অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: এক-শো পঁচিশ



অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে এই ভাবনাটি মুক্ত জীবনের কর্মতত্ত্বের সারাংশ প্রকাশ করে—কর্মের মর্মবদল মানে কর্ম ত্যাগ নয়, বরং কর্তা-ভাব থেকে অবসর।

জ্ঞান উঠলে চেতনার ভেতরে এক নিখুঁত স্বচ্ছতা উদ্‌ভাসিত হয়। তখন কাজ আর “আমার করা” বলে আলাদা দাঁড়ায় না। কাজ ঘটে—কিন্তু তা সাক্ষী-চৈতন্যের সামনে একটি ঘটমান দৃশ্যমাত্র। এই চৈতন্য কোনো কর্মী নয়, বরং সমস্ত ক্রিয়ার আলো। যখন ফলের প্রতি আসক্তি ঝরে যায়, তখন কর্মের উদ্যোগ ক্ষীণ হয় না; বরং তা আরও স্বচ্ছ ও শুদ্ধ প্রবাহে রূপ নেয়।

আগে কাজ হতো নিজের লাভ, সুখ বা স্বীকৃতির জন্য—এখন তা হয় নিছক চেতনার প্রকাশের জন্য। যেমন ফুল ফোটে কারণ ফোটাই তার স্বভাব, তেমনি জ্ঞানীর কর্মও ঘটে কারণ চেতনার প্রকৃতি প্রকাশ।

এই অবস্থায় দান, সেবা, শিক্ষা, প্রেরণা—সবই হয়ে ওঠে অহং-শূন্য প্রকাশ, ব্রহ্মে নিবেদন। তখন “আমি দিচ্ছি”, “আমি সাহায্য করছি” এই চিন্তা আর থাকে না। যা ঘটে, তা স্বতঃস্ফূর্ত সহানুভূতি—চেতনারই নিজের প্রতি দান।

গীতা এই অবস্থার কথা এভাবে বলে—“ব্রহ্মণ্যাধায় কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা করোতি যঃ।” (ভগবদ্গীতা, ৫.১০) অর্থাৎ, যে-ব্যক্তি সমস্ত কর্ম ব্রহ্মে অর্পণ করে, ফলের আসক্তি ত্যাগ করে কাজ করে—তার কর্ম তাকে আর বেঁধে রাখে না।

শ্রীকৃষ্ণ আরও বলেন—“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।” (গীতা, ২.৪৭) অর্থাৎ, তোমার অধিকার কেবল কর্মে, ফলে নয়।

এই “ফলত্যাগ” আসলে কর্তা-ভাবের ত্যাগই; ফল আসবে না বলেই নয়, বরং কারণ আর আমি-ভাবের বন্ধন নেই।

অতএব, যখন কর্ম ব্রহ্মে নিবেদিত হয়, তখন কর্ম করেও অকার্ম সাধিত হয়—কাজ হয়, কিন্তু বন্ধন সৃষ্টি করে না। চলন থাকে, কিন্তু গিঁট নেই; গতি থাকে, কিন্তু কর্তা নেই। এই অবস্থায় কর্ম আর বন্ধন নয়, হয়ে ওঠে মুক্তিরই প্রকাশ। প্রতিটি কাজ তখন ধ্যান, প্রতিটি গতি স্মরণ। কর্তা বিলীন হলে কর্ম নিজেই পূজা-আরাধনা হয়ে যায়, আর জীবন নিজেই হয়ে ওঠে গতি-মুক্ত স্থিরতা—যেখানে চলা আর স্থির থাকা একাত্ম হয়ে যায়।

এটাই অদ্বৈতের জীবন্মুক্তের জীবন—চেতনা সর্বত্র কার্য করছে, অথচ সর্বত্র নিঃস্পন্দ; জীবন বহমান, অথচ চিরস্থির; এমন এক অবস্থা, যেখানে কর্মই ধ্যান, আর ধ্যানই কর্ম—কারণ সবই ব্রহ্মের লীলা।

