অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: এক-শো এক


পতঞ্জলি যোগসূত্রের শেষ সূত্রে বলেছেন—পুরুষার্থশূন্যানাং গুণানাং প্রতিপ্রসবঃ কৈবল্যং স্বরূপপ্রতিষ্ঠা বা চিতিশক্তিরিতি (যোগসূত্র, ৪.৩৪)।

এর অর্থ ধাপে ধাপে বোঝানো যায়—

গুণত্রয়—সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ—প্রকৃতির তিন গুণ। এদের মাধ্যমেই মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি ও সমগ্র জগত কাজ করে।

পুরুষার্থশূন্যানাং মানে—যখন এই গুণত্রয় পুরুষের জন্য আর কোনো কাজ রাখে না। যতদিন জ্ঞান অসম্পূর্ণ, ততদিন প্রকৃতি পুরুষের জন্য কাজ করে—অভিজ্ঞতা দেয়, শিক্ষা দেয়, ক্লেশ ও আনন্দের মাধ্যমে শুদ্ধি ঘটায়। যখন যোগীর ভেদজ্ঞান (বিবেকখ্যাতি) সম্পূর্ণ হয়, তখন পুরুষ বুঝে ফেলে—আমি দ্রষ্টা, প্রকৃতি দৃশ্যমাত্র। তখন গুণত্রয়ের আর কোনো উদ্দেশ্য থাকে না।

প্রতিপ্রসব মানে—উলটো প্রবাহ, নিজের উৎসে ফিরে যাওয়া। যে-প্রকৃতি থেকে মন, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, তন্মাত্রা ও জগত প্রকাশিত হয়েছিল, এখন সেগুলি আবার নিজের কার্যে ফিরে যায়, স্থির হয়, শান্ত হয়। এই অবস্থায় মন আর কোনো কর্ম করে না; ইন্দ্রিয় ও চিন্তা নিজের উৎসে লীন হয়। এই প্রতিপ্রসব অবস্থাই কৈবল্য।

কৈবল্য মানে পুরুষের স্বরূপে প্রতিষ্ঠা—শুদ্ধ চেতনা, যা নিজের মধ্যে সম্পূর্ণ, স্বাধীন ও স্বয়ংপ্রভ। এই অবস্থায় চিতিশক্তি (সচেতনতার শক্তি) নিজেই নিজের মধ্যে স্থিত থাকে—আর কোনো অবলম্বন, গুণ বা উপাধি থাকে না।

এখানে কোনো ক্লেশ নেই—অবিদ্যা, অহংকার, রাগ, দ্বেষ, অভিনিবেশ সব লুপ্ত। কর্ম ও সংস্কারের বীজও শেষ—কোনো নতুন জন্মের কারণ অবশিষ্ট নেই। পুরুষ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, অবিচল ও নির্ভরহীন।

যোগদর্শনে মুক্তির এই অবস্থা “কৈবল্য”—পুরুষের সম্পূর্ণ একাকিত্ব ও স্বাতন্ত্র্য। বেদান্তে একে বলা হয় আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠা—উপাধি-লয়ে ব্রহ্মসাক্ষাৎকার। যোগে বলা হয় প্রকৃতির প্রতিপ্রসব; বেদান্তে বলা হয় উপাধির বিলয়—দুই ভাষা ভিন্ন, কিন্তু সত্য একই।

চিত্ত ও কর্ম গুণত্রয়ের দ্বারা চালিত। যখন যোগী অবিচল বিবেকজ্ঞান অর্জন করে, তখন সব গুণ, কর্ম ও ধর্ম ঝরে পড়ে। মন সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ হয়ে যায়, প্রকৃতি নিজের উৎসে ফিরে যায়, আর পুরুষ নিজের চিরস্বাধীন স্বরূপে স্থিত হয়। এই অবস্থাই পতঞ্জলির কৈবল্য—যেখানে চেতনা নিজের মধ্যে আলোকিত, স্বয়ংপ্রভ ও সম্পূর্ণ মুক্ত।

এই অবস্থায় গুণত্রয় তাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ করে ফেলে এবং আর পুরুষকে আবৃত রাখে না। তখন গুণেরা “প্রতিপ্রসব”—নিজ নিজ উৎসে লীন হয়ে যায়।

