অবিদ্যা “উৎপন্ন” নয় বলে তার “উৎপত্তি” নিয়ে প্রশ্নই অর্থহীন। এটি নিত্য নয়, কারণ জ্ঞান হলে তা লুপ্ত হয়; আবার কালগতও নয়, কারণ কোনো সময়ে এর আরম্ভ বা সৃষ্টির প্রশ্ন ওঠে না। এর স্থায়িত্ব জ্ঞানের অভাবে, এবং বিলোপ জ্ঞানের উদয়ে—এই দুই সীমার মধ্যেই এর আপাত অস্তিত্ব ধরা পড়ে।
এই লোপ বা অবিদ্যার বিলোপ কোনো তর্কজ প্রক্রিয়া নয়, কোনো চিন্তা-অনুশীলনের ফলও নয়; এটি একেবারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিষয়—অপরোক্ষ-অনুভব (aparokṣānubhūti)। তর্ক, মানসিক যুক্তি বা ধারণাগত বিশ্লেষণ চূড়ান্ত জ্ঞান দেয় না; এগুলো কেবল প্রস্তুতি। প্রকৃত ব্রহ্ম-জ্ঞান ঘটে, যখন শ্রুতিবাক্য—“তৎ ত্বম্ অসি” (“তুই সেই”)—মনন ও অন্তর্লয়ে এমন এক বিশেষ রূপ ধারণ করে, যা মনের ভেদ পেরিয়ে আত্মার চৈতন্যে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিফলিত করে। এই অবস্থাকেই বলা হয় ব্রহ্ম-আকৃতি-বুদ্ধি বা অখণ্ডাকার-বৃত্তি (akhaṇḍākāra-vṛtti)।
এই বৃত্তি প্রথমে জাগে মনের স্তরে, কিন্তু সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তির মতো নয়—এটি সীমাবদ্ধ বস্তুর নয়, অসীম চৈতন্যের আকৃতি ধারণ করে। যখন এই বৃত্তি আত্মার মধ্যে প্রসারিত হয়, তখন দুটি স্তর স্পষ্ট হয়—বৃত্তি-ব্যাপ্তি ও ফল-ব্যাপ্তি। বৃত্তি-ব্যাপ্তি মানে, চিত্তে এমন এক জ্ঞানরূপ বৃত্তির উদয়, যা ব্রহ্মবিষয়ক; এটি যেন জানালার পর্দা সরানোর মতো—চেতনার মুখোমুখি হওয়া। ফল-ব্যাপ্তি মানে, সেই চেতনা নিজের মধ্যে নিজেরই অভিজ্ঞতা লাভ করে—যা আত্মার স্বরূপ-স্মরণ। এই অবস্থায় “জ্ঞান” কোনো নতুন কিছু উৎপন্ন করে না; বরং অবিদ্যা নামক আচ্ছাদনকে বিলোপিত করে।
এখানে ক্রিয়া নয়, উদ্ভাসই মুখ্য। সাপকে মেরে ফেলা নয়—দড়িকে চিনে নেওয়াই জ্ঞানের কাজ। যতক্ষণ ভ্রম আছে, ততক্ষণ সাপ প্রতীয়মান; জ্ঞান উঠলে সাপের বিলোপ ঘটে, অথচ দড়ির কোনো নতুন সৃষ্টি হয় না। একইভাবে ব্রহ্মজ্ঞান নতুন কিছু সৃষ্টি করে না; কেবল মিথ্যা প্রতীতি (অবিদ্যা-জাত ভ্রম) সরিয়ে দেয়।
এই নীতি থেকেই শঙ্কর অবিদ্যার মিথ্যাত্ব ব্যাখ্যা করেন। মিথ্যা মানে কেবল “অসত্য” নয়; বরং যা উচ্চতর জ্ঞানে বিলোপযোগ্য—যেমন স্বপ্ন বা মরীচিকা। অবিদ্যা বাস্তব নয়, কারণ জ্ঞান উঠলেই তা থাকে না; আবার একেবারে অস্থিতও নয়, কারণ যতক্ষণ অজ্ঞতা থাকে, ততক্ষণ জগৎ, কর্তা, ভোক্তা, সুখ-দুঃখ, রাগ-দ্বেষ—সবই কার্যকর। তাই অবিদ্যা ব্যাবহারিক সত্য (vyāvahārika-sattā)-র অন্তর্ভুক্ত; এটি পরমার্থত সত্য নয়, আবার সম্পূর্ণ অসত্যও নয়। এই দ্বৈত অবস্থাই একে অনির্বচনীয় (inexplicable) করে তোলে—না সত্য, না মিথ্যা; “সদসদ্ভ্যাম্ অনির্বচনীয়ম্”।
