“নিরস্বভাবতা/নিঃস্বভাবতা-দর্শন” (Nairātmya-darśana / Niḥsvabhāvatā-darśana) মহাযান বৌদ্ধদর্শনের এক কেন্দ্রীয় ধারণা—বিশেষত নাগার্জুনের মধ্যমক (Madhyamaka) শাখায়। এটি বোঝায় এমন এক অন্তর্দৃষ্টি বা উপলব্ধিকে, যেখানে দেখা যায় যে, সমস্ত কিছুই নিরস্বভাব (Niḥsvabhāva)—অর্থাৎ কোনো কিছুরই নিজস্ব, স্বাধীন, চিরন্তন সত্তা বা স্বরূপ নেই।
“নির” মানে “বর্জিত”, “বিহীন”, “স্বভাব” মানে “নিজস্ব প্রকৃতি”, “অন্তর্নিহিত অস্তিত্ব”, “দর্শন” মানে “দেখা”, “উপলব্ধি”, “জ্ঞান”; তাই নিরস্বভাবতা/নিঃস্বভাবতা-দর্শন মানে—“সকল বস্তুর নিজস্ব স্বভাব বা স্বাধীন অস্তিত্ব নেই”—এই সত্যের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি। বৌদ্ধ দর্শনের মূল সূত্র হলো প্রতীত্যসমুৎপাদ (pratītya-samutpāda)—অর্থাৎ, “যা-কিছু আছে, তা পরস্পরনির্ভরভাবে উদিত।” কিছুই একা, স্বাধীনভাবে, নিজের জোরে অস্তিত্বে আসে না। প্রতিটি বস্তুর অস্তিত্ব অন্য কিছুর উপর নির্ভর করে—এ যেন প্রভাবের এক অনন্ত জাল।
এ থেকে নাগার্জুন উপসংহারে পৌঁছান যে—“যা পরনির্ভর, তা নিজের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়। যা নিজের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়, তা নিরস্বভাব।” নিরস্বভাবতা/নিঃস্বভাবতা মানে কোনো জিনিসের নিজস্ব ও অপরিবর্তনীয় সত্তা না থাকা। এটি তিন স্তরে ব্যাখ্যা করা হয়—
পদার্থতাত্ত্বিকভাবে: কোনো বস্তুরই চিরস্থায়ী “সত্তা” নেই—সবই পরিবর্তনশীল ও সম্পর্কনির্ভর।
মনস্তাত্ত্বিকভাবে: কোনো “আমি” বা “আত্মা” স্বাধীনভাবে বিদ্যমান নয়—মনও পরনির্ভর প্রক্রিয়া।
অধিবিদ্যাগতভাবে: “অস্তিত্ব” ও “অনস্তিত্ব”-এর দ্বন্দ্বই ভুল দৃষ্টিভঙ্গি—বাস্তবতা এই দ্বৈততার বাইরে।
নাগার্জুনের দৃষ্টিতে নিরস্বভাবতা/নিঃস্বভাবতা: “যা প্রতীত্যসমুৎপাদ (পরনির্ভর উৎপত্তি), তাকেই আমরা “শূন্যতা” বলি।” (Mūlamadhyamakakārikā, ২৪.১৮) অর্থাৎ, শূন্যতা মানে কোনো কিছু না থাকা নয়, বরং সব কিছু অন্যের দ্বারা নির্ধারিত হওয়া—এবং সেইজন্য, “নিজস্বভাবে কিছুই থাকা সম্ভব নয়”—এই উপলব্ধিই নিরস্বভাবতা/নিঃস্বভাবতা-দর্শন।
নিরস্বভাবতা/নিঃস্বভাবতা-দর্শনের ফল: যখন কেউ প্রত্যক্ষভাবে দেখে যে, সব কিছুই সম্পর্কনির্ভর, অনিত্য, অনাত্মা—তখন অহংকার, আসক্তি, ভয়, রাগ ইত্যাদি বিলীন হয়ে যায়। কারণ এগুলোর মূলে ছিল “আমি” ও “আমার” ধারণা। এই উপলব্ধিই হলো প্রজ্ঞা (prajñā)—যা বৌদ্ধমতে মুক্তির মূল। তখন সাধক আর কিছু আঁকড়ে থাকে না—মন স্বয়ংক্রিয়ভাবে শান্ত, মুক্ত ও নিস্তরঙ্গ হয়। এ অবস্থাই নির্বাণ/নিব্বান।