বেদান্তের আলোকে “নিষ্কর্ম্যতা” (niṣkarmyatā) শব্দটির প্রকৃত অর্থ কখনোই কর্মবিরতি নয়, বরং এক উচ্চতর চেতনা-অবস্থা, যেখানে কর্ম ঘটে, কিন্তু কর্তা নেই; গতি থাকে, কিন্তু টান নেই। এটি জীবন্মুক্তির স্বাভাবিক প্রকাশ, যেখানে কার্যকলাপের মধ্যেও চেতনা অচঞ্চল, স্বতঃস্ফূর্ত ও নির্বিকার থাকে।

গীতায় বলা হয়েছে—“যঃ পশ্যেত্ অকার্মণি কর্ম যঃ, কর্মণি চ অকার্ম যঃ।” (গীতা ৪.১৮) অর্থাৎ, যে কর্মের মধ্যেও অকর্ম দেখে এবং অকর্মের মধ্যেও কর্মের উপস্থিতি উপলব্ধি করে, সে-ই প্রকৃত যোগী, প্রকৃত জ্ঞানী। এখানে “অকর্ম” মানে নিষ্ক্রিয়তা নয়, বরং কর্তা-ভাবের অনুপস্থিতি।

বেদান্তের ব্যাখ্যায় ‘কর্মে অকর্ম দেখা’ মানে বোঝা যে, কর্মের সমস্ত ঘটমানতা কেবল উপাধির স্তরে—দেহ, মন, ইন্দ্রিয়ের পরিসরে—ঘটে; আত্মা বা চেতনা তার সাক্ষী, কখনোই কর্মী নয়।

শঙ্করাচার্য গীতাভাষ্যে (গীতা, ৪.১৮) বলেন—“কর্মণি অকার্মদর্শী ন অনাসক্তঃ, কৃত্স্নক্রিয়াবিরোধী, কৃতস্নবুদ্ধ্যাভিসম্বন্ধী।” অর্থাৎ, জ্ঞানী কর্ম ত্যাগ করেন না; তিনি কর্মের মধ্যেই তার অকার্ম স্বরূপ দেখেন। এই বোধেই তাঁর কর্ম নিষ্কর্ম্য হয়ে যায়—কর্ম করেও কর্মফল জন্মায় না, কারণ কর্তা আর অবশিষ্ট থাকে না।

যখন এই দৃষ্টি জাগে, তখন ইচ্ছা, অহংকার, আর ফলের প্রতি আকর্ষণ স্বয়ং মিলিয়ে যায়। কর্ম তখন আর কর্তব্যের চাপ নয়, হয়ে ওঠে লীলা—ব্রহ্মের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। কাজ তখন “করতে হবে” বলে নয়, বরং “ঘটে যায়” বলে ঘটে। এটি নিষ্ক্রিয়তা নয়, বরং পরম সজাগতা—যেখানে চেতনা নিঃস্পন্দ থেকেও সর্বদা সচল।

এই লীলার মধ্যে নীতি বা ধর্ম আর বাইরে থেকে চাপানো কোনো বিধান নয়; তা ভেতর থেকে উঠে-আসা এক স্বাভাবিক শুভবৃত্তি। এটি শুভ-অশুভের গণনা করে না, বরং এক অন্তর্নিহিত সদ্বুদ্ধির সুরে আচরণ করে। যেমন ফুল সুবাস ছড়ায়—চেষ্টা করে নয়, স্বভাবে—তেমনি জ্ঞানীর জীবনে করুণা, দয়া, অপরিগ্রহ, সত্য প্রভৃতি গুণ স্বতঃসিদ্ধভাবে বিকশিত হয়।

গীতায় এই অবস্থার বর্ণনা আছে—“দুঃখেষু অনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ।” (গীতা, ২.৫৬) অর্থাৎ, দুঃখে অনুদ্‌বিগ্ন ও সুখে অনাসক্ত—এমন স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি কর্মের মধ্যেও নির্বিকার।

তাই সত্যদৃষ্টিতে প্রতিষ্ঠা মানেই অহিংসা, দয়া, অপরিগ্রহ—এগুলো কোনো যুক্তি দিয়ে ধারণ করতে হয় না। এগুলো কোনো বিধান নয়; বরং আত্মার স্বরূপে জেগে ওঠা প্রাকৃতিক গুণ। অহংকার বিলুপ্ত হলে এ গুণগুলো নিজ থেকেই প্রকাশিত হয়, যেমন অন্ধকার সরলে আলো নিজে থেকেই উদ্‌ভাসিত হয়।

