অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: এক-শো আট



যোগসূত্র এই প্রক্রিয়াটি বিশ্লেষণ করেছে স্পষ্টভাবে (YS, 1.50-1.51): যখন নতুন জ্ঞানোৎপন্ন সংস্কারগুলি ধারাবাহিকভাবে স্থিত থাকে, তারা পুরোনো সংস্কারগুলিকে তখন নিস্ক্রিয় করে। পুরোনো বীজগুলির কার্যশক্তি ক্ষীণ হয়, শুকিয়ে যায়; চিত্তের তরঙ্গ থেমে যায়; তখন নির্বীজ সমাধির দ্বার উন্মুক্ত হয়—যেখানে আর কোনো নতুন সংস্কার জন্ম নেয় না।

অদ্বৈত বেদান্তে একই প্রক্রিয়া অন্য ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে। শ্রবণ ও মননের মাধ্যমে আবরণ বা অগ্রহণ সরে যায়—অজ্ঞানতা ভেদ হয়। নিদিধ্যাসনের মাধ্যমে বিক্ষেপ বা অন্যথা-গ্রহণ থেমে যায়—মন স্থির হয়। তখন বাসনা-ক্ষয়ের ফলে কর্তা-ভাব নিজে থেকেই গলে যায়। আত্মা তখন নিজের স্ব-দ্যোতনায়, নির্ভরহীন চৈতন্যে, স্বাভাবিকভাবে দীপ্ত ও বিশ্রামপ্রাপ্ত হয়।

এটাই সেই অন্তর্লয়ের রোদ-হাওয়া, যার স্পর্শে মন আর প্রতিক্রিয়া করে না—কেবল জাগ্রত থাকে, বিশুদ্ধ ও নীরব, নিজের আলোকেই।

এই অবস্থার বিশ্লেষণ অদ্বৈত বেদান্তে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে করা হয়েছে।

যখন শাস্ত্রশ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের ধারাবাহিক সাধনায় ব্রহ্মবিষয়ক অখণ্ডাকার-বৃত্তি (akhaṇḍākāra-vṛtti) উদিত হয়—অর্থাৎ মনের প্রতীতি একাকার হয়ে যায় ব্রহ্মস্বরূপে—তখন অবিদ্যার আবরণ এক আঘাতে নাশ পায়। এই জ্ঞানের প্রকৃতি নিবৃত্তি-লক্ষণ (nivṛtti-lakṣaṇa)—এটি কিছু নতুন সৃষ্টি করে না, কেবল অজ্ঞানতার আচ্ছাদন সরিয়ে দেয়। এই মুহূর্তেই আত্মা নিজের পরম সত্যে প্রত্যক্ষভাবে উদ্‌ভাসিত হয়; এটিই অপরোক্ষ জ্ঞান (aparokṣa-jñāna), যেখানে আত্মা আর তত্ত্বতত্ত্বে নয়, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় নিজেকে ব্রহ্মরূপে জানে।

তবে আবরণ সরে গেলেও, বিক্ষেপ বা অস্থিরতা সঙ্গে সঙ্গে মুছে যায় না। দীর্ঘকালীন অভ্যাস, প্রারব্ধ-কর্মের দোল, ও চিত্তে সঞ্চিত বাসনা কিছু সময় সেই বিক্ষেপকে টিকিয়ে রাখে। জ্ঞানী জানেন—“এ সবই মিথ্যা, আত্মার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই”—তবু শরীর, মন, ইন্দ্রিয়ের স্বাভাবিক প্রবাহ পুরোনো গতি ধরে কিছুদিন চলে।

এই অবস্থাকে বোঝানো হয় উপাধির অবশিষ্ট জড়তা হিসেবে—যেমন নৌকা দাঁড় টেনে থামিয়ে দিলে কিছুক্ষণ তরঙ্গের দোল চলতেই থাকে, তেমনি প্রারব্ধ-গতি নিজের পূর্ণতা পর্যন্ত চলতে থাকে। কিন্তু এই দোলের মধ্যে আর অজ্ঞান নেই; কেবল পুরোনো গতির অবশিষ্ট প্রতিফলন।

