অদ্বৈতের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই চক্রটি ব্রহ্মের অদ্বৈত প্রকৃতিকে স্পর্শ করে না। ব্রহ্ম স্বয়ং অচঞ্চল, অস্পর্শিত, অদ্বিতীয় চেতনা। তবে আবরণ ও বিক্ষেপ শক্তির মিলিত ক্রিয়া এমন এক আপাত বাস্তবতার সৃষ্টি করে, যেখানে দ্বৈত অভিজ্ঞতা কার্যকরভাবে বিদ্যমান থাকে, কিন্তু চূড়ান্ত সত্যে কোনো স্বতন্ত্র বাস্তবতা পায় না। এটি একধরনের “অস্তিত্বমূলক ভার্চুয়াল রিয়ালিটি”—যা দেখা যায়, অনুভূত হয়, কিন্তু যার নিজের কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই।
এই বিভ্রমের দ্বৈত প্রক্রিয়া ব্রহ্মের পরম অখণ্ডতাকে বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ন না করেই জীবকে অভিজ্ঞতামূলক জগতে স্থিত রাখে। জীবের সীমাবদ্ধ অস্তিত্বের জন্য এই দুই শক্তির একযোগে কাজ করা অপরিহার্য: আবরণ শক্তি আত্মার অসীমতাকে সীমিত করে তোলে, আর বিক্ষেপ শক্তি সেই সীমিত আত্মার জন্য একটি মিথ্যা মঞ্চ তৈরি করে, যেখানে সে অভিনয় করতে পারে। এর ফলে ব্যক্তি মনে করে, সে বাস্তবতার অংশ, যদিও বাস্তবে সে কেবল প্রতিফলিত আলো—চেতনারই একটি বিবর্তিত প্রতিচ্ছবি।
এই দ্বৈত শক্তি একদিকে বন্ধন সৃষ্টি করে, অন্যদিকে মুক্তির সম্ভাবনাও জাগ্রত রাখে। যখন আবরণ শক্তি জ্ঞানের (vidyā) আলোয় বিলীন হয়, তখন বিক্ষেপ শক্তির দ্বারা নির্মিত জগৎও ক্রমে মিথ্যা বলে প্রতীয়মান হয়। এই উপলব্ধিই মুক্তি (mokṣa)—যেখানে জানা যায়, “আমি ব্রহ্ম”—একক, অবিকৃত, অদ্বৈত চেতনা।
এখন এই প্রেক্ষাপটে অবিদ্যা ও মায়ার পার্থক্য বোঝা জরুরি। উভয়ই বিভ্রমের শক্তিকে বোঝালেও, তাদের ক্ষেত্র, পরিধি ও কার্যক্ষমতা ভিন্ন।
মায়া (Māyā) হচ্ছে অজ্ঞানতার সর্বজনীন রূপ—যা মূল অবিদ্যা (Mūla-Avidyā)-এর সমার্থক। এটি মহাজাগতিক বা বিশ্বজনীন বিভ্রমের শক্তি, যার দ্বারা গোটা সৃষ্টি ও মহাবিশ্বের কাঠামো প্রকাশিত হয়। অদ্বৈতের ভাষায়, মায়া হচ্ছে সেই আদিম শক্তি, যা ব্রহ্মের ওপর আরোপিত হয়ে ব্রহ্মকে কার্যত স্রষ্টা (Īśvara) হিসেবে প্রতীয়মান করে। ঈশ্বর এখানে মায়া দ্বারা শর্তযুক্ত ব্রহ্ম—যিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা, রক্ষক ও সংহারক বলে অনুভূত হন।