পুরুষ তখন নিজের স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত থাকে—সম্পূর্ণ স্বাধীন, নিস্পৃহ ও স্বয়ংপ্রভ। এ-ই কৈবল্য, যা পতঞ্জলি সংজ্ঞায়িত করেছেন—“পুরুষার্থ-শূন্য হয়ে যাওয়া গুণদের প্রত্যাবর্তন, দ্রষ্টার স্বস্বরূপে একাকিত্ব।” (যোগসূত্র, ৪.৩৪)

এই কৈবল্যই যোগদর্শনের চূড়ান্ত মুক্তি—যেখানে আর কোনো ক্লেশ, কর্ম বা জন্মের সম্ভাবনা অবশিষ্ট থাকে না, এবং চেতনা নিজের শুদ্ধ, অপরিবর্তনীয় সত্তায় স্থিত হয়।

সমাধি-পাদ লক্ষ্য স্থির করে ও মানসকে স্থিত করে; সাধন-পাদ অনুশীলনের সোপান দেয়; বিভূতি-পাদ ক্ষমতার মোহ ছাড়তে শেখায়; কৈবল্য-পাদ মুক্তির দার্শনিক নিষ্পত্তি দেয়—যেখানে দ্রষ্টা অচঞ্চল স্বাধীনতায় থাকে।

বেদান্তে কৈবল্য মানে আত্মার নিজের স্বরূপে প্রতিষ্ঠা, আর বৈকল্য মানে সেই স্বরূপ থেকে বিভ্রান্ত বা বিকৃত হওয়া। দুটি শব্দ দর্শনগতভাবে পরস্পরবিরোধী অবস্থা বোঝায়।

‘কৈবল্য’ শব্দটি এসেছে “কেবল” থেকে, যার অর্থ একমাত্র, অদ্বিতীয়, স্বতন্ত্র। কৈবল্য মানে সেই অবস্থা, যেখানে আত্মা নিজের প্রকৃত স্বরূপে স্থিত থাকে—চেতনা হিসেবে, ব্রহ্মস্বরূপে। সেখানে আর কোনো দ্বিতীয়তা, উপাধি বা সম্পর্ক থাকে না।

অদ্বৈত বেদান্তে কৈবল্যই মুক্তি। এই অবস্থায় অবিদ্যা সম্পূর্ণ দূর হয়, জীব ও ব্রহ্মের ভেদবুদ্ধি লুপ্ত হয়, এবং আত্মা উপলব্ধি করে—“আমি ব্রহ্ম”, “আমি চেতনা ছাড়া আর কিছু নই।” শঙ্করাচার্য গীতাভাষ্যে (১৮.৫০) বলেন—“কৈবল্য” মানে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা, যা আত্মজ্ঞান দ্বারা অর্জিত হয়।

‘বৈকল্য’ শব্দের অর্থ বিকৃতি বা অপূর্ণতা। এটি এসেছে “কল” (পূর্ণতা) থেকে, যার সঙ্গে “বি” উপসর্গ যোগে অর্থ দাঁড়ায় “অপূর্ণ” বা “বিকৃত”। বেদান্তে বৈকল্য মানে আত্মার স্বরূপে অজ্ঞানজনিত বিকৃতি—অর্থাৎ আত্মা নিজের প্রকৃত সত্তা ভুলে নিজেকে দেহ, মন বা কর্তা বলে ভাবা।

শঙ্করাচার্য সরাসরি “বৈকল্য মানে মিথ্যা অভিমান” বলেননি, কিন্তু তাঁর দর্শনে এই অর্থই নিহিত। তিনি বলেন—“আত্মানং অজ্ঞানাত্‌ শরীরাদি-সঙ্গিনং সুখী-দুঃখী ইতি অভিমন্যতে।” (বৃহদারণ্যক উপনিষদভাষ্য, ১.৪.১০) অর্থাৎ—অবিদ্যার কারণে আত্মা নিজেকে দেহ ও মনসঙ্গী মনে করে, সুখী বা দুঃখী বলে ভাবে—এটাই মিথ্যা অভিমান।

এই ভুল আত্মপরিচয়ই জীববন্ধনের মূল কারণ, আর সেটাই বৈকল্যের প্রকৃত অর্থ। শঙ্করের ভাষায় এই ভ্রান্তি হলো অধ্যাস—আত্মা ও অনাত্মার মিথ্যা সম্পর্ক। এই অধ্যাস থেকেই “আমি দেহ”, “আমি কর্তা”, “আমি সুখী/দুঃখী”—এই ধারণা জন্ম নেয়। এই অবস্থায় আত্মা সীমাবদ্ধ মনে হয়, তার চৈতন্য ঢাকা পড়ে, আর এই বিভ্রান্ত অবস্থাকেই বৈকল্য বলা যায়।

