অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: তিন



অবিদ্যা সম্পর্কে বলা হয়: এটি সহজাত (svabhāvika) ও অনাদি (anādi)—এর কোনো শুরু নেই। আবার এটি জ্ঞান দ্বারা নিবারিত (jñāna-nivartya)—সত্যজ্ঞান উদিত হলে অবিদ্যা বিলীন হয়। দর্শনের সাধারণ নিয়ম হলো: যা অনাদি, তা নিত্য (চিরস্থায়ী), তাই তার বিলয় হয় না। যেমন: ন্যায়-বৈশেষিক মতে পরমাণুর গুণ (যেমন কৃষ্ণত্ব বা কালো রং) অনাদি—তাই শাশ্বত, নিবারণীয় নয়; কিন্তু অবিদ্যা—যদি সত্যিই অনাদি হয়, তবে সেটিও নিত্য হওয়া উচিত, আর জ্ঞানে নিবারণীয় হওয়া উচিত নয়।

স্ববিরোধের জায়গাটা এখানেই। বলা হচ্ছে, অবিদ্যা শুরুহীন বা অনাদি (অতএব, নিত্য)। আবার বলা হচ্ছে, জ্ঞান দ্বারা অবিদ্যার নাশ হয় (অবিদ্যা শেষযোগ্য)। দুইটি দাবি পরস্পর-বিরোধী। এই দ্বন্দ্ব থেকে দার্শনিকরা বলেন: “অবিদ্যা অনাদি ও জ্ঞাননিবার্য—দুটো একসাথে বলা যৌক্তিকভাবে অসংগত।” কারণ, এতে “অনাদিত্ব” বৈশিষ্ট্যটি সঠিকভাবে টেকে না। অবিদ্যাকে একইসাথে “অনাদি” (শুরুহীন, নিত্য) এবং “জ্ঞান দ্বারা নিবার্য” বলা যায় না, কারণ শুরুহীনতা মানে সাধারণত চিরস্থায়ীতা, আর নিবারণীয় মানে ক্ষণস্থায়ীতা—এই দুই অবস্থান একত্র করলে স্ববিরোধ তৈরি হয়।

৩. শুরুরহিত এবং অনির্বচনীয় অজ্ঞতা (Anādi-anirvacanīya ajñānam):

এই সংজ্ঞাটি "অনাদি" দিকটিকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করে এবং "অনির্বচনীয়ত্ব"-এর ধারণা প্রবর্তন করে। এখানে বলা হয়, অবিদ্যা হলো তা-ই, যা অনাদি এবং যাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। "অনির্বচনীয়" (Anirvācya)-এর মূল ধারণাটি স্পষ্ট করা হয়েছে: যা সত্তা (Bhāva) বা নঞসত্তা (Abhāva)—কোনোটিই নয়। এ দ্বারা বোঝাতে চাওয়া হয়, অবিদ্যা এমন কিছু, যা অস্তিত্ব বা অনস্তিত্বের প্রচলিত বিভাগগুলির বাইরে অবস্থিত, এবং তাই এটিকে কোনো প্রচলিত সংজ্ঞার ছাঁচে ফেলা যায় না। এটি অদ্বৈত বেদান্তের কেন্দ্রীয় ধারণাগুলির মধ্যে একটি, যেখানে অবিদ্যাকে "সদসদ্বিলক্ষণ" বলা হয়, অর্থাৎ যা সৎ (অস্তিত্বশীল) ও অসৎ (অনস্তিত্বশীল) উভয় থেকেই ভিন্ন। এটি একধরনের রহস্যময় সত্তা, যা মায়ার সৃষ্টি করে, কিন্তু নিজে সৎও নয়, অসৎও নয়।

