অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: পঁচিশ



"অসৎ"-এর এই ধারণাটি বিভিন্ন ভারতীয় দর্শন, বিশেষ করে অদ্বৈত বেদান্ত, ন্যায় এবং বৈশেষিক দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেখানে বাস্তবতার স্বরূপ এবং অস্তিত্বের বিভিন্ন স্তর নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। এই দর্শনগুলিতে, "অসৎ" এমন একটি শ্রেণী, যা কোনোভাবেই বিদ্যমান নয়, এবং এ থেকে "মিথ্যা" (যা একসময় বিদ্যমান ছিল বা দেখা যায় কিন্তু পরে বিলীন হয়ে যায়) বা "অনির্ণেয়" (যা বাস্তব বা অবাস্তব কোনটিই নয়)-এর পার্থক্য করা হয়।

ট্যাবুলা রাসা (Tabula Rasa) একটি লাতিন শব্দগুচ্ছ, যার আক্ষরিক অর্থ—“মুছে-ফেলা ট্যাবলেট” বা “খালি পাতা”। দার্শনিক অর্থে, এর মাধ্যমে বোঝানো হয় যে, মানুষের মনের জন্মগত কোনো অন্তর্নিহিত জ্ঞান থাকে না। জন্মের সময় মানুষের মন একেবারে সাদা/খালি স্লেটের মতো থাকে। জীবনের অভিজ্ঞতা, পরিবেশ, শিক্ষা ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান দিয়ে সেই খালি পাতায় ধীরে ধীরে লেখা হয়।

এ ধারণাটি প্রধানত জন লক (John Locke) নামক ইংরেজ দার্শনিকের সঙ্গে সম্পর্কিত (১৭শ শতাব্দী)। তিনি বলেছিলেন, অভিজ্ঞতা (experience) ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান (sense perception)—এই দুটির মাধ্যমেই মানুষের মস্তিষ্ক গড়ে ওঠে; অর্থাৎ, কোনো জন্মগত ধারণা (innate ideas) নেই। একটি শিশুর মস্তিষ্ক জন্মের সময় খালি কাগজের মতো। ধীরে ধীরে সমাজ, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা—এইসব দিয়ে তাতে জ্ঞানের লেখা জমা হয়। জন লকের “ট্যাবুলা রাসা” ধারণায় মানুষের মন জন্মের সময় একেবারে খালি থাকে, যেন সাদা কাগজে কিছু লেখা নেই। অভিজ্ঞতা, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা ও শিক্ষা ধীরে ধীরে সেই খালি পাতাকে পূর্ণ করে তোলে; কিন্তু ভারতীয় দর্শনে এ ধারণা একেবারেই মেলে না।

ন্যায়কারগণ মনে করেন, জ্ঞান অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই আসে, তবে আত্মা আগের জন্মের সংস্কার সঙ্গে নিয়ে আসে। তাই একেবারে খালি নয়। অদ্বৈত বেদান্তে আত্মাকে স্বরূপে জ্ঞানময় বলা হয়—কিন্তু অবিদ্যার আচ্ছাদনে সেই জ্ঞান জন্মের সময় প্রকাশিত হয় না। এখানে মন খালি নয়, বরং অন্তর্লীন জ্ঞান ঢাকা পড়ে থাকে। যোগ দর্শনে বলা হয়েছে, শিশুর চিত্তে আগের জন্মের বহু সংস্কার লুকিয়ে থাকে; তাই নতুন অভিজ্ঞতা সেই পুরোনো ছাপের সঙ্গে মিশে যায়। তবে, বৌদ্ধ দর্শনে স্থায়ী আত্মার ধারণা নেই; মনকে তারা ক্ষণিক প্রবাহ বলে মানে। তাই জন্মের সময় কোনো অন্তর্নিহিত জ্ঞান নেই—এই দিক থেকে বৌদ্ধ ধারণা লকের “ট্যাবুলা রাসা”-র কাছাকাছি।

সুতরাং পাশ্চাত্যের ‘ট্যাবুলা রাসা’ ধারণার সঙ্গে ভারতীয় বৌদ্ধ দর্শনের মিল সবচেয়ে বেশি, ন্যায় দর্শনের সঙ্গে আংশিক মিল আছে, কিন্তু অদ্বৈত বেদান্তে তা সরাসরি অস্বীকার করা হয়, কারণ তাদের মতে, জ্ঞান সর্বদা অন্তর্লীন অবস্থায় থাকে, শুধু অবিদ্যার কারণে ঢাকা। উপমা দিয়ে যদি বলি—

