অদ্বৈত বেদান্তে এই গুণ ব্রহ্মের সঙ্গে যুক্ত। ব্রহ্ম স্বাতন্ত্র্য-নিরালম্ব, কারণ তিনি অন্য কিছুর দ্বারা সৃষ্ট নন, তাঁর অস্তিত্ব কারও ওপর নির্ভরশীল নয়, তিনি নিজেই চেতনার উৎস। যেমন আলো নিজের দ্বারা আলোকিত হয়, অন্য প্রদীপের সাহায্য লাগে না, তেমনি ব্রহ্ম নিজপ্রকাশ।
জগৎ বা ব্যক্তিসত্তা এর বিপরীত, কারণ তারা আলম্বিত। জগৎ নির্ভরশীল ব্রহ্মের উপর, দেহ প্রাকৃতিক উপাদানের উপর, মন ইন্দ্রিয়ের উপর। কিন্তু ব্রহ্ম কারও ওপর নির্ভরশীল নন।
“কৈবল্য”-র লক্ষণগুলো সংজ্ঞা, চিহ্ন ও সূত্র-ইঙ্গিত-সহ যোগসূত্র, সাংখ্যকারিকা অনুসারে লিখছি:
(YS = পতঞ্জলির Yoga Sūtra(s) (যোগসূত্র)। উদ্ধৃতির ধরন: ‘YS, 2.25’ মানে ‘অধ্যায় (পাদ) ২, সূত্র ২৫’। চার পাদ: সমাধি, সাধন, বিভূতি, কৈবল্য)
পতঞ্জলির যোগসূত্র চার “পাদ” (অধ্যায়): সমাধি, সাধন, বিভূতি, কৈবল্য। প্রত্যেকটির কাজ আলাদা, কিন্তু লক্ষ্য এক—দ্রষ্টা (পুরুষ)-কে দৃশ্য (প্রকৃতি/চিত্ত) থেকে নিঃশর্ত পৃথকতায় প্রতিষ্ঠা করা।
সমাধি-পাদ (অধ্যায় ১): যোগসূত্রের প্রথম অধ্যায়ের নাম সমাধি-পাদ। এখানে পতঞ্জলি যোগের মূল সংজ্ঞা, উপায় ও ধ্যানের ধাপ ব্যাখ্যা করেছেন।
যোগের সংজ্ঞা হলো “যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ”—অর্থাৎ চিত্তের সমস্ত বিক্ষিপ্ত ভাব বা বৃত্তির নিবৃত্তিই যোগ। যখন মন স্থির, শান্ত ও একাগ্র হয়, তখন যোগ ঘটে।
চিত্তকে শান্ত করার দুটি উপায় আছে—অভ্যাস ও বৈরাগ্য। অভ্যাস মানে মনকে বার বার একাগ্র করার অনুশীলন, নিয়মিত ধ্যান ও মনোসংযম। বৈরাগ্য মানে আকাঙ্ক্ষা ও আসক্তি থেকে মুক্ত থাকা, যা আসে তা নিয়ে না জড়ানো, বিরক্ত না হওয়া থেকে।
ঈশ্বর-প্রণিধান মানে ঈশ্বরের প্রতি গভীর আত্মসমর্পণ বা ভক্তি। ঈশ্বরকে ধ্যানের কেন্দ্র করে মনকে স্থির করা যায়।
প্রণব বা ওঁ-ধ্যানও যোগের গুরুত্বপূর্ণ উপায়। ঈশ্বরের নাম বা প্রতীক হিসেবে ওঁ ধ্বনি উচ্চারণ ও ধ্যান করলে মন একাগ্র হয় এবং চিত্ত ধীরে ধীরে স্থিরতার দিকে যায়।
যখন মন সম্পূর্ণভাবে এক বিষয়ে স্থির হয়, তখন তাকে সমাধি বলে। সমাধির দুটি রূপ আছে—সমপ্রজ্ঞাত সমাধি, যেখানে চেতনা জ্ঞাত-বস্তুর সঙ্গে যুক্ত থাকে; এবং অসমপ্রজ্ঞাত সমাধি, যেখানে সমস্ত জ্ঞাত-বস্তু বিলীন হয়ে চেতনা কেবল নিজের মধ্যেই স্থিত থাকে।
