অবিদ্যা-তত্ত্ব-দীপিকা: উনচল্লিশ



গৌড়ীয় বৈষ্ণবের অচিন্ত্য ভেদাভেদ: গৌড়ীয় বৈষ্ণব (চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রচারিত) এক ভিন্ন অবস্থান নেয়। একদিকে তাঁরা মানেন যে, জগৎ ও ভগবান (কৃষ্ণ) আলাদা। অন্যদিকে তাঁরা মানেন, জগৎ ও ভগবান অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্তও। এই দুই বিপরীত অবস্থাকে বোঝাতে তাঁরা বলেন “অচিন্ত্য ভেদাভেদ”—অর্থাৎ, সম্পর্কটি অচিন্ত্য (বুদ্ধি দিয়ে পুরোপুরি ধরা যায় না), তবে সত্য। উদাহরণ দিই। সমুদ্র আর তার ঢেউ—ঢেউ সমুদ্র থেকে আলাদা মনে হয়, কিন্তু আসলে সমুদ্রই তার রূপ। ঢেউ-সমুদ্র সম্পর্ক যেমন, কৃষ্ণ আর তাঁর শক্তি (জগৎ, ভক্ত, প্রকৃতি)—এমনই—একসাথে ভিন্নও, অভিন্নও।

অদ্বৈত: জগৎ অনির্বচনীয়, চূড়ান্ত সত্য শুধু ব্রহ্ম। ভেদাভেদ: জগৎ বাস্তব, তবে ব্রহ্মের উপর নির্ভরশীল। অচিন্ত্য ভেদাভেদ: জগৎ ও ভগবান একই সাথে অভিন্ন ও ভিন্ন, যা মানববুদ্ধি দিয়ে সম্পূর্ণরূপে বোঝা যায় না। সহজ ভাষায়—অদ্বৈত: “স্বপ্নের মতো—শেষে জগৎ নেই, শুধু ব্রহ্ম আছে।” ভেদাভেদ: “সূর্য আর রশ্মির মতো—জগৎও সত্য, তবে সর্বদা ব্রহ্মের সাথে যুক্ত।” অচিন্ত্য ভেদাভেদ: “ঢেউ আর সমুদ্রের মতো—জগৎ আর ভগবান একসাথে ভিন্নও, অভিন্নও।”

অদ্বৈত থেকে অন্যান্য মতের মৌলিক পার্থক্য বহুবিধ। যেমন—

১. জগতের বাস্তবতা: অদ্বৈত বলে, জগৎ শেষপর্যন্ত মিথ্যা (mithyā)। যেমন স্বপ্নে সব কিছু সত্য মনে হলেও ঘুম ভাঙলে আর থাকে না। অচিন্ত্য ভেদাভেদ বলে, জগৎ বাস্তব, তবে অস্থায়ী। যেমন ঢেউ আসলেই আছে, কিন্তু ক্ষণস্থায়ী; তবু তাকে বিভ্রম বলা যায় না।

২. ঈশ্বরের প্রকৃতি: অদ্বৈত বলে, ঈশ্বর মানে ব্রহ্ম—ব্যক্তিসত্তাহীন, গুণবিহীন, রূপহীন। যেমন আকাশ—কোনো রং বা আকার নেই, কেবল সর্বব্যাপী। অচিন্ত্য ভেদাভেদ বলে, ঈশ্বর কৃষ্ণ—শাশ্বত রূপ, সৌন্দর্য, গুণ, প্রেমসহ। যেমন সূর্য শুধু আলো নয়, সৌন্দর্য ও শক্তি ছড়ায়।

৩. আত্মার প্রকৃতি: অদ্বৈত বলে, জীবের আলাদা কোনো সত্তা নেই। দড়ির সাপের মতো—আসলে সবই ব্রহ্ম। অচিন্ত্য ভেদাভেদ বলে, আত্মা ঈশ্বরের অংশবিশেষ—গুণে একই (যেমন সূর্যের আলো), কিন্তু পরিমাণে সীমিত; তাই আত্মা চিরকাল ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল।

৪. মুক্তির পথ: অদ্বৈত বলে, মুক্তি কেবল জ্ঞান দ্বারা। বুঝতে হবে—“আমি ব্রহ্ম।” অচিন্ত্য ভেদাভেদ বলে, মুক্তি আসে কেবল ভক্তি দ্বারা। কৃষ্ণের প্রতি প্রেমময় ভক্তিই একমাত্র মুক্তির পথ।

