অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: একচল্লিশ



ধাপ ৪: নাগার্জুনের শূন্যতা: নাগার্জুন বলেন, কেবল জগৎ নয়, চেতনা বা আত্মাও নিজস্বভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। সব কিছুই নির্ভরশীল উৎপত্তি (pratītyasamutpāda)—একটি অন্যটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তাই, কোনো কিছুরই নিজস্ব স্বভাব (svabhāva) নেই। দৃষ্টান্ত: রথ-দৃষ্টান্ত—রথ আলাদা কোনো জিনিস নয়; অংশগুলির সম্পর্ক মাত্র।

মধ্যমক (Mādhyamika বা Madhyamaka) হলো মহাযান বৌদ্ধ দর্শনের একটি প্রধান শাখা, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আচার্য নাগার্জুন (খ্রিস্টীয় ২য় শতক)। এটিকে বাংলায় বলা যায় “মধ্যপথের দর্শন”। এর মূল শিক্ষা হলো—

শূন্যতা (Śūnyatā): কোনো সত্তা বা বস্তু নিজের মধ্যে স্বতন্ত্রভাবে বিদ্যমান নয়। সব কিছু পরস্পর-নির্ভর (Pratītyasamutpāda: পরস্পর-উৎপত্তি)। অর্থাৎ, জগতে কোনো “নিজস্ব স্বভাব” (Svabhāva) নেই।

মধ্যপথ: নাগার্জুন বলেন, আমরা যেন দুই চরমে না পড়ি—একদিকে “চিরন্তন বাস্তবতা আছে” (শাশ্বতবাদ, eternalism); আরেকদিকে “কিছুই নেই, সব নাশ” (শূন্যবাদ, nihilism)। এর মাঝেই হলো মধ্যমক পথ: জগৎ স্বতন্ত্র সত্য নয়, আবার একেবারে শূন্যও নয়—এটি সম্পর্কের ভেতরে নির্ভরশীলভাবে বিদ্যমান।

যাত্রার তিন ধাপ—অদ্বৈত: জগৎ মিথ্যা, আত্মা-ব্রহ্মই সত্য। যোগাচার: জগৎ নেই, কেবল চেতনা আছে। শূন্যতা: আত্মা-চেতনা-জগৎ—সবই শূন্য। প্রতিটি ধাপ জগতকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, কিন্তু প্রতিবার আরও গভীর স্তরে নেমে যায়। এভাবে ভারতীয় দর্শনের ভেতর দিয়ে এগোতে এগোতে আমরা এক চরম পর্যায়ে পৌঁছাই—যেখানে কেবল চূড়ান্ত শূন্যতা বা নিরুপাধি ব্রহ্ম সামনে আসে।

প্রমাণ ও অধ্যাসের স্তরক্রম: অদ্বৈতের উলটোপথ

১. প্রচলিত চিন্তা ও এর সীমাবদ্ধতা: সাধারণ মানব অভিজ্ঞতায় আমরা মনে করি—বাইরের জগৎ (টেবিল, চেয়ার, গাছ, ঘর) সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। কারণ এগুলো চোখে দেখা যায়, কানে শোনা যায়, হাতে ধরা যায়। আর আত্মা বা চেতনা অদৃশ্য; তাই কম নিশ্চিত মনে হয়। কিন্তু এ ধারণা অদ্বৈতের মতে ভুল ভিত্তি। এর কারণ: বাইরের জগৎকে জানার জন্য আমরা যে-উপায় (প্রমাণ: প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ ইত্যাদি) ব্যবহার করি, সেগুলো সব সীমিত ও শর্তসাপেক্ষ।

উদাহরণস্বরূপ, চোখে দেখা সবসময় নির্ভুল হয় না (মরুভূমিতে মরীচিকা দেখা যায়)। অনুমান ভুল হতে পারে (ধোঁয়া দেখে আগুন ভাবলাম, কিন্তু সেটা কুয়াশা ছিল)। অতএব, বাইরের জগতের সত্যতা সবসময় প্রশ্নবিদ্ধ।

