অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: এক-শো সতেরো



ভট্ট-মীমাংসা ও অদ্বৈত দর্শনে “অনুপলব্ধি” বা “‘না-পাওয়া’ থেকে ‘নেই’ জানা” প্রমাণকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ভাগের নিজস্ব যুক্তি আছে, এবং প্রত্যেকটি নির্দিষ্টভাবে বোঝায়, কীভাবে “না-দেখা” থেকে “অভাব” বা “নেই”-এর জ্ঞান ঘটে।

প্রথম ভাগ হলো কারণ-অনুপলব্ধি। এর অর্থ, যে-কারণ থাকলে কোনো বস্তু প্রতীয়মান হতো, সেই কারণই যদি অনুপস্থিত থাকে, তাহলে বোঝা যায়, বস্তুও নেই। কারণ ছাড়া ফল হয় না। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, রাতে তুমি আকাশে তাকিয়ে দেখছ, আলো নেই। এখন যদি জানো, আজ অমাবস্যা, তাহলে বোঝা যায় চাঁদও নেই, কারণ চাঁদই আলোর কারণ। এই যুক্তি দাঁড়ায়—যেখানে কারণ নেই, সেখানে ফলও নেই। তাই আলো না থাকা থেকে চাঁদের অভাব জ্ঞান হয়।

দ্বিতীয় ভাগ হলো ব্যাপক-অনুপলব্ধি। এর অর্থ, যে-ব্যাপক থাকলে তার অধীন ব্যাপ্য অবশ্যই প্রকাশ পেত, সেখানে ব্যাপ্য ধরা না-পড়লে বোঝা যায়, ব্যাপকও নেই। অর্থাৎ, যা সর্বদা অন্যটির সঙ্গে থাকে, সেটির অনুপস্থিতি জানা যায় অন্যটির না-পাওয়া থেকে। উদাহরণ হিসেবে, তুমি ঘরের ছাদে কোনো ধোঁয়া দেখছ না। তুমি জানো, যেখানে ধোঁয়া থাকে, সেখানে আগুন থাকে। এখন ধোঁয়া নেই—তাহলে আগুনও নেই। এখানে আগুন ব্যাপক, ধোঁয়া ব্যাপ্য। ধোঁয়া না দেখা মানে আগুন নেই জানা।

তৃতীয় ভাগ হলো স্বভাব-অনুপলব্ধি। এর অর্থ, কোনো বস্তুর স্বভাবই এমন যে, থাকলে তা অনিবার্যভাবে প্রতীয়মান হতো; কিন্তু তা প্রতীয়মান হয়নি—অতএব সেটি নেই। অর্থাৎ, যার প্রকৃতি এমন যে, উপস্থিত হলে দেখা যেত, না-দেখা মানে নেই। উদাহরণ হিসেবে, তুমি আলো-জ্বালানো ঘরে টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছ। আলো আছে, দৃষ্টি ঠিক আছে, আড়াল নেই, মনোযোগও আছে। এখন যদি টেবিলে হাতি দেখা না যায়, তুমি সরাসরি জানো—“হাতি নেই।” কারণ হাতি থাকলে তা স্বভাবতই প্রতীয়মান হতো। তাই না-প্রতীতি মানেই অভাব-জ্ঞান।

চতুর্থ ভাগ হলো বিরুদ্ধ-অনুপলব্ধি। এর অর্থ, যে-বস্তু বর্তমানে আছে, তার সঙ্গে কোনো নির্দিষ্ট জিনিসের সহাবস্থান অসম্ভব; তাই উপস্থিত বস্তুর মাধ্যমে বিরোধী বস্তুর অভাব জানা যায়। অর্থাৎ, দুটি জিনিস একসঙ্গে থাকতে পারে না—তাহলে একটির উপস্থিতি অন্যটির অনুপস্থিতি প্রমাণ করে। উদাহরণ হিসেবে, তুমি আগুন জ্বলতে দেখছ। আগুনের সঙ্গে বরফ একসঙ্গে থাকতে পারে না। তাই কোথাও আগুন দেখা মানে সেখানে বরফ নেই; একইভাবে, বরফ দেখা মানে আগুন নেই। সহাবস্থান-বিরুদ্ধতা থেকেই এখানে অভাবের জ্ঞান হয়।