৫. মূল দার্শনিক উপকরণ: অদ্বৈতের বেলায়—অনির্বচনীয়তা (anirvacanīya)—জগৎকে পুরোপুরি সত্যও বলা যায় না, মিথ্যাও বলা যায় না। অচিন্ত্য ভেদাভেদের বেলায়—অচিন্ত্য (achintya)—ঈশ্বর ও জগত একই সাথে অভিন্নও, ভিন্নও—এমনভাবে, যা মানববুদ্ধি দিয়ে সম্পূর্ণ ধরা যায় না।

অদ্বৈত বলে, জগৎ স্বপ্নের মতো—শেষে জেগে ওঠলে (জ্ঞান হলে) সব বিলীন, কেবল ব্রহ্ম থাকে। অচিন্ত্য ভেদাভেদ বলে, জগৎ ও ঈশ্বর ঢেউ ও সমুদ্রের মতো—ঢেউ সত্যিই আছে, তবে সমুদ্র ছাড়া নেই; আর সমুদ্র-ঢেউয়ের সম্পর্ক চিরন্তন, প্রেমময়। অদ্বৈত প্রচার করে, জ্ঞানই মুক্তি, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। অচিন্ত্য ভেদাভেদ প্রচার করে, ভক্তিই মুক্তি, ঈশ্বর ও জগত দুটোই বাস্তব, চিরন্তন সম্পর্কের বন্ধনে যুক্ত।

ধরা যাক, তুমি রাতে স্বপ্ন দেখছ—নদী পার হচ্ছ, নৌকা আছে, বন্ধু আছে, ভয় আছে। ঘুম ভাঙতেই দেখলে—সব মিলিয়ে গেছে। বাস্তবে কিছুই ছিল না, শুধু তোমার চেতনা (ব্রহ্ম) ছিল। এটাই অদ্বৈতের দৃষ্টিভঙ্গি—জগৎ আমাদের চোখে সত্যি মনে হয়, কিন্তু চূড়ান্ত জ্ঞানের আলো জ্বললে (ব্রহ্ম-উপলব্ধি হলে) সব বিলীন হয়ে যায়, শুধু একটাই সত্য থাকে—ব্রহ্ম।

এবার ভাবো—একজন ভক্ত কৃষ্ণকে ভালোবাসে। সে মন্দিরে ফুল দেয়, গান গায়, কৃষ্ণের নাম জপ করে। এই প্রেম আসলেই বাস্তব। কৃষ্ণও আছেন, ভক্তও আছেন। তারা আলাদা, তবুও এক গভীর সম্পর্কের বাঁধনে যুক্ত—যেমন ঢেউ সমুদ্র থেকে আলাদা দেখায়, কিন্তু আসলে সমুদ্রই তার প্রাণ। তেমনি ভক্ত আর কৃষ্ণ—ভিন্নও, অভিন্নও। এ সম্পর্ককে অচিন্ত্য ভেদাভেদ বলা হয়।

অদ্বৈত বলে: “স্বপ্ন ভাঙলেই বোঝা যায়—সব মিথ্যা ছিল, শুধু ব্রহ্ম সত্য।” অচিন্ত্য ভেদাভেদ বলে: “প্রেমই মুক্তি। ভক্ত আর কৃষ্ণ আলাদা থেকেও এক, আর এই সম্পর্ক অচিন্ত্য, চিরন্তন।” তাই, অদ্বৈতের পথ হলো জ্ঞান (স্বপ্ন ভাঙা), আর অচিন্ত্য ভেদাভেদের পথ হলো ভক্তি (প্রেমে ডুবে থাকা)।

মীমাংসার কাজ ছিল বৈদিক পাঠ্যের ব্যাখ্যা করা। কখনো কখনো বেদে বিপরীত নির্দেশ পাওয়া যায়—যেমন অহিংসা নিষেধ, আবার যজ্ঞে পশুবলি অনুমোদন। এই দ্বন্দ্ব মেটাতে তিনটি উপায় ব্যবহার করা হয়—ষড়-লিঙ্গ: পাঠ্যের আসল তাৎপর্য খুঁজে বের করা। উৎসর্গ-অপবাদ নীতি: সাধারণ নিয়ম বিশেষ ব্যতিক্রম দিয়ে সংশোধিত করা। বিকল্প (Vikalpa): সমান শক্তিশালী দুটি নির্দেশ থাকলে যে-কোনো একটি পালন করা। কুমারিল ভট্ট বলেন: যজ্ঞে যে-হিংসা হয়, তা আসল উদ্দেশ্য নয়, বরং অনুষঙ্গ মাত্র। ফলে অহিংসা-নিষেধ ভাঙা হয় না, আর সব বৈদিক আদেশই বৈধ থাকে।