জন লকের ‘ট্যাবুলা রাসা’ ঠিক যেন একেবারে সাদা কাগজ। জন্মের সময় সেই কাগজ একেবারে ফাঁকা, পরে অভিজ্ঞতা আর শিক্ষার কলমে ধীরে ধীরে লেখা জমে। কিন্তু অদ্বৈত বেদান্ত বলবে, মন খালি কাগজ নয়, বরং একটা উজ্জ্বল আয়না—যা জন্ম থেকেই আলো ছড়াতে পারে। কিন্তু আয়নাটির ওপর ধুলো জমে গেছে (অবিদ্যা বা মায়া)। অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান হলো সেই ধুলো মুছে ফেলার প্রক্রিয়া, যাতে আয়নার আসল দীপ্তি ফুটে ওঠে। ন্যায় দর্শন আবার বলবে, কাগজ একেবারে খালি নয়—তার গায়ে আগের জন্মের কিছু হালকা ছাপ বা জলের দাগ রয়ে গেছে (সংস্কার)। নতুন লেখাগুলো সেই পুরোনো দাগের ওপরেই বসে। আর বৌদ্ধ দর্শন বলবে, ‘মন’ কাগজ বা আয়না—কোনোটাই নয়। বরং মন হলো প্রতিমুহূর্তে তৈরি-হওয়া বালির রেখা, যেখানে ঢেউ এসে নতুন ছাপ ফেলে যায়, তারপরই মুছে যায়। এতে কোনো স্থায়ী লেখা বা আলো নেই। তাই উপমার মাধ্যমে বলা যায়: লকের মতে, মন = সাদা কাগজ; বেদান্তমতে, মন = ধুলো-ঢাকা আয়না; ন্যায়মতে, মন = পুরোনো দাগযুক্ত কাগজ; বৌদ্ধমতে মন = বালির ওপর ঢেউয়ের ছাপ।

"জগৎ পূর্বেই জ্ঞাত হবে", এই কৌতূহলোদ্দীপক ধারণাটি একটি গভীর অবস্থার বিষয়ে নির্দেশ করে, যেখানে জগৎ সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধি এবং অভিজ্ঞতা একটি 'ট্যাবুলা রাসা' বা অলিখিত স্লেট থেকে উৎপন্ন হয় না। পরিবর্তে, জগতের সামগ্রিকতা—বস্তু, ঘটনা এবং অভিজ্ঞতা হিসেবে—অন্তর্নিহিতভাবে একটি প্রদত্ত বিষয়, একটি পূর্ব-বিদ্যমান জ্ঞানীয় কাঠামো, বা গভীরভাবে প্রোথিত অনুমানের একটি সেট হিসেবে বিবেচিত হয়, যা আমাদের সচেতন উপলব্ধিকে প্রভাবিত করে এবং তার আগেই বিদ্যমান থাকে।

এই 'পূর্বজ্ঞান' হলো পূর্বানুমান, সাংস্কৃতিক প্রবৃত্তি, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিশ্বাস, মৌলিক অধিবিদ্যাগত অনুমান, ভাষাগত কাঠামো এবং এমনকি বাস্তবতা কীভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে গভীরভাবে নিহিত জৈবিক প্রবণতা থেকে বোনা একটি সমৃদ্ধ চিত্র। এই জটিল সংগ্রহটি বিশ্ব সম্পর্কে পরবর্তী পর্যবেক্ষণ, অনুমান এবং ব্যাখ্যাগুলি কীভাবে প্রক্রিয়াজাত ও বোঝা হয়, তা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে, আকার দেয় এবং সুচারুরূপে ছেঁকে নেয়। এটি জ্ঞানীয় সত্তা হিসেবে আমাদের অন্তর্নিহিত বিষয়গততা এবং অনিবার্য 'ফিল্টার'-সমূহকে শক্তিশালীভাবে তুলে ধরে, যার মাধ্যমে আমরা বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা উপলব্ধি করি এবং নির্মাণ করি। বিশ্বের সাথে আমাদের সম্পৃক্ততা সর্বদা পূর্বেই অবহিত থাকে, কখনও সত্যিকারের একটি নিরপেক্ষ, শর্তহীন বিন্দু থেকে শুরু হয় না। এই ধারণাটি জ্ঞানীয় পক্ষপাত, সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা এবং মানব-উপলব্ধির স্থাপত্য সম্পর্কিত আলোচনাগুলিকে সংযুক্ত করে।