অদ্বৈত বেদান্তের সঙ্গে তুলনা: অদ্বৈতে “স্বভাব” বা “সত্তা”-র ধারণা ব্রহ্মে একীভূত—সবই ব্রহ্মস্বরূপ। কিন্তু মধ্যমকে বলা হয়, কিছুই নিজের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়—সবই শূন্য। ফলে বেদান্তে “সব এক”, মধ্যমকে “কোনো কিছুর নিজস্ব সত্তা নেই”—তবে উভয়ের লক্ষ্য একই—অহংবোধের লয় ও পরম মুক্তি।
নিরস্বভাবতা/নিঃস্বভাবতা-দর্শন হলো এমন জাগরণ, যেখানে দেখা যায়—“কিছুই নিজের দ্বারা স্থায়ী নয়, সবই সম্পর্কনির্ভর, ক্ষণিক ও শূন্য।” এই উপলব্ধি মনের আসক্তি ভেঙে দেয়, অহংকারকে বিলীন করে, এবং চেতনা পৌঁছে যায় নির্বাণের প্রশান্তিতে।
“নিরস্বভাবতা/নিঃস্বভাবতা-দর্শন” (শূন্যতার প্রত্যক্ষ উপলব্ধি) ও “নির্বাণ” (দুঃখ-তৃষ্ণা-অভাসের সম্পূর্ণ নিবারণ)—এই দুইয়ের অন্তর্গত ঐক্য নিয়ে বলা যাক। এরা আপাতভাবে দুটি আলাদা ধারণা মনে হলেও, বৌদ্ধ-তত্ত্বে এরা একে অপরের কারণ ও ফল, দেখা ও দেখা-ফল, জ্ঞান ও মুক্তি।
“দেখা” ও “অবসান”: নিরস্বভাবতা/নিঃস্বভাবতা-দর্শন মানে হলো এমন এক অন্তর্দৃষ্টি, যেখানে দেখা যায়—সব কিছুই নির্ভরশীল, অনিত্য, অনাত্মা, এবং কোনো কিছুরই নিজস্ব স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। আর নির্বাণ হলো সেই দর্শনের মনস্তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক পরিণতি—যখন এই উপলব্ধি সম্পূর্ণ হয়, তখন মনের সব আসক্তি, তৃষ্ণা, ভয় ও দ্বন্দ্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিঃশেষ হয়। অর্থাৎ—নিরস্বভাবতা/নিঃস্বভাবতা দেখা হচ্ছে নির্বাণ অর্জন। দর্শনই মুক্তি; জ্ঞানই নিবৃত্তি।
নাগার্জুন লিখছেন—”যে প্রতীত্যসমুৎপাদ (পরনির্ভর উৎপত্তি), তাকেই আমরা শূন্যতা বলি; এবং এই শূন্যতার বোঝাপড়াই মধ্যম পথ।” (Mūlamadhyamakakārikā, ২৪.১৮) যে-মুহূর্তে আমরা দেখতে পাই—সব কিছু পরনির্ভর, তাই কিছুই নিজে থেকে “অস্তিত্বশীল” নয়, সেই মুহূর্তেই “অস্তিত্ব” ও “অনস্তিত্ব”–এর দ্বন্দ্ব শেষ হয়ে যায়। এই অবস্থা-ই নির্বাণ, যেখানে মন আর কিছু আঁকড়ে থাকে না।
“দর্শন” ও “অভিজ্ঞতা”-র দ্বৈততার বিলুপ্তি: প্রাত্যহিক জীবনে “দেখা” ও “দেখা-বস্তু” আলাদা; কিন্তু নিরস্বভাবতা/নিঃস্বভাবতা-দর্শনের সময় এই দ্বৈততা মুছে যায়। যখন দেখা যায় যে, “দেখা”-র ক্রিয়াটাও অনিত্য ও নিরস্বভাব, তখন “দর্শক”, “দৃষ্ট” ও “দর্শন”—তিনেরই ভেদ বিলীন হয়। এই অবস্থায় যা থাকে, সেটিই নির্বাণ—অচঞ্চল, নিরুপাধিক, শান্ত, অনাসক্ত চৈতন্য। এখানে আর “আমি” কেউ নেই, যে “শূন্যতা” দেখছে; শূন্যতা নিজেই তখন “দর্শন” হয়ে ওঠে। এই অদ্বৈত অভিজ্ঞতাই বুদ্ধের চূড়ান্ত মুক্তি-জ্ঞান।
মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা: নিরস্বভাবতা/নিঃস্বভাবতা-দর্শন হলো চেতনার গভীর পর্যবেক্ষণ, যেখানে মন নিজেকে ও সমস্ত বস্তুকে—নাম, রূপ, চিন্তা, অনুভূতি—এক এক করে পর্যবেক্ষণ করে এবং দেখে যে, সবই পরিবর্তনশীল ও নির্ভরশীল। যখন মন এই পরিবর্তনশীলতার ধারাকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করে, তখন কোনো কিছুর উপর নির্ভর করার প্রয়োজন থাকে না। এই মুহূর্তেই মন নির্ভরহীন (asaṅkhata) হয়ে যায়—এটাই নির্বাণ। অর্থাৎ, নিরস্বভাবতা/নিঃস্বভাবতা-দর্শন মানসিক কাঠামো ভেঙে দেয়, আর নির্বাণ হলো সেই কাঠামোভঙ্গের পরিণত শান্তি।
অভিজ্ঞতার দৃষ্টিতে: যখন দেখা যায়—“কিছুই নিজে থেকে অস্তিত্বশীল নয়, সবই সম্পর্কনির্ভর, ক্ষণিক ও শূন্য”, তখন মন থেকে মুছে যায়—“আমি আছি”, “আমার আছে”, “আমাকে পেতে হবে”—এই সমস্ত ধারণা। এর সঙ্গে সঙ্গে তৃষ্ণা, রাগ, মোহ—এই মানসিক বিকারও নিঃশেষ হয়। এই অন্তর্গত প্রশান্তিই নির্বাণের স্বরূপ। অর্থাৎ, শূন্যতার বোধ—অহংবোধের অবসান—নির্বাণ।
মধ্যমক ও যোগাচার-এর মিলন: মধ্যমক বলে, সব কিছু স্বভাবশূন্য—জ্ঞানই মুক্তি। যোগাচার বলে, মনই সব কিছু; যখন মন নিজ স্বরূপে বিশুদ্ধ হয়, তখন নির্বাণ। উভয়ের মূলকথাই এক—“যখন মন নিজস্বতা হারায়, তখন সে অনন্ত শূন্যতায় পরিণত হয়, আর সেই শূন্যতাই পরম শান্তি।”
অদ্বৈত বেদান্তের সাথে তুলনা: অদ্বৈতে “আত্মব্রহ্ম” অভিজ্ঞতা ও বৌদ্ধ “নিরস্বভাবতা/নিঃস্বভাবতা-দর্শন” একই রকম অভ্যন্তরীণ স্তব্ধতা নির্দেশ করে। বেদান্ত বলে—“যা অবশিষ্ট থাকে, তা ব্রহ্ম—চিরচৈতন্য।” মধ্যমক বলে—“যা অবশিষ্ট থাকে, তা শূন্যতা—নিরন্বয়।” একজন বলে—“সবই এক”, অন্যজন বলে—“কিছুরই স্বত্ব নেই”, কিন্তু উভয়েই নির্দেশ করে সেই অদ্বৈত অভিজ্ঞতাকে, যেখানে জানা ও জানার প্রক্রিয়া এক হয়ে যায়।
নিরস্বভাবতা/নিঃস্বভাবতা-দর্শন হলো সত্যকে দেখা—“কিছুই নিজের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়।” নির্বাণ হলো সেই দর্শনের ফল—“যখন আর কোনো আঁকড়ে ধরা নেই।” দর্শনই মুক্তি, দেখা-ই নিভৃতির সূচনা, আর নিভৃতি-ই দেখা—জ্ঞান—চেতনা-র পরম প্রশান্ত ঐক্য।
নির্বাণ (Nirvāṇa)—দুঃখ ও তৃষ্ণার নিঃশেষ; শূন্যতা (Śūnyatā)—সমস্ত বস্তুর স্বভাবশূন্যতা। থেরবাদে, নির্বাণ হলো শান্ত বাস্তবতা। মধ্যমকে, নির্বাণ হলো শূন্যতার জাগরণ। ফলে, নির্বাণ কোনো স্থান বা অবস্থা নয়, বরং অজ্ঞানের পর্দা সরলে যা থাকে—সেই “শূন্যতাই নির্বাণ”।