‘সদসদ্বিলক্ষণ’ (Sadasadvilakṣaṇa) হলো অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পারিভাষিক শব্দ, যা অবিদ্যা বা মায়ার প্রকৃতি বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়। এটি মূলত একটি সংস্কৃত যৌগ শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ হলো—সৎ (Sat): বিদ্যমান বা বাস্তব (Exist/Real)। অসৎ (Asat): বিদ্যমান নয় বা অবাস্তব (Non-existent/Unreal)। বিলক্ষণ (Vilakṣaṇa): থেকে ভিন্ন বা স্বতন্ত্র (Distinct from)। অতএব, সদসদ্বিলক্ষণ বলতে বোঝায়, যা সৎ (বিদ্যমান বা বাস্তব) এবং অসৎ (অবিদ্যমান বা অবাস্তব)—উভয় থেকেই ভিন্ন বা স্বতন্ত্র। অদ্বৈত বেদান্ত এই পদটি প্রধানত অবিদ্যা (বা মায়া) এবং মায়ার কার্য বা এই দৃশ্যমান জগৎকে সংজ্ঞায়িত করতে ব্যবহার করে। এটি এমন একটি সত্তাতাত্ত্বিক অবস্থান, যা প্রচলিত অস্তিত্ব বা অনস্তিত্বের কোনো বিভাগেই পড়ে না।


১. কেন এটি 'সৎ' নয়? (অবাস্তবতা)—অবিদ্যাকে 'সৎ' বলা যায় না, কারণ এটি জ্ঞান দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয় (অপসারিত হয়)। যা চূড়ান্ত সত্য বা অপরিবর্তনীয়, তা কখনও অপসারিত হতে পারে না। ব্রহ্মই একমাত্র সৎ, যা ত্রিকালেও (ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান) অপরিবর্তিত থাকে। যেহেতু অবিদ্যা ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পর বিলীন হয়ে যায়, তাই এটি মিথ্যা বা অবাস্তব।


২. কেন এটি 'অসৎ' নয়? (ভাবরূপতা)—অবিদ্যাকে পুরোপুরি 'অসৎ' বা অবাস্তব বলাও যায় না, কারণ এটি প্রকাশিত হয় এবং কার্য সৃষ্টি করে। অসৎ বস্তু (যেমন, বন্ধ‍্যা-পুত্র বা আকাশে ফুল) কোনো কার্য সৃষ্টি করতে পারে না। কিন্তু অবিদ্যা এই দৃশ্যমান জগৎ ও জীবের বন্ধন সৃষ্টি করে এবং অভিজ্ঞতায় অনুভূত হয়। তাই অবিদ্যা হলো ভাবরূপ (Positive Entity), নিছক শূন্যতা বা জ্ঞানের অভাব নয়।


৩. সদসদ্বিলক্ষণ-এর সিদ্ধান্ত—যেহেতু অবিদ্যাকে সৎও বলা যায় না (কারণ তা বিনাশী) এবং অসৎও বলা যায় না (কারণ তা কার্যকারী ও অনুভূত), তাই অদ্বৈত সিদ্ধান্তীগণ এটিকে একটি তৃতীয় শ্রেণিতে স্থান দেন, যা হলো সদসদ্বিলক্ষণ বা অনির্বচনীয় (যা সংজ্ঞায়িত করা যায় না)।


সংক্ষেপে, সদসদ্বিলক্ষণ হলো একটি সত্তাতাত্ত্বিক রহস্য, যা মিথ্যাত্বকে নির্দেশ করে—যা বাস্তবও নয়, আবার অবাস্তবও নয়, বরং ভ্রান্তি বা আপেক্ষিক সত্য। এটি অদ্বৈত বেদান্তের মূল ভিত্তি, যা ব্রহ্মের একত্ব এবং জগতের মিথ্যাত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

তবে, এই সংজ্ঞাটিও ভুল বলে বিবেচিত। এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তিটি হলো: অবিদ্যা অস্তিত্ব এবং অনস্তিত্ব থেকে সেই স্বতন্ত্রতা ধারণ করে না, যা প্রকৃতই সংজ্ঞার অতীত হওয়ার জন্য প্রয়োজন। এই দার্শনিক প্রেক্ষাপটে অনির্বচনীয়তা দু-প্রকার বলে উপস্থাপন করা হয়েছে:

১. সংজ্ঞার বস্তুর অভাব (Nirvacana-viṣayatā-bhāvaṁ): এটি এমন কিছুকে বোঝায়, যা কেবল ধারণাগতভাবে উপলব্ধি করা বা সংজ্ঞায়িত করা যায় না। এটি হয়তো আমাদের জ্ঞানগত সীমাবদ্ধতার কারণে ঘটতে পারে, যেখানে আমরা কোনো বস্তুর পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা দিতে অক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, প্রেম বা চেতনার মতো বিমূর্ত ধারণাগুলিকে পুরোপুরি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন হতে পারে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তারা অস্তিত্ব এবং অনস্তিত্বের বাইরে।

২. অস্তিত্ব এবং অনস্তিত্ব থেকে স্বতন্ত্রতা (Bhāvābhāva-vilakṣaṇatvaṁ): এটি অনির্বচনীয়তার একটি আরও গভীর রূপ, যেখানে সত্তাটি অস্তিত্ব এবং অনস্তিত্বের বিভাগগুলিকে অতিক্রম করে। এটি এমন বস্তু, যা প্রচলিত দার্শনিক কাঠামোতে অস্তিত্ব বা অনস্তিত্বের কোনো শ্রেণিতেই পড়ে না। এটি এমন একটি অবস্থা, যেখানে সত্তাটি বিদ্যমান বা বিদ্যমান নয়—কোনোটিই বলা যায় না। অদ্বৈত বেদান্তের মতে, একমাত্র ব্রহ্মই সত্য, জগৎ মায়িক, এবং মায়াকে এই দ্বিতীয় প্রকারের অনির্বচনীয় বলা হয়।

দ্বিতীয় প্রকারের অনির্বচনীয়তা অবিদ্যার মধ্যে উপস্থিত নেই। ব্যাবহারিক অর্থে অবিদ্যা সংজ্ঞায়িত করা কঠিন হতে পারে (যা প্রথম প্রকারের অনির্বচনীয়তার আওতায় পড়ে), কিন্তু এই সংজ্ঞার জন্য প্রয়োজনীয় উপায়ে এটি মৌলিকভাবে অস্তিত্ব বা অনস্তিত্বের বিভাগগুলিকে অতিক্রম করে না। অর্থাৎ, অবিদ্যাকে হয় অস্তিত্বের একটি রূপ (যেমন একটি মানসিক অবস্থা) অথবা অনস্তিত্বের একটি রূপ (যেমন জ্ঞানের অভাব) হিসাবে দেখা যেতে পারে, কিন্তু এটি উভয় থেকেই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র নয়। এটি ব্রহ্মের মতো পরম সত্তা নয়, যা সত্তা-অসত্তার ঊর্ধ্বে। অতএব, এটিকে কেবল অনির্বচনীয় হিসাবে চিহ্নিত করা একটি দৃঢ় দার্শনিক সংজ্ঞা প্রদান করে না। এটি তার অনন্য সত্তাগত মর্যাদাকে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয় এবং কেবল ধারণাগত অস্পষ্টতার জন্ম দেয়।

৪. ভ্রমের উপাদান কারণই অজ্ঞতা (Bhramopādānaṁ ajñānam):

সবশেষে, এই প্রস্তাবনাটি তুলে ধরা হয় যে, অবিদ্যা হলো ভ্রমের (Bhramaṁ) উপাদান কারণ। এটি বোঝা সহজ যে, অজ্ঞতা ভুল ধারণা ও ভ্রান্ত উপলব্ধির জন্ম দেয়। যেমন, রজ্জুতে সর্পভ্রম অজ্ঞতার কারণেই ঘটে। এখানে দড়ি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবের কারণে সর্পের ভ্রম সৃষ্টি হয়। ঠিক যেমন মাটি একটি পাত্রের উপাদান কারণ, তেমনি অবিদ্যাও, এই দৃষ্টিকোণে, হবে মৌলিক উপাদান বা শর্ত, যেখান থেকে ভ্রম ও বিভ্রমের সমস্ত রূপ প্রকাশিত হয়। এটি একটি আকর্ষণীয় সংজ্ঞা, কারণ এটি সরাসরি অবিদ্যাকে আমাদের মিথ্যা বা ভুল উপলব্ধি হিসাবে অনুভূত ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করে। তবুও, এই সংজ্ঞাটিও সঠিক নয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