মায়ার অধীনে সমগ্র জগৎ তিনটি গুণ (Guṇa)—সত্ত্ব (Sattva: স্বচ্ছতা ও জ্ঞান), রজঃ (Rajas: গতি ও কর্ম), এবং তমঃ (Tamas: স্থবিরতা ও অন্ধকার)—এর সমন্বয়ে গঠিত। এই তিনটি উপাদানের সূক্ষ্ম ভারসাম্যের মাধ্যমেই একক চেতনা বহুরূপে প্রকাশিত হয়—পদার্থ, মন, প্রাকৃতি, দেবতা ও জীব—সবই মায়ার প্রক্ষেপণ। সত্ত্ব গুণ আলো ও জ্ঞান আনে, রজঃ সৃষ্টি ও গতি ঘটায়, তমঃ অন্ধকার ও অজ্ঞতা সৃষ্টি করে। এই তিনের সমবায়ই জগতের শৃঙ্খলা, গতিশীলতা ও বৈচিত্র্যের কারণ।
অন্যদিকে, অবিদ্যা (Avidyā) হচ্ছে মায়ার ব্যক্তিগত প্রতিফলন—জীবের অভ্যন্তরীণ অজ্ঞানতা। মায়া যতটা মহাজাগতিক, অবিদ্যা ততটাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। মায়া ঈশ্বরের অধীনে নিয়ন্ত্রিত; অবিদ্যা জীবের অভিজ্ঞতায় সীমাবদ্ধ। মায়া গোটা জগৎ সৃষ্টি করে, অবিদ্যা সেই জগৎকে ভুলভাবে বাস্তব বলে প্রতীয়মান করে।
এভাবে অদ্বৈত দেখায় যে, একই শক্তি, জ্ঞানের অভাবে, দুইভাবে কাজ করে—মায়া হিসেবে বিশ্বব্যবস্থায়, অবিদ্যা হিসেবে ব্যক্তির চেতনায়। এবং, যতক্ষণ এই দ্বৈত শক্তির প্রভাব অব্যাহত থাকে, ততক্ষণ সংসারের বন্ধনও অটুট থাকে। মুক্তি আসে তখনই, যখন আবরণ ও বিক্ষেপ—উভয়েরই কার্য বিলীন হয়, এবং চেতনা নিজের অখণ্ড, স্ব-প্রভাময় স্বরূপে প্রত্যক্ষ হয়।
অবিদ্যার (Avidyā) ব্যক্তিগত দিকটি অদ্বৈত বেদান্তের অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতাবাদী কাঠামোর একটি সূক্ষ্ম কিন্তু মৌলিক উপাদান। এটি সেই সীমিত অজ্ঞানতা, যা প্রতিটি জীবকে তার নিজস্ব দেহ, মন ও পরিচয়ের সঙ্গে একীভূত করে রাখে। অবিদ্যা এখানে সর্বজনীন নয়, বরং ব্যক্তিনিষ্ঠ; এটি প্রতিটি জীবের চেতনায় সৃষ্ট সেই পর্দা, যা আত্মার অসীম প্রকৃতিকে আড়াল করে রাখে এবং ব্যক্তিসত্তার (jīvatva) জন্ম দেয়।
এই ব্যক্তিগত অবিদ্যা হলো জীবের অস্তিত্বগত বন্ধনের তাৎক্ষণিক কারণ। জীব, অবিদ্যার প্রভাবে, নিজেকে দেহ ও মনের সঙ্গে অভিন্ন মনে করে এবং ফলস্বরূপ "আমি" এবং "অন্য"—এই বিভাজন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে সে সুখ-দুঃখ, ইচ্ছা, ভয়, আসক্তি, কর্মফল প্রভৃতি অভিজ্ঞতা লাভ করতে থাকে। এই সমস্ত অভিজ্ঞতা অবিদ্যারই ফল, যা বিদ্যা (আত্ম-জ্ঞান) অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। যতক্ষণ না জীব উপলব্ধি করে যে, সে ব্রহ্ম থেকে পৃথক নয়, ততক্ষণ অবিদ্যা কার্যকর থাকে।