পরবর্তী ব্যাখ্যাকাররা—যেমন সুরেশ্বর, আনন্দগিরি, বিদ্যারণ্য—এই আত্মভ্রান্তিকেই “বৈকল্য” নামে অভিহিত করেছেন। বিদ্যারণ্য স্বামী পঞ্চদশীতে বলেছেন, বৈকল্য হলো সেই অবস্থা যেখানে চেতনা মায়ার প্রভাবে বিকৃত প্রতীয়মান হয়, কিন্তু আসলে অপরিবর্তনীয়ই থাকে।

কৈবল্য ও বৈকল্যের মধ্যে পার্থক্য হলো—কৈবল্য সত্য, বৈকল্য মিথ্যা। কৈবল্য জ্ঞানজনিত, বৈকল্য অবিদ্যা-জনিত। কৈবল্য মুক্তির অবস্থা, বৈকল্য বন্ধনের কারণ। কৈবল্যে আত্মা নিজের স্বরূপে স্থিত, চিরস্বাধীন ও স্বয়ংপ্রভ। বৈকল্যে আত্মা নিজেকে সীমাবদ্ধ ভাবে, দেহ-মনকেই আত্মা বলে মনে করে। বেদান্তের সাধনার লক্ষ্য হলো এই বৈকল্য দূর করে কৈবল্যে প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ, অবিদ্যা ও মায়ার আবরণ সরিয়ে আত্মার স্বরূপে স্থিত হওয়া।

যখন আত্মা উপলব্ধি করে যে, সে কখনোই দেহ বা মন ছিল না—সে নিজেই শুদ্ধ চেতনা—তখন সমস্ত বৈকল্য বিলীন হয়, এবং কৈবল্য বা মুক্তি ঘটে।

বৈকল্য মানে অবিদ্যা-জনিত বিভ্রম, মিথ্যা আত্মপরিচয় ও দ্বৈততা। কৈবল্য মানে আত্মজ্ঞান, অদ্বৈতাবস্থা ও স্বরূপে প্রতিষ্ঠা। বৈকল্য হলো মায়ার ছায়া, কৈবল্য হলো চেতনার নিজের আলো।

যোগদর্শনে চূড়ান্ত মুক্তির নাম কৈবল্য। পতঞ্জলি বলেন—পরম পুরুষার্থই কৈবল্য। দ্রষ্টা (পুরুষ) ও দৃশ্য (প্রকৃতি)-র মধ্যে যতক্ষণ সংযোগ থাকে, ততক্ষণই বন্ধন ও দুঃখ থাকে। যখন এই সংযোগ ছিন্ন হয়, তখনই মুক্তি লাভ হয়। এই ছিন্ন হওয়াকে পতঞ্জলি বলেছেন “হান”—অর্থাৎ অপসারণ বা অপনয়ন (যোগসূত্র, ২.২৫)।

যোগসূত্র অনুযায়ী,
– ভবিষ্যৎ দুঃখ পরিহার্য (২.১৬)।
– সংযোগই দুঃখের কারণ (২.১৭)।
– সংযোগের মূল হেতু অবিদ্যা (২.২৪)।

অবিদ্যা দূর হলে সংযোগও দূর হয়, কারণ অবিদ্যাই দ্রষ্টা ও দৃশ্যের ভেদ না বোঝার মূল। এই অবিদ্যা-নিবৃত্তিই হান, আর হানই কৈবল্য—পুরুষের নিজের স্বরূপে প্রতিষ্ঠা।

এই হানের একমাত্র উপায় হলো অবিচ্ছিন্ন বিবেকজ্ঞান—দ্রষ্টা ও দৃশ্যের পার্থক্য সম্পর্কে নিরবচ্ছিন্ন উপলব্ধি। পতঞ্জলি বলেন, বিবেকখ্যাতি (২.২৬) একনিষ্ঠ হলে অবিদ্যা সম্পূর্ণ কেটে যায়।