অবিদ্যা চিরন্তন নয়, কারণ জ্ঞান উদিত হলেই তা বিলীন হয়; তবে অনাদি, কারণ এর কোনো কালগত সূচনা নেই। এটি কালের বাইরে, কেবল জ্ঞান-অভাবের পরিমণ্ডলে প্রতীয়মান। তাই শঙ্কর বলেন, অবিদ্যা “অনাদি নিত্যনিবর্ত্যা”—শুরুহীন, কিন্তু জ্ঞানোদয়ে তৎক্ষণাৎ বিলোপযোগ্য।
“অনাদি নিত্যনিবর্ত্যা” (anadi nitya-nivartya)—এই বিখ্যাত সংজ্ঞাটি শঙ্করাচার্যের ভাষ্যসাহিত্যের অন্যতম মূল সূত্র। এটি পাওয়া যায় ব্রহ্মসূত্রভাষ্য-এর দ্বিতীয় অধ্যায়, প্রথম পক্ষ, পঁয়ত্রিশ নম্বর সূত্রে—অর্থাৎ, ব্রহ্মসূত্র ২.১.৩৫-এর আলোচনায়।
এই অংশে শঙ্করাচার্য অবিদ্যার আশ্রয়-প্রশ্ন ও তার প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করছেন। প্রসঙ্গটি এমন—যদি ব্রহ্ম সর্বজ্ঞ, স্বপ্রকাশ ও চৈতন্যস্বরূপ হন, তাহলে তাঁর মধ্যে অজ্ঞান থাকা সম্ভব নয়; আবার যদি বলা হয় জীবের মধ্যে অবিদ্যা, তবে জীব তো অবিদ্যারই ফল—তাহলে অবিদ্যা ও জীব একে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই দ্বন্দ্ব থেকেই প্রশ্ন ওঠে—অবিদ্যা আসলে কোথায় অবস্থিত?
এই প্রসঙ্গে শঙ্কর অবিদ্যার প্রকৃতি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন—“অবিদ্যা নাম অনাদি নিত্যনিবর্ত্যা অনির্বচনীয়া।”
অর্থাৎ, অবিদ্যা এমন এক সত্তা যার—
১. অনাদি (anadi): কোনো সূচনা বা কালগত আরম্ভ নেই। এটি কখনও “সৃষ্টি” হয়নি; কারণ অজ্ঞান কোনো সময় থেকে শুরু হয়েছে, এটা বলা মানে, তার আগে আগে জ্ঞান ছিল, যা তর্কগতভাবে অসম্ভব।
২. নিত্যনিবর্ত্যা (nitya-nivartya): এটি স্থায়ী বা চিরন্তন নয়; বরং জ্ঞান উদিত হলেই তা তৎক্ষণাৎ বিলীন হয়। জ্ঞান ও অবিদ্যা কখনও সহাবস্থান করতে পারে না—যেমন সূর্য উঠলে অন্ধকার থাকে না।
৩. অনির্বচনীয় (anirvacaniya): এটি না সত্য, না মিথ্যা; কারণ অভিজ্ঞতায় কার্যকর হলেও পরমার্থে বিলোপযোগ্য। তাই একে “সদসদ্ভ্যাম্ অনির্বচনীয়ম্” বলা হয়।
এই এক সংজ্ঞাতেই অদ্বৈত বেদান্তের অবিদ্যা-তত্ত্বের মূল কাঠামো প্রকাশিত হয়েছে। অবিদ্যা কোনো বাস্তব পদার্থ নয়, কোনো “অস্তিত্ব”ও নয়; এটি কেবল চেতনার আচ্ছাদন, যা জ্ঞানের অভাবে প্রতীয়মান। যখন জ্ঞান উদয় হয়, তখন অবিদ্যা নিজেই স্বয়ং বিলুপ্ত হয়—কারণ তার অস্তিত্বই ছিল কেবল অজ্ঞতার পরিসরে।
