অদ্বৈত দর্শনের যৌক্তিক শৃঙ্খলা তার গভীর দ্বান্দ্বিক কাঠামোয় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। প্রতিদ্বন্দ্বী দর্শনগুলো (Pūrvapakṣa)—যেমন ন্যায়, সাংখ্য, বা দ্বৈত বেদান্ত—যখন জগতের বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, অদ্বৈত সেগুলোর উত্তর দেয় যুক্তির (Anumāna) যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে।
যখন এই যুক্তি ব্যর্থ হয় বা বিভ্রান্তিকর কারণের ওপর দাঁড়ায়, তখন সেটিকে হেত্বাভাস (Hetvābhāsa) বলা হয়—অর্থাৎ, এমন একটি কারণ, যা দেখতে যুক্তিসঙ্গত মনে হয়, কিন্তু আসলে ভুল বা বিভ্রান্তিকর।
ভারতীয় তর্কশাস্ত্রে (Nyāya tradition) কোনো যুক্তি বা অনুমান (Anumāna) তখনই বৈধ (Valid) গণ্য হয়, যখন এর মধ্যপদ বা হেতু (Hetu)—অর্থাৎ প্রমাণের ভিত্তি—সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রধান পদ বা প্রতিপাদ্য (Sādhya)-এর সঙ্গে একটি অবিচ্ছিন্ন, সর্বজনীন সম্পর্ক (Vyāpti) বজায় রাখে।
এই সম্পর্কটি এমন হতে হবে যে, যেখানেই সাধ্য উপস্থিত, সেখানে হেতুও উপস্থিত থাকবে, এবং যেখানেই সাধ্য অনুপস্থিত, সেখানে হেতুও অনুপস্থিত থাকবে। এই সর্বজনীন সহচরিতা বা অবিচ্ছিন্ন সহাবস্থানই (Vyāpti) হলো যুক্তির প্রাণ।
একটি বৈধ হেতুর চারটি প্রধান শর্ত থাকে।
প্রথমত, সপক্ষসত্ত্বা (Sapakṣasattva)—যেসব ক্ষেত্রে প্রধান পদ (Sādhya) উপস্থিত, সেখানে হেতুও অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, “মেঘে জলীয় বাষ্প থাকে”—এই যুক্তি সত্য, কারণ যেখানে মেঘ আছে (যেমন বর্ষার আকাশে), সেখানে জলীয় বাষ্পও থাকে। এখানে মেঘের উপস্থিতি (সপক্ষ) বাষ্পের উপস্থিতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত।
দ্বিতীয়ত, বিপক্ষসত্ত্বা (Vipakṣasattva)—যেসব ক্ষেত্রে প্রধান পদ অনুপস্থিত, সেখানে হেতুও অনুপস্থিত থাকতে হবে। যেমন, শুষ্ক মরুভূমিতে মেঘ থাকে না, তাই সেখানে জলীয় বাষ্পও থাকে না। এভাবে নিশ্চিত হয় যে, জলীয় বাষ্প কেবল মেঘের সঙ্গে সম্পর্কিত, অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে নয়।
তৃতীয়ত, অবাধিত (Abādhita)—হেতু কখনোই এমন কিছু প্রমাণ করতে পারবে না, যা প্রধান পদের প্রকৃত স্বভাবের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি করে। যেমন, কেউ যদি বলে “সূর্য অন্ধকারাচ্ছন্ন, কারণ এটি ছায়া সৃষ্টি করে”—তবে এটি অবাধিত নয়, কারণ ছায়া আলো থেকে নয়, বরং আলোর প্রতিবন্ধ থেকে জন্মায়; ফলে সূর্যের অন্ধকার হওয়া তার প্রকৃত ধর্মের (আলোদান) সঙ্গে সরাসরি বিরোধ করে।
চতুর্থত, অবিরুদ্ধ (Aviruddha)—অর্থাৎ এমন কোনো শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী কারণ থাকা চলবে না, যা এই হেতুকে খণ্ডন করতে পারে। যেমন, কেউ যদি বলে, “ফুল সুগন্ধযুক্ত, কারণ এতে রং আছে”—তাহলে এটি অবিরুদ্ধ নয়, কারণ অন্য কারণ (যেমন রাসায়নিক উপাদান বা গন্ধগ্রাহী তেল) প্রকৃতপক্ষে সুগন্ধের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করে; ফলে রং থাকাই সব ক্ষেত্রে সুগন্ধ প্রমাণ করতে পারে না।
