অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: এক-শো চৌদ্দ



যখন বাধক জ্ঞান (যা নিবারণ ঘটায়) বাধ্য জ্ঞানকে (যা ভ্রান্ত প্রতীতি) সম্পূর্ণভাবে বাধিত করতে পারে না, তখন অদ্বৈত বেদান্তে বলা হয়—অবিদ্যা আংশিকভাবে টিকে থাকে। এই অবস্থাকে বোঝাতে প্রথমে বুঝতে হবে, বাধন (বাধ) বা নিবারণ কীভাবে ঘটে এবং কেন তা কখনো কখনো অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

বাধ্য জ্ঞান হলো অবিদ্যা থেকে উৎপন্ন ভুল প্রতীতি—যেমন অন্ধকারে দড়িকে সাপ মনে করা বা আত্মাকে দেহ ভাবা। বাধক জ্ঞান হলো সেই সঠিক জ্ঞান, যা ভ্রান্ত প্রতীতিকে নিবারণ করে—যেমন “এটা দড়ি” বা “আমি ব্রহ্ম”। যখন এই বাধক জ্ঞান যথাযথভাবে কার্যকর হয়, তখন ভ্রান্ত প্রতীতি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়। কিন্তু যদি বাধন অসম্পূর্ণ হয়, তবে ভ্রান্তি আংশিকভাবে টিকে থাকে।

এই অবস্থায় জ্ঞান ও অজ্ঞান একসাথে সহাবস্থান করে। অদ্বৈতে একে বলা হয়—“জ্ঞান-অজ্ঞান-সংসর্গ”—অর্থাৎ, তত্ত্বত জানা হয়েছে, কিন্তু চিত্তে তা পুরোপুরি স্থায়ী হয়নি। যেমন, আলো জ্বেলে জানলে “এটা দড়ি”, তবুও কিছুক্ষণ পর্যন্ত সাপের ভয় থেকে পুরোপুরি মুক্ত হওয়া যায় না। দড়ি সম্পর্কিত সঠিক জ্ঞান এসেছে, কিন্তু সাপ-সংস্কারের প্রভাব টিকে আছে। ব্রহ্মজ্ঞানেও একইরকম ঘটনা ঘটে—যতক্ষণ অহংকার ও দেহ-অভিমান পুরোপুরি লুপ্ত না হয়, ততক্ষণ জ্ঞান মুক্তির ফল দেয় না।

অদ্বৈতের মতে, জ্ঞানের পরিপূর্ণ বিকাশ তিন ধাপে হয়—শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন। কেবল শ্রবণ বা মনন করলে তত্ত্ব জানা যায়, কিন্তু যদি সেই জ্ঞান নিদিধ্যাসনের মাধ্যমে স্থিত না হয়, তাহলে তা আংশিক থেকে যায়। এই অবস্থায় মানুষ ব্রহ্মতত্ত্ব জানে, কিন্তু অভ্যন্তরে অবিদ্যা টিকে থাকে। এই অসম্পূর্ণ জ্ঞানকে বলা হয় “জ্ঞান-আভাস”—অর্থাৎ জ্ঞানের ছায়া, যা গভীর অবিদ্যাকে স্পর্শ করতে পারে না।

এই পরিস্থিতিতে বাধক জ্ঞান তাত্ত্বিকভাবে সত্য, কিন্তু তা অভিজ্ঞতাগতভাবে দৃঢ় নয়। ফলে তার বাধনও আংশিক। এই জ্ঞান ‘পরোক্ষ জ্ঞান’ (parokṣa–jñāna) রূপে থাকে—বুদ্ধিগত উপলব্ধি, কিন্তু ‘অপরোক্ষ অভিজ্ঞতা’ নয়। জানা গেছে “আমি ব্রহ্ম”, কিন্তু দেখা যায়নি যে, “ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছু নেই।” এই জ্ঞান মাথায় আছে, হৃদয়ে স্থিত হয়নি।