অদ্বৈত বেদান্তে এই অবস্থাই জ্ঞানীর জীবন্মুক্তির প্রান্তভূমি—আবরণ সম্পূর্ণ সরে গেছে, বিক্ষেপ ধীরে ধীরে স্তিমিত হচ্ছে, আত্মা নিজের স্ব-দ্যোতনায় স্থির। বাকি কেবল প্রারব্ধ-প্রবাহের স্বাভাবিক নিঃশেষ।

এই বিক্ষেপ-নিবৃত্তি (মন-চাঞ্চল্যের সম্পূর্ণ স্তব্ধতা) অর্জিত হয় জ্ঞাননিষ্ঠা ও নিধিধ্যাসন-এর দৃঢ়, সচেতন অনুশীলনে। জ্ঞাননিষ্ঠা মানে কেবল “জেনেছি” নয়, সেই জ্ঞানে অবিচল অবস্থান—প্রতিটি মুহূর্তে আত্মস্বরূপ চৈতন্যে ফিরে আসার স্বভাব তৈরি করা। নিধিধ্যাসন মানে সেই আত্মস্মৃতি বা প্রত্যভিজ্ঞান (“অহং ব্রহ্মাস্মি”)-এর মধ্যে বার বার নিমজ্জিত হওয়া, যতক্ষণ না তা অবিচ্ছিন্ন স্রোত হয়ে যায়।

এই অনুশীলনের সঙ্গে যুক্ত থাকে ষট্‌-সাধন-সম্পত্তি—শম (মন-শান্তি), দম (ইন্দ্রিয়-সংযম), উপরতি (বাহ্যবস্তুর অনাসক্তি), তিতিক্ষা (সহিষ্ণুতা), শ্রদ্ধা (গুরু-শাস্ত্র-বাক্যে আস্থা) ও সমাধান (একাগ্রতা)। যখন এই গুণগুলো দৃঢ় হয়, তখন চিন্তার বৈকল্য কমে আসে, রাগ-দ্বেষের প্রবণতা ক্ষীণ হয়, কর্তা-ভোক্তা-ভাব আলগা হয়ে যায়।

এভাবেই ধীরে ধীরে বাসনা-ক্ষয় (vāsanā-kṣaya) ও মনো-নাশ (mano-nāśa) প্রায়োগিক অর্থে সিদ্ধ হতে শুরু করে—মন তখন আর নতুন চঞ্চলতা তোলে না, পুরোনো গতি নিঃশেষ হয়।

এই স্তরে জগৎ-প্রতীতি থাকলেও, তা আর বাঁধতে পারে না। যেমন দগ্ধ-রজ্জু (পোড়া দড়ি) দেখতে দড়ির মতো, কিন্তু তা দিয়ে কিছু বাঁধা যায় না; অথবা যেমন বাতাসে ঘূর্ণায়মান পাখা বন্ধ হওয়ার পরও কিছুক্ষণ ঘোরে, তবু আর কাজ করে না—ঠিক তেমনই জ্ঞানীর কাছে জগৎ দেখা যায়, কিন্তু তা আর কোনো বন্ধন সৃষ্টি করে না।

এই অবস্থাতেই বিক্ষেপ-নিবৃত্তি পূর্ণতা পায়—চিন্তা-প্রবাহ থাকে, কিন্তু তার তেজ নেই; দেহ-মন কাজ করে, কিন্তু আত্মা অচঞ্চল; দেখা-শোনা চলে, কিন্তু দ্রষ্টা বিশুদ্ধ ও অবিকৃত। এটাই জীবন্মুক্তির প্রায় চূড়ান্ত পরিণতি, যেখানে জ্ঞান নিঃসংশয়, মন নিস্পৃহ, আর আত্মা নিজস্ব স্বরূপে উজ্জ্বল।

অদ্বৈত বেদান্তে জ্ঞানের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকে বোঝাতে “বৃত্তি-ব্যাপ্তি” ও “ফল-ব্যাপ্তি”—এই দুই ধরনের বিশ্লেষণ ব্যবহার করা হয়।