যোগপথে নানা ব্যাঘাত বা অন্তরায় আসে—অসুস্থতা, অলসতা, সন্দেহ, উদাসীনতা ইত্যাদি। এই বাধাগুলির প্রতিকার হলো মনোসংযম, বিশ্বাস, অধ্যবসায়, শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ম ও ঈশ্বর-চিন্তন।
সবশেষে, যোগের লক্ষ্য একটাই—চিত্তকে একাগ্র, স্থির ও স্বচ্ছ করা, যাতে চেতনা নিজের প্রকৃত স্বরূপে স্থিত হতে পারে। এই অবস্থাই সমাধি, আর এখানেই যোগের পরিপূর্ণতা।
সাধন-পাদ (অধ্যায় ২): যোগসূত্রের দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম সাধন-পাদ। এই অধ্যায়ে পতঞ্জলি প্রারম্ভিক অনুশীলন বা ক্রিয়া-যোগ সম্পর্কে বলেছেন। সূত্রটিতে বলা হয়েছে—তপঃ (সংযম), স্বাধ্যায় (আত্মপাঠ) এবং ঈশ্বর-প্রণিধান (ঈশ্বরের প্রতি আত্মসমর্পণ)—এই তিনটির সমষ্টিই ক্রিয়া-যোগ। (যোগসূত্র, ২.১)
পরবর্তী সূত্রে পতঞ্জলি এর উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন—এই ক্রিয়া-যোগের উদ্দেশ্য দুটি—প্রথমত, সমাধি বা একাগ্রতার অনুকূল মানসিক অবস্থা সৃষ্টি করা; দ্বিতীয়ত, ক্লেশ বা মানসিক বিকার (অবিদ্যা, আস্মিতা, রাগ, দ্বেষ, অভিনিবেশ) ক্ষয় করা। (যোগসূত্র ২.২)
এই তিনটি অনুশীলনের অর্থ—
তপঃ মানে সংযম, শৃঙ্খলা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ। এটি শরীর, মন ও ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখার সাধনা। এর উদ্দেশ্য কষ্ট দেওয়া নয়, বরং সহিষ্ণুতা, মনোসংযম ও স্থিতি বাড়ানো। নিয়মিত অনুশীলন, ব্রহ্মচর্য, উপবাস বা আত্মসংযম—সবই তপের অংশ।
স্বাধ্যায় মানে নিজের দ্বারা অধ্যয়ন বা আত্মপাঠ। এটি দুইভাবে প্রযোজ্য—এক, শাস্ত্র ও যোগবিধির পাঠ ও চিন্তা, যা আত্মজ্ঞানকে জাগায়; দুই, নিজের মনের পর্যবেক্ষণ—আমি কী ভাবছি, কেন ভাবছি, কেমন আচরণ করছি—এই আত্মবিচার। স্বাধ্যায় মনকে অন্তর্মুখ করে এবং জ্ঞানমুখী করে তোলে।
ঈশ্বর-প্রণিধান মানে ঈশ্বরের প্রতি আত্মসমর্পণ। এটি অন্ধ ভক্তি নয়, বরং অহং ত্যাগ করে সর্বোচ্চ চেতনার প্রতি ভরসা ও শ্রদ্ধা রাখা। যে-কাজই করা হোক, ফলের আসক্তি না রেখে তা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা। এতে মন নম্র, শান্ত ও স্থিত হয়।
সংক্ষেপে, তপঃ আনে শরীর ও ইন্দ্রিয়ের শুদ্ধি, স্বাধ্যায় জাগায় আত্মবোধ, আর ঈশ্বর-প্রণিধান আনে বিনয় ও অন্তঃশান্তি। এই তিনের সম্মিলনে চিত্তের ক্লেশ বা দুঃখের মূল কারণ ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়, মন স্থির হয়, এবং যোগের গভীর স্তর—সমাধির জন্য প্রস্তুত হয়।
