অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: ছিয়ানব্বই



সব পথের লক্ষ্য একটাই—চিন্তার অবসান, ধ্বনির অর্থে স্থিতি, এবং স্ব-স্ফূর্ত তুরীয়-নিষ্ঠা, যেখানে ধ্বনি, ভাবনা ও জপ সব বিলীন হয়ে কেবল চেতনা অবশিষ্ট থাকে, কেননা ব্রহ্ম নিজে কোনো পদ্ধিতে সীমাবদ্ধ নন; তিনি সর্বপদ্ধি-অতিক্রান্ত।

অদ্বৈত বেদান্তে মুক্তির একমাত্র কারণ হলো ব্রহ্ম-জ্ঞান—নিজেকে ব্রহ্মরূপে জানা। কিন্তু এই জ্ঞানের উদয় ঘটার জন্য চিত্তকে প্রস্তুত হতে হয়; আর “ওঁ”-উপাসনা সেই প্রস্তুতির অন্যতম শক্তিশালী উপায়। “ওঁ”-জপ ও ধ্যান মনকে ধীরে ধীরে নির্মল, স্থিত ও অন্তর্মুখ করে। যখন মন বিশুদ্ধ ও স্থির হয়, তখন শ্রবণ (শাস্ত্রশ্রবণ), মনন (যুক্তিচিন্তা) এবং নিদিধ্যাসন (গভীর ধ্যান)—এই তিন ধারায় মহাবাক্যের অর্থ স্বচ্ছভাবে উদ্ঘাটিত হয়।

উপাসনা এবং বিবেক—এই দুই সাধনা একত্রে চললে চিহ্ন ও তত্ত্ব একাকার হয়ে যায়। প্রতীক “ওঁ” তখন কেবল ধ্বনি নয়, তার “বাচ্য”—যাকে “ওঁ” নির্দেশ করে, সেই ব্রহ্ম—উন্মুক্ত ও স্ব-প্রকাশিত হয়। আর যদি কেউ কেবল শব্দেই আটকে থাকে, তবে ধ্বনি-স্তরে সীমাবদ্ধ থাকে; তুরীয় বা চূড়ান্ত চেতনা প্রকাশ পায় না। আবার যদি কেবল দর্শনচর্চায় রত থাকে, কিন্তু চিত্তের স্থিরতা না আসে, তবে অনুধ্যান সিদ্ধ হয় না। এজন্য অদ্বৈতে, সমন্বয়ই কৌশল—উপাসনা দেয় অন্তঃশুদ্ধি ও মনোসংযম, আর বিবেক দেয় জ্ঞানের আলো; উভয় মিলেই ঘটে ব্রহ্ম-অনুভব।

অতিরিক্ত উচ্চারণের জোর, অনিয়ন্ত্রিত কুম্ভক বা জোরালো রণধ্বনি, কিংবা ধ্যানের সময় কল্পচিত্রে আসক্তি—সবই নাড়ি, মন ও প্রাণে অপ্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাই “ওঁ”-সাধনা সর্বদা গুরুর নির্দেশে ধীরে ধীরে করতে হয়। সাধনার স্বাভাবিক ক্রম—প্রথমে বৈখরী, অর্থাৎ শ্রুত জপ বা উচ্চারণযোগ্য ধ্বনি; এরপর মানসিক জপ, যেখানে শব্দ অন্তর্মুখ হয়; তারপর নাদের অনুসন্ধান, যেখানে ধ্বনি সূক্ষ্ম হয়ে যায়; এবং শেষে নিস্তব্ধ ধারণা, যেখানে ধ্বনি নিঃশেষ হয়ে কেবল চেতনা অবশিষ্ট থাকে।

সাধনার মাপকাঠি একটাই—আসক্তি, ভয় ও ক্রোধ ক্রমে ক্ষয় হচ্ছে কি, আর অনুকম্পা, সমতা ও স্বচ্ছতা বাড়ছে কি—তা। যদি এগুলি না ঘটে, তবে বুঝতে হয়, পদ্ধতি অনুপযুক্ত এবং সেটি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। কারণ কোনো পদ্ধতিই নিজে গন্তব্য নয়; সবই পথ মাত্র।