যখন ব্রহ্মবিষয়ক বৃত্তি উদিত হয়—অর্থাৎ মনের প্রত্যয় ব্রহ্মাকারে একাকার হয়ে যায়—তখন সেই জ্ঞানবৃত্তি অবিদ্যার আবরণ ভেদ করে ফেলে। এটি হলো বৃত্তি-ব্যাপ্তি: জ্ঞানের মানসিক রূপটি এখন ব্রহ্মতত্ত্বে পৌঁছেছে। এর ফলে ব্রহ্ম যেন “উদ্ঘাটিত” হয়, যদিও আসলে ব্রহ্ম সর্বদাই প্রকাশমান; কেবল অজ্ঞানরূপ আচ্ছাদন সরে গেছে।

এখানে ফল-ব্যাপ্তি কোনো নতুন আলোকপাত নয়, বরং সেই স্বপ্রকাশ চৈতন্যের অবরোধের অবসান। যেমন মেঘ সরলে সূর্যের আলো ফুটে ওঠে, কিন্তু আলো নতুন করে সৃষ্টি হয় না—তেমনি বৃত্তি-ব্যাপ্তির ফল হিসেবে আত্মচৈতন্যের অবরোধ দূর হয়, এবং আত্মা নিজ স্বরূপে প্রকাশিত হয়।

তাই আবরণ-নিবৃত্তি হয় তাৎক্ষণিক (sadyonivṛtti)—কারণ জ্ঞান উদিত হতেই অবিদ্যা দূর হয়; কিন্তু বিক্ষেপ-নিবৃত্তি ঘটে ক্রমে (kramanivṛtti)—কারণ দীর্ঘকালীন অভ্যাস, বাসনা, সংস্কার, ও প্রারব্ধের টানে মন কিছু সময় চঞ্চল থাকে, যদিও জ্ঞানী জানেন তা মিথ্যা।

এই দ্বৈত প্রক্রিয়ার প্রতিফলন দেখা যায় শিক্ষণপদ্ধতিতেও। প্রথমে শিক্ষক অধ্যারোপ-অপবাদ (adhyāropa–apavāda) পদ্ধতিতে শিষ্যকে জ্ঞানের উপযুক্ত মানসে উন্নীত করেন। অর্থাৎ, শুরুতে জগত, ঈশ্বর, কারণত্ব ইত্যাদি ধারণাকে অধ্যারোপ করা হয়—যেন বুদ্ধি “ধারণার সেতু”-তে ওঠে। এতে চিত্ত প্রস্তুত হয় অবিদ্যার পর্দা ভেদ করতে।

এরপর আসে অপবাদ—অর্থাৎ সব আরোপিত ধারণাকে প্রত্যাহার করা। “নেতি নেতি” (এ নয়, এ নয়) এবং “তত্ত্বমসি”-র ভাগত্যাগ-লক্ষণা (bhāga-tyāga-lakṣaṇā) দ্বারা শিষ্যকে বোঝানো হয়—দেহ, মন, ইন্দ্রিয় ইত্যাদি উপাধি ত্যাগ করলে যা অবশিষ্ট থাকে, সেই অনন্ত চৈতন্যই তুমি। এই জ্ঞানই আবরণ-নিবারক, কারণ এটি অজ্ঞানকে প্রত্যক্ষভাবে দূর করে দেয়।

কিন্তু শিক্ষণ এখানে শেষ নয়। জ্ঞান জন্ম নিলেও স্থায়ী হওয়ার জন্য প্রয়োজন জ্ঞাননিষ্ঠা—অর্থাৎ সেই বোধে অবিচল অবস্থান। এর ধারাবাহিক অনুশীলনে নিধিধ্যাসন, স্মরণ, উপাধি-সংযোগে নিস্পৃহতা এবং সন্নিহিত করুণা বিকশিত হয়। এই ক্রমে বিক্ষেপের অবসান ঘটে—মন স্থিত হয়, বাসনা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, ও আত্মা তার স্বরূপে স্থির হয়।

অতএব, আবরণ ভেদ হয় এক আঘাতে—জ্ঞানোদয়ে; কিন্তু বিক্ষেপ স্তব্ধ হয় ধীরে ধীরে—নিষ্ঠার অনুশীলনে। এই দ্বৈত গতি মিলেই সম্পূর্ণ মুক্তির রূপ সম্পন্ন হয়: তাৎক্ষণিক আত্ম-প্রকাশ, এবং ক্রমাগত স্থিতি সেই প্রকাশে।