এই চারটি শর্ত পূর্ণ হলে একটি হেতু বৈধ হয় এবং তার ওপর নির্মিত অনুমান (Anumāna) যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ হিসেবে গণ্য হয়। অদ্বৈত বেদান্ত এই যুক্তিগত কাঠামোকে গ্রহণ করে, কিন্তু সেটিকে ব্যবহার করে দ্বৈত অভিজ্ঞতার ভ্রান্ত স্বরূপ দেখাতে—যাতে বোঝানো যায়, সব যুক্তির চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে সেই অনন্ত, অবিভক্ত চেতনার প্রকাশ, যেখানে হেতু, সাধ্য ও সপক্ষ—সব এক হয়ে যায়।
অদ্বৈত দর্শনের তর্কতত্ত্বে ভ্রান্ত যুক্তির (Hetvābhāsa) ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমে বোঝা যায়, কোন যুক্তি প্রকৃত প্রমাণ নয়—বরং প্রমাণের মতো দেখালেও আসলে ভুল পথে পরিচালিত করে। যুক্তির এই বিকৃতি ঘটে তখনই, যখন মধ্যপদ (hetu) বৈধতার শর্তগুলি লঙ্ঘন করে—যেমন, সর্বজনীন সহচরিতা (vyāpti) ঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া, বা প্রধান পদের সঙ্গে বিপরীত সম্পর্ক তৈরি করা। এই ব্যর্থতা থেকেই জন্ম নেয় পাঁচটি প্রধান ভ্রান্ত যুক্তি।
প্রথমটি হলো সব্যভিচার (Savyabhicāra) বা অনৈকান্তিক (Anaikāntika)। এটি তখন ঘটে, যখন মধ্যপদটি সিদ্ধান্ত নির্ধারণে স্থির ও নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থাৎ, একই হেতু কখনো প্রধান পদের সঙ্গে থাকে, আবার কখনো থাকে না। উদাহরণস্বরূপ, “পাহাড়ে আগুন আছে, কারণ সেখানে ধোঁয়া আছে”—এটি তখন ভুল হয়ে যায়, যদি দেখা যায় ধোঁয়া কেবল আগুনের কারণে নয়, বরং কুয়াশা বা ধূলিকণার কারণেও হতে পারে। তখন মধ্যপদটি অনিয়মিত হয়, কারণ তা একাধিক উৎসে দেখা দেয়, এবং সিদ্ধান্তে স্থায়ী সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না।
দ্বিতীয়টি হলো বিরুদ্ধ (Viruddha)—এটি এমন এক ভ্রান্ত যুক্তি যেখানে মধ্যপদ (hetu) আসলে সিদ্ধান্তের (sādhya) বিপরীত ফল প্রমাণ করে, অর্থাৎ যুক্তিটি নিজেই নিজের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি বলে, “চাঁদ সূর্যের মতো জ্বলন্ত, কারণ এটি আলো দেয়”, তাহলে এখানে “আলো দেয়” এই হেতুটি বিপরীত ফল প্রমাণ করছে। চাঁদ নিজে জ্বলন্ত নয়, বরং সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে উজ্জ্বল দেখায়—তাই এটি আগুনের মতো জ্বলন্ত বলা ভুল। অর্থাৎ, এখানে হেতু (আলো দেয়া) এবং সাধ্য (জ্বলন্ত হওয়া) পরস্পরের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ফলে যুক্তিটি বিরুদ্ধ—এটি সিদ্ধান্তকে প্রমাণ না করে, বরং খণ্ডন করে।
তৃতীয়টি হলো সৎপ্রতিপক্ষ (Satpratipakṣa)—অর্থাৎ এমন একটি যৌক্তিক ভ্রান্তি, যেখানে কোনো যুক্তি সমান শক্তির বিপরীত যুক্তির মুখে টিকে থাকতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি বলে, “চাঁদ উষ্ণ, কারণ তা আলোকিত”, তখন এর বিপরীতে বলা যায়, “চাঁদ শীতল, কারণ তা সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে”। দুটি যুক্তির শক্তি ও যৌক্তিক কাঠামো যদি সমান হয়, তবে কোনো পক্ষই সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। এই অবস্থাতেই বলা হয়, যুক্তিটি সৎপ্রতিপক্ষ, কারণ এর শক্তি বিপরীত যুক্তি দ্বারা সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধিত হয়েছে।