ক্লেশ পাঁচটি—অবিদ্যা,অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ এবং অভিনিবেশ (২.৩–২.৯)। অবিদ্যা মানে অজ্ঞতা বা ভুল জানা, অস্মিতা মানে “আমি”-র অহংবোধ, রাগ মানে আকাঙ্ক্ষা, দ্বেষ মানে বিরাগ বা ঘৃণা, আর অভিনিবেশ মানে মৃত্যুভয় বা জীবনকে আঁকড়ে থাকা। এগুলির থেকেই কর্ম ও সংস্কার জন্ম নেয়, এবং তার ফলস্বরূপ দুঃখের অভিজ্ঞতা ঘটে (২.১২–২.১৪)।
অষ্টাঙ্গ-যোগ পতঞ্জলির যোগসূত্রের দ্বিতীয় অধ্যায়ে, সাধন-পাদে (সূত্র ২.২৯-২.৫৫) বর্ণিত হয়েছে। পতঞ্জলি বলেছেন, যোগের পূর্ণতা অর্জনের জন্য চিত্তকে ধীরে ধীরে শুদ্ধ ও স্থিত করার একটি আট-ধাপের পথ আছে, যাকে অষ্টাঙ্গ-যোগ বলা হয়। এই আটটি ধাপ হলো যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান এবং সমাধি।
যম মানে আচরণ-সংযম—সমাজে ও জীবনে নৈতিক শৃঙ্খলারক্ষা। যম যোগের প্রথম অঙ্গ, যার অর্থ নৈতিক সংযম বা আচরণবিধি। এর পাঁচটি উপাংশ হলো অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহ।
অহিংসা মানে কোনো প্রাণীর প্রতি চিন্তা, কথা বা কাজে হিংসা না করা। এটি দয়া, সহানুভূতি ও করুণার ভিত্তি।
সত্য মানে চিন্তা, বাক্য ও আচরণে সত্যনিষ্ঠ থাকা। সত্য শুধু কথায় নয়, মন ও কর্মেও অসত্য থেকে বিরত থাকা।
অস্তেয় মানে যা নিজের নয়, তা গ্রহণ না করা। অন্যের সম্পদ, ভাবনা বা কৃতিত্বে লোভ না করা এবং অন্যের অধিকার সম্মান করা।
ব্রহ্মচর্য মানে ইন্দ্রিয়সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণ। এটি কেবলই যৌন সংযম সংশ্লিষ্ট বিষয় নয়, বরং এটি সমস্ত ইন্দ্রিয়শক্তিকে সঠিক পথে ব্যবহার করাকে নির্দেশ করে।
অপরিগ্রহ মানে অপ্রয়োজনীয় জিনিস বা আকাঙ্ক্ষা জমিয়ে না রাখা। যত কম আসক্তি, তত বেশি স্বাধীনতা ও মানসিক স্বচ্ছতা।
এই পাঁচটি যম মানুষকে নৈতিকভাবে শুদ্ধ করে এবং সমাজ ও নিজের মধ্যে সমতা স্থাপন করে।
নিয়ম যোগের দ্বিতীয় অঙ্গ, যার অর্থ ব্যক্তিগত শৃঙ্খলা বা আত্মনিয়ন্ত্রণের নিয়ম। এটি মানুষকে অন্তর থেকে শুদ্ধ ও স্থির রাখে। এর পাঁচটি দিক হলো শৌচ, সন্তোষ, তপঃ, স্বাধ্যায় এবং ঈশ্বর-প্রণিধান।
শৌচ মানে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ পরিচ্ছন্নতা। শরীর, পরিবেশ ও মন—সব কিছু পরিষ্কার ও পবিত্র রাখা। শৌচে দেহের পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে মন থেকে ঈর্ষা, হিংসা ও আসক্তি দূর করাও অন্তর্ভুক্ত।