অদ্বৈত বেদান্ত মীমাংসার এই সরঞ্জামগুলো গ্রহণ করল, কিন্তু আচার-কেন্দ্রিকতা (কর্মকাণ্ড) থেকে মনোযোগ সরিয়ে দিল জ্ঞান-কেন্দ্রিকতায় (মুক্তিদায়ক জ্ঞান)। তারা বলল: শুধু আচার নয়, চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো আত্মা-ব্রহ্ম উপলব্ধি।

অদ্বৈতের দার্শনিক কাঠামোয় অভিজ্ঞতা তিন স্তরে বিভক্ত হয়:
১) প্রাত্যহিক সত্য (Vyāvahārika Satya): দৈনন্দিন জগৎ, লেনদেন, সমাজ।
২) প্রত্যক্ষ ভ্রম (Prātibhāsika Satya): মায়া বা বিভ্রমের সত্য (যেমন দড়িকে সাপ মনে হওয়া)।
৩) চূড়ান্ত সত্য (Pāramārthika Satya): কেবল ব্রহ্ম সত্য, একমাত্র অ-বাতিলযোগ্য।

এই স্তরবিন্যাসের কারণে দরকার হয় বাধ (Bādha)—যা দেখায়, জগত আপাত সত্য হলেও, ব্রহ্ম-জ্ঞান হলে তা বাতিল হয়ে যায়। যেমন আলো জ্বালালে সাপ-বিভ্রম মুছে গিয়ে দড়ি প্রকাশিত হয়।

উপলব্ধির ব্যাখ্যা (প্রত্যক্ষ জ্ঞান): অদ্বৈত উপলব্ধিকে শুধু ইন্দ্রিয়-সংযোগ নয়, বরং অন্তঃকরণবৃত্তির (মন/বুদ্ধির পরিবর্তন) মাধ্যমে বোঝা যায়। অন্তঃকরণ বস্তুর আকার ধারণ করে (যেমন মন কলসির আকার নেয়), আর আত্মার আলো সেই জ্ঞানকে আলোকিত করে। এতে প্রমাণিত হয়—চেতনা (আত্মা) কখনও বস্তুগত নয়, বরং সর্বদা শুদ্ধ ও অদ্বিতীয়।

সামগ্রিক দার্শনিক গতিপথ বিবেচনা করলে, মীমাংসা: আচারগত দ্বন্দ্ব নিরসন—ধর্ম ও কর্তব্যের বৈধতা রক্ষা করে। অদ্বৈত: জগতের দ্বন্দ্ব নিরসন—চূড়ান্ত সত্যের (ব্রহ্ম) উপলব্ধি দেয়। এভাবে, একই জ্ঞানতাত্ত্বিক সরঞ্জাম—যা আগে আচার রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল, অদ্বৈতে তা ব্যবহার করা হলো মুক্তির জন্য। মীমাংসা আর অদ্বৈত দুই-ই একই বৈদিক ভিত্তি থেকে শুরু হলেও—মীমাংসা গুরুত্ব দিল আচার ও কর্তব্যকে, অদ্বৈত গুরুত্ব দিল মুক্তিদায়ক জ্ঞানকে। এই রূপান্তর প্রমাণ করে, ভারতীয় দর্শন কেবল আচাররক্ষায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং ধীরে ধীরে সর্বোচ্চ সত্য ও মুক্তির সন্ধানে অগ্রসর হয়েছে।

সত্তাতত্ত্বের প্রশ্ন—কেন প্রপঞ্চকে প্রশ্ন করা হয়?

প্রাচীন ভারতীয় অধিবিদ্যায় প্রপঞ্চ ও তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মূল আলোচ্য বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম হলো জগতের বাস্তবতা। এখানে “প্রপঞ্চ” শব্দ দিয়ে বোঝানো হয় প্রকাশিত বিশ্ব—যা বহু রূপে, বহু বৈচিত্র্যে আমাদের সামনে উদ্‌ভাসিত। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই বিশ্ব আসলেই কি স্বতন্ত্রভাবে বাস্তব, না কি এটি কেবল একটি আপাত প্রকাশ?

