অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: এক-শো একুশ



যে-বোধ নিজে আলোকিত নয়, তাকে চেতনা আলোকিত করে—যেমন চাঁদ সূর্যের আলোয় জ্বলে। কিন্তু চেতনা নিজের আলোয় নিজেই জ্বলে, অন্য কোনো উৎস থেকে নয়। তাই তার বোধ মধ্যবিহীন, অপরোক্ষ—সরাসরি, স্বতঃসিদ্ধ।

অভিজ্ঞতায় যা ওঠে, তার সবই জ্ঞেয়—অর্থাৎ, সীমিত ও নির্ভরশীল। কিন্তু অভিজ্ঞতার পেছনে যে অক্ষয় দীপ্তি, সেটিই চিত্—অসীম, স্বাধীন, অপরোক্ষ। চেতনা জানায়, কিন্তু তাকে জানা যায় না; সে সব জ্ঞানের মূল, এবং সমস্ত অভিজ্ঞতার নিঃশব্দ অধিষ্ঠান।

বেদান্তে যখন প্রশ্ন তোলা হয়—“যদি ব্রহ্ম কখনও প্রমেয় (জ্ঞেয়) না হন, তবে ব্রহ্ম-জ্ঞানও কি প্রমা (সত্য জ্ঞান) নয়?”—তখন অদ্বৈত এই আপাত-বিরোধের মধ্যেই এক গভীর সত্য ব্যাখ্যা করে।

প্রমা (pramā) মানে সাধারণত এমন জ্ঞান, যা কোনো বস্তুর (প্রমেয়) সঠিক ধারণা দেয়। যেমন, “এটা ঘট”—এখানে ঘট জ্ঞেয়, আর সেই ঘট সম্পর্কিত সঠিক জ্ঞানই প্রমা। কিন্তু ব্রহ্ম কখনও জ্ঞেয় বস্তু নন। তাই ব্রহ্ম-জ্ঞান কোনো প্রমেয়-জ্ঞান হতে পারে না; এটি অন্য প্রকৃতির জ্ঞান।

অদ্বৈত বলে, ব্রহ্ম-জ্ঞান হলো প্রমাণ-নিবর্তক জ্ঞান (nirvartyāvaraṇa–jñāna)—অর্থাৎ, এর কাজ নতুন কিছু জানানো নয়, বরং অবিদ্যা বা আচ্ছাদন সরানো। এই জ্ঞান এমন জ্ঞান, যা কোনো নতুন বস্তু জানায় না, বরং ভুল ধারণা বা অবিদ্যা দূর করে। ব্রহ্মজ্ঞান নতুন কোনো জ্ঞেয় বস্তুকে প্রকাশ করে নয়, বরং অবিদ্যার আচ্ছাদন সরিয়ে ফেলে।

সাধারণত “প্রমাণ” বলতে বোঝায় এমন মাধ্যম, যা কোনো অজানা বস্তুকে প্রকাশ করে। যেমন চোখ আলোয় বস্তু দেখায়, কান শব্দ প্রকাশ করে, মন ও যুক্তি ধারণা তৈরি করে। এই ধরনের প্রমাণের ফলক জ্ঞানকে বলা হয় প্রমা—অর্থাৎ কোনো প্রমেয় বা জানার বিষয়ের সঠিক ধারণা। কিন্তু ব্রহ্ম কখনও প্রমেয় নন, কারণ তাঁকে কোনো প্রমাণের মাধ্যমে ধরা যায় না; তিনি সমস্ত প্রমাণ-ক্রিয়ারই অধিষ্ঠান। তাই ব্রহ্মজ্ঞানকে সাধারণ প্রমা বলা যায় না।

অদ্বৈত বলে, ব্রহ্মজ্ঞান হলো অবিদ্যা-নিবর্তক বা প্রমাণ-নিবর্তক জ্ঞান। এর কাজ হলো “আমি দেহ”, “আমি মন”, “আমি কর্তা”, “আমি ভোক্তা”—এই সব ভ্রান্ত আরোপ ভেঙে দেওয়া। অবিদ্যা যতদিন থাকে, ততদিন আত্মার স্বপ্রকাশ আড়াল থাকে। যখন শাস্ত্র বা গুরু-বাক্যের দ্বারা যে জ্ঞান-বৃত্তি ওঠে, সেটি নতুন কোনো বস্তু আনে না; বরং এই ভুল ধারণাগুলো দূর করে দেয়। তখন আত্মা নিজের মতো জ্যোতির্ময়ভাবে প্রকাশিত হয়।