সন্তোষ মানে তৃপ্তি ও কৃতজ্ঞতা। যা আছে, তাতে শান্ত থাকা, অধিক চাওয়ার তৃষ্ণা কমানো এবং প্রতিটি অবস্থাকে শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করা। সন্তোষ মনকে শান্ত ও স্থিত রাখে।
তপঃ মানে শৃঙ্খলা ও আত্মসংযম। কষ্ট বা বাধার মধ্যেও মনকে অটল রাখা, নিয়মিত সাধনা করা এবং আত্মোন্নতির পথে স্থির থাকা।
স্বাধ্যায় মানে নিজের দ্বারা অধ্যয়ন ও আত্মপর্যবেক্ষণ। শাস্ত্রপাঠ, মন্ত্রজপ এবং নিজের মনের গঠন ও আচরণ পর্যবেক্ষণ—সবই স্বাধ্যায়ের অংশ।
ঈশ্বর-প্রণিধান মানে ঈশ্বরের প্রতি আত্মসমর্পণ। অহংবোধ ত্যাগ করে কর্মফল ঈশ্বরকে নিবেদন করা এবং জীবনের প্রতিটি কাজে ঈশ্বরচেতনা বজায় রাখা।
এই পাঁচটি নিয়ম মানুষকে অন্তর্মুখ, সংযত ও ঈশ্বরনিষ্ঠ করে তোলে। এগুলি যমের বাহ্যিক সংযমের সঙ্গে মিলিয়ে যোগীর চিত্তকে স্থিরতা ও শান্তির দিকে নিয়ে যায়।
আসন মানে দেহকে স্থির ও আরামদায়কভাবে ধরে রাখার অনুশীলন। আসনের মাধ্যমে শরীর ধীরে ধীরে ভারসাম্যপূর্ণ ও স্থিতিশীল হয়, যাতে দীর্ঘ সময় ধ্যানে বসা সম্ভব হয়।
প্রাণায়াম মানে শ্বাসের নিয়ন্ত্রণ। এটি প্রাণের প্রবাহকে নিয়মিত করে, দেহ ও মন উভয়কে স্থির ও শান্ত রাখে।
প্রত্যাহার মানে ইন্দ্রিয়কে বাহ্যবস্তুর থেকে ফিরিয়ে নেওয়া। মন তখন বাইরের পরিবর্তে অন্তর্মুখ হয়।
ধারণা মানে মনকে একবিন্দুতে বা একভাবনায় স্থির রাখা, যেমন কোনো মন্ত্র, প্রতীক বা চেতনা-বিন্দুতে মনোনিবেশ।
ধ্যান মানে সেই ধারণার ধারাবাহিক প্রবাহ, যেখানে মন একাগ্র হয়ে একটিমাত্র ভাবনায় নিমগ্ন থাকে।
সমাধি মানে মন, ধ্যান ও ধ্যেয় একাকার হয়ে যাওয়া। এই অবস্থায় মন সম্পূর্ণ স্থির, স্বচ্ছ ও চেতনার সঙ্গে মিশে যায়।
এই আটটি ধাপের অনুশীলনে চিত্ত ধীরে ধীরে বিশুদ্ধ ও স্থিত হয়। যখন মন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত ও স্থির হয়ে নিজের স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখনই যোগের পরিপূর্ণতা ঘটে।
যখন মন সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত, স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ হয়ে যায়, তখন এক বিশেষ জ্ঞান উদ্ভাসিত হয়, যাকে বলা হয় ‘বিবেকখ্যাতি’।
বিবেকখ্যাতি মানে হলো অবিচল ও স্পষ্ট ভেদজ্ঞান—যেখানে যোগী বুঝতে পারেন যে, দ্রষ্টা (পুরুষ) এবং দৃশ্য (প্রকৃতি) এক নয়। পুরুষ হলো নিঃস্পৃহ, চিরসচেতন সাক্ষী; আর প্রকৃতি হলো পরিবর্তনশীল জগৎ—দেহ, মন, ইন্দ্রিয় ও চিন্তার সমষ্টি।