২. আত্মার স্বপ্রকাশতা (Svaprakāśa): আত্মা বা চেতনার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা। আত্মার অস্তিত্ব জানার জন্য আলাদা কোনো প্রমাণ লাগে না। আমি আছি—এই বোধই প্রমাণ। এমনকি যদি সন্দেহও করি—“আমি আছি কি না”—তখনও সন্দেহ করার জন্য “আমার থাকা” দরকার। অতএব, আত্মা নিজেই নিজের প্রমাণ। এটাই স্বপ্রকাশতা—নিজে জ্বলে ওঠে, অন্য কিছুর আলো ধার করতে হয় না।

উদাহরণস্বরূপ, প্রদীপ যখন জ্বলে, তখন অন্য কিছুকে আলোকিত করে, আবার নিজেকেও প্রমাণ করে। তেমনি আত্মা নিজেও আলোকিত করে (নিজেকে প্রমাণ করে) এবং অন্য অভিজ্ঞতাকেও আলোয় আনে।

৩. উলটোদিকের স্তরক্রম: এখানে অদ্বৈতের বৈপ্লবিক যুক্তি—বাইরের জগৎ যতই দৃশ্যমান হোক, সেটা প্রমাণের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু আত্মা কোনো প্রমাণের উপর নির্ভরশীল নয়, সে নিজেই প্রমাণ। তাই আসল সত্য আত্মা (বা ব্রহ্ম)। আর জগৎ হলো প্রমাণসাপেক্ষ, ফলে দুর্বল, চূড়ান্ত নয়।

৪. অধ্যাস (ভুল আরোপ): যখন আমরা জগৎকে চূড়ান্ত সত্য ভাবি, সেটা হলো অধ্যাস—ভুল আরোপ। আমরা ব্রহ্ম (যা এক, নিরাকার, চিরন্তন)-র উপর নাম-রূপ চাপিয়ে দিই। যেমন দড়িকে সাপ মনে করা। দড়ি আসলেই আছে। কিন্তু তার উপর “সাপ”-এর ভাব চাপানো হলো ভুল। তেমনি ব্রহ্ম আছে, কিন্তু তার উপর আমরা জগতের নানা রূপ চাপাই। ফলে—জগৎ স্বাধীনভাবে বাস্তব নয়। বরং জগতের অভিজ্ঞতা হলো আমাদের ভুল চিন্তার ফল।

এই যুক্তির গভীর তাৎপর্য হলো: আত্মা/ব্রহ্মই একমাত্র স্বতঃসিদ্ধ, স্বপ্রকাশিত সত্য। জগৎ প্রমাণের উপর নির্ভরশীল, তাই অস্থায়ী প্রতিভাস। যখন আমরা আত্মাকে যেমন আছে তেমন দেখি, তখন জগৎ আর আলাদা বাস্তব বলে মনে হয় না। সহজ কথায়, জগতের প্রমাণ চাই, আত্মার প্রমাণ চাই না। আত্মা নিজেই প্রমাণ। আর যা প্রমাণের উপর নির্ভরশীল, তা চূড়ান্ত সত্য হতে পারে না।

অ-চূড়ান্ত বাস্তবতার ইতিবাচক প্রমাণ: বাধ বা তিরোভাবযোগ্যতা (Badha)

বাধ-এর দ্বান্দ্বিক কাঠামো: আমরা যেভাবে জগতকে জানি, সেটা পূর্ণ বা চূড়ান্ত নয়। আমাদের জ্ঞান সীমিত, তাই সেই জ্ঞানকে নির্ভরযোগ্য বলা যায় না। এরপর দর্শনে আনা হলো “বাধ” (sublation) ধারণা। বাধ মানে হলো—কোনো কিছুকে আমরা বাস্তব ভেবে নিচ্ছি, কিন্তু পরে আরও গভীর বা উচ্চতর জ্ঞানে তা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। অর্থাৎ, কোনো কিছুর অস্থিরতা, পরিবর্তনশীলতা বা অ-চূড়ান্ত সত্য হওয়া প্রকাশ পায়। সহজ কথায়, আজ যা সত্য মনে হচ্ছে, আগামীকাল তা ভুল প্রমাণিত হতে পারে—এটাই বাধ।