সূর্য সবসময় আকাশে থাকে, কিন্তু মেঘে ঢেকে থাকলে দেখা যায় না; মেঘ সরে গেলে সূর্য আবার দেখা যায়। সূর্য তখন নতুন করে ওঠে না—শুধু আবরণ সরে যায়। তেমনি, ব্রহ্মজ্ঞানও কোনো নতুন বস্তুকে জানায় না; এটি মায়া বা অবিদ্যার পর্দা সরিয়ে দেয়, ফলে আত্মা নিজেই নিজেকে প্রকাশ করে।

শাস্ত্রে বলা হয়েছে, মহাবাক্য “তৎ ত্বম্ অসি”—এর কাজ কোনো নতুন তথ্য দেওয়া নয়; এটি কেবল মনের মধ্যে এক বিশেষ অখণ্ডাকার বৃত্তি জাগায়, যা আত্মা ও ব্রহ্মের অভিন্নতা উপলব্ধি করায়। শঙ্করাচার্য বলেন, শাস্ত্র কোনো নতুন বস্তু প্রকাশ করে না, বরং অবিদ্যা-আবরণ দূরীকরণে সাহায্য করে। তাই ব্রহ্মজ্ঞান “প্রাপ্তস্য প্রাপ্তি”—যা সবসময়ই ছিল, শুধু এখন স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

প্রমাণ-নিবর্তক জ্ঞান সেই জ্ঞান, যা কিছু “জানায়” না, বরং “অজ্ঞান সরায়”। এর কাজ হলো আবরণ-নিবৃত্তি। ব্রহ্মজ্ঞান তাই কোনো প্রমেয়-জ্ঞানের মতো প্রমা নয়, বরং চেতনার এমন উন্মেষ, যেখানে জানন ও জানা মিলেমিশে এক হয়ে যায়, আর অবশিষ্ট থাকে সেই চির-আলোকিত আত্মা, যিনি সর্বদা সব জানার পেছনে নীরবে উপস্থিত।

অজ্ঞান যতদিন থাকে, ততদিন আত্মা আড়াল পড়ে থাকে—“আমি দেহ”, “আমি মন”, “আমি কর্তা” ইত্যাদি ভুল আরোপের মধ্যে। যখন শাস্ত্র বা গুরু-বাক্যের দ্বারা সেই অবিদ্যা-বৃত্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তখন আত্মা নিজের মতো জ্যোতির্ময়ভাবে প্রকাশিত হন।

শাস্ত্র বা মহাবাক্য যেমন “তৎ ত্বম্ অসি” কোনো নতুন তথ্য দেয় না। কারণ ব্রহ্মকে প্রমাণ-যন্ত্রে ধরা যায় না, তাঁকে উপস্থাপন করারও প্রয়োজন নেই। শাস্ত্র কেবল মন-বুদ্ধিতে এক বিশেষ “অখণ্ডাকার-বৃত্তি” জাগায়, যা ভুল আরোপ ভেঙে দেয়। এই ভাঙন ঘটলে আত্মার স্বপ্রকাশে কোনো নতুন বস্তুর উদয় ঘটে না; কেবল ভুল ধারণার অবসান ঘটে।

এই কারণেই ব্রহ্মকে বলা হয় “ব্যবহারযোগ্য অথচ অজ্ঞেয়”। তিনি ব্যবহারযোগ্য, এই অর্থে যে, তাঁর মাধ্যমেই সব দেখা, জানা, চিন্তা সম্ভব; তিনি সমস্ত প্রমাণ-ক্রিয়ার অধিষ্ঠান। কিন্তু তিনি অজ্ঞেয়, কারণ তাঁকে কোনো প্রমাণের দ্বারা জানা যায় না। প্রমাণ-প্রকরণ বা প্রমাণের মাধ্যম (উপায়), যেমন চোখ বা মন, সব তাঁর আলোয় কাজ করে; কিন্তু সেই আলোকে তারা ধরতে পারে না।