“ওঁ”-এর ধ্বনি-রূপ শাস্ত্রসম্মত ও গুরুপ্রবর্তিত উপায়—ধ্যান, জপ, একাগ্রতার জন্য। কিন্তু অর্থে স্থিত “ওঁ” হলো ব্রহ্মস্মরণ; আর অর্থ-স্বরূপ যে-ব্রহ্ম, তিনি ধ্বনি-অতিক্রান্ত, নীরব ও স্বয়ংপ্রকাশ। তত্ত্বগতভাবে “ওঁ” এবং ব্রহ্ম এক নয়; কিন্তু সাধনায় “ওঁ” হচ্ছে ব্রহ্মের দ্বার। প্রতীকের কাজ শেষ হলে প্রতীক নিজে মিলিয়ে যায়; যা অবশিষ্ট থাকে, তা আত্ম-প্রকাশ, তুরীয়, নির্গুণ ব্রহ্ম।

ব্রহ্ম (Brahman) ও ব্রহ্মা (Brahmā) এক জিনিস নয়। ব্রহ্ম হলো সর্বোচ্চ, নির্গুণ-নিরাকার পরম সত্তা; আর ব্রহ্মা হলো পুরাণ-প্রচলিত “সৃষ্টিকর্তা দেবতা”, মহাজাগতিক শৃঙ্খলার ভেতরের এক পদ/ব্যক্তি। নিচে এদের মধ্যকার পার্থক্য ও মিল-অমিলগুলো লিখছি—

নাম, ব্যাকরণ ও উচ্চারণ: Brahman (ব্রহ্ম): সংস্কৃত নপুংসকলিঙ্গ শব্দ brahman, যার অর্থ—বিস্তৃতি/বৃহত্ত্ব থেকে ‘অসীম চেতনা’; উচ্চারণে শেষে -n ধ্বনি নিহিত; আর বাংলায় “ব্রহ্ম”। Brahmā (ব্রহ্মা): পুংলিঙ্গ, দীর্ঘ আ-কার—brahmā। চার-মুখবিশিষ্ট পুরাণীয় দেবতা; আর বাংলায় “ব্রহ্মা”। আবার Brāhmin (ব্রাহ্মণ) হচ্ছে পুরোহিত-বর্গ; আর Brāhmaṇa বেদীয় গদ্য-খণ্ড। এগুলোও আলাদা। অনেক সময় ইংরেজিতে “Brahma” লিখে Brahman বোঝানো হয়—এখানেই বড়ো কনফিউশনটা হয়।

সত্তাতত্ত্ব—কে কী: ব্রহ্ম (Brahman) হচ্ছে উপনিষদ্‌বর্ণিত পরম সত্য—সৎ-চিত্-আনন্দরূপ, নিরাকার, নির্গুণ, অদ্বিতীয়। সময়-স্থান-কারণের ঊর্ধ্বে; সব কিছুর আধার, কিন্তু কোনো কিছুর দ্বারা শর্তিত নন। অদ্বৈতে এটি পারমার্থিক সত্য। ব্রহ্মা (Brahmā): সৃষ্টির আরম্ভে “হিরণ্যগর্ভ/ঈশ্বর”-প্রণোদিত একটি ব্যাবহারিক (vyāvahārika) স্তরের দেবতা/পদ। বহু পুরাণে তিনি বিশ্ব-রূপায়ণ (নাম-রূপ-লয়) পরিচালনা করেন; একেক কল্পে একেক ব্রহ্মা—মানে, পদটি বদলায়।

‘শর্তিত অর্থ’ মানে এমন অর্থ, যা নিজের মধ্যে সম্পূর্ণ নয়, বরং কোনো শর্ত, প্রসঙ্গ বা অবস্থার ওপর নির্ভর করে প্রকাশ পায়। যখন কোনো শব্দ বা ধারণা স্বতঃসিদ্ধ নয়, বরং নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বা শর্তসাপেক্ষে সত্য হয়, তখন তার অর্থকে শর্তিত বলা হয়। যেমন “অগ্নি দাহক”—এই অর্থ শর্তিত, কারণ অগ্নি তখনই দাহক, যখন তা কোনো দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে আসে। “দাহকতা” তখন শর্তসাপেক্ষে কার্যকর।