অদ্বৈতের দৃষ্টিতে নিষ্কর্ম্যতা হলো এমন অন্তর্মুক্তি, যেখানে কর্ম চলে কিন্তু কর্তা নেই; গতি থাকে কিন্তু টান নেই; নীতি, ধর্ম, দয়া—সবই বাহ্যিক আরোপ নয়, বরং চেতনার স্বাভাবিক সুবাস।

যেমন চেতনা নিজেই আলো, আর আলো নিজেই পথ, তেমনি নিষ্কর্ম্যতা মানে জীবন আর দর্শনের একীভবন—যেখানে কর্মই ধ্যান, আর ধ্যানই কর্ম; ক্রিয়া ঘটে, কিন্তু কর্তা থাকে না; এবং সেই অবস্থায় জীবনের প্রতিটি স্পন্দন হয়ে ওঠে ব্রহ্মের লীলা।

প্রারব্ধের ধারণা কেবল ব্যাবহারিক স্তরের ব্যাখ্যা। জ্ঞানোদয়ের পর দেহ-মন-ইন্দ্রিয় হঠাৎ থেমে যায় না। নিক্ষিপ্ত তীর যেমন লক্ষ্যে পৌঁছানো পর্যন্ত উড়ে চলে, তেমনি জ্ঞান উঠলেও শরীর সেই আগের বেগেই কিছুদিন কাজ চালায়।

অহংকার তখন পোড়া দড়ির মতো—রেখা চোখে পড়ে, কিন্তু বাঁধতে পারে না। বাসনার ঢেউ ওঠে-নামে, কিন্তু বীজ পোড়া—নতুন কর্মফল আর জন্মায় না। সঞ্চিত কর্ম পুড়ে যায়। আগামী কর্ম জন্ম নেয় না। শুধু প্রারব্ধ কর্ম ক্ষয় হতে থাকে—যা ইতিমধ্যেই ফল দিতে শুরু করেছিল।

এইটুকুই জ্ঞানীর জীবনের ব্যাখ্যা। তিনি কাজ করেন, কিন্তু কর্তা নন। জীবন চলে, কিন্তু বন্ধন নয়—এ কেবল প্রারব্ধের ক্ষয় পর্যন্ত এক শান্ত লীলা।

জীবনমুক্তির মাহাত্ম্য এখানেই যে, মুক্তি কোনো মৃত্যুর পরের অবস্থা নয়, এটি এক জীবন্ত অভিজ্ঞতা। জগৎ তখন অদৃশ্য হয় না, কিন্তু তার “বাস্তব” দাবি হারিয়ে ফেলে। সব কিছু দেখা যায়, অনুভূত হয়, কিন্তু ভেতরের বন্ধন সরে যায়। কর্ম থামে না, কিন্তু কর্তা-ভাব ঝরে যায়; কাজ ঘটে, অথচ “আমি করছি” বলে কোনো গর্ব বা ভয় জাগে না।

জাগ্রত, স্বপ্ন, ও সুষুপ্তি—এই তিন অবস্থার ওঠা-নামা তখন এক নীরব পটভূমিতে ধরা পড়ে। সেই পটভূমিই তুরীয়—অপরিবর্তনীয় চেতনার ধ্রুব উপস্থিতি, যা সব অভিজ্ঞতার নিচে জেগে থাকে।

স্মৃতি ও সংস্কারের পুরোনো অভ্যাস তখনও চোখে পড়ে, কিন্তু তাদের শক্তি কমে যায়। আগের মতো প্রতিক্রিয়াশীলতা থাকে না; সাড়া থাকে, প্রতিক্রিয়া নয়। ঘটনার সঙ্গে জ্ঞানীর সংগতি থাকে, জড়িয়ে পড়া থাকে না।

এই অবস্থায় মন হয় এক স্বচ্ছ আয়না—সব প্রতিফলন আসে-যায়, কিন্তু কিছু আটকায় না। নীরবতা তখন নিস্ক্রিয় নয়; তা আচরণের ভিতরে এক গভীর সুরের মতো বাজে—চলাফেরায়, কথায়, দৃষ্টিতে—সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এক প্রশান্ত দীপ্তি।