অদ্বৈত ব্যাখ্যায়, অবিদ্যা ও মায়া আসলে একই শক্তির দুটি দৃষ্টিকোণ। মহাজাগতিক স্তরে এই বিভ্রমকে মায়া বলা হয়—যা ঈশ্বরের (Īśvara) নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং সৃষ্ট জগতের শৃঙ্খলা ও নিয়ম বজায় রাখে। ব্যক্তিগত স্তরে একই বিভ্রমকে অবিদ্যা বলা হয়—যা জীবের (jīva) অভ্যন্তরে কার্যকর হয় এবং তাকে সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতার মধ্যে আবদ্ধ রাখে। এই পার্থক্য দার্শনিকভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমে একদিকে জগতের সমবায়, সুশৃঙ্খল অভিজ্ঞতার কারণ ব্যাখ্যা করা যায়, অন্যদিকে ব্যক্তিগত বন্ধন ও মুক্তির পথও সুস্পষ্ট হয়।
যদি ব্যক্তিগত অবিদ্যাই একমাত্র কার্যকর শক্তি হতো, তবে প্রত্যেক জীবের উপলব্ধি ও জগৎ সম্পূর্ণভাবে পৃথক এবং স্বকেন্দ্রিক হয়ে যেত; বিশ্বে কোনো সমন্বয় বা সাধারণ অভিজ্ঞতা থাকত না। কিন্তু ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রিত মায়া মহাবিশ্বে কাঠামো, কার্যকারণ এবং অভিন্ন অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। এইভাবে, ব্যক্তিগত অবিদ্যা জীবের সীমিত চেতনার মধ্যে দুঃখ, ভয়, আকাঙ্ক্ষা ও অজ্ঞানতার অভিজ্ঞতা ঘটায়, আর মহাজাগতিক মায়া সেই অভিজ্ঞতাকে এক সুশৃঙ্খল বাস্তবতার আকার দেয়।
মায়া ও অবিদ্যার পার্থক্য কেবল কার্যক্ষেত্রে নয়, বরং তাদের ontological স্তরেও সুস্পষ্ট। অবিদ্যা মূলত জ্ঞানের প্রতিবন্ধকতা, যা আত্মাকে নিজের স্বরূপ উপলব্ধি থেকে বিরত রাখে। এটি জ্ঞানতাত্ত্বিক (epistemic) অন্ধকার, যা আত্মার স্বপ্রকাশ প্রকৃতিকে আচ্ছন্ন করে রাখে। অন্যদিকে, মায়া হলো সেই অন্ধকারের সৃষ্টিশক্তি—এটি সত্তাতাত্ত্বিক (ontological) শক্তি, যার ফলে সমগ্র জগতের প্রতীয়মানতা সম্ভব হয়। অবিদ্যা জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করে, মায়া অস্তিত্বকেই বিকৃত করে।
অবিদ্যা কার্যকর হয় আত্মচেতনার স্তরে; মায়া কাজ করে বিশ্বচেতনার স্তরে। একটির কার্য পরিসর অন্তর্মুখী, অন্যটির বহির্মুখী। অবিদ্যা “আমি কে”—এই প্রশ্নে বিভ্রান্তি আনে, আর মায়া “এই জগৎ কী”—তার ভুল প্রতিরূপ রচনা করে। অবিদ্যা আত্মস্বরূপে অন্ধকার সৃষ্টি করে, মায়া সেই অন্ধকারের উপর বহির্জগৎ প্রক্ষেপণ করে।
মায়া ও অবিদ্যার মধ্যে আরেকটি পার্থক্য তাদের নিবৃত্তির প্রকৃতিতে। অবিদ্যা বিলীন হয় আত্মজ্ঞান দ্বারা, কারণ এটি ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ অজ্ঞানতা; মায়া বিলীন হয় না, বরং জ্ঞানীর দৃষ্টিতে তার প্রতীয়মানতা হারায়। অর্থাৎ, জ্ঞানীও জগৎ দেখে, কিন্তু জানে এটি মায়ার প্রতিফলন, বাস্তব নয়। অবিদ্যা নাশ পেলে আত্মা মুক্ত হয়; মায়া নিস্ক্রিয় হলে বিশ্ব তার আপাত বাস্তবতা হারায়।