দর্শনে, বিশেষ করে অদ্বৈত ও ন্যায়-দর্শনে, ‘শর্তিত অর্থ’ মানে ব্যাবহারিক বা আপেক্ষিক অর্থ, যা নির্দিষ্ট অবস্থা বা দৃষ্টিকোণ থেকে সত্য। যেমন, “জগৎ সত্য”—এই সত্যতা ব্যাবহারিক বা শর্তিত; কিন্তু পরমার্থে, অর্থাৎ শর্ত-অতিক্রান্ত দৃষ্টিতে, জগৎ মিথ্যা এবং ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। অতএব, ‘শর্তিত অর্থ’ হল সেই অর্থ, যা কেবল কোনো বিশেষ শর্ত বা অবস্থার অধীনে প্রযোজ্য, এবং এটি অশর্তিত বা পরমার্থিক অর্থের বিপরীত।

উপনিষদের দৃষ্টিতে “অহম্‌ ব্রহ্মাস্মি”, “তৎ ত্বমসি”, “প্রজ্ঞ্যানম্‌ ব্রহ্ম”—এসব বাক্যই ব্রহ্ম-জ্ঞান নির্দেশ করে। এখানে “ব্রহ্মা” নামে কোনো দেবতাস্বরূপ সৃষ্টিকর্তাকে বোঝানো হয় না; উদ্দেশ্য একমাত্র নিরাকার, নির্গুণ, চেতনা-স্বরূপ পরম ব্রহ্ম। গীতায় “প্রণব” বা “ওঁ”-কে বলা হয়েছে স্মরণ ও ধ্যানের সোপান, এবং “ব্রহ্ম” বা “অক্ষর”-কে পরম ধাম বা চূড়ান্ত গন্তব্য। অর্থাৎ “ওঁ”-জপ মনকে কেন্দ্রীভূত করে সেই অক্ষর ব্রহ্মের উপলব্ধির পথে নিয়ে যায়। যোগসূত্রে বলা হয়েছে, “তস্য বাচকঃ প্রণবঃ”—অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রকাশ বা নাম-রূপ হল “ওঁ”। কিন্তু এই ঈশ্বর বা সগুণ ব্রহ্মও পরমার্থে নির্গুণ ব্রহ্মেই লীন। ঈশ্বর রূপে ধ্যান হলো পথ; ব্রহ্মরূপে চেতনা হলো পরিণতি। পুরাণে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও রুদ্র—এই ত্রিমূর্তি ব্যাবহারিক জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের প্রতীক। দিন-রাত মিলিয়ে এক ব্রহ্মার কালচক্র ৪.৩২ বিলিয়ন বছর ধরে চলে। এক-শো ব্রহ্ম-বর্ষের পূর্ণায়ু প্রায় ৩১১ ট্রিলিয়ন বছরের সমান। এই বিশাল সময়মাত্রাও মায়ার অন্তর্গত; পরমার্থে ব্রহ্ম কাল-অতিক্রান্ত ও অপরিবর্তনীয়।

অদ্বৈত ব্যাখ্যায় স্তরভেদে এই সমাধান দেওয়া হয়:

ব্রহ্ম হলো পরম, অদ্বিতীয়, নিরাকার, নির্গুণ, ধ্বনি-রূপ-গুণাতীত চেতনা—যাকে বলে পরমার্থিক সত্য। এই স্তরে কোনো নাম, রূপ, গুণ, বা কর্মের প্রযোজন নেই; ব্রহ্ম কেবল স্ব-স্বরূপ সত্তা ও চৈতন্য।

ঈশ্বর হলো সেই একই ব্রহ্ম, কিন্তু মায়া-উপাধি-সহ। মায়া যুক্ত হলে ব্রহ্ম ব্যাবহারিক জগতে সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, সৃষ্টিকর্তা ও নিয়ন্তা রূপে প্রতীয়মান হন। এটি ব্যাবহারিক বা আপেক্ষিক স্তর—যেখানে সগুণ ব্রহ্মই ঈশ্বর।

ব্রহ্মা হলো এই সগুণ-ঈশ্বরের অধীন “সৃষ্টির কার্যনির্বাহী”—একপ্রকার “সৃষ্টির কর্তা” বা পদ। একেক কল্পে (চিন্তন-গঠিত বা মনন-নির্মিত “ধারণা”, “ব্যাখ্যার ধরন”, বা “তত্ত্বগত অনুমান”—যেমন “ব্রহ্ম-কল্প”, “মায়া-কল্প”, “প্রতিবিম্ব-কল্প”) ভিন্ন জ্যোতিষ্মান সত্তা এই ব্রহ্মা-পদে অধিষ্ঠিত হন; তাই ব্রহ্মা কোনো চিরন্তন ব্যক্তি নয়, বরং একটি মহাজাগতিক দায়িত্ব বা ভূমিকা।