এই বিবেকখ্যাতি সাতটি ধাপে ক্রমবর্ধমান হয় (২.২৭)। প্রতিটি ধাপে যোগীর চিত্ত আরও সূক্ষ্ম, স্থির ও স্বচ্ছ হয়ে ওঠে, এবং শেষ পর্যন্ত গুণত্রয়ের প্রভাব লয়প্রাপ্ত হয়। তখন পুরুষ বা চেতনা নিজের স্বরূপে স্থিত থাকে—অচল, অদ্বিতীয় ও স্বাধীন। এই স্বাতন্ত্র্যই কৈবল্য—যোগদর্শনের পরম পুরুষার্থ।

যোগসূত্রে বলা হয়েছে—“তস্য সপ্তধা প্রজ্ঞা।” অর্থাৎ, যার মধ্যে একনিষ্ঠ বিবেকজ্ঞান জেগে উঠেছে, তার প্রজ্ঞা বা জ্ঞান সাত ধাপে বিকশিত হয়। এই সাতটি ধাপকে বলা হয় “সপ্ত প্রজ্ঞা-ভূমি।”

প্রথম ধাপ—তত্ত্বজ্ঞা। এখানে যোগী স্পষ্টভাবে বুঝতে শুরু করে যে, জগৎ প্রকৃতি, আর আত্মা বা পুরুষ চিরচেতনা। সে উপলব্ধি করে—“আমি দ্রষ্টা, আমি চেতনা; যা দেখি, তা গুণময় প্রকৃতি।”

দ্বিতীয় ধাপ—অনারম্ভজ্ঞা। এই স্তরে জ্ঞান স্থির হয়। যোগী আর নতুন ভোগ বা নতুন কর্ম শুরু করে না। তার মধ্যে আর কোনো ফললিপ্সা বা কর্তা-ভাব থাকে না।

তৃতীয় ধাপ—উপশমজ্ঞা। এখানে রাগ, দ্বেষ, আসক্তি, ভয় প্রভৃতি ক্লেশ প্রশমিত হয়। চিত্ত শান্ত, প্রশান্ত ও স্থিতিশীল হয়ে ওঠে।

চতুর্থ ধাপ—অশরীরজ্ঞা। এই অবস্থায় যোগী শরীরবোধ থেকে মুক্ত হয়। সে বুঝতে পারে—“আমি দেহ নই, আমি চেতনা মাত্র।” শরীর, ইন্দ্রিয় ও মন কেবল উপাধি বলে প্রতীয়মান হয়।

পঞ্চম ধাপ—তদ্বিপাকজ্ঞা। পুরনো সংস্কার ও কর্মবীজ সম্পূর্ণ দগ্ধ হয়ে যায়। অতীতের প্রভাব আর ফল দেয় না। যোগী কর্মফলচক্র থেকে মুক্ত হয়।

ষষ্ঠ ধাপ—গুণবৈতৃণ্যজ্ঞা। এই স্তরে যোগী সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—এই তিন গুণের প্রভাব সম্পূর্ণ অতিক্রম করে। প্রকৃতির কোনো গতিবিধি আর তাকে স্পর্শ করতে পারে না।

সপ্তম ধাপ—কৈবল্যজ্ঞা। এটি চূড়ান্ত স্তর। এখানে পুরুষ নিজের স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকৃতি প্রতিপ্রসব করে—নিজের উৎসে লীন হয়। সব উপাধি ও বিভ্রম বিলীন হয়ে যায়। যোগী একমাত্র নিজের চেতনার আলোয় স্থিত থাকে—এই অবস্থাই কৈবল্য।

এই সাত ধাপ যোগীর অন্তর্জাগরণের পূর্ণ ক্রম। প্রথম ধাপে জ্ঞান জাগে, শেষ ধাপে সেই জ্ঞান স্বরূপে স্থিত হয়। এভাবেই অজ্ঞান থেকে জ্ঞান, জ্ঞান থেকে স্থিতি, স্থিতি থেকে মুক্তিতে পৌঁছানোই যোগদর্শনের লক্ষ্য—কৈবল্য।

বিবেকখ্যাতি মানে যোগসূত্রে বর্ণিত সেই স্থায়ী, অবিচ্ছিন্ন ও নির্ভুল পার্থক্যবোধ, যেখানে যোগী স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করে—দ্রষ্টা (পুরুষ) এবং দৃশ্য (প্রকৃতি বা চিত্তের সব বৃত্তি) এক নয়।