এইভাবে দেখা যায়, অনুপলব্ধির চারটি ধরন চারটি পৃথক যুক্তির দিক আত্মপ্রকাশ করে—কখনো কারণ নেই বলে ফল নেই; কখনো ব্যাপ্য নেই বলে ব্যাপক নেই; কখনো স্বভাবতই দেখা যেত বলে না-দেখা মানে নেই; আর কখনো বিরোধী উপস্থিত বলে অন্যটি অনুপস্থিত। এই চার প্রকার অনুপলব্ধি দেখায়, “নেই” জানা সবসময় অনুমান নয়; অনেক সময় না-প্রতীতি নিজেই সরাসরি অভাব-জ্ঞান দেয়। এই কারণেই ভট্ট-মীমাংসা ও অদ্বৈত দর্শনে অনুপলব্ধিকে স্বতন্ত্র প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

অদ্বৈতে এর প্রয়োগ স্পষ্ট—“দড়িতে সাপ নেই”, “শুক্তিতে রূপা নেই”, “মরুভূমিতে জল নেই”—এই সব অভাব-জ্ঞান অনুপলব্ধি দিয়েই স্থির হয়। তারপর ভ্রম-প্রতীতি (সাপ/রুপা/মায়াজল) নিবারণে “সত্যতার দাবি” থেকে অব্যাহতি পায়; ইতিহাসে বা অভিজ্ঞতায় থাকে যে, “মনে হয়েছিল”, কিন্তু অধিষ্ঠানে কখনও ছিল না। এখানেই মিথ্যাত্বের লক্ষণ ধরা পড়ে—প্রতীতি আছে, তবু ত্রিকালে অনুপস্থিতি আছে; অর্থাৎ সদসদ্বিলক্ষণ।

ন্যায়ে অভাব-জ্ঞান মূলত অনুমান (আর নব্য-ন্যায়ে কখনো প্রত্যক্ষের বিশেষ রূপ), অনুপলব্ধি আলাদা প্রমাণ নয়। ভট্ট-মীমাংসা ও অদ্বৈতে অনুপলব্ধি স্বতন্ত্র প্রমাণ—শর্ত পূর্ণ হলেই ‘না-পাওয়া’ থেকে সরাসরি ‘অভাব’ জানা যায়, এবং এই প্রমাণই মিথ্যাত্ব-তত্ত্বকে কার্যকরভাবে ব্যাখ্যা করতে কাজে লাগে।

“স্কিমা” শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো গঠন, বিন্যাস, বা কাঠামো। এটি গ্রিক শব্দ skhēma থেকে এসেছে, যার মানে “রূপ” বা “ছাঁচ।” মূল ভাবটি একটাই—যে-কোনো তথ্য, অভিজ্ঞতা, বা যুক্তিকে বোঝা এবং সাজানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট কাঠামো বা নকশা।

দর্শন ও যুক্তিতে স্কিমা মানে যুক্তির রূপ বা কাঠামো। কোনো যুক্তি বা অনুমানের বিষয়বস্তু বদলালেও তার গঠন অপরিবর্তিত থাকে। যেমন, “যেখানে ধোঁয়া আছে, সেখানে আগুন আছে”—এই উদাহরণে যুক্তির স্কিমা হলো “যেখানে হেতু আছে, সেখানে সাধ্য আছে।” এখানে ধোঁয়া ও আগুন বদলানো গেলেও যুক্তির ছাঁচ একই থাকে। তাই স্কিমা বলতে বোঝায় যুক্তির গঠন বা রূপ, যেটা বিষয়বস্তুর ওপরে নির্ভর করে না।

মনোবিজ্ঞানে স্কিমা মানে অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক মানসিক কাঠামো, যার মাধ্যমে মানুষ নতুন তথ্য বোঝে, ব্যাখ্যা করে, ও মনে রাখে। যেমন, রেস্টুরেন্টে গেলে আগে অর্ডার, তারপর খাওয়া-শেষে বিল—এই ধারাবাহিক প্রত্যাশা মানসিকভাবে এক ধরনের “রেস্টুরেন্ট স্কিমা।” অর্থাৎ, স্কিমা হলো অভ্যাস ও অভিজ্ঞতা থেকে গঠিত মানসিক নকশা, যা চিন্তা ও আচরণের ছন্দ নির্ধারণ করে।

