অন্তর্মার্গ: ৯




কণ্ঠ ১ (কাঁপা কণ্ঠে, যেন গোপন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে): সব জেনেও মনে হয়—কিছু এখনও অজানা…এই ‘সব’-এর পেছনে কি লুকিয়ে আছে কিছু, যা বলা যায় না, শেখানো যায় না?
কণ্ঠ ২ (নিঃশব্দের স্বরবিন্দুতে ভেসে উঠে): হ্যাঁ, আছে। তুমি যা শোনো না, তুমি যা বলো না, তুমি যা ভাবাও না—তোমার অন্তঃস্থলে লুকিয়ে সে-ই ব্রহ্ম। এই উপদেশ বলে না—জাগিয়ে তোলে।
কণ্ঠ ১ (ধীরে ধীরে, হৃদয়ছোঁয়া আবেগে): তবে গুরু কি বলেন না কিছু? নির্দেশ দেন না কোনো সাধনার?
(কণ্ঠ ২): প্রকৃত গুরু মৌনী। তাঁর শিক্ষা শব্দে নয়—চেতনায়। তিনি বলেন না ‘এই করো’, ‘ওই কোরো না’—তিনি এই চেতনা জাগিয়ে তোলেন—"তুমি কে, তা মনে রাখো।"
কণ্ঠ ১ (বিস্ময়ে): তবে কি সব সাধনার বাইরে কিছু থাকে?
(কণ্ঠ ২): হ্যাঁ, সব সাধনার শেষে থাকে এক নীরব পর্বত, যার শিখরে পৌঁছোয় কেবল নিঃশব্দ চেতনা।

দু-জন একসাথে (রহস্যময় তালে, চেতনার স্পন্দনে—ধ্বনিহীন ছন্দে, ধ্যানমগ্ন বোধে): এই উপদেশ কেউ দেয় না—তবু সে পৌঁছে যায়, যখন তুমি নিজেকেই হারিয়ে ফেলো। গুরু, শিষ্য, শব্দ, জ্ঞান—সব ফেলে, যখন তুমি শুধু ‘আছ’, তখনই শোনা যায় সেই গূঢ় উপদেশ। কথা নয়, মন্ত্র নয়, ইঙ্গিতও নয়—গূঢ়তম জ্ঞান ওঠে নীরবতার পর্দা সরিয়ে। নেই তাতে প্রশ্ন, নেই উত্তরের ছায়া, আছে শুধু এক অভ্যন্তর অনুরণন—তুমি আছ…এই হওয়াটাই শিক্ষা।

কণ্ঠ ১ (চোখ মেলে তাকায় আকাশে): এই বিশ্বজোড়া রং… বাতাস, নদী, আগুন, মানুষ, প্রাণ—এ সবই কি আলাদা? না কি এরা এক আত্মারই ভিন্ন মুখ?
কণ্ঠ ২ (স্থির ও প্রশান্ত কণ্ঠে): সবই ব্রহ্ম। আলো ব্রহ্ম, অন্ধকারও ব্রহ্ম। শব্দ ব্রহ্ম, নীরবতাও ব্রহ্ম। তুমি যাকে ছুঁতে পারো না, তাকে ছুঁতে চাও—সেটাও ব্রহ্ম।
কণ্ঠ ১ (ধীরে ধীরে অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে): তবে আমি, আমার কাজ, আমার ভাবনা, আমার ভুল, আমার ভয়… তা-ও কি ব্রহ্ম?
কণ্ঠ ২ (গভীর মমতায়): তা-ও ব্রহ্ম। ব্রহ্ম নিজেই সব ভূমিকায়—সে অভিনয় করে ‘আমি’ হয়ে, আর দেখে নিজেকেই—‘তুমি’ হয়ে।
কণ্ঠ ১ (বিস্ময়ে কেঁপে ওঠে): তবে কি সে আলাদা? না কি আমি-ই সে?
কণ্ঠ ২ (হালকা হাসিতে আলোকময় উচ্চারণে): তুমি-ই সে। তবে তুমি নিজেকে ভুলে গেছ—নাম, রূপ, পরিচয়ে ডুবে গেছ। যখন সব কিছু খসে পড়ে, তখনও যা থাকে—সেটাই ব্রহ্ম।

দু-জন একসাথে (ধ্বনি ও নিঃশব্দ একাকার হয়ে—ধ্রুপদী ছন্দে, ধ্যানভরে উচ্চারিত): আমি ব্রহ্ম। তুমি ব্রহ্ম। এই বিশ্বজোড়া রূপ-ছায়া—সবই ব্রহ্ম। চোখ মেলো, দেখো—সব ব্রহ্ম। বাতাস ব্রহ্ম, শব্দ ব্রহ্ম, আলো ব্রহ্ম, ছায়াও ব্রহ্ম। চেতনার গভীরে তুমি যা দেখো—সেই এক চৈতন্যের দ্যুতি সবই। আমি আলাদা নই, তুমি আলাদা নও—বিভেদের পর্দা সরালেই…সবই ব্রহ্ম।