অদ্বৈতে অবিদ্যা দুই স্তরের—মূল অবিদ্যা (mūlāvidyā) ও উপাধিজ অবিদ্যা (tūlāvidyā)। যদি বাধক জ্ঞান কেবল উপাধিজ অবিদ্যা দূর করতে পারে, কিন্তু মূল অবিদ্যা টিকে থাকে, তবে মুক্তি আংশিক। তখন মানুষ দার্শনিকভাবে মুক্তির সত্য জানলেও, জীবনে বদ্ধের মতো আচরণ করে। শঙ্করাচার্য বলেন—“অবিদ্যা কেবল জ্ঞানেই দূর হয়, কিন্তু কেবল জ্ঞানের শ্রবণেই নয়, বরং দূর হয় দৃঢ় নিষ্ঠা ও প্রত্যক্ষ উপলব্ধিতেই।”

যখন বাধক জ্ঞান সম্পূর্ণ শক্তিশালী হয়, তখন তা সব অবিদ্যা দূর করে। চেতনা স্থিত হয় জ্ঞান-নিষ্ঠায় (jñāna–niṣṭhā), আর এই অবস্থাই জীবন্মুক্তি। তখন আর কোনো বাধ্য প্রতীতি থাকে না। চিত্তের সংস্কার ও অভ্যাস বিলুপ্ত হয়, আত্মা তার স্বরূপে স্থিত হয়। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তি তত্ত্বত মুক্ত হলেও আচরণে তখনও বদ্ধের মতো থাকে—যেমন দড়ি চিনলেও ‘মিথ্যা’ সাপের ভয় টিকে থাকে।

সুতরাং, যখন বাধক জ্ঞান বাধ্য জ্ঞানকে সম্পূর্ণভাবে বাধিত করতে পারে না, তখন অবিদ্যা আংশিকভাবে স্থায়ী থাকে। জ্ঞান থাকে বৌদ্ধিক স্তরে, মুক্তি থাকে তত্ত্বে, কিন্তু অভিজ্ঞতায় নয়। তখন মানুষ জ্ঞানী, কিন্তু জাগ্রত নয়—যে ব্রহ্ম জানে, কিন্তু ব্রহ্মে স্থিত নয়। পূর্ণ মুক্তির জন্য দরকার সেই জ্ঞান, যা শুধু সত্য জানায় না, সত্যে স্থিত করায়।

অদ্বৈত বেদান্তে, “মিথ্যা নয়, বরং অসত্ত্ব”, এই উক্তিটি মিথ্যা ও অসত্ত্ব—এই দুই ধারণার সূক্ষ্ম অথচ মৌলিক পার্থক্য নির্দেশ করে। “অসত্ত্ব” মানে কেবল মিথ্যা নয়, বরং সম্পূর্ণ অস্থিত—যার কোনো স্তরে, কোনো সময়ে, কোনো অবস্থায়ও অস্তিত্ব নেই, এমনকি প্রতীতির স্তরেও নয়। বেদান্তে “সত্ত্ব” বা অস্তিত্ব বলতে বোঝানো হয় চেতনায় কোনো কিছুর প্রতীয়মান হওয়া। তাই যে-বস্তু কখনোই চেতনায় প্রতীয়মান হয় না, যার কোনো অভিজ্ঞতা বা ধারণাও সম্ভব নয়, তাকে বলা হয় “অসত্ত্ব”—অস্তিত্বহীন, অর্থাৎ non-being; যেমন শিংধারী খরগোশ, আকাশ-পুষ্প, স্বর্ণ-পর্বত।

অন্যদিকে “মিথ্যা” হলো এমন কিছু, যা কোনো স্তরে প্রতীয়মান হয়, অর্থাৎ দেখা যায়, অনুভূত হয়, কোনো সময়ে বাস্তব বলে প্রতীত হয়; কিন্তু পরে উচ্চতর জ্ঞানে নিবারিত/বাধিত হয়। মিথ্যা বস্তু তাই অভিজ্ঞতার স্তরে থাকে, কিন্তু চূড়ান্ত সত্যের স্তরে টিকে না। অদ্বৈতের মায়াবাদের পরিভাষায়, এটি সেই জগৎ বা প্রতীতি, যা ব্রহ্মজ্ঞানের উদয়ে বিলীন হয়ে যায়।