“নিব্বানায় ধাতু” বৌদ্ধ-চিন্তায় চেতনার চূড়ান্ত রূপান্তর নির্দেশ করে। এটি কোনো ‘শূন্যতা’র অর্থে শূন্য নয়, বরং এমন এক অচঞ্চল প্রশান্ত অবস্থা, যেখানে দ্বন্দ্ব, আসক্তি ও জন্মের শর্তগুলি আর কার্যকর নয়। এ কারণেই বুদ্ধ বলেন—“নিব্বানম পরমং সুখং”—“নিব্বানই সর্বোচ্চ শান্তি।” নিব্বানায় ধাতু—মানে নির্বাণের প্রকৃতি বা অবস্থা। এর দুই রূপ—সোপাধিশেষ নিব্বানধাতু—জীবিত অবস্থায় মুক্তি (অরহত্ত্ব/জীবন্মুক্তি); অনুপাধিশেষ নিব্বানধাতু—মৃত্যুর পর সম্পূর্ণ মুক্তি (সম্পূর্ণ নিব্বান/বিদেহমুক্তি)। প্রথমটি চেতনার পরিশুদ্ধি, দ্বিতীয়টি অস্তিত্বের নিঃশেষ প্রশান্তি।
নিরোধ বনাম দমন: দমন (Damana) শব্দের অর্থ হলো “চেপে রাখা” বা “জোর করে দমিয়ে রাখা”। এটি একধরনের মানসিক প্রয়োগ, যেখানে চিন্তা, বাসনা বা আবেগকে বলপূর্বক থামানোর চেষ্টা করা হয়। দমনে মনকে জোর করে নিস্তব্ধ করতে হয়—ফলে ভেতরে চাপ, অস্থিরতা বা দমনকৃত ইচ্ছার প্রতিক্রিয়া থেকে যায়। এটি এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক দমন (repression)—যেখানে চেতনার নিচে ইচ্ছা বা চিন্তার সঞ্চয় থাকে, এবং পরে সুযোগ পেলে সেগুলি আবার প্রকাশ পায়।
অন্যদিকে, নিরোধ (Nirodha) হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রক্রিয়া। এখানে মনকে জোর করে থামানো হয় না, বরং মন নিজে থেকেই থেমে যায়, যখন জ্ঞান ও সচেতনতা গভীর হয়। যখন দেখার মধ্যে কোনো “দেখনেওয়ালা” থাকে না, যখন পর্যবেক্ষক ও পর্যবেক্ষণের মধ্যে ফাঁক বিলীন হয়—তখন মন স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিস্তরঙ্গ হয়ে যায়। এই অবস্থাতেই নিরোধ ঘটে—যেখানে কোনো অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ বা দমন নেই, আছে কেবল প্রশান্ত সচেতনতা।
দমনে আছে জোর, ভয়, প্রত্যাখ্যান; নিরোধে আছে মুক্তি, স্বাভাবিকতা ও আত্মপ্রকাশ।
দমন মনকে ভারী করে; নিরোধ মনকে বিলীন করে আত্মায় স্থিত করে।
দমন মানে চিন্তা বা ইচ্ছাকে জোর করে চেপে রাখা, আর নিরোধ মানে সেই অবস্থায় পৌঁছানো, যেখানে চিন্তা বা ইচ্ছা নিজের থেকেই নিঃশেষ হয়।
দমন হলো মানসিক প্রতিরোধ, নিরোধ হলো আত্মিক প্রশান্তি।
নিরোধের অবস্থা: যখন মন সম্পূর্ণ শান্ত, তখন—কোনো চিন্তা নেই, কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই, কোনো ভয় নেই, কোনো অহং নেই। তখন যা থাকে, তা হলো নির্মল সচেতনতা, যা স্বয়ংপ্রকাশমান—আত্মা বা ব্রহ্ম। এ অবস্থায়—জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয়—এই তিনের ভেদ মুছে যায়; কেবল “চৈতন্যমাত্রা” অবস্থান করে।