অতএব, ব্রহ্ম-জ্ঞান কোনো প্রমা নয়, কারণ এটি কোনো জ্ঞেয় বস্তু প্রকাশ করে না। এটি কেবল অবিদ্যা-নিবারণমূলক চেতনার উন্মেষ—যেখানে জানন ও জানা মিলেমিশে এক হয়ে যায়। তখন অবশিষ্ট থাকে না কোনো প্রমাণ, কোনো বস্তুর ধারণা; থাকে কেবল সেই চির-আলোকিত আত্মা, যিনি সর্বদা সব জানার পেছনে নীরবে উপস্থিত।

অদ্বৈতের মতে, “জ্ঞেয়তা মিথ্যাত্বের চিহ্ন”—এই কথার অর্থ ধাপে ধাপে খুব সহজভাবে বোঝানো যায়।

যে-জিনিসকে জানা যায়, সেটি জ্ঞেয়। জানা মানেই সেটি চেতনার উপর নির্ভর করছে, নিজে স্বাধীন নয়। যেমন, কোনো বস্তু চোখের সাহায্যে দেখা যায়, মনের সাহায্যে ভাবা যায়, বুদ্ধির সাহায্যে বোঝা যায়—অর্থাৎ, সেটি সর্বদা কোনো উপায় বা আধারের উপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরতা দেখায় যে, সেটি ক্ষণস্থায়ী ও সীমাবদ্ধ, চিরস্থায়ী নয়।

যা সীমাবদ্ধ, তা বাধ-যোগ্য—অর্থাৎ, উচ্চতর জ্ঞানে তা অতিক্রম করা যায়। স্বপ্ন যেমন জাগরণের জ্ঞানে বিলুপ্ত হয়, তেমনি জাগ্রত জগৎও ব্রহ্ম-জ্ঞান উদিত হলে বাধিত হয়। তাই যা জ্ঞেয়, তা বাধ-যোগ্য; আর যা বাধ-যোগ্য, তা পারমার্থিক সত্য নয়।

অন্যদিকে, যে-চেতনা সব কিছুকে জানায়, তাকে কখনও জানা যায় না, কারণ তিনি নিজেই সব জ্ঞানের উৎস। চেতনা সব কিছুকে আলোকিত করে, কিন্তু নিজে কখনও আলোকিত বস্তু হয় না। সূর্যের আলোয় সব কিছু দেখা যায়, কিন্তু সূর্যকে অন্য আলো দিয়ে দেখা যায় না—তেমনি আত্মা বা চিত্ সব কিছুকে প্রকাশ করে, কিন্তু তাকে কেউ প্রকাশ করতে পারে না।

তাই “যা জানা যায়, তা ব্রহ্ম নয়; যা নিজেই জানন (বা পরমজ্ঞান), সেটিই ব্রহ্ম”—এই উক্তি কোনো কাব্যিক সৌন্দর্য নয়, একদম কঠিন যুক্তির সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে। দড়ি-সাপের উদাহরণেই এই সত্য স্পষ্ট। সাপ-জ্ঞানে সাপের ধারণা থাকে, কিন্তু দড়ি-জ্ঞানে সাপের ভুলটা নিজে থেকেই মুছে যায়। ঠিক তেমনি, আমরা যখন বস্তু-জ্ঞানে আছি, তখন বস্তু-ধারণা ও ভোগ-চক্র চলতে থাকে; কিন্তু আত্ম-জ্ঞান বা স্ব-জ্ঞানে সেই ধারণা ভেঙে যায়—দেখা যায়, যা-কিছু দেখা হচ্ছিল, সবই চেতনারই প্রকাশ।

