অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: এক-শো দুই



সমাধির গভীরে পৌঁছালে চিত্তের বীজ-সংস্কার নিঃশেষ হয়—প্রজ্ঞা এমন সূক্ষ্ম হয় যে, কোনো নতুন বৃত্তি জন্ম নেয় না (১.৫০–১.৫১, ৩.৯–৩.১২)। মন সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ, স্থিত ও নিরাসক্ত হয়ে যায়।

বিবেকখ্যাতি হলো সেই নিরবচ্ছিন্ন জাগরণ, যেখানে যোগী প্রতিক্ষণে দেখে—আমি দ্রষ্টা, দৃশ্য কেবল গুণময় কার্য। এই স্পষ্ট, অব্যর্থ ও অনবচ্ছিন্ন জ্ঞানই যোগীর সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে, এবং তাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা—কৈবল্যে—স্থাপন করে।

বিবেক-প্রকাশ আসে ক্রিয়া-যোগ ও অষ্টাঙ্গ-সাধনার মাধ্যমে। পতঞ্জলি বলেন—তপঃ, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বর-প্রণিধান দুঃখক্ষয় ও সমাধির উপায় (যোগসূত্র ২.১–২.২)। এরপর আসে অষ্টাঙ্গ-অভ্যাস—যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি (২.২৯)। এই আট ধাপের অনুশীলনে চিত্ত ক্রমে নির্মল, সংযত ও স্থিত হয়।

ক্রিয়া-যোগ পতঞ্জলির যোগসূত্রে (২.১–২.২) বর্ণিত একটি প্রাথমিক সাধনাপদ্ধতি, যা চিত্তকে শুদ্ধ ও সংযত করে এবং সমাধির জন্য প্রস্তুত করে।

পতঞ্জলি বলেছেন—“তপঃ, স্বাধ্যায়, ঈশ্বর-প্রণিধানানি ক্রিয়া-যোগঃ।” অর্থাৎ তপঃ, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বর-প্রণিধান—এই তিনটির সমষ্টিই ক্রিয়া-যোগ।

তপঃ মানে দেহ, বাক্‌ ও মনের সংযম। এটি কঠোর আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সহিষ্ণুতার সাধনা। তপের মাধ্যমে ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রিত হয়, ক্লেশ হ্রাস পায়, আর চিত্তে দৃঢ়তা আসে।

স্বাধ্যায় মানে আত্ম-অধ্যয়ন। এর অর্থ শাস্ত্রপাঠ, আত্মচিন্তা ও নিজের মনন পর্যবেক্ষণ। স্বাধ্যায় যোগীর বুদ্ধিকে পরিষ্কার করে, আত্মজ্ঞান ও বিবেকজ্ঞান জন্ম দেয়।

ঈশ্বর-প্রণিধান মানে সর্বোচ্চ চেতনার প্রতি আত্মসমর্পণ ও নিষ্কাম ভক্তি। এতে অহংকার ক্ষয় হয়, কর্তা-ভাব বিলীন হয়, আর যোগী শান্ত ও একাগ্র হয়।

পতঞ্জলি বলেছেন—“সমাধি-ভাবনার্থঃ ক্লেশ-তনূ-করর্ণার্থশ্চ।” অর্থাৎ ক্রিয়া-যোগের উদ্দেশ্য দুইটি—সমাধি লাভের প্রস্তুতি এবং ক্লেশ বা মানসিক অশুদ্ধি হ্রাস।

তপে দেহ ও ইন্দ্রিয় শুদ্ধ হয়, স্বাধ্যায়ে মন ও বুদ্ধি নির্মল হয়, ঈশ্বর-প্রণিধানে অহংকার বিলীন হয়। ফলে চিত্ত শান্ত, সংযত ও স্থিত হয়ে ওঠে। এই চিত্তই পরে অষ্টাঙ্গ-যোগে প্রবেশের উপযুক্ত হয়, যেখানে ধ্যান ও সমাধির মাধ্যমে বিবেকজ্ঞান সম্পূর্ণ বিকশিত হয়।

ক্রিয়া-যোগ হলো যোগপথের প্রস্তুতিপর্ব—চিত্তশুদ্ধি, সংযম ও আত্মনিবেদন দ্বারা মুক্তি বা কৈবল্যের পথে প্রথম ধাপ।