এর চূড়ান্ত খণ্ডনটি আত্মা (Ātmāvuṁ) এবং সত্যের (Satya) সঙ্গে এর সম্পর্কের প্রকৃতির গভীরে প্রবেশ করে। আত্মাকে ভ্রমের উপাদান কারণ হিসাবে দেখা উচিত নয়, বরং আত্মাই হলো সত্যের (Truth/Reality) উপাদান কারণ। আত্মা পরম সত্য এবং সকল বাস্তবতার চূড়ান্ত ভিত্তি। এটি বিশুদ্ধ, কলুষমুক্ত এবং যা-কিছু সত্য ও বাস্তব, তার উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়। আত্মাকে ভ্রম সৃষ্টির কারণ হিসাবে আরোপ করাটা তার নিখুঁত প্রকৃতিকে ক্ষুণ্ন করবে, কারণ আত্মা নিজেই কোনো ভ্রমের কারণ হতে পারে না।

এরপর একটি গুরুত্বপূর্ণ পালটা-যুক্তি উপস্থাপন করা হয়: যদি বলা হয় যে, ভ্রম (Bhramaṁ) সত্য (Satyaṁ), কারণ তা আত্মা (Ātmāv-ennanāl), তবে তা সঠিক নয়। এটি একটি মৌলিক পার্থক্য তুলে ধরে। যদিও আত্মা চূড়ান্তভাবে সত্য, এবং সম্ভবত সমস্ত বাস্তবতার ভিত্তি, এর অর্থ এই নয় যে, অবিদ্যা থেকে উদ্ভূত ভ্রম নিজেই সত্য, কেবল এই কারণে যে, এটি চূড়ান্তভাবে আত্মা দ্বারা বজায়-রাখা সীমার মধ্যে আবির্ভূত হয়। ভ্রম হলো বাস্তবতার মধ্যে একটি আভাস—যা আত্মার মতো নিজের মধ্যে নিজেই কোনো বাস্তবতা রূপে আবির্ভূত নয়। উদাহরণস্বরূপ, মরুভূমিতে মরীচিকা দেখা যায়, মরুভূমিটি বাস্তব, কিন্তু মরীচিকাটি (জল) নিজে বাস্তব নয়। একইভাবে, ভ্রম এবং বিভ্রম, যদিও আত্মার প্রেক্ষাপটে ঘটে, সেগুলি অবিদ্যার পণ্য, আত্মা নিজে তা নয়। তারা আত্মার দ্বারা সৃষ্ট হয় না, বরং অবিদ্যার প্রভাবেই আত্মার উপর আরোপিত হয়।

ভ্রমের নিজস্ব অস্তিত্ব (svarūpa-sattā) রয়েছে, যার অর্থ, এটি একটি স্বতন্ত্র ঘটনা, সরাসরি আত্মা থেকে এর উপাদান কারণ হিসাবে উদ্ভূত নয়, এবং তাই, ভ্রমের উপাদান কারণ হিসাবে অবিদ্যা একটি অপর্যাপ্ত সংজ্ঞা। ভ্রমের এই "নিজস্ব অস্তিত্বে"-র সঠিক প্রকৃতি ও উৎস আরও আলোচনার দাবি রাখে, যা অবিদ্যার প্রকৃত সারমর্মকে কেবলই ভ্রমে সীমাবদ্ধ করে রাখার অসারত্বকে তুলে ধরে। এই অনির্ণয়ই প্রমাণ করে—অবিদ্যার প্রকৃত সত্তাকে নির্দিষ্টভাবে ঘিরে ফেলা দার্শনিকভাবে অত্যন্ত দুরূহ। অবিদ্যার এই বৈশিষ্ট্য তাকে প্রচলিত কার্যকারণ সম্পর্ক থেকে পৃথক করে এবং তাকে একটি স্বতন্ত্র দার্শনিক অবস্থানে স্থাপন করে।

