জগৎ কাজ করছে। তাই এখানে একটা টানাপোড়েন আছে—শাস্ত্র বলে: ভেদ নেই। প্রত্যক্ষ বলে: ভেদ আছে। তাহলে এই টানাপোড়েন মেটানো হয় কীভাবে?
অদ্বৈত সরাসরি বিরোধ মানে না, বরং বলে—এটা স্তরভেদ (levels of reality)।
স্তর ১: ব্যাবহারিক সত্য (Vyavahārika Satya / Transactional Reality): আমাদের চোখে যে জগৎ, নৈতিক কাজ, ফলাফল, দুঃখ-সুখ দেখা যায়—এগুলো ব্যাবহারিকভাবে সত্য, কারণ এগুলো না মানলে সাধনা, নৈতিকতা, মুক্তির পথই সম্ভব হতো না। উদাহরণস্বরূপ, স্বপ্নে জগৎ যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ স্বপ্নে খাওয়া-দাওয়া, দৌড়ানো, ভয়—সব বাস্তব মনে হয়। তেমনি জাগতিক স্তরে দুঃখ-সুখ, কর্মফল বাস্তব।
স্তর ২: পরম সত্য (Pāramārthika Satya / Absolute Reality): গভীর দর্শনে গেলে দেখা যায়—সবই ব্রহ্ম। ভেদ, বহুত্ব, দুঃখ—সব মায়া। আসল সত্য—একটাই ব্রহ্ম। উদাহরণস্বরূপ, আলো জ্বললে দড়িকে সাপ মনে হওয়ার ভ্রম ভেঙে যায়। তেমনি ব্রহ্ম-জ্ঞান উদিত হলে জগতের সব ভেদ মায়া বলে ধরা পড়ে।
কেন জগৎ পুরোপুরি মিথ্যা বলা যায় না? কারণ, যদি জগৎ সম্পূর্ণ অবাস্তব হতো (যেমন বন্ধ্যা নারীর সন্তান = যা কোনোদিনই সম্ভব নয়), তাহলে আধ্যাত্মিক অনুশীলন (সাধনা), নৈতিক কাজ, মুক্তির পথ কিছুই সম্ভব হতো না। তাই জগৎকে কাজের স্তরে সত্য ধরা হয়, যদিও চূড়ান্তভাবে মিথ্যা।
সংক্ষেপে, শাস্ত্র—ব্রহ্ম একমাত্র সত্য (ভেদহীন)। অভিজ্ঞতা—জগৎ আছে, ভেদ আছে (ভেদগ্রাহী)। এর সমাধান—স্তরভেদে সত্য ধরা হয়। ব্যাবহারিক স্তরে—জগৎ, নৈতিকতা, সাধনা সত্য। পরম স্তরে—কেবল ব্রহ্মই সত্য। সহজ দৃষ্টান্ত দেখি। স্বপ্ন: যতক্ষণ চলছে, বাস্তব মনে হয়; কাজকর্ম হয়। কিন্তু জাগরণের পর বোঝা যায়—স্বপ্ন সত্য নয়। তেমনি জগৎও ব্যাবহারিকভাবে সত্য, কিন্তু ব্রহ্ম-জ্ঞানে বোঝা যায়—কেবল ব্রহ্মই পরম সত্য।