এছাড়া অবিদ্যা আচ্ছাদন (āvaraṇa) শক্তি হিসেবে বেশি কাজ করে, মায়া বিক্ষেপ (vikṣepa) শক্তি হিসেবে—একটি সত্যকে লুকিয়ে রাখে, অন্যটি মিথ্যা প্রতিরূপ সৃষ্টি করে। এই দুটি শক্তি একত্রেই বিভ্রান্তির পূর্ণ কাঠামো তৈরি করে। মায়া ছাড়া অবিদ্যা প্রকাশ পায় না, অবিদ্যা ছাড়া মায়া কাজ করতে পারে না।
দার্শনিকভাবে, অবিদ্যা ব্যক্তির বন্ধনের কারণ, আর মায়া সেই বন্ধনকে মহাবিশ্বের নকশায় পরিণত করে। অবিদ্যা একক আত্মাকে পরিমিত সত্তা বলে প্রতীত করায়; মায়া সেই সীমাবদ্ধ আত্মাদের সমষ্টিকে এক পরস্পরনির্ভর জগতে স্থাপন করে। অবিদ্যা ব্যক্তিগত মোহের উৎস, মায়া সেই মোহের মহাজাগতিক নিয়ম।
অতএব, মায়া হলো ব্রহ্মের শক্তির বহির্মুখী প্রকাশ, যা জগতের প্রতীয়মানতা সৃষ্টি করে; অবিদ্যা হলো সেই একই শক্তির অন্তর্মুখী রূপ, যা আত্মার জ্ঞানকে আবৃত করে রাখে। একদিকে মায়া সৃষ্টি করে “অন্যতা” (otherness), অন্যদিকে অবিদ্যা সৃষ্টি করে “আমি” (ego); এবং এই দুই মিলে গড়ে ওঠে সমগ্র মিথ্যা অভিজ্ঞতার পরিসর, যার অবসান ঘটে কেবল জ্ঞানের পূর্ণ জাগরণে।
অদ্বৈত বেদান্তে মায়া ও অবিদ্যার পার্থক্য বোঝাতে নানা দার্শনিক দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়, যা এই দুই শক্তির সূক্ষ্ম সম্পর্ককে সহজভাবে অনুধাবন করতে সাহায্য করে।
সূর্য, মেঘ ও ছায়ার দৃষ্টান্তে ব্রহ্ম সূর্যের মতো—অচল, স্বপ্রভা ও চিরজ্ঞানময়। অবিদ্যা হলো সেই মেঘ, যা সূর্যের আলো আড়াল করে, আর মায়া হলো সেই মেঘের ছায়া, যা পৃথিবীতে পড়ে নানা আকার সৃষ্টি করে। মেঘ সূর্যের আলোকে আচ্ছন্ন করে যেমন চেতনার জ্ঞান ঢেকে দেয়, আর ছায়া যেমন জগৎ প্রতীয়মান করে, তেমনি মায়া বহুরূপ সৃষ্টি প্রকাশ করে।
সাপ-দড়ির দৃষ্টান্তেও একই সত্য প্রকাশ পায়। অন্ধকারে দড়িকে ভুল করে সাপ বলে ধরা অবিদ্যা, আর সেই ভুল ধারণা থেকে জন্ম নেওয়া ভয়, নড়াচড়া, দংশনের অনুভূতি ইত্যাদি মায়ার কাজ। আলো এলে বোঝা যায়, সাপ কখনোই ছিল না—দড়িই ছিল একমাত্র সত্য। অবিদ্যা ব্যক্তির ভ্রান্ত দৃষ্টি, মায়া সেই ভ্রান্তির বহির্জগতের রূপ।
স্বপ্নের দৃষ্টান্তে দেখা যায়—স্বপ্নদ্রষ্টা নিজেই স্বপ্নজগৎ সৃষ্টি করে, চরিত্র রচনা করে, আনন্দ ও ভয় অনুভব করে। এই স্বপ্নজগৎ মায়া, কিন্তু যে অচেতন অবস্থায় সে স্বপ্নকে বাস্তব মনে করে, সেটিই অবিদ্যা। জাগরণের পরে বোঝা যায়, সবই নিজের চেতনার খেলা।