যখন চিত্ত সমাধিতে স্থিত হয়, তখন তার রূপান্তর ঘটে—একে বলা হয় সমাধি-পরিণাম (৩.৯–৩.১২)। চিত্তের বীজসংস্কার ক্ষয় হতে থাকে, নতুন বৃত্তি জন্মায় না, পুরনো সংস্কার প্রশমিত হয়।

এই সিদ্ধ পরিণামের পর উদিত হয় ধর্মমেঘ-সমাধি—যেখানে ধর্ম বা গুণের মেঘের মতো জ্ঞান বর্ষিত হয় (৪.২৯)। যোগী তখন চিরশান্ত, অনাসক্ত ও অন্তর্জ্যোতিতে পূর্ণ।

এই অবস্থায় সমস্ত ক্লেশ ও কর্মের নিবৃত্তি ঘটে (৪.৩০)। অবিদ্যা, রাগ, দ্বেষ ও অভিনিবেশ লুপ্ত হয়। মন ও গুণত্রয় নিজের উৎসে ফিরে যায়, আর চেতনা নিজের স্বরূপে স্থিত হয়।

যোগসূত্রে (২.৩) পতঞ্জলি বলেছেন—অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ ও অভিনিবেশ—এই পাঁচটি ক্লেশ মানবদুঃখের মূল। এদের বলা হয় ক্লেশ-পঞ্চক। এর মধ্যে অবিদ্যা মূল কারণ, বাকিগুলি তার শাখা। এই ক্লেশগুলোই মনকে অশান্ত করে, কর্মবীজ তৈরি করে এবং জন্ম-মৃত্যুর চক্রকে অব্যাহত রাখে।

অবিদ্যা মানে অজ্ঞানতা বা ভুল উপলব্ধি। যখন মানুষ অনিত্যকে নিত্য, অশুদ্ধকে শুদ্ধ, দুঃখকে সুখ, এবং অনাত্মাকে আত্মা বলে মনে করে, তখন সেটিই অবিদ্যা। অবিদ্যা সব ক্লেশের মূল। এখান থেকেই অহংকার, রাগ, দ্বেষ ও মৃত্যুভয় জন্ম নেয়।

পতঞ্জলি যোগসূত্রে (২.৬) আস্মিতার সংজ্ঞা দিয়েছেন—“দৃষ্টশক্তি-দর্শনশক্ত্যোঃ একাত্মতা ইব আস্মিতা।” এর অর্থ হলো—যখন দ্রষ্টা (পুরুষ বা চেতনা) ও দর্শনশক্তি (বুদ্ধি বা চিত্তের জ্ঞানক্ষমতা) এক মনে হয়, তখন সেটিই আস্মিতা।

দ্রষ্টা বা পুরুষ স্বরূপে চৈতন্য সর্বদা শুদ্ধ, নিষ্ক্রিয় ও স্বতঃসিদ্ধ। দর্শনশক্তি বা বুদ্ধি প্রকৃতির একটি গুণবৃত্তি—যা দেখা, জানা ও চিন্তার কাজ করে। কিন্তু অবিদ্যার কারণে মানুষ মনে করে, “আমি-ই দেখি, আমি-ই জানি, আমি-ই কর্তা।” এই ‘আমি’-ভাবই আস্মিতা—যেখানে চৈতন্য ও মনোবৃত্তির তালগোল পাকিয়ে যাওয়া ঘটে।

এই ভ্রান্ত একাত্মতা থেকেই কর্তা-ভাব, ভোগ-ভাব, রাগ, দ্বেষ ও অভিনিবেশের জন্ম। অর্থাৎ, অবিদ্যা থেকে আস্মিতা, আর আস্মিতা থেকেই জীবের সমস্ত বন্ধন ও দুঃখের সূত্রপাত।

দ্রষ্টা ও দর্শনশক্তির একাত্মতার ভ্রান্তিই আস্মিতা, যেখানে আত্মা ও মনকে এক বলে মনে হয়, আর এই ভুল পরিচয়ই সমস্ত ক্লেশের দ্বিতীয় স্তর।