এই সমগ্র প্রক্রিয়ার দুই স্তর—আবরণ-নিবৃত্তি ও বিক্ষেপ-নিবৃত্তি—অদ্বৈত বেদান্তে মুক্তির (জীবন্মুক্তি ও বিদেহমুক্তি উভয়) পূর্ণ নকশা গঠন করে।

আবরণ-নিবৃত্তির লক্ষণ স্পষ্ট: এটি ঘটে জ্ঞানোদয়ের মুহূর্তে—যখন দার্শনিক সংশয়, অবিদ্যা-প্রসূত জিজ্ঞাসা, এবং “আমি কে?” এই মৌল অন্ধকার ভেদ হয়। তখন আত্মা নিজের প্রকৃত পরিচয় লাভ করে—“আমি শরীর, মন, ইন্দ্রিয় নই; আমি অখণ্ড চেতনা”—এই স্বপ্রকাশ সত্য অন্তরে অবিচলভাবে প্রতিধ্বনিত হয়। এই অবস্থায় চেতনা নিজেই নিজেকে আলোকিত করে, এবং সমস্ত তত্ত্বগত বিভ্রান্তি বিলীন হয়।

কিন্তু এই প্রথম বিজয়—মুক্তির পূর্ণতা নয়। কারণ পুরোনো অভ্যাসজনিত প্রবণতা, রাগ-দ্বেষ-ভয়-লোভ-অহংকার, এবং কর্তা-ভোক্তা-ভাবের গতি এখনও থেকে যেতে পারে। এই প্রবাহ থামে বিক্ষেপ-নিবৃত্তিতে, যা জ্ঞাননিষ্ঠা ও নিধিধ্যাসনের অনুশীলনে ক্রমে পরিপূর্ণ হয়। এখানে মন আর বহির্মুখী নয়—তার গতি অন্তর্মুখী, স্থিত, সমদর্শী। দ্বন্দ্ব-ভাব (পছন্দ-অপছন্দ, লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয়) ম্লান হয়ে যায়, এবং জীবনের প্রতি এক স্বতঃসিদ্ধ করুণা ও হিতেচ্ছা জন্মায়।

অতএব, আবরণ-নিবৃত্তি হলো জ্ঞানের প্রথম আলো—যেখানে আত্মা নিজের প্রকৃত স্বরূপে জাগ্রত হয়; আর বিক্ষেপ-নিবৃত্তি হলো সেই জ্ঞানের পরিপাক, যেখানে মনের সমস্ত বিকৃতি ও বাসনা নিঃশেষে শান্ত হয়।

যখন উভয় নিবৃত্তি সিদ্ধ হয়, তখনই উদ্‌ভাসিত হয় জীবন্মুক্তি—জ্ঞানী জগৎ ও শরীরের মধ্যেই অনাসক্ত, অবিকৃত, অদ্বিতীয় চৈতন্যে স্থিত থাকেন। তাঁর মধ্যে কোনো কর্তা-ভাব নেই, তবু কর্ম চলে; কোনো ভোক্তা-ভাব নেই, তবু অভিজ্ঞতা ঘটে—সবই নিস্পৃহভাবে, স্বভাবত।

আর যখন প্রারব্ধ-কর্মের ধারা নিঃশেষ হয়, তখন সেই জ্ঞানী বিদেহমুক্ত হন। কিন্তু বিদেহমুক্তিও কোনো নতুন অবস্থা নয়—কারণ শুরু থেকেই যা সত্য, তাই অনবচ্ছিন্নভাবে থেকে যায়। ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়; জ্ঞানী সেই অনন্ত চৈতন্যেই অবিরত প্রতিষ্ঠিত, যেন তরঙ্গ সরে গিয়ে সমুদ্র নিজেকে প্রকাশ করেছে—অপরিবর্তনীয়, নীরব, চিরপ্রকাশমান।

অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনে 'অবিদ্যা' বা 'অজ্ঞান' একটি কেন্দ্রীয় ধারণা, যা জীবের বন্ধন ও দুঃখের মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত। এই অবিদ্যার আশ্রয় কোথায়—এই প্রশ্নটি চিরকালই বেদান্ত আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই প্রশ্নের উত্তরে অদ্বৈত বেদান্তের বিভিন্ন শাখা সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রেখে তাদের মতবাদ উপস্থাপন করেছে।

অবিদ্যার আশ্রয়—জীব, না ব্রহ্ম?

