অন্তর্মার্গ: ৫



কণ্ঠ ১ (থমকে দাঁড়ায়, গভীর বিস্ময়ে): জীবন্মুক্ত তো বুঝলাম—তাহলে বিদেহমুক্ত কে? তিনি কি তারও ঊর্ধ্বে?
কণ্ঠ ২ (শব্দহীনতার মতো শান্ত উচ্চারণ): তিনি—যিনি নিজেকেও বিস্মৃত। না আছে 'আমি ব্রহ্ম' ভাব, না আছে মুক্তি চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। তিনি নিঃশব্দ চৈতন্য।
কণ্ঠ ১ (থমকে যায়): তবে কি তাঁর কোনো সত্তাও নেই?
কণ্ঠ ২ (ধীরগতি, যেন স্রোতহীন নদী): তিনি স্বরূপে আছেন, তবু নিজেকে ‘আছি’ বলেন না। নেই কোনো সময়বোধ, নেই কোনো 'আমি', 'তুমি', 'এটা', 'ওটা'। তিনি সেই—যিনি “বলা যায় না”।
(কণ্ঠ ১): তবে কি তিনি জ্ঞানী? ধ্যানী? তপস্বী?
(কণ্ঠ ২): তিনি কেউ নন, তবু সব। তাঁর কোনো পরিচয় নেই, কেননা নাম-রূপ তাঁর গায়ে লাগে না।

দু-জন একসাথে (ধীরে, স্তব্ধতার জলের মধ্যে গলা মিলিয়ে): তিনি না জাগ্রত, না ঘুমন্ত, না ধ্যানমগ্ন, না ধ্যানাতীত। তিনি এক চির-বোধ, যার না আছে শ্বাস, না আছে শব্দ।

কণ্ঠ ২ (স্তব্ধতার গহীন থেকে উঠে আসে): তাঁকে দেখা যায় না, তবু তিনি সব। তাঁকে ছোঁয়া যায় না, তবু তিনিই ছোঁয়ার আদিস্বরূপ। তিনি বিদেহমুক্ত—নেই আমি, আছি আমি। না জাগরণ, না ঘুম, না চেতনা, না অচেতন। তিনি ‘আমি’ শব্দেরও আগে, তিনি সেই—যিনি নিজে ‘নেই’ হয়ে আছেন। না বাঁচা, না মরার সীমানা, না অভিজ্ঞতা, না স্মৃতি। যে নেই, সে-ই আছে—বিদেহমুক্ত, নিঃশেষে পূর্ণ।

কণ্ঠ ১ (বিস্ময়ে ভরা, শ্রদ্ধাভরে প্রশ্ন রাখে): তাহলে যেটুকু আমি দেখি, যা-কিছু ছুঁই, ভাবি, স্মরণ করি—তা-ও কি আত্মা?
কণ্ঠ ২ (এক অদৃশ্য আত্মবিশ্বাসে বলে ওঠে): হ্যাঁ…যা-কিছু আছে—জড় ও চেতন, জাগ্রত, স্বপ্ন, নিদ্রা—সবই আত্মা।
কণ্ঠ ১ (খানিক থেমে, ভেবে): তবে এই পঞ্চভূত? মাটি, জল, আগুন, বায়ু, আকাশ?
(কণ্ঠ ২): তা-ও আত্মা। এই নাম-রূপ সবই আত্মার খেলা। আত্মা নিজেকে ভুলে গিয়ে নিজেরই নাচনে মত্ত।
কণ্ঠ ১ (আবেগে আচ্ছন্ন, যেন উপলব্ধির কিনারায়): তাহলে আমি-তুমি নেই? ভয়, লোভ, দুঃখ, ক্রোধ—এ সবই কি কল্পনা?
কণ্ঠ ২ (নৈর্ব্যক্তিক, স্থির): সবই আত্মা, আত্মারই রূপান্তর। তুমি যে ভাবছ “তুমি”, সেই ভাবনাটাও আত্মা।

দু-জন একসাথে (আত্মিক সুরে, যেন একই ঢেউয়ের দুটি কণ্ঠ): সর্বত্র আত্মা—ভেতরেও, বাইরেও, প্রেমেও, অভিমানেও, মৃত্যুতেও, জন্মেও। আমি ছাড়া কিছু নেই। আর সেই ‘আমি’-ই আত্মা।

কণ্ঠ ২ (শেষ পঙ্‌ক্তিতে, গভীর চেতনার ঢেউয়ে, ধ্যানমগ্ন ছন্দে, নিঃশব্দতাকে জাগিয়ে): নিজেকে দেখো, নিজেকে জানো—তোমার দেখা সমস্ত কিছুই তোমারই ভিন্ন ভিন্ন রূপ।

...আমি বৃক্ষ, আমি পাখি, আমি বাতাসের ছায়া, আমি নদী, আমি পাথর, আমি আগুনের মায়া। আমি দুঃখের অন্তর, আমি আনন্দের গান, আমি চেতনার রেখা, আমি নীরবের প্রাণ। আমি ছাড়া নেই কিছু, দেখা-শোনা, রূপ-রস—সব আত্মা, সব আমি।