চতুর্থটি হলো বাধিত (Bādhita)। এটি ঘটে, যখন অনুমানমূলক যুক্তি পরে অন্য কোনো অধিক শক্তিশালী প্রমাণ দ্বারা নাকচ হয়। যেমন কেউ যদি বলে, “সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে, কারণ আমরা তা দেখতে পাই”, তবে এটি পরবর্তীকালে প্রত্যক্ষ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দ্বারা বাতিল হয়। অর্থাৎ, অনুমানটি সত্য হতে পারে না, কারণ আরও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ (যেমন প্রত্যক্ষ বা শব্দ) সেটিকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে।
পঞ্চমটি হলো অসিদ্ধ (Asiddha)—যেখানে মধ্যপদ নিজেই প্রমাণিত নয়, অর্থাৎ যুক্তির ভিত্তি অনিশ্চিত। এর দুটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ আছে।
প্রথমটি স্বরূপাসিদ্ধি (Svarūpāsiddhi), যখন মধ্যপদটি সেই বস্তুর মধ্যে যৌক্তিকভাবে উপস্থিত নয়। যেমন বলা হয়, “শব্দ বিনাশশীল, কারণ এটি চোখে দেখা যায়”। এখানে “চোখে দেখা যায়” গুণটি শব্দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়—তাই এটি স্বরূপাসিদ্ধ।
দ্বিতীয়টি আশ্রয়াসিদ্ধি (Āśrayāsiddhi), যখন যার উপর গুণ আরোপ করা হচ্ছে, সেই বস্তুটিই অবাস্তব। যেমন বলা হয়, “আকাশ-পদ্ম সুগন্ধযুক্ত, কারণ এটি পদ্ম”। এখানে “আকাশ-পদ্ম” বাস্তবে নেই, তাই এর ওপর কোনো গুণ আরোপ করাই যুক্তিহীন। এটি সম্পূর্ণরূপে এক মিথ্যা ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো যুক্তি।
এই পাঁচ ধরনের হেত্বাভাসই দেখায়, কীভাবে ভুল মধ্যপদ যুক্তির কাঠামোকে দুর্বল করে দেয়। অদ্বৈত দর্শনে এগুলোর অধ্যয়ন শুধুমাত্র তর্কবিদ্যার অনুশীলন নয়—বরং সত্য ও ভ্রমের সূক্ষ্ম পার্থক্য বোঝার দার্শনিক পদ্ধতি। মিথ্যা যুক্তির সনাক্তকরণই আসলে মনকে শুদ্ধ করে, যাতে তা অজ্ঞান (Avidyā) অতিক্রম করে সেই অদ্বিতীয় সত্য—ব্রহ্ম—উপলব্ধি করতে পারে।
অদ্বৈত বেদান্তে আশ্রয়াসিদ্ধি (Āśrayāsiddhi) ধারণাটি শুধু একটি সাধারণ যুক্তিগত ত্রুটি নয়—এটি এক গভীর দার্শনিক অস্ত্র। এর কৌশলগত প্রয়োগ অদ্বৈতকে অন্যান্য বাস্তববাদী (realist) দর্শনগুলোর বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী দ্বান্দ্বিক অবস্থান নিতে সাহায্য করে।
ন্যায় বা মীমাংসার মতো বাস্তববাদী দর্শনগুলো জাগতিক জগৎকে (jagat) চূড়ান্তভাবে বাস্তব বলে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তারা বলে—বিশ্ব স্বাধীনভাবে বিদ্যমান; এটি কেবল অভিজ্ঞতার বা জ্ঞানের ফল নয়, বরং নিজের অধিকারেই সত্য। অদ্বৈত এখানেই প্রতিআক্রমণ করে আশ্রয়াসিদ্ধি ভ্রান্তির মাধ্যমে।
অদ্বৈতের মূল নীতি অনুযায়ী, পারমার্থিক সত্যের (Pāramārthika Satya) স্তরে জগৎ মিথ্যা (mithyā)—অর্থাৎ এটি সম্পূর্ণ অবাস্তব নয়, কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে বা চূড়ান্তভাবে বাস্তবও নয়। এর অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল (dependent)—ব্রহ্মের ওপর, চেতনার ওপর। অতএব, কেউ যদি যুক্তির মাধ্যমে জগৎকে “স্বাধীনভাবে বিদ্যমান সত্য” হিসেবে প্রমাণ করতে চায়, তবে অদ্বৈত তাকে সঙ্গে সঙ্গে আশ্রয়াসিদ্ধি-র অভিযোগে অভিযুক্ত করে।
কারণ সেই যুক্তির “আশ্রয়” বা “গৌণ পদ”—যার ওপর পুরো প্রমাণ দাঁড়িয়ে আছে—অদ্বৈতের মতে আদৌ প্রতিষ্ঠিত নয়। অর্থাৎ, যদি জগৎ নিজেই চূড়ান্ত স্তরে অবাস্তব হয়, তবে জগৎকে “বাস্তবতার উদাহরণ” হিসেবে ব্যবহার করা মানেই এক অবাস্তব আশ্রয়ের ওপর যুক্তি দাঁড় করানো। এটি “আকাশ-পদ্ম” (sky-lotus)-এর মতো—যা দৃষ্টিতে আসে না, স্পর্শে ধরা যায় না, তবু কেউ যদি তার গন্ধ বা রং প্রমাণ করতে চায়, সেটি যুক্তিগতভাবে শূন্য।