সাধক কবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্য রচিত শ্যামাসংগীতে পাই—“শ্যামা কখনো পুরুষ, কখনো প্রকৃতি, কখনো শূন্যরূপা রে।” এই ভাবনার মূল হলো শাক্ত দর্শন ও অদ্বৈত বেদান্তের সংমিশ্রণ, যেখানে দেবী কালী বা শ্যামাকে পরম সত্যরূপে দেখা হয়েছে।
কমলাকান্ত ভট্টাচার্য রামপ্রসাদী ধারার সাধককবি। তাঁর সাধনায় শ্যামা কেবল দেবী নন, তিনি একাধারে মহাশক্তি ও পরম চেতনা। তাই তিনি কখনো প্রকৃতি, কখনো পুরুষ, আবার কখনো শূন্যরূপা—এই তিন রূপেই একই সত্তা।
পুরুষ শব্দটি সাংখ্য ও বেদান্তে চেতনা বা দ্রষ্টাকে বোঝায়। পুরুষ অচল, অক্রিয়, নিস্পৃহ ও চিরচেতন। তিনি কিছু করেন না, কেবল সাক্ষী থাকেন।
প্রকৃতি মানে ত্রিগুণাত্মিকা শক্তি—সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—যার দ্বারা সৃষ্টি, পালন ও লয় ঘটে। প্রকৃতি সক্রিয়, গতিময় ও জগতের রূপকার।
কমলাকান্তের দৃষ্টিতে, শ্যামা কখনো সেই অচল চেতনা, আবার কখনো সেই গতিশীল শক্তি। তিনি একদিকে পুরুষরূপে নীরব সাক্ষী, অন্যদিকে প্রকৃতিরূপে নৃত্যময় সৃষ্টিশক্তি।
অদ্বৈত বেদান্তে ব্রহ্ম ও মায়া পৃথক নয়। ব্রহ্ম যখন স্থিত, তখন তিনি পুরুষ—নির্গুণ, অচল ও নির্লিপ্ত। ব্রহ্ম যখন প্রকাশিত, তখন তিনি প্রকৃতি—সগুণ, গতিময় ও সৃষ্টিশীল। এই দুই রূপ একই পরম সত্তার দুই দিক।
যখন শ্যামা পুরুষ, তখন তিনি নিস্পৃহ চেতনা। যখন তিনি প্রকৃতি, তখন তিনি ক্রিয়ার উৎস। আর যখন তিনি শূন্যরূপা, তখন তিনি এই দুইয়েরও ঊর্ধ্বে—নির্গুণ ব্রহ্ম, যেখানে কোনো গুণ, নাম বা ক্রিয়া নেই।
কমলাকান্তের সাধনায় এই উপলব্ধি সম্পূর্ণ অদ্বৈত। তিনি দেখেছেন, ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ। শ্যামা-ই পুরুষ, শ্যামা-ই প্রকৃতি, শ্যামা-ই শূন্য। তিনিই চেতনা, তিনিই মায়া, তিনিই পরম সত্য। শ্যামা সেই অদ্বৈত ব্রহ্মশক্তি, যিনি একই সঙ্গে অচল চেতনা ও চলমান মায়া, আর শেষপর্যন্ত সেই দুইয়েরও ঊর্ধ্বে পরম, নির্গুণ, তুরীয় সত্তা।
যখন এই ভেদ স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, তখন আর বিভ্রম থাকে না। মানুষ আর “আমি দেহ” বা “আমি কর্তা” বলে ভুল করে না। সে জানে, “আমি শুধু দর্শক, চেতনা মাত্র”। এই অবস্থাই মুক্তির সূচনা, কারণ এখানেই অবিদ্যা ভেঙে যায় এবং আত্মা নিজের স্বরূপে স্থিত হয়—অপরিবর্তনীয়, শান্ত ও স্বাধীন চেতনা হিসেবে।