আরও গভীরে গেলে, এই 'পূর্বজ্ঞান' বিভিন্ন লেন্সের মাধ্যমে বোঝা যায়। দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি কান্টের অতীন্দ্রিয় আদর্শবাদকে প্রতিধ্বনিত করে, যেখানে মন কেবল ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্য গ্রহণ করে না, বরং বোঝার সহজাত বিভাগ অনুসারে সক্রিয়ভাবে সেগুলিকে কাঠামোবদ্ধ করে। আমরা কেবল স্থান এবং সময়কে উপলব্ধি করি না; আমরা স্থান ও সময়ে উপলব্ধি করি, এগুলি আমাদের জ্ঞানীয়তার মৌলিক কাঠামো। একইভাবে, আমাদের সাংস্কৃতিক লালন-পালন ঘটনাসমূহকে শ্রেণীবদ্ধ করার এবং সেগুলিকে মূল্য দেওয়ার একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিকে অনুপ্রাণিত করে। একটি বনকে এক সংস্কৃতি দ্বারা সম্পদের উৎস হিসেবে, অন্য সংস্কৃতি দ্বারা একটি পবিত্র উপবন হিসেবে, বা তৃতীয় আরেক সংস্কৃতি দ্বারা কেবল গাছের সংগ্রহ হিসেবে দেখা যেতে পারে। এই বিভিন্ন ব্যাখ্যা কেবল বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে নয় বরং পূর্ব-বিদ্যমান ‘সাংস্কৃতিক স্কিমা’-র দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়।

সাংস্কৃতিক স্কিমা (Cultural Schema) হলো মনোবিজ্ঞান ও নৃতত্ত্বে ব্যবহৃত একটি ধারণা। সহজভাবে, স্কিমা মানে হলো মনের ভেতরকার একটি কাঠামোবদ্ধ ছক বা মানসিক নকশা—যা আমাদের ভাবনা, আচরণ আর অভিজ্ঞতাকে সংগঠিত করে। যখন সেটি সংস্কৃতির প্রভাবে গড়ে ওঠে, তখন সেটিকে বলা হয় সাংস্কৃতিক স্কিমা।

প্রতিটি সংস্কৃতির নিজস্ব মূল্যবোধ, বিশ্বাস, আচার-আচরণ, ভাষা, প্রতীক, গল্প, রীতি আছে। মানুষ ছোটোবেলা থেকে পরিবার, সমাজ, শিক্ষা ও অভ্যাসের মাধ্যমে এইসব উপাদান আত্মস্থ করে। এর ফলে তার মনে একটা মানসিক ছক বা ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি হয়—যেটি তাকে সিদ্ধান্ত নিতে, অন্যকে বুঝতে এবং নতুন অভিজ্ঞতাকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে।

কিছু উদাহরণ দিচ্ছি।
অতিথি-আপ্যায়ন: বাংলাদেশি বা ভারতীয় সংস্কৃতিতে অতিথি এলে “অতিথি দেবতা” ভেবে আপ্যায়ন করা হয়। এই মনোভাব একটা সাংস্কৃতিক স্কিমা—যা পশ্চিমা সংস্কৃতিতে ভিন্ন হতে পারে।
বিয়ে: পশ্চিমে বিয়ে মানে প্রায়শই প্রেমিক-প্রেমিকার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত; আবার দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক পরিবারিক ও সামাজিক অংশগ্রহণ থাকে। এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিই সাংস্কৃতিক স্কিমার কাজ।
শ্রদ্ধা: অনেক এশীয় সমাজে বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন বাধ্যতামূলক ধরা হয়। এটাই সেই সংস্কৃতির মানসিক ছক।

‘সাংস্কৃতিক স্কিমা’ হলো সংস্কৃতির ভেতরে বেড়ে-ওঠা মানুষের মনে তৈরি-হওয়া একধরনের “অদৃশ্য মানসিক নকশা”। এটি আমাদের আচরণ, ব্যাখ্যা, যোগাযোগ ও সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। ভারতীয় দর্শনের আলোকে সাংস্কৃতিক স্কিমা ব্যাখ্যা করি—

১. ধর্ম (Dharma): ভারতীয় সংস্কৃতিতে “ধর্ম” শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং নৈতিকতা, কর্তব্য ও সামাজিক ভূমিকার ছক। যেমন, পুত্রের কর্তব্য হলো পিতামাতার সেবা করা—এটি এক সাংস্কৃতিক স্কিমা। এটি ছোটোবেলা থেকে শেখানো হয়, ফলে ব্যক্তি কোনো পরিস্থিতিতে কীভাবে আচরণ করবে, তা এই মানসিক ছক দ্বারা নির্ধারিত হয়।

২. সংস্কার (Saṁskāra): সংস্কার মানে হলো মানুষের মনে জন্ম থেকে সঞ্চিত প্রভাব বা ছাপ। বিবাহসংস্কার, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন ইত্যাদি আচার কেবল আচার নয়, এগুলো ব্যক্তির মনে সাংস্কৃতিক মানসিক ছক গঠন করে। যেমন, অন্নপ্রাশনে শিশুকে ভাত খাওয়ানো মানে হলো—“এখন থেকে সে সামাজিক খাদ্যগ্রহণের অঙ্গ।” এভাবে সামাজিক দায়িত্ব ও পরিচয় শিশুর মনে প্রতিষ্ঠিত হয়।