দর্শনশাস্ত্র এখানে কোনো সাধারণ সংশয় বা সন্দেহ থেকে শুরু করে না। বরং এটি চূড়ান্ত সত্য (Paramārthika Satya) নির্ধারণের দায়বদ্ধতা থেকেই জগৎকে প্রশ্ন করে। এই দায়বদ্ধতা থেকেই প্রপঞ্চকে বলা হয় “বিবাদাস্পদী ভূতঃ”—অর্থাৎ এমন এক সত্তা, যা বিতর্কিত, যা নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ তর্ক-বিতর্ক করে।

সরল বাস্তবতাকে অস্বীকার: এই অবস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় কৌশল। সাধারণ বাস্তববাদ বলে—“যা চোখে দেখি, যা স্পর্শ করি, তা-ই বাস্তব।” কিন্তু ভারতীয় দার্শনিকরা শুরুতেই এই সরল সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেন। তাঁরা বলেন—জগৎ সত্যিই স্বাধীনভাবে আছে কি না, তা যুক্তি ও পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করতে হবে। এভাবে “বিবাদাস্পদী ভূতঃ” বলাটা কেবল শব্দচয়ন নয়; এটি দর্শনের জন্য অপরিহার্য একটি পদ্ধতিগত ধাপ।

অনুসন্ধানের গভীর উদ্দেশ্য: এই অনুসন্ধান কখনোই টেবিল-চেয়ার বা সাধারণ দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাকে মিথ্যা বলার জন্য নয়, বরং এর লক্ষ্য হলো: উপরিভাগের অভিজ্ঞতার বাইরে গিয়ে একটি গভীর সত্য খুঁজে পাওয়া। এখন প্রশ্ন হলো—এই জগতের যা-কিছু আলাদা ও স্বাধীন বলে মনে হয়, সেগুলি কি সত্যিই চূড়ান্ত পরীক্ষায় টিকে থাকে?

বাস্তবতার পুনর্বিবেচনা: এইভাবে প্রপঞ্চ নিয়ে বিতর্ক আসলে আমাদের বাধ্য করে বাস্তবতার সংজ্ঞাকে পুনর্বিবেচনা করতে। “বাস্তব” মানে কী? যা দেখা যায়, স্পর্শ করা যায়, তা-ই কি বাস্তব? না কি এমন একটি সত্য আছে, যা সকল অভিজ্ঞতার অতীত? এই প্রশ্নগুলো শুধু চিন্তার দিগন্তকে প্রসারিতই করে না, বরং জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সীমাকেও নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে।

সহজভাবে বলতে গেলে, ভারতীয় দর্শনে জগতকে শুরুতেই “প্রশ্নবিদ্ধ” বা বিতর্কযোগ্য করে তোলা হয়, যাতে আমরা সরলভাবে “যা দেখি, তা-ই সত্য” ফাঁদে না পড়ি, বরং গভীর সত্যের দিকে অগ্রসর হই।

এবার দেখি, বিভিন্ন দর্শন প্রপঞ্চ বা জগতের বাস্তবতা নিয়ে কী বলে।

অদ্বৈত বেদান্ত (শঙ্কর)
মূল অবস্থান: কেবল ব্রহ্মই সত্য; জগৎ মিথ্যা (mithyā)।
যুক্তি: জগৎ স্বপ্নের মতো—অভিজ্ঞতায় বাস্তব মনে হয়, কিন্তু চূড়ান্ত জ্ঞান হলে বিলীন হয়ে যায়।
দৃষ্টান্ত: দড়িকে সাপ মনে করার ভ্রম। সাপ নেই, কিন্তু অভিজ্ঞতা বাস্তব মনে হয়।

দ্বৈত বেদান্ত (মাধবাচার্য)
মূল অবস্থান: ঈশ্বর, আত্মা ও জগৎ—সবগুলো আলাদা, এবং সব বাস্তব।
যুক্তি: যদি জগৎ ভ্রম হতো, তাহলে পাপ-পুণ্য, মুক্তি, ভক্তি—কোনোটাই সম্ভব হতো না।
দৃষ্টান্ত: রাজা আর প্রজা আলাদা হলেও, দু-জনের বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না।