ভাষাতত্ত্বে স্কিমা মানে একটি বাক্য বা ভাষার নিয়মের স্থায়ী রূপ। যেমন, “যদি X হয়, তবে Y হবে”—এটি একটি শর্তবাক্য-স্কিমা। এখানে X ও Y বদলালেও গঠন একই থাকে।

তথ্যপ্রযুক্তিতে স্কিমা মানে তথ্যসংগ্রহের গঠন বা নকশা। যেমন, কোনো ডেটাবেসে “User Table”-এ নাম, ইমেল, পাসওয়ার্ড—এই বিন্যাসটাই হলো তার স্কিমা। অর্থাৎ, কীভাবে তথ্য সাজানো ও সংযুক্ত থাকবে—এই নকশাটিই স্কিমা।

যুক্তি, মনোবিজ্ঞান, ভাষা বা তথ্যপ্রযুক্তি—সব ক্ষেত্রেই স্কিমা মানে হলো একটি ছাঁচ বা কাঠামো, যার মাধ্যমে আমরা চিন্তা, অভিজ্ঞতা বা তথ্যকে বিন্যস্তভাবে বুঝি।

১) ন্যায়ে “না-দেখা মানে নেই”—এর আনুষ্ঠানিক স্কিমা দাঁড়ায়: যেখানে X থাকলে অবশ্যম্ভাবীভাবে স্ব-প্রতীয়মান হতো (উপকরণসমূহ—আলো, দূরত্ব, আড়াল-অনুপস্থিতি, ইন্দ্রিয়/মন সচল—সব আছে), সেখানে X প্রতীয়মান হয়নি; অতএব X নেই। এখানে ব্যাপ্তি হলো—“উপযুক্ত শর্তে যা থাকে, তা প্রতীয়মান হয়”; হেতু—“এক্ষুনি প্রতীয়মান হয়নি”; সিদ্ধান্ত—“অভাব”।

২) একই স্কিমা অন্বয়-ব্যতিরেক ছকে: অন্বয়—উপযুক্ত শর্তের উপস্থিতিতে X (উপস্থিত) থাকলে তা দেখা যায়। ব্যতিরেক—উপযুক্ত শর্ত থাকা সত্ত্বেও X দেখা যায়নি, তাই সিদ্ধান্ত—X অনুপস্থিত। এই “উপযুক্ত শর্ত”-ই ন্যায়ে মুখ্য; না থাকলে হেতু ভ্রান্ত হবে।

৩) প্রতিআপত্তি: “অন্ধকারে তো না-দেখা সংঘটিত হলো, তাই কি X ‘নেই’?”—এর উত্তর: অন্ধকারে “উপযুক্ত শর্ত (আলোর উপস্থিতি)” অপূর্ণ; তাই না-দেখা থেকে ‘নেই’ বলা অনুচিত। ন্যায়ে, শর্তপূর্তির প্রমাণ আগে, সিদ্ধান্ত পরে।

৪) প্রতিআপত্তি: “বস্তু খুব ক্ষুদ্র/দূরস্থ—সেজন্য না-দেখা হলো”—এর উত্তর: এটি উপাধিযুক্ত—উপাধি হচ্ছে, এমন সীমাবদ্ধকারী শর্ত বা প্রতিবন্ধক কারণ, যার উপস্থিতির কারণে একটি সাধারণ নিয়ম (ব্যাপ্তি) বা অনুমান আংশিকভাবে খণ্ডিত বা বিভ্রান্ত হয়; তাই এখানে, ইন্দ্রিয়-সামর্থ্য সীমিত থাকলে “থাকলে ধরা পড়বে” ব্যাপ্তি প্রযোজ্য নয়। কাজেই ‘না-দেখা = নেই’ নয়; আগে সক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে।

৫) প্রতিআপত্তি: “আড়াল ছিল”—উত্তর: আড়াল থাকলে প্রতীয়মানতা নিতান্তই নিবার্য নয়—অর্থাৎ, যদি কোনো বস্তুর সামনে আড়াল (অবসারণ, বাধা, প্রতিবন্ধক) থাকে, তবে সেই বস্তুকে না-দেখা মানেই তার অনুপস্থিতি নয়, কারণ সেই না-দেখা বস্তুর অনুপস্থিতির কারণে নয়, আড়ালের কারণে ঘটেছে; তাই এক্ষেত্রে উপযুক্ত শর্ত ভঙ্গ হয়েছে। ন্যায়ে, অভাব-নির্ণয়ে আড়াল-অনুপস্থিতি স্পষ্টভাবে শর্ত।