যদিও বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায় অবিদ্যার বহুমুখী এবং দুর্বোধ্য প্রকৃতিকে উন্মোচন করে তাকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছে, প্রতিটি প্রচেষ্টা শেষপর্যন্ত স্ববিরোধিতা বা অতিব্যাপ্তির দোষে দুষ্ট হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, অবিদ্যা নিছক একটি নেতিবাচক ধারণা বা জ্ঞানের অভাব নয়; এটি একটি মৌলিক ইতিবাচক সত্তা, যার নিজস্ব অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা প্রচলিত যৌক্তিক কাঠামোতে আবদ্ধ করা কঠিন। অবিদ্যার এই অনির্ণয়যোগ্যতা তার গভীরতা এবং মানুষের অস্তিত্ব ও উপলব্ধিতে তার মৌলিক প্রভাবকে আরও জোরদার করে। অবিদ্যার চূড়ান্ত নিবৃত্তিই মোক্ষ বা আত্ম-উপলব্ধির পথ, কিন্তু সেই মোক্ষের পূর্বশর্ত হিসেবে অবিদ্যার প্রকৃত স্বরূপ অনুধাবন করা অপরিহার্য। এই অনুসন্ধান শেষপর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, অবিদ্যার প্রকৃত সংজ্ঞা তার অনাদি, অনির্বচনীয়, এবং ভাবরূপ সত্তার মধ্যেই নিহিত, যা প্রচলিত যুক্তি ও ভাষা দিয়ে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

ভারতীয় দর্শনে, বিশেষ করে অদ্বৈত বেদান্ত এবং ন্যায়-বৈশেষিক মতবাদের মধ্যে, 'অবিদ্যা' (Avidyā/Ajñāna) বা অজ্ঞানতা এবং 'জ্ঞানের অভাব' (Jñānābhāva)-এর মধ্যে পার্থক্য একটি গভীর এবং জটিল দার্শনিক বিতর্ক। এই বিতর্কমূলক আলোচনাটি কেবল শব্দের আভিধানিক অর্থ নিয়ে নয়, বরং বাস্তবতা, জ্ঞানতত্ত্ব, এবং মুক্তির ধারণার মৌলিক ভিত্তি নিয়ে—যা অবিদ্যাকে নিছক জ্ঞানের অনুপস্থিতি হিসাবে দেখার তার্কিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং এটিকে একটি স্বতন্ত্র, ইতিবাচক সত্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার অদ্বৈত বেদান্তের প্রচেষ্টার মধ্যে মূল পার্থক্যগুলি উন্মোচন করে।

১. অবিদ্যার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা: "আমি অজ্ঞ" (Aho’haṁ / Ajño’haṁ):

অদ্বৈত মতের মূল দাবি ও ব্যাখ্যা: অদ্বৈত বেদান্তের অনুসারীরা মনে করেন, "আমি অজ্ঞ" (Aho’haṁ / Ajño’haṁ)—এই প্রত্যক্ষ উপলব্ধি অবিদ্যার অস্তিত্বের প্রধান প্রমাণ (pramāṇam)। এই উপলব্ধি কোনো পরোক্ষ অনুমান বা বিশ্লেষণ নয়, বরং অজ্ঞতার একটি সরাসরি, স্বতঃসিদ্ধ জ্ঞান। যখন একজন ব্যক্তি বলে, "আমি জানি না," তখন সে কেবল কোনো নির্দিষ্ট তথ্য বা জ্ঞান না থাকার কথা বলছে না, বরং নিজের মধ্যে বিদ্যমান একটি গভীরতর অজ্ঞতার অবস্থাকে নির্দেশ করছে। এই অভিজ্ঞতা অবিদ্যার একটি স্বতন্ত্র, ভাবরূপ (positive entity) সত্তা হিসাবে উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয়, যা কেবল আলোর অনুপস্থিতি নয়, বরং অন্ধকার নিজেই।