বিদেহমুক্তি আসলে জীবনমুক্তিরই স্বাভাবিক পূর্ণতা। জ্ঞান ওঠার পর যে প্রারব্ধ কর্ম অবশিষ্ট থাকে, তা যখন সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়, তখন দেহ-মন-ইন্দ্রিয়ের এই উপাধি-মঞ্চও গুটিয়ে যায়। নাটক শেষ হয়, কিন্তু দর্শক—অর্থাৎ, সাক্ষী-চেতনা—অবিচল থাকে।

পারমার্থিক দৃষ্টিতে জীবনমুক্তি ও বিদেহমুক্তির মধ্যে কোনো ভেদ নেই। উভয় অবস্থায়ই অবিদ্যা লুপ্ত, কর্তা-ভাব নিঃশেষ, এবং আত্মা নিজের স্বরূপে জাগ্রত। পার্থক্যটি কেবল ব্যাবহারিক স্তরে।

শঙ্কর বলেন (ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য, ৪.১.১৫): “জ্ঞানোদয়াত্ প্রারব্ধকর্মণো ন নাশঃ।” অর্থাৎ, জ্ঞান উঠলেও প্রারব্ধকর্ম বিনষ্ট হয় না—তাই শরীর কিছুদিন টিকে থাকে। কিন্তু প্রারব্ধ শেষ হলে, “দেহ–অবসানেই সম্পূর্ণ মুক্তি”—এটাই বিদেহমুক্তি। একই ভাব বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৪.৬-৪.৪.৭)–এর শঙ্করভাষ্যে।

যখন জ্ঞান উদয় হয়, তখন অবিদ্যা নাশ হয়, ফলে নতুন কর্মের আরম্ভ ঘটে না (অকর্মদর্শিতা)। তবে পূর্বজন্মের প্রারব্ধ কর্ম যতক্ষণ অবশিষ্ট, ততক্ষণ দেহ টিকে থাকে। প্রারব্ধ ফুরোলে দেহ পতিত হয়, এবং তখন বিদেহমুক্তি ঘটে—অর্থাৎ ব্রহ্মের সঙ্গে চূড়ান্ত অভেদাবস্থা।

সূর্যোদয়ের পর মেঘ যখন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়, তখন আকাশ যেমন সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়, তেমনি জীবন্মুক্ত জ্ঞানীর দেহ ঝরে গেলে চেতনা-আকাশ সম্পূর্ণ অনাবৃত হয়—এটাই বিদেহমুক্তি।

জীবনমুক্ত অবস্থায় মঞ্চে আলো জ্বলছে—অভিনেতা (দেহ-মন) এখনও চলছে, সংলাপও চলছে, কিন্তু অভিনেতা জানে যে, সে চরিত্র নয়; সে কেবল অভিনয় করছে। আর বিদেহমুক্তিতে আলোও নিভে যায়, মঞ্চও শূন্য হয়—তবু “জেগে-থাকা” সেই একই চেতনা অবশিষ্ট থাকে—নিস্পন্দ, নির্ভার, অনন্ত।

জ্ঞান উঠলে অবিদ্যা ও আগামী-সংচিত কর্ম নষ্ট হয়—এই কথাটি অদ্বৈত বেদান্তের মুক্তি-তত্ত্বের মৌলিক সত্য। এটি শঙ্করাচার্য তাঁর ব্রহ্মসূত্রভাষ্য (৪.১.১৫-৪.১.১৬) এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদভাষ্য (৪.৪.৬-৪.৪.৭)–এ বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

অবিদ্যা মানে নিজের প্রকৃত স্বরূপ না জানা—আত্মা যে ব্রহ্ম, তা না জেনে ‘আমি দেহ’, ‘আমি কর্তা’, ‘আমি ভোক্তা’ বলে ভুল করা। এই ভুল থেকেই কর্মের বন্ধন শুরু হয়—কারণ কর্তা থাকলে কর্ম জমে, আর কর্ম জমলে ফল পেতে হয়।