অর্থাৎ, ব্রহ্মা ঈশ্বরীয় ব্যবস্থার অংশমাত্র; ঈশ্বর সেই ব্যবস্থা পরিচালনাকারী সত্তা; আর ব্রহ্ম সেই পরম, নিরুপাধি চেতনা—যার উপর পুরো “ব্যবস্থা” দাঁড়িয়ে আছে। ব্রহ্ম ভিত্তি, ঈশ্বর পরিচালনাকারী, ব্রহ্মা কার্যসম্পাদক। সবশেষে, তিন স্তরেই এক চেতনা বিরাজমান—কেবল দৃষ্টিভঙ্গি ও উপাধির তারতম্যে নামের পার্থক্য।

অদ্বৈত দৃষ্টিতে উপাসনা, মুক্তি ও লক্ষ্য–এর মধ্যে একটি স্তরভিত্তিক সম্পর্ক রয়েছে।

ব্রহ্মা-উপাসনা পুরাণীয় ভক্তি-প্রথায় বিদ্যমান, তবে তুলনামূলকভাবে কম প্রচলিত। এর মূল কারণ—ব্রহ্মা-সংক্রান্ত মিথ, সৃষ্টি-কার্যনির্ভর কাহিনি, এবং কিছু তীর্থভিত্তিক আচার, যেখানে ব্রহ্মার আরাধনা সীমিত আকারে দেখা যায়। এই উপাসনায় লক্ষ্য সাধারণত ব্রহ্মলোক-লাভ—অর্থাৎ ব্রহ্মার ধ্যানে স্থিত সেই উচ্চতর জগত। কিন্তু অদ্বৈত মতে, ব্রহ্মলোক-প্রাপ্তিও চূড়ান্ত মুক্তি নয়; কারণ সেখানে অবিদ্যা সম্পূর্ণরূপে নাশ হয় না। জ্ঞান উদয় না হলে সেই লোক থেকেও পুনর্জন্ম সম্ভব।

অদ্বৈতের মূল মুক্তিপথ উপনিষদের ব্রহ্ম-জ্ঞান। শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের মাধ্যমে যখন প্রত্যক্ষ হয় যে, আত্মা ও ব্রহ্ম এক, তখন অবিদ্যা ক্ষয় হয় এবং জীব মুক্ত হয়। এই মুক্তি কোনো স্থান-প্রাপ্তি নয়, বরং চেতনার অন্তর্দৃষ্টিতে নিজস্ব স্বরূপ উপলব্ধি—যেখানে জানা যায়, “আমি কর্তা, ভোক্তা, দেহ বা মন নই; আমি সেই চিরন্তন চেতনা।”

অদ্বৈতে কোনো দেবতা, উপাসনা, বা সোপানকেই চূড়ান্ত ধরা হয় না—সবই উপায়মাত্র। সব উপাসনার উদ্দেশ্য একটিই—চিত্তশুদ্ধি ও মনোসংযম, যাতে জ্ঞান উদয় সম্ভব হয়। লক্ষ্য কেবল এক—ব্রহ্ম-অনুভব, যেখানে সব রূপ, নাম ও উপাসনা বিলীন হয়ে একমাত্র সত্য চেতনা অবশিষ্ট থাকে।

ব্রহ্ম ও ব্রহ্মা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয় কখনো কখনো।

প্রথমত, ভাষাতত্ত্বের বিভ্রান্তি—সংস্কৃত মূল শব্দে “Brahman” (ব্রহ্ম) ও “Brahmā” (ব্রহ্মা)-এর মধ্যে দীর্ঘ “আ”-কারের পার্থক্য স্পষ্ট; কিন্তু ইংরেজি লেখায় দুটোই প্রায়শই “Brahma” লেখা হয়। এই কারণে অনেকসময় বোঝা যায় না, কখন বলা হচ্ছে নির্গুণ ব্রহ্ম, আর কখন পুরাণীয় দেবতা ব্রহ্মা।