এই পার্থক্য বোঝাতে উদাহরণই সবচেয়ে উপযুক্ত। অন্ধকারে দড়িকে সাপ মনে করা—এখানে সাপ প্রতীয়মান হয়েছে, কিন্তু পরে জেনে গেলে—তা নিবারিত হয়েছে। তাই সেটি মিথ্যা। কিন্তু “বর্গচক্র”—যা যুক্তিগতভাবে অসম্ভব—এটি কখনোই প্রতীয়মান হয় না, না জাগরণে, না স্বপ্নে, না বিভ্রমে। এর কোনো অভিজ্ঞতা সম্ভব নয়। তাই এটি মিথ্যা নয়, অসত্ত্ব—অস্তিত্বহীন।

অদ্বৈতের বিশ্লেষণে এই দুই অবস্থার পার্থক্য স্পষ্ট। মিথ্যা বস্তুর প্রতীতি থাকে, যদিও তা অনির্বচনীয়; কিন্তু অসত্ত্ব বস্তুর কোনো প্রতীতি কখনোই থাকে না। অদ্বৈতের ভাষায়, যা একবার প্রতীয়মান হয়ে পরে নিবারিত হয়, তা “মিথ্যা”; আর যা কোনো অবস্থাতেই প্রতীয়মান হয় না, তা “অসত্ত্ব”।

এই পার্থক্য বোঝাতে বেদান্ত তিন স্তরের বাস্তবতা নির্ধারণ করেছে—পারমার্থিক সত্য, ব্যাবহারিক সত্য, ও প্রাতিভাসিক সত্য। পারমার্থিক সত্য, যেমন ব্রহ্ম, কখনও নিবারিত হয় না। ব্যাবহারিক সত্য, যেমন জাগতিক জগৎ, উচ্চতর জ্ঞানে নিবারিত হয়—তাই মিথ্যা। প্রাতিভাসিক সত্য, যেমন স্বপ্ন বা মায়া, তৎক্ষণাৎ নিবারিত হয়। কিন্তু অসত্ত্ব কোনো স্তরেই পড়ে না, কারণ তা কখনোই প্রতীয়মান হয় না।

উপনিষদেও এই অর্থের আভাস পাওয়া যায়—“অসতো মা সদ্গময়”, অর্থাৎ, হে ঈশ্বর, আমাকে অসৎ থেকে সত্যে নিয়ে চলো। এখানে “অসৎ” মানে অজ্ঞতা বা সম্পূর্ণ অচেতনতা—যার কোনো সত্যতা নেই। অদ্বৈত ব্যাখ্যায় এটি সেই অবস্থা, যেখানে প্রতীতি অসম্ভব।

তুলনামূলকভাবে বলা যায়, সত্য হলো যা একবার জানা গেলে আর নিবারিত হয় না, যেমন ব্রহ্ম; মিথ্যা হলো যা প্রতীয়মান হয়, কিন্তু পরে বিলুপ্ত হয়, যেমন দড়ির সাপ বা স্বপ্নজগৎ; আর অসত্ত্ব হলো যা কখনোই প্রতীয়মান হয় না, যেমন বর্গচক্র বা রংহীন আগুন। তাই বলা হয়—যা দেখা যায়, কিন্তু স্থায়ী নয়, তা মিথ্যা; আর যা কখনোই দেখা যায় না, তা অসত্ত্ব। সেই বস্তু সম্পূর্ণ অস্থিত, অভিজ্ঞতার বাইরে, অস্তিত্বহীন—তাই সেটি “অসত্ত্ব”।

প্রতীতি বলতে বোঝায়—কোনো কিছুর ‘এখন-এখানে-এভাবে’ প্রতীয়মান হওয়া; নিবারণ হলো—উচ্চতর জ্ঞানে সেই প্রতীতির অযোগ্যতা প্রকাশ। অদ্বৈতের ভাষায় প্রতীতি ঘটে এক আধারে (idam/“এই”)—লক্ষ্যবস্তুর উপর ‘অর্থ’ বা বাচ্য-ধারণা আরোপিত হয় (অধ্যাস, adhyāsa); নিবারণ সেই আরোপিত অর্থকে প্রত্যাহার (apavāda) করে দেখায় যে, প্রতীতি যে-রূপে ধরা পড়েছিল, তা উচ্চতর মান্যের (pramāṇa) কাছে টেকে না। ফলে, নিবারণ প্রতীতিকে ভেঙে ফেলতে নয়, তার ‘কোথায় বৈধ, কোথায় অবৈধ’—এই সীমা টেনে দিতে আসে।