ভামতী-মত: অদ্বৈত বেদান্তের ভামতী সম্প্রদায় মনে করে যে, অবিদ্যার আশ্রয় হলো জীব। তাদের যুক্তি হলো, ব্রহ্ম নিত্যশুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্তস্বভাব এবং নির্গুণ। ব্রহ্মে অজ্ঞান-যোগ অর্থাৎ, অবিদ্যার সম্পর্ক স্থাপন করা অনুচিত, কারণ তা ব্রহ্মের শুদ্ধতাকে ক্ষুণ্ণ করবে। যদি ব্রহ্ম অবিদ্যার আশ্রয় হয়, তবে ব্রহ্ম নিজেই মায়াবদ্ধ হয়ে পড়বেন, যা ব্রহ্মের স্বরূপের পরিপন্থী। অতএব, জীবই অবিদ্যার আশ্রয় এবং জীবই অবিদ্যার কারণে সংসারচক্রে আবর্তিত হয়। জীবের উপাধিযুক্ত চৈতন্যই অবিদ্যার আশ্রয়।

বিবরণ মত: বিবরণ সম্প্রদায় এর বিপরীত মত পোষণ করে। তারা বলে যে, অবিদ্যার আশ্রয় হলো ব্রহ্ম। তাদের যুক্তির মূল ভিত্তি হলো, ব্রহ্ম ব্যতীত অন্য কিছুই তো পারমার্থিকভাবে সত্য নয়। যদি জীবকে অবিদ্যার আশ্রয় বলা হয়, তবে জীবকে ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন ও সত্য বলে স্বীকার করতে হয়, যা অদ্বৈতবাদের মূল সিদ্ধান্ত 'একমেবাদ্বিতীয়ম্' (এক ব্রহ্মই অদ্বিতীয়) এর পরিপন্থী। ব্রহ্মই একমাত্র সত্য এবং ব্রহ্মই সমস্ত উপাধির কারণ। তাই অবিদ্যার আশ্রয় ব্রহ্ম ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। ব্রহ্মই নিজের মায়াশক্তির দ্বারা জগৎ সৃষ্টি করেন এবং ব্রহ্মই নিজেকে জীব রূপে প্রকাশ করেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, অবিদ্যা ব্রহ্মকে আবৃত করে রাখে এবং ব্রহ্মের উপরই জগতের মিথ্যা প্রতিভাস সৃষ্টি করে।

দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়—ব্যষ্টি ও সমষ্টি: অদ্বৈত বেদান্তের এই দুটি আপাতবিরোধী মতবাদের সমন্বয় করা হয় দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের ভিত্তিতে:

ব্যষ্টি-দৃষ্টিতে (Individual Perspective): যখন আমরা individual বা ব্যষ্টি জীবের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তখন অবিদ্যাকে জীবাশ্রয় বলা হয়। প্রতিটি জীব তার নিজস্ব অবিদ্যার কারণে জগৎকে ভিন্নভাবে দেখে এবং সংসারচক্রে আবদ্ধ হয়। জীবের অজ্ঞানই জীবের দুঃখের কারণ। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, জীব তার ব্যক্তিগত অবিদ্যার দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং তার মোক্ষের জন্য এই অবিদ্যাকে দূর করা অপরিহার্য।

সমষ্টি-দৃষ্টিতে (Cosmic Perspective): যখন আমরা cosmic বা সমষ্টির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তখন অবিদ্যাকে ব্রহ্মাশ্রয় বলা হয়। এই সমষ্টি অবিদ্যাকে 'মায়া' বলা হয়, যা সমগ্র জগতের উপাদানের কারণ। ব্রহ্মই মায়াকে আশ্রয় করে এই বিচিত্র জগৎ সৃষ্টি করেন এবং বহু রূপে প্রতীয়মান হন। এই মায়া ব্রহ্মের শক্তি এবং এটি সমগ্র জগতের কারণ। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, ব্রহ্মই মায়ার আশ্রয় এবং মায়া ব্রহ্মের উপরই অধ্যস্ত।