ভেদাভেদ বেদান্ত (ভল্লভ, নিম্বরক)
মূল অবস্থান: জগৎ বাস্তব, তবে ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল।
যুক্তি: সূর্য আর রশ্মির সম্পর্কের মতো—সূর্য ছাড়া রশ্মি নেই, তবুও রশ্মি সত্য।
দৃষ্টান্ত: ঈশ্বর হলো অগ্নি, জগৎ হলো অগ্নির উষ্ণতা।

শুদ্ধাদ্বৈত (ভল্লভ)
মূল অবস্থান: জগৎও ব্রহ্মেরই প্রকাশ, তাই মিথ্যা নয়।
যুক্তি: ব্রহ্ম যদি সত্য হয়, তার প্রকাশকেও মিথ্যা বলা যায় না।
দৃষ্টান্ত: সমুদ্রের ঢেউ সমুদ্র থেকেই—তাই ঢেউ-ও সত্য।

অচিন্ত্য ভেদাভেদ (চৈতন্য, গৌড়ীয় বৈষ্ণব)
মূল অবস্থান: ঈশ্বর ও জগৎ একই সাথে অভিন্নও, ভিন্নও—এই সম্পর্ক অচিন্ত্য।
যুক্তি: ঈশ্বর কৃষ্ণ চিরন্তন, জগৎও তাঁর শক্তি। ভক্তি ছাড়া মুক্তি নেই।
দৃষ্টান্ত: ঢেউ আর সমুদ্র—ঢেউ আলাদা মনে হয়, কিন্তু সমুদ্র ছাড়া কিছু নয়।

সারসংক্ষেপ—
অদ্বৈত: জগৎ অনির্বচনীয়, শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মই সত্য।
দ্বৈত: জগৎ, আত্মা, ঈশ্বর—সবই সত্য, সবই পৃথক।
ভেদাভেদ: জগৎ সত্য, কিন্তু ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল।
শুদ্ধাদ্বৈত: জগৎও ব্রহ্মের প্রকাশ, তাই সত্য।
অচিন্ত্য ভেদাভেদ: জগৎ ও ঈশ্বরের সম্পর্ক একই সাথে ভিন্ন ও অভিন্ন—যা চিন্তার অতীত।

বিবাদাস্পদী ভূতঃ-এর কৌশলগত ভূমিকা: প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে জগতকে “বিবাদাস্পদী ভূতঃ”—অর্থাৎ বিতর্কযোগ্য সত্তা—হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এটি কেবল শব্দের অলঙ্কার নয়, বরং এক গভীর কৌশল।

কেন এটিকে বিতর্কযোগ্য বলা হলো?
যদি জগৎকে শুরু থেকেই একটি স্বীকৃত সত্য ধরা হতো, তাহলে দর্শন কেবল এটিকে ব্যাখ্যা করার দায়িত্বেই সীমিত থাকত। কিন্তু “বিবাদাস্পদী ভূতঃ” বলার উদ্দেশ্য হলো—জগৎকে একেবারে শুরু থেকেই প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। এতে জগৎকে আর “অবিতর্কিত ভিত্তি” ধরে নেওয়া যায় না; বরং এটি নিয়ে কঠোর যুক্তি ও দ্বন্দ্ব (vāda)-এর মাধ্যমে প্রমাণ দিতে হবে।

প্রমাণের দায়ভার পরিবর্তন: সাধারণত বাস্তববাদীরা বলেন, “বিশ্ব তো আছেই, এখন তার প্রকৃতি বুঝতে হবে।” কিন্তু এখানে যুক্তি উলটো পথে যায়: যারা বলছে, জগৎ স্বাধীনভাবে বাস্তব, তারাই এটা প্রমাণ করবে। দর্শন নিজে আগে থেকে কোনো অনুমান ধরে নেয় না। এতে করে অদ্বৈত বেদান্তের মতো দর্শনগুলো একটি বিশেষ সুবিধা পায়—তারা চূড়ান্ত সত্য (ব্রহ্ম) প্রমাণে তাড়াহুড়ো করে না, বরং ধাপে ধাপে প্রচলিত প্রমাণগুলির (pramāṇa) সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে জগৎকে মিথ্যা (mithyā) বা অনির্বচনীয় হিসেবে চিহ্নিত করে।