রজ্জু-সাপ উদাহরণে প্রথমে চেতনায় উঠে আসে “এই—সাপ”; এখানে “এই” অপরিবর্তিত অধিষ্ঠান, কিন্তু “সাপ” যোগ্য-ধারণা হিসেবে আরোপ। আলোয় যখন “এই—রজ্জু” জ্ঞান উদয় হয়, তখন ‘সাপ’ পদার্থটি বিনষ্ট করা হয় না—বরং দেখানো হয় যে, ‘সাপ’ এই-অধিষ্ঠানে বাস্তবে কখনও ছিলই না। অর্থাৎ, নিবারণ ‘এই’-সচেতনতা বা দেখা-ঘটার সত্যতাকে অস্বীকার করে না; অস্বীকার করে আরোপিত অর্থকে। তাই প্রতীতি নিবারণের শত্রু নয়—নিবারণ প্রতীতির উপর বেড়ি পরিয়ে দেয়, বলে: “এ প্রতীতি এই স্তর পর্যন্তই; এর ঊর্ধ্বে নয়।”

এখানেই বাধ-সামানাধিকরণ্য—প্রতীতি ও নিবারণ একই আধারে। প্রথম বোধে “এই” ছিল সাপ-অর্থে, পরে সেই “এই” থাকে রজ্জু-অর্থে; আধার-নির্দিষ্টতা অবিচল, অর্থ-নির্দিষ্টতা রূপান্তরিত। নিবারণ যদি প্রতীতিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করত, তবে “কী” নিবারিত হলো, তা-ই অজানা থাকত; বাস্তবে যা হয়, তা হলো—প্রথম বোধ ‘বাধিত’ হয়, ফলে তার সত্য-দাবি রহিত হয়, অথচ অভিজ্ঞতার আকার (যে ‘এই’ দেখা গিয়েছিল) স্মৃতিতে স্থিত থাকে। এ কারণেই বলা হয়: “যা কখনোই প্রতীয়মান নয়, তা অসত্ত্ব; যা প্রতীয়মান কিন্তু বাধ্য, তা মিথ্যা; যা কখনও বাধিত হওয়ার বিষয় নয়, তা সত্য।”

প্রমেয়-প্রমাণের স্তরবিন্যাসে এই সম্পর্ক আরও স্পষ্ট। স্বপ্নে ‘বাঘ’-প্রতীতি স্বপ্নস্তরে কার্যকর—ভয়, দৌড়, ঘাম—সবই ঘটে; জাগরণ-প্রমা তা নিবারণ করে জানায়—“এ প্রতীতি ওই স্তরেই সীমিত।” আবার জাগতিক ব্যবহারে বিশ্ব-প্রতীতি কার্যকর; ব্রহ্মজ্ঞানে সেই ব্যাবহারিক সত্যই বাধিত হয়—জগৎ ‘অপারমার্থিক’ প্রমাণিত হয়, তবে লেনদেন (vyavahāra) চলতে থাকে। নিবারণ এখানে জগৎ-প্রতীতিকে শূন্যে মিলিয়ে দেয় না; তার সত্য-দাবিকে সীমাবদ্ধ করে—“ব্যবহারে হ্যাঁ, পরমে না।” জ্ঞানোত্তর জগৎ ‘দগ্ধরজ্জু-ন্যায়’: রূপ আছে, বদ্ধ করার ক্ষমতা নেই; দেখা-শোনা অব্যাহত, আবদ্ধতা নিবারিত।

ব্যাকরণে যখন বলা হয় “নীলঃ ঘটঃ”—অর্থাৎ “নীল ঘড়া”—তখন ‘নীল’ ও ‘ঘট’ এই দুই শব্দের অর্থ ভিন্ন হলেও, তাদের আধার এক। ‘ঘট’ হলো পদার্থ, ‘নীল’ হলো তার গুণ। এক বস্তুতেই উভয় বোধের সমাবেশ ঘটে। একেই বলা হয় সামানাধিকরণ্য—যেখানে দুটি অর্থ বা ধারণা এক আধারে যুক্ত থাকে।