দ্বিতীয়ত ধর্মতত্ত্বের মিশ্রতা—স্মার্ত, ত্রিমূর্তি বা ভক্তিধারার প্রসঙ্গে ঈশ্বর, ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব একসাথে উল্লিখিত হয়। ফলে এক “ঈশ্বর” ধারণার মধ্যে ব্রহ্মা শব্দটি ঢুকে যায়। কিন্তু দর্শনগত স্তরে এগুলির ভেদ আছে—অদ্বৈত মতে ঈশ্বরও মায়া-উপাধিযুক্ত ব্রহ্ম, আর ব্রহ্মা সেই ব্যবস্থার এক কার্যনির্বাহী দেবতা।

তৃতীয়ত রূপক ও কাব্যভাষা—অনেক কবি, সাধক বা গ্রন্থকার “ব্রহ্ম” শব্দটি ঢিলেঢালা ভাবে “ঈশ্বরত্ব”, “পরম সত্য” বা “দিব্যতা” বোঝাতে ব্যবহার করেছেন। এই রূপক ব্যবহার দার্শনিক কঠোর অর্থে সঠিক নয়, কিন্তু সাহিত্যিক ও ভক্তিমূলক প্রকাশে প্রচলিত।

ব্রহ্ম হলো পরম, নির্গুণ, নিরাকার, নাম-রূপ-কারণাতীত চেতনা; সব কিছুর অধিষ্ঠান, যাকে জ্ঞানে উপলব্ধি করা যায়, কিন্তু বস্তুরূপে জানা যায় না। আর ব্রহ্মা হল সৃষ্টি-কার্যে নিয়োজিত পুরাণীয় দেবতা—একটি মহাজাগতিক “পদ” বা দায়িত্ব, যা কল্প-চক্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ফলত, ব্রহ্ম ও ব্রহ্মা এক নয়। ব্রহ্মা যত উচ্চ ও পূজ্যই হোন, তিনি ব্যাবহারিক জগতের দেবতা-পদধারী; আর ব্রহ্ম সেই অদ্বৈত পরমার্থ, যার জ্ঞানেই সমস্ত ভেদ ও দ্বৈততা বিলীন হয়ে যায়।

লক্ষণা-বৃত্তি (ভাগত্যাগ-লক্ষণা)—এটি বেদান্তের একটি মৌলিক ভাষাতাত্ত্বিক ও দার্শনিক ধারণা, যা শব্দের অর্থবোধকতা এবং ব্রহ্মজ্ঞানের উৎপত্তি বোঝাতে অপরিহার্য। নিচে এর নিরবচ্ছিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছি—

বেদান্তে বলা হয়, ব্রহ্মজ্ঞানের সূত্র: “তত্ত্বমসি” (“তুমি সেই”)—এই বাক্যটি শুনেই মুক্তির উপযোগী জ্ঞান জন্মায়। কিন্তু এখানে একটি সমস্যা দেখা দেয়: “তৎ” মানে ঈশ্বর, যার গুণ অপরিমেয়, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, জগতের কারণ; “ত্বম্” মানে জীব, যে সীমাবদ্ধ, দেহ-মনবুদ্ধির দ্বারা আবদ্ধ, অজ্ঞ, সুখ-দুঃখভোগী। এই দুইয়ের মধ্যে সরাসরি কোনো মিল নেই। যদি শব্দগুলিকে তাদের আক্ষরিক অর্থে ধরা হয়, তবে এই বাক্যটি অর্থহীন বা আত্মবিরোধী হয়ে যায়। তাই প্রয়োজন হয় লক্ষণা-বৃত্তি, অর্থাৎ প্রত্যক্ষ বা মূল অর্থ থেকে গিয়ে গৌণ বা প্রাসঙ্গিক অর্থে শব্দগ্রহণের পদ্ধতি।

সংস্কৃত ব্যাকরণে তিন প্রকার অর্থবোধ পদ্ধতি বলা হয়েছে—
(১) অভিধা: মূল বা আক্ষরিক অর্থ; যেমন “গঙ্গা” মানে নদী।
(২) লক্ষণা: গৌণ অর্থ; যখন মূল অর্থে অর্থগঠন অসম্ভব হয়, তখন প্রাসঙ্গিক কোনো অংশ বা গুণ ধরে নতুন অর্থ নেওয়া হয়; যেমন “গঙ্গায়াম্ ঘোষঃ” (গঙ্গার ধারে গ্রাম)—এখানে “গঙ্গা” শব্দের মূল অর্থ নদী নয়, বরং নদীর তীর।
(৩) ব্যঞ্জনা: ইঙ্গিত বা প্রতীকী অর্থ।