৩. সমাজদৃষ্টি (Social Vision): ভারতীয় সমাজে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক, বয়োজ্যেষ্ঠের প্রতি শ্রদ্ধা, অথবা “অতিথি দেবো ভব” ধারণা—এসবই সাংস্কৃতিক স্কিমার অংশ। যেমন, বাড়িতে অতিথি এলে শিশুটি শিখে যে, তাঁকে সসম্মানে জল দিতে হবে। এটা একপ্রকার অচেতন সাংস্কৃতিক ছক, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসে।

৪. অদ্বৈত বেদান্ত দৃষ্টিতে: অদ্বৈত বেদান্ত বলবে—এসব সাংস্কৃতিক স্কিমা আসলে অবিদ্যার স্তরে তৈরি এক “মন-সংস্কার”, যা জীবকে সমাজের ছাঁচে গড়ে তোলে। কিন্তু এগুলো আত্মার প্রকৃত স্বরূপ নয়; এগুলো কেবল মানসিক ছাপ (vāsanā), যা মুক্তির পথে অতিক্রম করতে হয়।

সাংস্কৃতিক স্কিমা ভারতীয় দর্শনের ভাষায় হলো ‘সংস্কার + ধর্ম + সমাজদৃষ্টি’ মিলে গড়ে-ওঠা মানসিক ছক, যা আমাদের ভাবনা, সিদ্ধান্ত, আচার ও সম্পর্ককে চালিত করে। পাশ্চাত্য মনোবিজ্ঞানে একে বলা হয় schema, আর ভারতীয় পরিভাষায় একে বোঝানো যায় “সংস্কার” বা “অচেতন মানসিক ছাপ” দিয়ে। “schema” আর “scheme”–দুটো শব্দ কাছাকাছি মনে হলেও আসলে আলাদা অর্থ বহন করে।

Schema—গ্রিক skhēma থেকে এসেছে, মানে “আকৃতি, গঠন”। আধুনিক মনোবিজ্ঞান, জ্ঞানতত্ত্ব (cognitive science), ভাষাতত্ত্বে ব্যবহৃত হয়। এখানে schema মানে হলো মানসিক ছক, কাঠামো, মনের মধ্যে জ্ঞানের সংগঠিত নকশা। উদাহরণ: cultural schema, cognitive schema, self-schema ইত্যাদি। অন্যদিকে, Scheme মানে হলো পরিকল্পনা, ছক, প্রোগ্রাম, কৌশল। সাধারণত বাস্তব জীবনে পরিকল্পনা বা কোনো কাজ বাস্তবায়নের ধাপ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণ: five-year scheme, government housing scheme ইত্যাদি। সহজভাবে, Schema—মনের ভেতরে থাকা জ্ঞানের কাঠামো; Scheme—বাইরের জগতে কোনো পরিকল্পনা বা প্রকল্প।

স্যাপির-হোরফ হাইপোথিসিস (Sapir-Whorf Hypothesis) বা ভাষাগত আপেক্ষিকতা (linguistic relativity) ভাষাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। এটিকে বলা হয় ভাষাগত আপেক্ষিকতার তত্ত্ব (Linguistic Relativity Theory)। এর মূল বক্তব্য—মানুষ যে-ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষা তার চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার ধরনকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং মানুষের জগৎ বোঝার ধরনকেও গঠন করে।

আমেরিকান ভাষাবিজ্ঞানী ও নৃতত্ত্ববিদ এডওয়ার্ড স্যাপির (Edward Sapir) উত্তর আমেরিকার আদিবাসী (Native American) ভাষাগুলোর ওপর গভীর গবেষণা করে দেখিয়েছিলেন যে, ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং কোনো সমাজের সংস্কৃতি, জীবনযাপন ও ভাবনার ছককে প্রতিফলিত করে। তাঁর মতে, ভাষার গঠন বুঝতে পারলে সেই সমাজের মানসিকতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তাঁরই ছাত্র ও অনুসারী আমেরিকান ভাষাবিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ ও শখের দমকলকর্মী বেনজামিন লি হোরফ (Benjamin Lee Whorf) ভাষার গঠন কীভাবে মানুষের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে, তা বিশ্লেষণ করেছিলেন। তিনি হোপি (Hopi) নামক এক আদিবাসী ভাষা নিয়ে গবেষণা করে দেখান যে, তাদের ভাষায় সময়ের ধারণা (past-present-future) ইউরোপীয় ভাষার মতো নয়। ফলে তাদের সময়-চিন্তাও আলাদা। এর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে ভাষা বাস্তবতাকে বোঝার ধরনকে প্রভাবিত করে। তাঁদের যৌথ ভাবনা থেকেই এই হাইপোথিসিস গড়ে ওঠে।