বেদান্ত এই উদাহরণটিকে ব্যবহার করে ভ্রম বা আরোপ-অধিষ্ঠানের ব্যাখ্যা দিতে। যেমন অন্ধকারে দড়িকে সাপ বলে ভ্রম হয়, তখন ‘সাপ’ ও ‘রজ্জু’—এই দুই বোধের আধার এক, কিন্তু অর্থ ভিন্ন। তখন ‘সাপ’-বোধটি আসলে অধিষ্ঠানবস্তুর (দড়ির) উপর আরোপিত হয়। পরে যখন আলো বা জ্ঞান আসে, তখন আমরা জানি—“এটা সাপ নয়, এটা দড়ি।” তখন ‘সাপ’-বোধের সত্যতা বাতিল হয়, কিন্তু ‘এটা’-বোধ—যে-চেতনার মধ্যে দড়ি ও সাপ দুই-ই ধরা পড়েছিল—সেটি টিকে থাকে।

এখানেই দেখা যায়, নিবারণ মানে ধ্বংস নয়, বরং বোধের সংশোধন। “এটা সাপ”, এই বাক্যের ‘সাপ’ অংশটি ভুল প্রমাণিত হলেও, ‘এটা’ অংশটি স্থায়ী। নিবারণ মানে ভুল অর্থকে বাতিল করে সঠিক অর্থ প্রকাশ করা। বস্তু ধ্বংস হয় না; কেবল জ্ঞানের স্তর পরিবর্তিত হয়।

অদ্বৈত দর্শনের তিন স্তরের বাস্তবতা—প্রাতিভাসিক, ব্যাবহারিক, ও পারমার্থিক—এই একই যুক্তিতে গঠিত। প্রাতিভাসিক স্তরে (স্বপ্ন বা ভ্রমে) যা প্রতীয়মান হয়, তা জাগরণের ব্যাবহারিক জ্ঞানে নিবারিত হয়। আবার ব্যাবহারিক স্তরে যে-প্রতীতি (জাগতিক জ্ঞান) থাকে, তা ব্রহ্মজ্ঞানে নিবারিত হয়। কিন্তু প্রতিটি উচ্চতর স্তরের জ্ঞান নিচের স্তরের প্রতীতিকে সম্পূর্ণ মুছে দেয় না; বরং তার সীমা ও সত্যতার পরিধি নির্দিষ্ট করে।

বেদান্তের মতে, যা কখনোই প্রতীয়মান হয়নি, তার নিবারণও সম্ভব নয়। কারণ নিবারণ মানে হলো—যা প্রতীত হয়েছে, তার সত্যতার দাবিকে সংশোধন করা। যদি কোনো কিছুর প্রতীতি-ই না ঘটে, তাহলে তার ভুল-ভাবও ধরা যাবে না। তাই প্রতীতি হলো নিবারণের পূর্বশর্ত, আর নিবারণ হলো প্রতীতির শুদ্ধিকরণ।

এইভাবে অদ্বৈত বলে—প্রতিটি স্তরের জ্ঞান পূর্বস্তরের প্রতীতিকে “বাধিত” করে, কিন্তু একে ধ্বংস করে না। দড়ি-সাপ ভ্রম যেমন জাগরণের জ্ঞানে বিলুপ্ত হয়, তেমনি জাগতিক জ্ঞানও ব্রহ্মজ্ঞানে বিলুপ্ত হয় না, বরং নিজের সত্যতার দাবি থেকে অব্যাহতি পায়। এভাবেই নিবারণ জ্ঞানের ক্রমোন্নতি—ভ্রম থেকে সত্যের দিকে যাত্রা।

ফলে সিদ্ধান্তটি দাঁড়ায়—প্রতীতি ও নিবারণ পরস্পরবিরোধী নয়, বরং ক্রমান্বয়ে সত্য-নির্ধারণের যৌথ প্রক্রিয়া। প্রতীতি ছাড়া বাধ অকর্তব্য; বাধ ছাড়া প্রতীতি অতিক্রমহীন। প্রতীতি আমাদেরকে অধিষ্ঠানের দিকে নিয়ে আসার প্রথম সোপান, নিবারণ সেই সোপানের সীমা চিহ্নিত করে অধিষ্ঠানকেই প্রত্যক্ষ করায়।