রাগ মানে আসক্তি বা আকর্ষণ। যে-অভিজ্ঞতা আগে সুখ দিয়েছে, তাকে পুনরায় পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাই রাগ। রাগ মনকে জড়ায়, ইন্দ্রিয়কে অস্থির করে, আর যোগীর স্থিতি নষ্ট করে। এটি অস্মিতারই বহির্প্রকাশ—“আমি ভোগী”—এই বোধ থেকে রাগের সৃষ্টি হয়।

দ্বেষ মানে বিতৃষ্ণা বা বিরক্তি। যে-অভিজ্ঞতা বা বস্তু আগে দুঃখ দিয়েছে, তাকে এড়ানোর প্রবণতাই দ্বেষ। রাগ ও দ্বেষ একে অপরের বিপরীত হলেও, দুটোই অবিদ্যা ও অস্মিতা থেকে উদ্ভূত। রাগে মানুষ আকর্ষিত হয়, দ্বেষে মানুষ প্রতিকর্ষিত হয়—কিন্তু দুটোই চিত্তে আন্দোলন আনে, শান্তি নষ্ট করে।

অভিনিবেশ মানে জীবনের প্রতি অন্ধ আসক্তি ও মৃত্যুভয়। এটি এমন গভীর প্রোথিত প্রবৃত্তি, যা জ্ঞানীর মধ্যেও থাকে। অভিনিবেশের মূলে আছে আত্মাকে দেহ বলে মনে করা। মানুষ ভাবে—“আমি দেহ, তাই মৃত্যুই আমার শেষ।” এই ভুল ধারণা থেকেই মৃত্যুভয়, নিরাপত্তাহীনতা ও বেঁচে থাকার অন্ধ তৃষ্ণা জন্ম নেয়।

এই পাঁচটি ক্লেশের মধ্যে অবিদ্যা হলো মূল। অবিদ্যা থেকে অস্মিতা, অস্মিতা থেকে রাগ ও দ্বেষ, আর রাগ-দ্বেষের পরিণতি অভিনিবেশ। অর্থাৎ অবিদ্যা মূলমূলিকা, বাকিগুলো তার শাখা।

যোগদর্শনে এই ক্লেশগুলোই দুঃখের কারণ। পতঞ্জলি বলেন—সংযোগই দুঃখের মূল, আর সংযোগের কারণ অবিদ্যা। যতক্ষণ অবিদ্যা থাকে, ততক্ষণ ক্লেশগুলো কাজ করে; অবিদ্যা দূর হলে সব ক্লেশ ক্ষীণ হয়।

যখন যোগী ক্রিয়া-যোগ, ধ্যান ও অষ্টাঙ্গ-সাধনার মাধ্যমে অবিচ্ছিন্ন বিবেকজ্ঞান অর্জন করে, তখন এই ক্লেশগুলো ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়—এটিই ক্লেশ-তনূকরণ। অবিদ্যা দূর হলে অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ ও অভিনিবেশও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলীন হয়।

ক্লেশ-তনূকরণ মানে ক্লেশ বা মানসিক অশুদ্ধিগুলিকে ধীরে ধীরে ক্ষীণ করা বা সূক্ষ্ম করা। পতঞ্জলি এই ধারণাটি যোগসূত্রে (২.১০–২.১১)-এ ব্যাখ্যা করেছেন।

অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ ও অভিনিবেশ—এই পাঁচটি ক্লেশ মানবচিত্তে গভীরভাবে প্রোথিত। এগুলিকে একদিনে দূর করা যায় না, ধীরে ধীরে দুর্বল করতে হয়। এই ধীরে ক্ষীণ করার প্রক্রিয়াই ক্লেশ-তনূকরণ। ‘তনূ’ মানে সূক্ষ্ম বা কোমল। ‘তনূকরণ’ মানে ভারী ক্লেশকে হালকা বা সূক্ষ্ম করা।

যোগী যখন ক্রিয়া-যোগ, ধ্যান, বৈরাগ্য ও বিবেক-জ্ঞান অনুশীলন করে, তখন অবিদ্যার প্রভাব ক্রমে কমতে থাকে। মন পরিষ্কার হয়, আসক্তি ও দ্বেষ লঘু হয়, মৃত্যুভয় হ্রাস পায়, অহংকার বিলীন হয়।