উদাহরণ (ঘট / পাত্র): একটি ঘট (মাটির পাত্র) আমাদের কাছে দৃঢ় ও স্থায়ী বলে মনে হয়। আমরা বলি, “এই ঘট বাধের আশ্রয়স্থল”। এর মানে— যদিও অভিজ্ঞতায় ঘট বাস্তব মনে হয়, কিন্তু চূড়ান্ত জ্ঞান লাভ করলে বোঝা যাবে যে, এটা টেকসই সত্য নয়; বরং বাতিলযোগ্য। “বাধ” বলতে বোঝায়—যা এখন বাস্তব মনে হচ্ছে, তা উচ্চতর জ্ঞানে ভ্রান্ত বা বাতিল বলে প্রকাশ পেতে পারে।

এক্ষেত্রে দাবি আসে—ঘট (পাত্র) আসলে বাতিলযোগ্য (নিবারণযোগ্য)। কেন? কারণ ঘট একটি দ্রব্য (Dravya / পদার্থ বা সত্তা)। অর্থাৎ, যত ধরনের পদার্থ আছে, সবই বাতিলযোগ্য। শুধু ঘট নয়। ঘটকে আমরা বাস্তব মনে করি, কিন্তু উচ্চতর জ্ঞানে বোঝা যায় এটি চূড়ান্ত সত্য নয়। ঘটকে বাতিলযোগ্য বলা মানে—সকল দ্রব্যই বাতিলযোগ্য। এটি শুধু এক ঘট নয়, বরং দ্রব্যজাতীয় সব কিছুর সাধারণ বৈশিষ্ট্য।

অন্য ঘট দিয়ে প্রমাণ (Paraghatavat): অন্য ঘটও একইভাবে বাতিলযোগ্য। তাই এ নিয়ম সর্বজনীন—সব প্রকাশিত সত্তা (entities) আপেক্ষিক, নির্ভরশীল ও অ-চূড়ান্ত।

প্রচলিত স্তরে (Vyavaharika Satya): ঘটকে আমরা স্বীকার করি। এটি কাজে লাগে—জল রাখা যায়, বিক্রি হয়, ব্যাবহারিক উদ্দেশ্য পূরণ করে। পরমার্থিক স্তরে (Paramarthika Satya): ঘটের মধ্যে সেই অপরিবর্তনীয়, স্থায়ী, সর্বাত্মক সত্য নেই। তাই চূড়ান্ত সত্য হিসেবে ঘট বা কোনো দ্রব্য গ্রহণযোগ্য নয়। ঘট উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করা হলো যে— সব পদার্থ (দ্রব্য) আপেক্ষিক সত্যে বিদ্যমান হলেও, চূড়ান্ত সত্যে তারা বাতিলযোগ্য। অর্থাৎ, তারা নির্ভরশীল ও অ-চূড়ান্ত।

বাস্তবতার পার্থক্য (Vyavaharika–Paramarthika–Bheda): সব সত্তাই বাধযোগ্য। যে-কোনো পদার্থ বা সত্তা আপেক্ষিক ও অস্থায়ী। এই দিক থেকে বোঝা যায়, জগৎকে আমরা যেভাবে দেখি, তা চূড়ান্ত সত্য নয়।

অ-দ্বৈতবাদী মূল ধারণা: এখান থেকে অদ্বৈতের মূল শিক্ষা বেরিয়ে আসে—প্রচলিত বাস্তবতা (Vyavaharika Satya) আর চূড়ান্ত বাস্তবতা (Paramarthika Satya) আলাদা। জগৎকে আমরা ব্যবহার করি, কাজে লাগাই, সেটি কার্যকরী সত্য। কিন্তু পরম সত্যে (ব্রহ্ম-স্বরূপে) এই জগতের নিজস্ব স্থায়ী সত্য নেই। এক্ষেত্রে স্তরভিত্তিক বোঝাপড়া দরকার।