পতঞ্জলি বলেন—“বিবেকখ্যাতির অবিপ্লবা হানোপায়ঃ।” অর্থাৎ যে বিবেকপ্রজ্ঞা কখনও বিচলিত হয় না, সেটিই দুঃখ দূর করার একমাত্র উপায় (যোগসূত্র ২.২৬)। এই প্রজ্ঞা সাত ধাপে বিকশিত হয় (২.২৭), এবং এর পরিণতি ধর্মমেঘ-সমাধি হয়ে কৈবল্যে পৌঁছায় (৪.২৯–৪.৩৪)।

বিবেকখ্যাতি কেবল বুদ্ধির বিশ্লেষণ বা চিন্তাশক্তি নয়। এটি ধ্যান ও সমাধির গভীরে প্রতিষ্ঠিত এমন এক অন্তর্দৃষ্টি, যা কখনও ভঙ্গ হয় না। প্রতিক্ষণে যোগী স্পষ্ট দেখতে থাকে—যা পরিবর্তনশীল, গুণত্রয়-নির্মিত এবং দেখা যায়, তা দৃশ্য; আর আমি সেই দ্রষ্টা, অপরিবর্তনীয় চেতনা।

এই স্থায়ী ভেদজ্ঞানই সমস্ত ক্লেশ, কর্ম ও সংস্কারকে নিস্তেজ করে দেয়। রাগ, দ্বেষ ও অবিদ্যা ধীরে ধীরে বিলীন হয়। মন ক্রমে স্বচ্ছ হয়, আসক্তি ঝরে পড়ে।

বিবেকখ্যাতির পরিণতি হলো গুণত্রয়ের প্রতিপ্রসব—অর্থাৎ গুণরা তাদের উৎসে ফিরে যায়। প্রকৃতির কার্যক্ষমতা শেষ হয়। তখন পুরুষ নিজের স্বরূপে স্থিত থাকে, চিরস্বাধীন ও অচল।

যোগসূত্রের ধারাবাহিক ব্যাখ্যায় দেখা যায়—দুঃখের কারণ সংযোগ (২.১৭), তার মূল অবিদ্যা (২.২৪), আর অবিদ্যা নাশের উপায় অবিচ্ছিন্ন বিবেকজ্ঞান (২.২৬)। এই জ্ঞানের পূর্ণতা ঘটলে হান—অর্থাৎ সংযোগের অপসারণ—ঘটে, এবং তার পরিণতি কৈবল্য (৪.৩৪)।

সংক্ষেপে, বিবেকখ্যাতি হলো যোগীর সেই অন্তর্জাগরণ, যেখানে “আমি ও দৃশ্য” এই ভেদবোধ আর কখনও মিশে যায় না। এই অবিচল জ্ঞানই ক্লেশ, কর্ম, সংস্কার ও গুণত্রয়ের প্রভাব লোপ করে পুরুষকে তার নিজের চিরমুক্ত স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত করে।

অর্জনের পথ হলো ক্রিয়া-যোগ ও অষ্টাঙ্গ-সাধনা। পতঞ্জলি বলেন—তপঃ, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বর-প্রণিধান (যোগসূত্র ২.১), এই তিন অনুশীলন মিলেই ক্রিয়া-যোগ, যা চিত্তের ক্লেশ দূর করে ও সমাধির প্রস্তুতি ঘটায় (২.২)। এরপর আসে অষ্টাঙ্গ-যোগ—যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি (২.২৯)। এই আটটি অঙ্গের নিয়মিত চর্চা চিত্তকে নির্মল ও স্থিত করে, ফলে বিবেকখ্যাতির আলো জ্বলে ওঠে।

যে-যোগী এই সাধনায় স্থির থাকে, তার মধ্যে অবিচ্ছিন্ন বিবেক-প্রকাশ জন্মায়। মন ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হয়, গুণবিকার প্রশমিত হয়, আর দ্রষ্টা ও দৃশ্যের পার্থক্য স্থায়ীভাবে অনুভূত হয়।

বিবেকখ্যাতির লক্ষণও পতঞ্জলি স্পষ্ট করেছেন। ভবিষ্যৎ দুঃখের প্রবাহ বন্ধ হয় (২.১৬)। বস্তু, ভোগ ও কর্মফলের প্রতি আসক্তি ক্ষীণ হতে থাকে। সমতা, করুণা, শান্তি ও স্বচ্ছতা ক্রমে বৃদ্ধি পায়।