আয়না ও প্রতিবিম্বের দৃষ্টান্তেও এদের সম্পর্ক স্পষ্ট। ব্রহ্ম আয়নার মতো নির্মল, অবিদ্যা হলো আয়নার উপর জমে-থাকা ধুলো, আর মায়া সেই বিকৃত প্রতিফলন। ধুলো মুছে গেলে প্রতিফলন স্পষ্ট হয়, যেমন জ্ঞানের উদয়ে অবিদ্যা বিলীন হয় এবং মায়ার জগৎ নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে।
চাঁদ ও জলের দৃষ্টান্তে চাঁদ একটাই, কিন্তু বিভিন্ন জলে তার বহু প্রতিফলন দেখা যায়। জলে তরঙ্গ থাকলে চাঁদ কেঁপে ওঠে বা বিকৃত বলে মনে হয়—এটি অবিদ্যা। কিন্তু সেই অসংখ্য প্রতিফলনই যখন বাস্তব বলে মনে হয়, তখন সেটিই মায়া।
অভিনেতা ও নাটকের দৃষ্টান্তও এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। অভিনেতা নানা চরিত্রে অভিনয় করেন—এটি মায়া। কিন্তু যখন তিনি চরিত্রের সঙ্গে নিজের পরিচয় ভুলে গিয়ে নিজেকে সেই চরিত্র মনে করেন—এটি অবিদ্যা। মায়া হলো প্রকাশ, অবিদ্যা হলো আত্মবিস্মৃতি।
আকাশ ও মেঘের দৃষ্টান্তে আকাশ সর্বদা বিশুদ্ধ ও নিঃস্পর্শ। মেঘ আকাশকে ঢেকে দেয়—এটি অবিদ্যা, আর মেঘের সৃষ্ট ঝড়-বৃষ্টি, রংধনু বা অন্ধকার হলো মায়া। আকাশ পরিবর্তিত হয় না, কিন্তু তার উপর পরিবর্তনের ছায়া পড়ে।
এইসব দৃষ্টান্তে দেখা যায়, অবিদ্যা হলো আত্মচেতনার অন্ধকার, আর মায়া হলো সেই অন্ধকারের দৃশ্যমান প্রতিফলন। অবিদ্যা ব্যক্তিগত বিভ্রম, মায়া সেই বিভ্রমের মহাজাগতিক সম্প্রসারণ। অবিদ্যা আত্মাকে সীমিত বলে মনে করায়, মায়া সেই সীমাবদ্ধ চেতনার উপর বিশ্বরূপ প্রক্ষেপণ করে। উভয়ই একই মূল বিভ্রান্তির দুই স্তর, যার অবসান ঘটে কেবল জ্ঞানের জাগরণে—যখন জানা যায়, যা প্রতীয়মান তা সত্য নয়, আর যে আত্মা প্রতীয়মান নয়, সেই একমাত্র সত্য।
এই দ্বৈত কাঠামো—মায়া ও অবিদ্যা—অদ্বৈত দর্শনের এক গভীর সমাধান প্রদান করে। এটি দেখায় যে, জগৎ ও ব্যক্তিসত্তা দুটিই কার্যকর অর্থে বাস্তব, কিন্তু পরম অর্থে মিথ্যা (mithyā)। উভয়ই ব্রহ্মের উপর আরোপিত বিভ্রম, যা একমাত্র জ্ঞানের (vidyā) দ্বারা অপসারিত হতে পারে।
এই ধারণাটিকে আরও স্পষ্ট করতে অদ্বৈত বেদান্ত অবিদ্যাকে “কারণ শরীর” (Kāraṇa Śarīra) বা কারণ দেহের সঙ্গে সমীকৃত করেছে। মানবসত্তার তিন দেহতত্ত্ব (Śarīra–traya) অনুসারে—স্থিত শরীর বা স্থূল শরীর (Sthūla Śarīra), সূক্ষ্ম শরীর (Sūkṣma Śarīra) এবং কারণ শরীর (Kāraṇa Śarīra)—এই শেষোক্ত কারণ দেহই অবিদ্যার অধিবাস। এটি সেই সূক্ষ্মতম অবস্থা, যেখানে আত্মা নিজেকে অজানার পর্দার আড়ালে আবৃত রাখে। এখান থেকেই সমস্ত অন্য দুই দেহ—সূক্ষ্ম ও স্থূল—উদ্ভূত হয়।