এই অবস্থায় অভিজ্ঞতা থাকে, কিন্তু তার কেন্দ্র বদলে যায়। আগে আমরা ভাবতাম—“আমি জানছি এই বস্তুটিকে”—অর্থাৎ, জ্ঞাতা, জ্ঞেয়, এবং জ্ঞান—এই তিনটি আলাদা জিনিস। কিন্তু আত্ম-জ্ঞান হলে দেখা যায়, তিনটি আসলে একই চেতনা-প্রবাহ। সেখানে জানা, দেখা, বোঝা—সবই এক চিত্-দীপ্তির মধ্যে লীন।

এই একত্বের অবস্থায় অভিজ্ঞতা মুছে যায় না, কেবল তার রূপ বদলে যায়। জ্ঞানের আলো তীব্র হলে বিভ্রম নিজে থেকেই মিলিয়ে যায়। তখন যা থাকে, তা কেবল নিরবচ্ছিন্ন, মধ্যহীন, অপরোক্ষ চেতনা—যেখানে সব জানা, দেখা, বলা কেবল লীলা, আর স্বরূপ থাকে চির-উজ্জ্বল ও অবিচল।

জ্ঞান উঠলে কর্তা-ভাব নিভে যায়, কিন্তু দেহ-মন তখনই থেমে যায় না। এটি কিছুদিন চলে প্রারব্ধ কর্মের বেগে। যেমন চাকা থামানোর পরও কিছুক্ষণ ঘোরে, তেমনি জ্ঞানীর দেহ-মনও কিছুদিন চলে, কিন্তু এই চলা “আমি করছি” বলে নয়। এটি সাক্ষীচেতনার সামনে ঘটমান এক দৃশ্যমাত্র।

অন্তরে তখন থাকে সম্পূর্ণ অনাসক্তি, বাইরে প্রকাশ পায় স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার। জ্ঞানী কথা বলেন, চলেন, আহার করেন, কিন্তু তাঁর ভিতরে কর্তার কোনো গোপন বোধ থাকে না। গীতায় বলা হয়েছে—“যিনি কর্মফলের আসক্তি ত্যাগ করেছেন, কর্মে প্রবৃত্ত হয়েও কিছুই করেন না।” এই অবস্থায় কর্ম হয়, কিন্তু কর্তা থাকে না।

অহংকার তখন পোড়া দড়ির মতো—রূপ আছে, কিন্তু শক্তি নেই। পুরোনো অভ্যাসের ছায়া থাকতে পারে, কিন্তু সেগুলো প্রাণহীন। তারা নতুন কর্মের বীজ রোপণ করতে পারে না, কারণ জ্ঞানীর দৃষ্টিতে ফলভোগী “আমি” আর নেই।

এই অবস্থায় কর্ম চলে, কিন্তু তা লীলা। দেহ-মন কাজ করে, কিন্তু সাক্ষীচেতনা থাকে নির্বিকার, নির্লিপ্ত। এই অবস্থাতেই মানুষ জীবন্মুক্ত—চলমান অথচ নিস্পৃহ, জাগতিক অথচ পরমার্থে নিত্য।

এ অবস্থায় নীতিশাস্ত্র আর বাহ্য নিয়ম নয়; ধর্ম হয় স্বতঃসিদ্ধ। কারণ জ্ঞানীর আচরণ আর কর্তব্যবোধের ফল নয়, তা চেতনার স্বাভাবিক প্রকাশ। “কেন সৎকর্ম করব” এই প্রশ্নের ভিত্তিই তখন থাকে না—সৎ আচরণ চেতনার নির্মল স্বরূপ থেকে নিজে থেকেই প্রবাহিত হয়।

অহংকার গলে গেলে হৃদয়ে স্বতঃস্ফূর্ত শুভেচ্ছা ও করুণা জেগে ওঠে। এটি কোনো দায় নয়, প্রচেষ্টা নয়—যেমন আলো নিজে থেকেই বিকিরণ করে, তেমনি চেতনা নিজের আলোয় অন্যের অন্ধকারে হাত বাড়ায়। তখন পরোপকার হয় স্বতঃস্ফূর্ত লীলা, দায় নয়।