শঙ্করের মতে, অবিদ্যা এক অনাদি কিন্তু নিবার্য বাস্তবতা—যা কালের বাইরে, শুরুহীন, কিন্তু জ্ঞানে তৎক্ষণাৎ নিবৃত্ত। এটি কোনো স্থায়ী বস্তু নয়; বরং ব্রহ্মের আলোয় অন্ধকারের মতো একটি আপাত-আচ্ছাদন, যা জ্ঞানে দূর হয়।
এই সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে অবিদ্যা এক অনাদি কিন্তু নিবার্য বাস্তবতা—যা নিজের মধ্যে কোনো স্বাধীন সত্তা নয়, কেবল চেতনার উপরে এক অপচ্ছায়া, এক “অস্মরণ”। জ্ঞান এখানে কিছু “নতুন” দেয় না; বরং যা ছিল, তা-ই উন্মোচন করে—যেমন সূর্য নিজে কিছু সৃষ্টি করে না, কেবল অন্ধকার সরায়।
এই লীলাত্মক প্রক্রিয়াই শঙ্করের দার্শনিক সৌন্দর্য: দড়ি সবসময়ই ছিল; অন্ধকারে সাপ প্রতীত হয়েছিল। আলো জ্বালাতেই বোঝা গেল—সাপ কখনোই ছিল না। জ্ঞান মানে তাই ধ্বংস নয়, বরং প্রকাশ; মুক্তি মানে তাই পরিবর্তন নয়, বরং স্বরূপে প্রত্যাবর্তন।
মূলাবিদ্যা, আশ্রয়-বিতর্ক, এবং ব্যক্তিগত-সমষ্টিগত আচ্ছাদনের ভেদ—এই তিনটি দৃষ্টিকোণ একত্রে ধরলে অদ্বৈত বেদান্তের প্রকৃত উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অদ্বৈত কখনোই অবিদ্যাকে বাস্তবতা দেয় না; এটি অবিদ্যাকে একটি ব্যাখ্যাগত আয়না হিসেবে ব্যবহার করে, যাতে অভিজ্ঞতার জটিলতাগুলি সামঞ্জস্যভাবে বোঝানো যায়। কারণ মানুষ জগৎ দেখে, কাজ করে, ভালো-মন্দ বিচার করে, দুঃখ-সুখ অনুভব করে—এসব ব্যাবহারিক স্তরে ঘটে; কিন্তু পরমার্থে এদের কোনো স্থায়ী ভিত্তি নেই।
এই অবস্থায় অবিদ্যা ধারণা হয়ে ওঠে এক শিক্ষণ-উপকরণ—যার সাহায্যে শাস্ত্র মানুষকে ধীরে ধীরে সত্যে পৌঁছে দেয়। যেমন একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে আয়নায় নিজের মুখ দেখায়, তেমনি অদ্বৈত শাস্ত্রও অবিদ্যার আয়নায় মানুষকে নিজের মুখ দেখায়। যখন সেই আয়নায় নিজের চেতনা দেখা যায়, তখন বোঝা যায়—ভুলটা মুখে নয়, দৃষ্টিতে ছিল; ব্রহ্ম কখনও বদলায়নি, বরং দৃষ্টিভঙ্গিই বিকৃত ছিল।
যে-মুহূর্তে এই প্রত্যভিজ্ঞা ঘটে, অবিদ্যার ‘ভাবরূপ’ শক্তি নিঃশক্ত হয়ে যায়; তার আবরণ ও বিক্ষেপ উভয়ই সে মুহূর্তে বিলীন হয়। আশ্রয়-বিতর্কেরও তখন কোনো অর্থ থাকে না—কারণ ‘কার’ অবিদ্যা, এই প্রশ্ন তখন অপ্রাসঙ্গিক; আর ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আচ্ছাদনের পার্থক্যও মুছে যায়, কারণ সেই মুহূর্তে চেতনা সর্বজনীন।
তখন যা অবশিষ্ট থাকে, তা একমাত্র চৈতন্যের নিজ-প্রভা—অখণ্ড, স্বয়ংজ্যোতিষ্মান, নিরুপাধিক। এই চৈতন্যেই অনাদি-অনন্ত বিতর্কের সব জট খুলে যায়, কারণ সেখানে সময়, কারণ ও দ্বৈততার স্থানই নেই। এবং, এই উপলব্ধিতেই মুক্তি কোনো নতুন অর্জন নয়; এটি হয়ে ওঠে এক স্বীকৃতি যে, আমি বরাবরই ছিলাম, আছি, এবং থাকব—অখণ্ড, অদ্বিতীয়, চিরসত্য ব্রহ্ম। “আমি সেই”—অহম্ ব্রহ্মাস্মি।