এইভাবে, অদ্বৈত দর্শন যুক্তিগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীর অস্তিত্ববাদী অবস্থানকে ভেতর থেকেই ধ্বংস করে। যখন প্রতিপক্ষ “বিশ্ব বাস্তব” প্রমাণ করতে যায়, তখন অদ্বৈত বলে—“তুমি যে বিশ্বকে প্রমাণ করতে চাইছ, সেটি তো তোমার যুক্তির ক্ষেত্রেই অবাস্তব”। এই অবস্থান যুক্তিকে নিজেই তার ভিত থেকে অকার্যকর করে তোলে।
অতএব, আশ্রয়াসিদ্ধি অদ্বৈতের এক সূক্ষ্ম দার্শনিক কৌশল—যার মাধ্যমে সে ঘোষণা করে, যুক্তি যতই তীক্ষ্ণ হোক, যদি তার ভিত্তি অবাস্তব হয়, তবে তার সমস্ত কাঠামো ভেঙে পড়বে। এবং এইভাবেই অদ্বৈত তার এই মৌলিক সত্যটি সুরক্ষিত রাখে যে, চূড়ান্তভাবে সত্য একটিই—ব্রহ্ম; বাকিটা সব নির্ভরশীল ও অনির্বচনীয়।
অদ্বৈত বেদান্তের সমগ্র দর্শনের কাঠামো গঠিত হয়েছে অবিদ্যা (Avidyā)—এই সর্বজনীন অজ্ঞানের ধারণাকে বোঝা ও নিবারণের ওপর। অবিদ্যা-ই সংসারের (Saṃsāra) মূল কারণ, এবং বিদ্যা (Vidyā)—অর্থাৎ আত্মজ্ঞান—এর অপসারণ ঘটিয়ে চূড়ান্ত মুক্তি (Mokṣa) এনে দেয়।
অদ্বৈতের সত্তাতাত্ত্বিক শ্রেণীবিন্যাস—সত্যের তিন স্তর (Pāramārthika, Vyāvahārika, Prātibhāsika)—অভিজ্ঞতা ও পরম সত্যের মধ্যে ব্যবধানকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়। এই ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থা শেখায় যে, জগৎ যদিও অভিজ্ঞতায় সত্য বলে প্রতীয়মান, তার সত্যতা আপেক্ষিক; চূড়ান্ত সত্য কেবল ব্রহ্ম।
জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোয় অদ্বৈত ছয়টি প্রমাণ (Pramāṇa) স্বীকার করে, তবে চূড়ান্ত সত্য উপলব্ধির ক্ষেত্রে একমাত্র কার্যকর মাধ্যম হলো শব্দ (Śabda)—বেদ ও উপনিষদের প্রামাণ্য বাণী। ব্রহ্ম ইন্দ্রিয় ও যুক্তির অতীত; তাই প্রত্যক্ষ (Pratyakṣa) বা অনুমান (Anumāna) তাকে ধরতে পারে না। শাস্ত্রের বাক্যই একমাত্র সেতু, যা জ্ঞানীর হৃদয়ে ব্রহ্ম-চেতনার উদয় ঘটায়।
অদ্বৈতের যৌক্তিক শক্তি প্রকাশ পায় তার দ্বান্দ্বিক রণকৌশলে। হেত্বাভাস (Hetvābhāsa)—বিশেষত আশ্রয়াসিদ্ধি (Āśrayāsiddhi)—ধারণার মাধ্যমে অদ্বৈত দেখায়, যে-দর্শন জগৎকে চূড়ান্তভাবে বাস্তব বলে প্রমাণ করতে চায়, তার যুক্তির ক্ষেত্রই অবাস্তব। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বী মতের যুক্তিভিত্তিই ধসে যায়। একইভাবে, উপাধি (Upādhi)-তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে, কীভাবে ঈশ্বর, জীব, ও ব্রহ্মের আপাত-পার্থক্য আসলে মায়াজাত সীমাবদ্ধতা—যা চেতনার অন্তর্নিহিত একত্বকে কখনও ছুঁতে পারে না।
চূড়ান্ত পর্যায়ে, বিদ্যা (Vidyā) অবিদ্যার আবরণ সরিয়ে দেয়। তখন মানুষ উপলব্ধি করে—জগৎ কোনো স্বাধীন ব্যবস্থা নয়; এটি কেবল চৈতন্যের (Turiya) সৃজনশীল প্রতিফলন, এক নির্ভরশীল প্রকাশ। মুক্তি (Mokṣa) তখন কোনো নতুন অর্জন নয়, বরং সীমাবদ্ধতার অপসারণ—নিজের মধ্যেই ব্রহ্মস্বরূপের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি।
এইভাবে অদ্বৈত বেদান্ত শেষপর্যন্ত ঘোষণা করে—“ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, বাকিটা সব তার প্রতিচ্ছবি”।