ক্লেশ দূর করার উপায় দুটি—অভ্যাস ও বৈরাগ্য (যোগসূত্র ১.১২), এবং বিবেকজ্ঞান (২.২৬)। অভ্যাস মনকে সংযত করে, বৈরাগ্য আসক্তি হ্রাস করে, আর বিবেকজ্ঞান দ্রষ্টা ও দৃশ্যের ভেদ স্পষ্ট করে।

যখন ক্লেশগুলো স্থূল থাকে, তখন তারা মনকে টানে ও দুঃখ সৃষ্টি করে। কিন্তু যোগীর সাধনায় এগুলো সূক্ষ্ম হয়ে যায়, আর চিন্তার গভীরে গেলেও প্রায় অকার্যকর হয়ে থাকে। এই অবস্থায় যোগী দেহে অবস্থান করেও ক্লেশ দ্বারা প্রভাবিত হয় না। ক্লেশ তখন কেবল সম্ভাবনা হিসেবে থাকে, কার্য নয়।

ক্লেশ-তনূকরণ মানে ক্লেশকে একেবারে ধ্বংস নয়, বরং ধীরে ধীরে দুর্বল করা। সাধনা, ধ্যান ও বিবেকজ্ঞান দ্বারা ক্লেশের শক্তি কমে, মন শান্ত হয়, আর যোগী কৈবল্যের পথে অগ্রসর হয়।

অবিদ্যা হলো ভুল দৃষ্টি—যেখানে বাস্তব ও অবাস্তবের ভেদ বোঝা যায় না। অস্মিতা হলো ভুল পরিচয়—যেখানে আত্মা ও মনকে এক বলে মনে হয়। রাগ হলো আকর্ষণ—সুখদ অভিজ্ঞতার প্রতি টান। দ্বেষ হলো প্রতিকর্ষণ—দুঃখদ অভিজ্ঞতার প্রতি বিতৃষ্ণা। অভিনিবেশ হলো মৃত্যুভয় ও জীবনের প্রতি আঁকড়ে থাকা।

এই পাঁচটি ক্লেশই চিত্তকে অশুদ্ধ রাখে ও বন্ধনে আবদ্ধ করে। এদের নিবৃত্তিই যোগসাধনার প্রথম লক্ষ্য। চিত্ত যখন ক্লেশমুক্ত হয়, তখন বিবেকজ্ঞান উদিত হয়, আর সেই অবিচ্ছিন্ন জ্ঞানই যোগীকে শেষ পর্যন্ত কৈবল্যের মুক্তিতে পৌঁছে দেয়।

পতঞ্জলি বলেন—তখন সব আচ্ছাদন সরে গিয়ে জ্ঞানের অনন্ততা প্রকাশিত হয় (৪.৩১)। যোগী উপলব্ধি করে—চেতনার আলো আর কোনো অবরোধে ঢাকা নেই; চিত্ত সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, পুরুষ নিজস্ব দীপ্তিতে স্বয়ংপ্রভ।

ক্রিয়া-যোগ ও অষ্টাঙ্গ-সাধনা চিত্তকে পরিশুদ্ধ ও একাগ্র করে, সমাধিতে সেটি রূপান্তরিত হয়, এবং ধর্মমেঘ-সমাধির মাধ্যমে সমস্ত আচ্ছাদন ঝরে গিয়ে জ্ঞান, স্বাধীনতা ও কৈবল্যে পরিণত হয়।

দ্রষ্টা ও দৃশ্যের ভেদ যোগদর্শন ও বেদান্ত উভয়ের মূল তত্ত্ব। এই ভেদ বোঝাই মুক্তির সূচনা।

দ্রষ্টা মানে যিনি দেখেন, যিনি সচেতন সাক্ষী। যোগসূত্রে দ্রষ্টা হলেন পুরুষ—শুদ্ধ চেতনা, অচল, অক্রিয় ও চিরসচেতন। তিনি কিছু করেন না, কেবল সব অভিজ্ঞতার সাক্ষী। তিনি দেহ, মন বা ইন্দ্রিয় নন; এইসব কেবল তাঁর সামনে ক্রিয়াশীল যন্ত্রমাত্র।