অদ্বৈত বেদান্তে মিথ্যাত্ব (mithyātva) এক সূক্ষ্ম ও দ্বিমুখী ধারণা—এটি একই সঙ্গে “প্রকাশ” ও “বিলোপ”-এর দুই দিক উন্মোচন করে। মিথ্যা মানে সম্পূর্ণ অনস্তিত্ব নয়, বরং এমন কিছু, যা নির্দিষ্ট আধারে (adhiṣṭhāna) প্রতীয়মান হয়, কিন্তু সেই আধারেই চূড়ান্তভাবে অস্থিত। অর্থাৎ, যা অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, কিন্তু জ্ঞানে বিলীন হয়—সেই বস্তুর নাম মিথ্যা।
এই অবস্থাকেই শাস্ত্রীয় পরিভাষায় বলা হয় স্বাশ্রয়-নিষ্ঠ-অত্যন্ত-অভাব-প্রতিযোগিতা (svāśraya-niṣṭha-atyantābhāva-pratiyogitā)। এর অর্থ হলো—যে-বস্তুর অনস্তিত্ব বা অভাব সেই একই আধারের (basis বা substratum-এর) সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন, অন্ধকারে দড়িকে ভুলবশত “সাপ” হিসেবে দেখা যায়। “এই” (idam) প্রতীতি তখনও সত্যি থাকে—কারণ কোনো কিছু প্রতীত হচ্ছে। কিন্তু পরে যখন আলো জ্বলে ওঠে, তখন একই “এই”-কে ধরে বলা হয়—“এটি সাপ নয়, এটি দড়ি।” এখানে প্রতীতি (প্রকাশ) ও বিলোপ (সংশোধন) দুটোই একই আধারে ঘটে—দড়ির উপর।
এই দৃষ্টান্তেই মিথ্যাত্বের সূক্ষ্ম দার্শনিক প্রকৃতি নিহিত—প্রতীতি আছে, অথচ তা চূড়ান্ত নয়; বিলোপ ঘটে, কিন্তু কোনো নতুন সৃষ্টির প্রয়োজন হয় না। যেমন আলো জ্বালালে অন্ধকার মিলিয়ে যায়, তেমনই জ্ঞানের আলোয় অবিদ্যা বা মিথ্যা প্রতীতি নিজে থেকেই লুপ্ত হয়।
মিথ্যাত্ব বলতে বোঝায় এমন এক সত্তা, যা না পরমার্থত সত্য, না সম্পূর্ণ মিথ্যা—বরং মধ্যস্থিত, যা জ্ঞানে বিলোপযোগ্য হলেও অভিজ্ঞতায় প্রতীয়মান। এই অনির্বচনীয় অবস্থা—না সৎ, না অসৎ—এই কারণেই অদ্বৈত বেদান্ত একে বলে “সদসদ্ভ্যাম্ অনির্বচনীয়ম্”, অর্থাৎ “সত্য ও অসত্য উভয় দ্বারা অবর্ণনীয়।”
বাধ-সামানাধিকরণ্য এমন এক সূক্ষ্ম দার্শনিক ধারণা, যার মাধ্যমে মিথ্যাত্বের প্রকৃতি অভিজ্ঞতার স্তরে ধরা পড়ে। যখন কোনো বস্তু বা অবস্থা এক জ্ঞানে প্রতীয়মান হয় এবং পরবর্তী কোনো উচ্চতর জ্ঞানে সেটি নিবারিত হয়, তখন বলা হয়, দুটি জ্ঞান—প্রতীতি ও নিবারণ—একই আধারে সংঘটিত হয়েছে। এই একই “আধার” বা “এই”-এর (idam) মধ্যে একবার ভুল প্রতীতি ঘটে, পরে সেই ভুলেরই নিবারণ ঘটে। তাই এই দুই অভিজ্ঞতা বিরোধী নয়, বরং একে অপরকে সম্পূর্ণ করে।