৬) প্রতিআপত্তি: “মনোযোগ ছিল না”—উত্তর: অমনোযোগে প্রতীতি এড়িয়ে যেতে পারে; তাই ‘না-দেখা’ থেকে ‘নেই’ বৈধ নয়। ন্যায়ে, মনোযোগও শর্তের অন্তর্গত।

৭) নব্য-ন্যায়ের সূক্ষ্মতা: কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের ইন্দ্রিয় সরাসরি কোনো “অভাব”-এর সঙ্গে যুক্ত হয় না, বরং সেই অভাব-সহ আধার—অর্থাৎ যে-বস্তুর মধ্যে সেই অভাব আছে—তার সঙ্গে যুক্ত হয়।

উদাহরণ হিসেবে, কেউ টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলছে, “টেবিলে ঘড়া নেই।” এখানে তার চোখ টেবিলকে প্রত্যক্ষ করছে, কিন্তু সেই টেবিলটি এখন “ঘড়া-শূন্য টেবিল” হিসেবে ধরা পড়ছে। অর্থাৎ, সে অভাবকে নয়, অভাববিশিষ্ট আধারকেই প্রত্যক্ষ করছে।

এই অবস্থাকে নব্য-ন্যায়কারেরা “অভাব-প্রত্যক্ষ” বলেন, কারণ এখানে “ঘড়ার অভাব” যেন সরাসরি দেখা যাচ্ছে। তবে ন্যায় দর্শন এটিকে নতুন কোনো প্রমাণ বা পৃথক জ্ঞানপথ হিসেবে গ্রহণ করে না। তাদের মতে, এটি প্রত্যক্ষ বা অনুমানেরই একটি বিশেষ অবস্থা, আলাদা কোনো প্রমাণ নয়।

কারণ, এখানে ইন্দ্রিয় আসলে “অভাব”-এর সঙ্গে সংযুক্ত নয়, বরং “আধার”-এর সঙ্গে। সেই আধারকে আমরা তার অভাব-সহ অবস্থায় প্রত্যক্ষ করি। তাই ঘড়া না-দেখা মানে ঘড়ার অভাব দেখা নয়, বরং ঘড়া-বিহীন টেবিল দেখা।

এভাবে, “অভাব-প্রত্যক্ষ” বলে যা বোঝানো হয়, তা মূলত প্রত্যক্ষ জ্ঞানেরই এক বিশেষ রূপ—নতুন কোনো প্রমাণ নয়। ইন্দ্রিয় যখন কোনো আধারকে “অভাব-বিশিষ্ট” অবস্থায় অনুভব করে, তখন আমরা বলি, “অভাব প্রত্যক্ষ হলো,” কিন্তু বাস্তবে তা প্রত্যক্ষ বা অনুমানের আওতাতেই পড়ে।

৮) ভট্ট-মীমাংসা ও অদ্বৈতের অবস্থান: “অনুপলব্ধি”কে স্বতন্ত্র প্রমাণ ধরা হয়—শর্ত পূর্ণ হলেই না-প্রতীতি থেকেই সরাসরি অভাব-জ্ঞান ওঠে; এর জন্য মধ্যবর্তী অনুমান দরকার হয় না। এই প্রমাণে চারটি ধরন দেখানো হয়—কারণ-, ব্যাপক-, স্বভাব-, বিরুদ্ধ-অনুপলব্ধি—সবগুলোর ভিত্তি: শর্ত ঠিক থাকলে ‘না-পাওয়া’ = ‘নেই’।

৯) ব্যাবহারিক নির্ণায়ক তালিকা (শর্ত-চেক): আলো ঠিক আছে কি, দূরত্ব/কোণ উপযুক্ত কি, আড়াল নেই তো, ইন্দ্রিয়/মন সচল কি, বস্তুটির প্রকৃতি এমন কি যে—ওই অবস্থায় থাকলে ধরা পড়ত? সব ‘হ্যাঁ’ হলে—না-দেখা থেকে ‘নেই’ (অভাব) স্থির; একটি ‘না’ থাকলে—সিদ্ধান্ত স্থগিত।