এই অবস্থায় সন্ন্যাসী ও গৃহস্থের মধ্যে কোনো বাহ্য পার্থক্য থাকে না; পার্থক্য থাকে কেবল সচেতনতার স্তরে। কেউ সংসারে থেকে কর্তা হলে আবদ্ধ, আবার কেউ সংসারে থেকেই সাক্ষী হলে মুক্ত।

যেখানে এই সাক্ষীস্বরূপ জ্ঞান উদিত হয়, সেখানে প্রতিটি কাজই সাধনা হয়ে যায়। বাড়ি, অফিস, সমাজ—সবই জীবন্মুক্তির ক্ষেত্র। কর্ম চলে, কিন্তু হৃদয় থাকে অচঞ্চল, অবাধ, অনাহত। এই অবস্থাতেই কর্ম ও অকর্ম এক হয়ে যায়—কর্ম ঘটে, কিন্তু কর্তা থাকে না।

জীবন্মুক্ত অবস্থার এই অবস্থা শুধু এক মনস্তাত্ত্বিক প্রশান্তি নয়; এটি গীতার স্থিতপ্রজ্ঞ-তত্ত্ব, মাণ্ডূক্য উপনিষদের তুরীয়-দৃষ্টি, শঙ্করাচার্যের জীবন্মুক্ত-ব্যাখ্যা, এবং গৌড়পাদাচার্যের অজাতিবাদ—এই সব ধারার মিলিত বাস্তবতা। বেদান্তের এই ঐক্যই বলে দেয়, মুক্তি মানে কোনো পরিবর্তন নয়, বরং অপরিবর্তনীয় চেতনার স্বরূপে স্থিতি।
গীতার স্থিতপ্রজ্ঞ, মাণ্ডূক্য উপনিষদের তুরীয়, শঙ্করাচার্যের জীবন্মুক্তি, এবং গৌড়পাদাচার্যের অজাতিবাদ—এই চারটি ধারণা আসলে এক ধারার চার ধাপ, যেখানে চেতনা ক্রমে নিজের পূর্ণ স্বরূপে উদ্ভাসিত হয়।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে “স্থিতপ্রজ্ঞ” মানুষের যে-বর্ণনা দেন (গীতা ২.৫৫-৭২), সেখানে মূল কথা—যিনি সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয় ইত্যাদিতে অচঞ্চল, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। তাঁর মন সব আসক্তি থেকে মুক্ত; তিনি আনন্দ বা দুঃখে সমানভাবে স্থিত। এই স্থিতি কোনো উদাসীনতা নয়, বরং চেতনার এমন স্থিতাবস্থা যেখানে মন ও ইন্দ্রিয় প্রশমিত, আর আত্মা নিজের মধ্যেই তৃপ্ত—“আত্মন্যেব আত্মনা তুষ্টঃ” (গীতা ২.৫৫)। এই অবস্থায় কর্ম চলে, কিন্তু কর্তা-ভাব থাকে না। এ হলো জীবন্মুক্তির প্রাথমিক রূপ, যেখানে ব্যক্তি জাগতিক ক্রিয়ার মধ্যে থেকেও অন্তরে অবিচল থাকে।

মাণ্ডূক্য উপনিষদ চারটি চেতনা-অবস্থার কথা বলে—জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি এবং তুরীয়। জাগ্রত-অবস্থায় চেতনা বহির্মুখ, স্বপ্নে অন্তর্মুখ, সুষুপ্তিতে আচ্ছন্ন; কিন্তু তুরীয়—এই তিনের সাক্ষী, যা কখনও পরিবর্তিত হয় না। শ্লোক ৭-এ বলা হয়েছে—“নান্তঃপ্রজ্ঞং, ন বহিঃপ্রজ্ঞং... প্রপঞ্চোপশমং, শান্তুং, শিবং, অদ্বৈতম্”—অর্থাৎ, তুরীয় কোনো জাগতিক বা মানসিক চেতনা নয়; এটি সমস্ত প্রপঞ্চের নিস্তব্ধ অবস্থা, অদ্বৈত, শুদ্ধ চৈতন্য। এ অবস্থায় জানন, জানা, ও জাননকারী—এই ত্রয়ীর ভেদ লুপ্ত হয়; থাকে কেবল স্বপ্রকাশ চেতনা।