এজন্য দর্শন এক ধরনের শ্রেণিবিন্যাস (Hierarchy) করে—কোন জিনিস কার্যকরী স্তরে সত্য, আর কোন জিনিস পরমার্থে সত্য। এর ফলে আমরা বুঝতে পারি—জগৎ কাজ করছে, কার্যকারিতা আছে, কিন্তু তা চূড়ান্ত মর্যাদা বহন করে না। “ব্যাবহারিক সত্য” আর “পরম সত্য” আলাদা। জগৎ ব্যাবহারিক স্তরে কার্যকরী, কিন্তু চূড়ান্ত সত্যে তা ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নয়।

প্রথম স্তর হলো ব্যাবহারিক সত্য (Vyavaharika Satya) বা প্রচলিত, অভিজ্ঞতানিষ্ঠ বাস্তবতা। এটি আমাদের দৈনন্দিন মিথস্ক্রিয়ার বাস্তবতা, যেখানে বস্তুগুলি নির্ভরযোগ্যভাবে কাজ করে এবং এতে ব্যাবহারিক উদ্দেশ্যগুলি পূরণ হয়। ঘট এখানে বিদ্যমান এবং একটি আধার হিসাবে কাজ করে। তবে, এই বাস্তবতা অস্থায়ী কারণ—এটি অবিদ্যা (ignorance) এবং প্রমাণের সীমাবদ্ধতার উপর নির্ভরশীল।

দ্বিতীয়, উচ্চতর স্তরটি হল পারমার্থিক সত্য (Paramarthika Satya), যা চূড়ান্ত, অপরিবর্তনীয় এবং স্বাধীন বাস্তবতা। এই বাস্তবতা মৌলিকভাবে অ-দ্বৈত। দার্শনিক উদ্দেশ্য হলো প্রমাণ করা যে, ব্যাবহারিক বাস্তবতা—সত্তার সমগ্র জগৎ—পারমার্থিক বাস্তবতার মর্যাদা রাখে না, কারণ এটি বাধ (Badha)-এর অধীন। এইভাবে সকল সত্তার সহজাত বাধযোগ্যতা (Etat-nishtha-badhyata-ashrayah) অনিবার্যভাবে তাদের ক্ষণস্থায়ী এবং নির্ভরশীল মর্যাদার দিকে নির্দেশ করে, যা বস্তুগত অস্তিত্বের পরম প্রকৃতিকে চ্যালেঞ্জ করে এবং মনোযোগকে একটি আরও মৌলিক, অপরিবর্তনীয় বাস্তবতার দিকে পরিচালিত করে, যা প্রায়শই চেতনার সাথে চিহ্নিত হয়।

সমালোচনার ক্ষেত্রে ‘দ্রব্যত্ব’ (পদার্থ হওয়া)-এর গুরুত্ব: আলোচনার এই অংশে, কোনো কিছুর ‘বাধযোগ্যতা’ বা বাতিল হওয়ার কারণ হিসেবে ‘দ্রব্যত্ব’ (Dravyatvat) বা ‘পদার্থ হওয়া’-কে বেছে নেওয়া হয়েছে। এটি একটি চিন্তাভাবনা করে নেওয়া দার্শনিক কৌশল। এর উদ্দেশ্য হলো—যুক্তিটিকে শুধু একটি নির্দিষ্ট জিনিস (যেমন একটি ঘট) নিয়ে সমালোচনা না রেখে, বস্তু বা পদার্থের পুরো বিভাগটির দিকে প্রসারিত করা।


যেমন বৈশেষিক দর্শনে, বাস্তব জগতকে কিছু মূল ভাগে ভাগ করা হয়, যার মধ্যে ‘দ্রব্য’ হলো প্রধান।
আমাদের পদ্ধতিগত লক্ষ্য হলো—এটা প্রমাণ করা যে, কোনো জিনিস বাধ (Badha) বা পরে বাতিল হওয়ার যোগ্য বলে এর চূড়ান্ত বাস্তবতা নেই। এই সর্বজনীন সত্য প্রমাণ করার জন্য আমরা কারণ হিসেবে ব্যবহার করি ‘দ্রব্যত্ব’-কে।