১০) দড়ি-সাপ, শুক্তি-রুপা, মরু-মায়াজল—এখানে অদ্বৈতীয় প্রয়োগ: অনুপলব্ধিতে স্থির হয় “দড়িতে সাপ নেই”, “শুক্তিতে রুপা নেই”, “মরুতে জল নেই”—এগুলো অভাব-জ্ঞান। ভ্রম-প্রতীতি পরে নিবারিত হয়ে “সত্যতার দাবি” হারায়; কিন্তু “প্রতীতি ঘটেছিল”—এই ঐতিহাসিক বা অভিজ্ঞতালব্ধ সত্য অক্ষুণ্ণ থাকে। এখানেই মিথ্যাত্ব: প্রতীতি আছে, ত্রিকালীন অনুপস্থিতিও আছে—সদসদ্বিলক্ষণ।

১১) ন্যায় দর্শনের মতে, কোনো বস্তুর অভাব জানা মানে সরাসরি দেখা নয়, বরং অনুমান করা। যখন আমরা কিছু দেখি না, তখন “না-দেখা মানে নেই” এই সিদ্ধান্ত অনুমানের মাধ্যমে তৈরি হয়। কেউ কেউ একে “অভাব-প্রত্যক্ষ” বলে, কিন্তু ন্যায় মূলত মনে করে, এটি প্রত্যক্ষ বা অনুমানেরই বিশেষ রূপ, আলাদা কোনো নতুন প্রমাণ নয়। এখানে “না-দেখা” থেকে “নেই” বলার আগে কিছু কঠোর শর্ত মানতে হয়—ইন্দ্রিয় ঠিক আছে কি না, আলো পর্যাপ্ত কি না, দূরত্ব ও আড়াল নেই কি না, মনোযোগ আছে কি না—এসব সব যাচাই করতে হয়। এসব শর্ত পূর্ণ না হলে “না দেখা” মানে “নেই” বলা ভুল হবে।

অন্যদিকে, ভট্ট-মীমাংসা ও অদ্বৈত দর্শন বলে—অনুপলব্ধি নিজেই এক স্বতন্ত্র প্রমাণ। অর্থাৎ, কিছু না-দেখা বা না-পাওয়া থেকেই সরাসরি বোঝা যায় যে, সেটি নেই, এর জন্য আলাদা কোনো অনুমান লাগে না। তবে শর্ত থাকতে হবে—যদি বস্তুটি থাকলে তা ধরা পড়ার কথা ছিল, এবং সব উপলব্ধির উপকরণ ঠিক আছে, তবেই না-প্রতীতি থেকে অভাবের জ্ঞান ওঠে।

ন্যায়ে অভাব-জ্ঞান অনুমান বা প্রত্যক্ষের অংশ, কিন্তু ভট্ট-মীমাংসা ও অদ্বৈতে এটি স্বতন্ত্র প্রমাণ; পার্থক্য মূলত “না-দেখা”র জ্ঞানের প্রকৃত ব্যাখ্যায়।

১২) ফলদর্শনে বলা যায়—ন্যায় দর্শনের এই পদ্ধতি “না-দেখা মানেই নেই” এই তাড়াহুড়ো সিদ্ধান্তকে থামায়। এটি শেখায় যে, না-দেখা সবসময় অভাব বোঝায় না; আগে দেখা দরকার শর্ত ঠিক আছে কি না। এতে ভুল অনুমান নিবারিত হয়।

অন্যদিকে, অদ্বৈত এই ধারণাকেই মিথ্যাত্ব-তত্ত্বে গভীরভাবে ব্যবহার করে। এখানে বলা হয়—অধিষ্ঠান বা ভিত্তি (যেমন দড়ি) সত্য, কারণ তা কখনও নিবারিত হয় না; কিন্তু আরোপ (যেমন দড়িতে সাপ দেখা) মিথ্যা, কারণ তা পরে অভাব-জ্ঞান দ্বারা নিবারিত হয়। ফলে অদ্বৈতের মতে, নিবারণ মানে কোনো কিছু ধ্বংস নয়, বরং জ্ঞানের সংশোধন—যেখানে ভুল আরোপ সরে যায়, আর সত্য অধিষ্ঠান প্রকাশ পায়।