দৃশ্য মানে যা দ্রষ্টার সামনে প্রকাশিত হয়। যোগসূত্রে বলা হয়েছে, দৃশ্য হলো গুণত্রয়—সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ—দ্বারা গঠিত প্রকৃতি, যার মধ্যে প্রকাশ, ক্রিয়া ও স্থিতি এই তিন ধর্ম আছে। দেহ, মন, ইন্দ্রিয়, চিন্তা, অনুভূতি ও বাহ্য জগত—সবই দৃশ্য, কারণ এগুলো পরিবর্তনশীল ও দ্রষ্টার সামনে উদিত হয়।

অবিদ্যার কারণে মানুষ দ্রষ্টা ও দৃশ্যকে এক করে ফেলে। পুরুষের সঙ্গে বুদ্ধির একাত্মতার ভ্রান্তিই তখন ঘটে, আর এখানেই জন্ম নেয় অস্মিতা—“আমি দেহ”, “আমি মন”, “আমি কর্তা”, “আমি ভোক্তা”। যোগসূত্র (২.৬)-এ বলা হয়েছে—“দৃষ্টশক্তি-দর্শনশক্ত্যোঃ একাত্মতা ইব অস্মিতা।” অর্থাৎ দ্রষ্টা ও দর্শনশক্তির একাত্মতার ভ্রান্তিই অস্মিতা।

এই ভুল পরিচয় থেকেই জন্ম নেয় রাগ, দ্বেষ ও অভিনিবেশ। মানুষ তখন সুখে আকৃষ্ট, দুঃখে বিকৃষ্ট, আর মৃত্যুভয়ে আক্রান্ত হয়। সব দুঃখের মূল কারণ এই সংযোগ—যেখানে দ্রষ্টা দৃশ্যকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে।

যখন যোগী সাধনা, ধ্যান ও বৈরাগ্যের মাধ্যমে বুঝতে শেখে—“আমি চেতনা, আমি দৃশ্যমান বস্তুর অংশ নই”—তখনই জন্ম নেয় ভেদজ্ঞান বা বিবেকখ্যাতি। যোগসূত্র (২.২৬) বলে—“অবিপ্লব বিবেকখ্যাতিরে হানোপায়ঃ”—অর্থাৎ অবিচল বিবেকজ্ঞানই দুঃখনিবৃত্তির উপায়।

বিবেকজ্ঞান মানে স্পষ্টভাবে দেখা—দেহ পরিবর্তিত হয়, মন ওঠানামা করে, অনুভূতি আসে যায়, কিন্তু আমি, দ্রষ্টা, অপরিবর্তনশীল ও শান্ত। এই অভ্যন্তরীণ উপলব্ধিতেই শুরু হয় মুক্তির প্রক্রিয়া।

যোগসূত্র (২.২৩-২.২৫)-এ বলা হয়েছে—দ্রষ্টা ও দৃশ্যের সংযোগই দুঃখের কারণ। অবিদ্যা এই সংযোগের হেতু। যখন জ্ঞান উদিত হয়, সংযোগ লুপ্ত হয়, এবং পুরুষ নিজের স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়—এটাই কৈবল্য।

বেদান্তেও একই কথা। ব্রহ্ম বা আত্মা হলো দ্রষ্টা, আর মায়া ও জগৎ হলো দৃশ্য। যতক্ষণ অবিদ্যা থাকে, আত্মা নিজেকে দেহ-মন বলে মনে করে। যখন আত্মা জানে—“আমি ব্রহ্ম”—তখন ভেদ সম্পূর্ণরূপে দূর হয়, আর মুক্তি ঘটে।

যোগে এই ভেদ রক্ষা করেই মুক্তি (কৈবল্য) অর্জিত হয়, আর বেদান্তে ভেদ অতিক্রম করেই মুক্তি (জ্ঞান-মোক্ষ) অর্জিত হয়।

দ্রষ্টা হলো চেতনা, দৃশ্য হলো প্রকৃতি। অবিদ্যা এই দুইকে এক মনে করায়, আর বিবেকজ্ঞান তাদের স্পষ্টভাবে পৃথক করে। এই ভেদ বোঝাই জ্ঞানের সূচনা, আর এই ভেদ প্রতিষ্ঠিত হলে ক্লেশ লয় হয়, গুণত্রয় তাদের উৎসে ফিরে যায়, আর পুরুষ নিজের স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়—এটাই যোগদর্শনে কৈবল্য ও বেদান্তে মুক্তি।