যেহেতু প্রতিপক্ষ দর্শনগুলো পৃথিবী, জল, আগুন-সহ পুরো বস্তুজগৎকেই ‘দ্রব্য’ বা পদার্থ হিসেবে ধরে, তাই যখন আমরা বলি, ‘পদার্থ হওয়া’ মানেই তার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হলো বাতিলযোগ্য হওয়া—তখন এর অর্থ দাঁড়ায়: আমাদের অনুভব-করা এই গোটা বস্তুজগতটিই, যা অনেকগুলো আলাদা আলাদা পদার্থ দিয়ে তৈরি, তা চূড়ান্ত বিচারে যৌক্তিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ। এই সমালোচনাটি তাই খুবই ব্যাপক, যা নিশ্চিত করে যে, আলাদা আলাদা পদার্থের স্থায়ী বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি যে-কোনো দার্শনিক ব্যবস্থাই নিয়মতান্ত্রিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।

সামঞ্জস্যের অভাব: সম্পর্ক এবং নিজস্ব কারণ—সম্পর্কের অযৌক্তিকতা (সম্বন্ধানুপপত্তি):


প্রকাশিত জগত বা বিশ্ব-কে শুধু যে ক্ষণস্থায়ী বলা হচ্ছে, তা নয়; তার চেয়েও বড়ো কথা হলো, 'সম্পর্কের অযৌক্তিকতা' (Sambandhanupapatti) ধারণাটি ব্যবহার করে এই জগতের ভেতরের কাঠামোগত সামঞ্জস্য-কেও চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। এই শব্দটি বোঝায়—বিশ্বের বিভিন্ন জিনিস, ধারণা, এমনকি যে অনুভব করে (দ্রষ্টা) এবং যা অনুভব করা হয় (দৃশ্য), তাদের মধ্যে থাকা মৌলিক সম্পর্কটি কী, তা যৌক্তিকভাবে সঠিকভাবে প্রমাণ করা বা সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব। সহজ কথায়, জিনিসগুলো একে অপরের সাথে কীভাবে যুক্ত হয়ে আছে, তা পরিষ্কার করে যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায় না।


সাংখ্য দর্শনের মতো যে-কোনো দর্শনে, যা দুটি আলাদা সত্তা (যেমন: পুরুষ বা চৈতন্য এবং প্রকৃতি বা জড়) বা অনেকগুলো সত্তা মেনে চলে, সেই ব্যবস্থার স্থায়িত্ব নির্ভর করে এই আলাদা অংশগুলো কীভাবে একে অপরের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে, তা সঠিকভাবে বোঝানোর ওপর। কিন্তু যদি যুক্তি দিয়ে তাদের সম্পর্কগুলো ঠিকঠাকভাবে ব্যাখ্যা করা না যায় বা প্রমাণ করা না যায় (Anupapatti), তবে সেই দার্শনিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তিগুলোই চরমভাবে নড়বড়ে হয়ে যায়।


অ-দ্বৈতবাদে পৌঁছানো (Advaita): সম্পর্ক নিয়ে তৈরি এই যুক্তির ব্যর্থতার কারণে একটি অনিবার্য দার্শনিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হয়, আর তা হলো অ-দ্বৈতবাদ (Advaita)। যদি এই জগতের বিভিন্ন জিনিসকে আলাদা আলাদা বলে প্রমাণ করা না যায় এবং তাদের মধ্যকার সম্পর্কগুলোও যুক্তি দিয়ে টিকিয়ে রাখা না যায়, তবে মানতেই হবে যে, চূড়ান্ত বাস্তবতা আসলে একটি অ-বিভেদযুক্ত ঐক্য।

এর ফলস্বরূপ, আমরা জগতে যে পার্থক্য, লেনদেন বা সম্পর্ক দেখি, তা সবই সেই মূল একত্বের উপর মিথ্যা বা ভুলভাবে চাপানো (অধ্যাস/Adhyasa) ছাড়া আর কিছুই নয়। এইভাবে, ‘সম্পর্কের অযৌক্তিকতা’ (Sambandhanupapatti) দেখিয়ে দেয় যে, যে-দর্শনই চূড়ান্তভাবে সব কিছুর আলাদা অস্তিত্ব দাবি করে, সেই দাবিটিই ভুল এবং অর্থহীন।