অন্তর্মার্গ: ৪




কণ্ঠ ১ (কিছুটা দ্বিধায়): তবে কি বাহ্যিক আগুন, আহুতি, মন্ত্র—সবই অর্থহীন?
(কণ্ঠ ২): তুমি যখন জানো—তুমি চৈতন্যের দীপ্তি, তখন আর বহির্বাহুতে আগুন জ্বালাতে হয় না... তুমি তখন নিজেই অনল—যে পুড়িয়ে ফেলে 'আমি'-'তুমি'-র বিভাজন।
(কণ্ঠ ১): এই চেতনা কি সর্বত্র প্রবাহিত? কী আছে, আর কে নেই?
(কণ্ঠ ২): আমি শূন্য, আমি পরিপূর্ণ, আমি নামহীন, রূপহীন, আমি সেই নীরব, অলক্ষ অর্ঘ্যদাতা—যার আগুন কোনো বৈদিক অনল নয়, বরং নিজ আত্মার দীপ্তি।

দু-জন একসাথে (সমবেত ধ্বনিতে, যেন চেতনার ঢেউ): আমি ব্রহ্ম, আমি সর্বত্র, আবার কোথাও নেই। আমি যজ্ঞ, আমি যাজক, আমি আহুতি, আমি প্রাপক। এই চেতনার দীপ্তিতেই সমস্ত যজ্ঞ পূর্ণতা পায়। নই আমি ঘৃত-ধারা, নই মন্ত্রের ধ্বনি। আমি নিজেই অগ্নিস্বরূপ—আমাতে সব পূর্ণ হয় ধ্যানময় সঙ্গী। “আমি ব্রহ্ম”—এ-ই অর্ঘ্য, এ-ই যজ্ঞের পুণ্যস্মৃতি। যেখানে আমি নেই, সেখানেই সব চেতনার গীতি।

কণ্ঠ ১ (কৌতূহলে টলমল): কে সেই—যিনি দেহে থেকেও দেহে নেই? যাঁর চোখে জগত, কিন্তু মনে জগত নেই, তাঁর পরিচয় কী?
কণ্ঠ ২ (স্থির, আত্মনিবিষ্ট কণ্ঠে): তিনি—জীবন্মুক্ত। চৈতন্যে স্থিত, মৌনভাবে প্রসারিত, জ্ঞানেও যিনি নির্জ্ঞান।
কণ্ঠ ১ (বিস্ময়ভরে): তবে কি তিনি অনুভব করেন না সুখ বা দুঃখ? ভয়, অভিমান বা প্রেম?
(কণ্ঠ ২): না। সুখ ও দুঃখ—তাঁর কাছে সমান। তাঁর কোনো ‘আমি’ নেই, এমনকি ‘আমি নিঃসত্তা’—এই ভাবনাটুকুও নেই।
কণ্ঠ ১ (ধীরে ধীরে মুগ্ধতায় ডুবে যেতে যেতে): তবে কি তিনি শূন্য?
কণ্ঠ ২ (মৃদু হাসিতে গা-ঢাকা অনন্ততা): না, তিনি পূর্ণ…তবে নিজেকে পূর্ণ ভাবেন না। তিনি থাকেন—নামহীন, সংকল্পহীন, স্পর্শবিহীন হয়ে।
(কণ্ঠ ১): তাহলে তিনি কী করেন? ধ্যান করেন? কীর্তন? ব্রত?
(কণ্ঠ ২): না, তিনি কোনো কিছু করেন না। তাঁর সত্তাই ধ্যান, তাঁর নিঃশব্দতাই উপাসনা।

দু-জন একসাথে (মিশ্র স্বরে, গভীর মৌনভাবকে জাগিয়ে): তিনি গুরু নন, শিষ্যও নন। তিনি জাগরণ নন, নিদ্রাও নন। তিনি সবের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, তবুও সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থিত।

কণ্ঠ ২ (শেষ পঙ্‌ক্তি, যেন অন্তর্হিত সুর—ধীর-নীরবধি ছন্দে, যেন শুদ্ধ বাতাসে ভেসে-ওঠা উপলব্ধি): তিনি জীবন্মুক্ত—যিনি থাকেন, কিন্তু নেই। নেই তাঁর আমি, নেই তৃষ্ণা, নেই মোহ। তিনি জগতের মাঝে থেকেও অপ্রবাহিত নির্ভ্রান্ত চৌম্বক-বোধ। “আমি ব্রহ্ম”—এ নয় তাঁর জপ, কারণ ব্রহ্ম-ভাবই তাঁর নিঃশ্বাসের স্তব। তিনি নেই—কারণ তিনি সব। তিনি জীবন্মুক্ত—অনন্তের অচঞ্চল স্তব।