যেমন, তুমি অন্ধকারে দড়িকে সাপ মনে করলে। প্রথম জ্ঞান—“এটা সাপ”—এবং পরে আলো জ্বেলে দ্বিতীয় জ্ঞান—“এটা দড়ি”—দুটিই একই চৈতন্যে ঘটে, একই “এই”-এর উপর। প্রথমে যে ভুল প্রতীতি হয়েছিল, পরে তার নিবারণ ঘটে, কিন্তু যে চেতনা “এটা” বলে নির্দেশ করেছিল, সেটি অপরিবর্তিত থাকে। এই এক-আধারত্বকেই সামানাধিকরণ্য বলা হয়, আর যখন নিবারণ সেই একই আধারে ঘটে, তখন তা হয় বাধ-সামানাধিকরণ্য। এটাই মিথ্যাত্বের কার্যকর লক্ষণ—যা প্রতীয়মান হয়, কিন্তু পরে উচ্চতর জ্ঞানে বিলুপ্ত হয়।
অদ্বৈত দর্শনে কোনো জিনিসকে “মিথ্যা” বলার জন্য দুটি শর্ত প্রয়োজন। প্রথমত, সেটি কিছু সময়ের জন্য প্রতীয়মান হতে হবে; দ্বিতীয়ত, পরবর্তী উচ্চতর জ্ঞানে সেটির নিবারণ ঘটতে হবে। দড়ির সাপ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ—সেটি প্রতীয়মান, কিন্তু পরে বিলুপ্ত। যা কখনও প্রতীয়মানই হয় না, যেমন বর্গচক্র (চক্র কখনও বর্গাকার হয় না, বৃত্তাকার হয়), তা মিথ্যা নয়, বরং অসত্ত্ব; আর যা একবার জানা গেলে আর নিবারিত হয় না, যেমন ব্রহ্ম, সেটিই সত্য।
এই তত্ত্বের ভিত্তিতে অদ্বৈত বেদান্ত তিন স্তরের বাস্তবতা নির্ধারণ করেছে। প্রথমত পারমার্থিক সত্য—যা কখনও নিবারিত হয় না, যেমন ব্রহ্ম। দ্বিতীয়ত ব্যাবহারিক সত্য—জাগতিক জগৎ, যা পরম সত্যে নিবারিত হয়, কিন্তু স্বপ্নের চেয়ে স্থায়ী। তৃতীয়ত প্রাতিভাসিক সত্য—স্বপ্ন বা মায়ার মতো, যা স্বল্পস্থায়ী ও তৎক্ষণাৎ নিবারিত হয়। এই তিন স্তরের ক্রমে দেখা যায়, প্রতিটি নিম্নস্তরের জ্ঞানকে উচ্চস্তরের জ্ঞান নিবারণ করে, কিন্তু নিবারণ ও প্রতীতি উভয়ই একই “এই”-এর উপর ঘটে। স্বপ্নে-দেখা বাঘ জাগ্রত জ্ঞানে নিবারিত হয়; জাগ্রত জগৎ আবার ব্রহ্মজ্ঞানে নিবারিত হয়। এই ধারাবাহিক নিবারণই অদ্বৈতের অভ্যন্তরীণ যুক্তি-পদ্ধতি।
অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে, প্রতীতি (উপলব্ধি) এবং নিবারণ (খণ্ডন বা বাতিলকরণ) একে অপরের বিরোধী নয়, বরং এক গভীর দার্শনিক সত্যের দুটি ভিন্ন দিক। অদ্বৈতমতে, প্রতীতি প্রায়শই উচ্চতর নিবারণের পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করে। এর অর্থ হলো, আমরা প্রথমে কোনো কিছুকে যেভাবে দেখি বা বুঝি (প্রতীতি), সেটাই পরবর্তীতে তার প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচনে (নিবারণ) সহায়তা করে। নিবারণ কখনোই প্রতীতিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে না, বরং তার সীমাবদ্ধতাগুলোকে স্পষ্ট করে এবং প্রকৃত সত্যের দিকে পরিচালিত করে।