শঙ্কর (ব্রহ্মসূত্রভাষ্য ৪.১.১৫) বলেন—“অবিদ্যায়া উপস্থিতো কর্তা–ভাবঃ, তস্য জ্ঞানোদয়ে নাশঃ।” অর্থাৎ, অবিদ্যা থেকেই কর্তা-ভাব জন্মে, আর জ্ঞান উদয় হলে সেই কর্তা-ভাব নষ্ট হয়।

জ্ঞান উঠলে—অর্থাৎ আত্মা যে ব্রহ্ম, তা প্রত্যক্ষ হলে—অবিদ্যা নিজে নিজেই বিলুপ্ত হয়। যেমন আলো এলে অন্ধকার টেকে না, তেমনি জ্ঞানের আলোয় অজ্ঞতা থাকে না।

বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৪.৪.১৯) বলে—“তমঃ প্রজাহ্যৈনম্ আয়াতি”—অর্থাৎ, জ্ঞানের আলোয় অন্ধকার দূর হয়।

অবিদ্যা চলে গেলে ‘আমি কর্তা’, এই ধারণা আর থাকে না। কর্তা না থাকলে কর্ম জমে না। ফলে আগামী (এই জন্মে নতুন কর্ম) আর উৎপন্ন হয় না।

গীতা (৪.১৮) ঘোষণা করছে: “কর্মণি অকার্মদর্শী যঃ, স পণ্ডিতঃ।” অর্থাৎ, যে-ব্যক্তি কর্মে কর্তা-ভাব দেখে না, সে-ই জ্ঞানী।

‘সংচিত কর্ম’ মানে পূর্বজন্মে সঞ্চিত সমস্ত কর্মফল। তার ফল দিতে পারে, এমন কোনো ‘অহং’ বা ‘কর্তা’ আর নেই—তাই সে কর্ম দগ্ধ-বীজের মতো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।

বৃহদারণ্যক উপনিষদভাষ্য (৪.৪.৬)–এ শঙ্কর বলেন—“যথা দগ্ধং বীজং নাঙ্কুরোত্পাদায় সক্ষমঃ, তথৈব জ্ঞানদগ্ধ–কর্মানাম্ অনারম্ভঃ।” অর্থাৎ, যেমন পুড়ে যাওয়া বীজ অঙ্কুরিত হয় না, তেমনি জ্ঞানে দগ্ধ কর্ম আর ফল দেয় না।

তবে প্রারব্ধ কর্ম, অর্থাৎ যেগুলোর ফল ইতিমধ্যেই এই দেহে কার্যকর হয়েছে, তা কিছুদিন থাকে। যেমন ছোড়া তীর মাঝপথে থামে না, তেমনি প্রারব্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেহ টিকে থাকে।

শঙ্কর (ব্রহ্মসূত্রভাষ্য, ৪.১.১৫) বলছেন: “প্রারব্ধস্য তু অপরিশেষে দেহপাতে বিদেহমুক্তিঃ।” অর্থাৎ, প্রারব্ধ শেষ হলে দেহের পতন ঘটে, আর তখন বিদেহমুক্তি।

জ্ঞান উঠলে—অবিদ্যা নষ্ট হয়, সংচিত ও আগামী কর্ম নিঃশেষ হয়, কেবল প্রারব্ধ কর্ম অবশিষ্ট থাকে, যা দেহকে চালিয়ে রাখে। প্রারব্ধ নিঃশেষ হলে দেহ পতন ঘটে, তখন আত্মা আর ব্রহ্ম-স্বরূপে একীভূত হয়—একে বলে বিদেহমুক্তি।

এই ধারণার সারসংক্ষেপ শঙ্করীয় সূত্রে প্রায়শই এভাবে বলা হয়—“জ্ঞানোদয়াত্ প্রারব্ধ—ক্ষয়ান্তে দেহ—পাতেন বিদেহ–মুক্তির্ভবতি।”

যার ভাব এরূপ—জ্ঞান হলে অবিদ্যা নাশ হয়; অবিদ্যা নাশে কর্তা-ভাব নষ্ট হয়; কর্তা-ভাব নষ্ট হলে নতুন কর্ম আর জন্ম নেয় না; প্রারব্ধ শেষ হলে দেহ পড়ে যায়; আর আত্মা চিরব্রহ্মে লীন হয়।