উপনিষদীয় সমর্থন: মনঃ-নিরোধ সম্পর্কিত মন্ত্র—“যেখান থেকে বাক্য ও মন ফিরে আসে, কারণ তাকে তারা স্পর্শ করতে পারে না—সেই চিরন্তন আত্মাই পরমসত্য।” (তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ২.৪.১) এখানেই নিরোধের শেষফল—মন থেমে যায়, বাক্য নিস্তব্ধ হয়, এবং কেবল আত্মা অবশিষ্ট থাকে।
নিরোধ মানে চিত্তবৃত্তির সম্পূর্ণ অবসান—চিন্তা, কামনা, প্রতিক্রিয়া, ইচ্ছা—সব নিস্তরঙ্গ হয়ে যায়। যোগে এটি “যোগের সংজ্ঞা”, বৌদ্ধধর্মে এটি “নির্বাণ/নিব্বান”, বেদান্তে এটি “আত্ম-স্থিতি” বা “ব্রহ্মসাক্ষাৎ”।
নাগার্জুন বলেন, “বুদ্ধের শিক্ষা কোনো মতবাদ নয়; তিনি শুধু চিন্তার নিস্তব্ধতা শেখান।” অর্থাৎ, সত্য উপলব্ধ হয়, যখন বোধ থেমে যায়।
তুলনামূলক বিশ্লেষণ: অদ্বৈত ও মাধ্যমক—উভয়েই জ্ঞানের সীমা স্বীকার করে, কিন্তু তাদের নীরবতার প্রকৃতি ভিন্ন দিক নির্দেশ করে। অদ্বৈতের নীরবতা হলো পূর্ণতার নীরবতা—চেতনা—সব শব্দকে অতিক্রম করে নিজের আলোয় স্থিত। মাধ্যমকের নীরবতা হলো শূন্যতার নীরবতা—সব ধারণা ও পার্থক্য লুপ্ত হয়ে যায়, কোনো “অস্তিত্ব” বা “অভিজ্ঞতা” অবশিষ্ট থাকে না। অদ্বৈতে নীরবতা মানে আত্ম-উন্মোচন; মাধ্যমকে নীরবতা মানে আত্ম-অপসারণ। তবু উভয়েই দেখায়—ভাষা ও যুক্তি কেবল প্রস্তুতি; সত্যের বোধ ঘটে তখনই, যখন বোধ নিজেই বিলুপ্ত হয়ে যায়।
শঙ্কর ও নাগার্জুন, দুই ভিন্ন পথের পথিক, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক জায়গায় এসে পৌঁছান—“সত্য বলা যায় না, কেবল উপলব্ধ হয়।” অদ্বৈত বলে, সেই উপলব্ধি হলো ব্রহ্মস্বরূপ চেতনার নিজস্ব দীপ্তি। মাধ্যমক বলে, সেই উপলব্ধি হলো সমস্ত দ্বন্দ্বের শূন্যতায় নিস্তরঙ্গ স্থিতি। একজন নীরবতাকে পূর্ণতার ভাষা বলে, অন্যজন নীরবতাকে ভাষাহীনতার পূর্ণতা বলে। দু-জনেই মানুষকে শেখান—সত্য কোনো ধারণা নয়, কোনো বাক্য নয়; এটি চেতনার নিঃশব্দ জাগরণ, যেখানে বলা, ভাবা বা জানা—সব থেমে যায়, আর অবশিষ্ট থাকে কেবল তা-ই, যা—অদ্বৈতের ভাষায় ব্রহ্ম, মাধ্যমকের ভাষায় শূন্যতা।
ব্রহ্ম ও শূন্যতার মিলনবিন্দু—অদ্বৈত ও মাধ্যমকের অন্তর্লীন সাযুজ্য—চূড়ান্ত সংলগ্নতা:
যদিও অদ্বৈত বেদান্ত ও মাধ্যমক ইতিহাসে একে অপরের বিপরীত মতবাদ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে, তবু গভীর দার্শনিক বিশ্লেষণে দেখা যায়—তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য, দৃষ্টিপথ ও অন্তর্লীন সত্যে এক বিস্ময়কর সাযুজ্য রয়েছে।