অনুব্রত, তোমাকে লিখছি। শেষ লিখেছি চার বছর হলো। এই চার বছরে, ডায়েরির পাতাগুলি অনেক বদলে গেছে, তোমাকে বলা হয়নি। এই দীর্ঘসময়ে, আমার অদেখার অনেক প্রহর তোমাকে দেখানো হয়নি।
আমার বিশ্বস্ত অক্ষরগুলি এখন আর পরের দিনের অপেক্ষায় থাকে না। ক্যানভাসটা আজও আছে, তবু ওখানে কোনও স্বপ্ন নেই, ওখানে কেবলই দিনযাপনের ক্ষতটুকু আছে।
অনুব্রত, আমাদের বাড়ির পেছনের বাগানটার কথা মনে আছে তোমার? ওখানে বসে থাকতাম তুমি আসবে বলে। নীলচুড়ি-হাতে পথের দিকে চেয়ে থাকতাম…
একসময় তুমি আসতে, ধীরপায়ে। আমার অধীর প্রতীক্ষার দৃষ্টি কেড়ে, অপরাজিতার ঝোপের ফাঁকে ফাঁকে নিঃশ্বাস মেখে খুব আলতো করে আমায় ছুঁতে… মনে আছে, অনুব্রত? তুমি নীলচুড়ি ভালোবাসতে।
খুব কান্না পাচ্ছে, চার বছর চলে গেল, কান্না আর ফুরোল না। তোমাকে লিখতে গেলে আজও কান্না পায়! এমন কেন হয়, অনুব্রত? আজ আর না লিখি…
অনুব্রত, চলে গেছ? একটু থাকো! জ্যামিতির ক্লাসে ইউক্লিডকে ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে আড়চোখে। তোমার মনে আছে? আমার হাত থেকে খড়িমাটি নিয়ে গ্লাসভর্তি জলে ডুবিয়ে দিতে। তখন তোমাকে খেপিয়ে দিতে ‘আকলু’ ডাকতাম।
তুমি কত ভালো ছাত্র ছিলে, অথচ আমাকে অঙ্ক বোঝাতে গিয়ে সূত্র ভুলে যেতে! একেবারেই সহজ সূত্রগুলিও তোমার মাথায় আসত না। তখন আমার ভীষণ ভালো লাগত। অঙ্ক বুঝতে ইচ্ছে করত না, শুধুই তোমাকে বুঝতে ইচ্ছে করত। খিলখিল শব্দ করে হাসতে ইচ্ছে করত, গাইতে ইচ্ছে করত। এটাকে ভালোবাসা বলে না, অনুব্রত?
আমি জানতাম, আমার চাহনিতে তুমি বারবারই আটকে যাচ্ছ। আমার দুষ্টুহাসির সমুদ্রে সাঁতরে সাঁতরে তুমি একটাজীবন পার করে দেবে। তোমাকে অনুভব করতে ভীষণ ভালো লাগত। তখনও, একটাজীবনের মানে যে কী, তা বুঝিনি।
ভাবছ নাকি, আমি খুব পাজি হয়েছি? আমার ডায়েরির পাতাটা উলটে দেবে এখুনিই? অনুব্রত, পাজি আমি আগেও ছিলাম, তোমাকে বুঝতে দিইনি কখনও। তুমি আমার সামনে এলে আমার বোধের জগতটা ফাঁকা হয়ে যেত, আমার সমস্ত ভাবনা একটা একটা করে কোথায় যেন হারিয়ে যেত।
সেইসব ক্লাসের কথা মনে পড়ছে, অনুব্রত। তিনটি সরলরেখা দিয়ে চতুর্ভুজ আঁকতাম। তুমি মাথায় টোকা মেরে বলতে…কী বোকা! তখন মনে হতো, তিনবাহুর চতুর্ভুজ দিয়েই কয়েকটা জীবন কাটিয়ে দিই! আহা, সে কী আলোয় চোখদুটো ভরে যেত! সবাই উপহাস করত। আমাকে নিয়ে ক্লাসে হাসাহাসি হতো। আমি ওদের দেখতাম, হাসতাম। মনে মনে বলতাম, তোমরা নাহয় অঙ্কে একশোই পেলে, অনুব্রতকে তো আর পেলে না! …অঙ্কে শূন্য পেয়ে আমার কী লাভ হলো, অনুব্রত?
আজ তুমি নেই। হৃদয়ের ঘরগুলিতে তুমি তবু থেকে গেছ… আজ তোমাকে এত লিখছি কেন, জানি না। সেই পুরনো দিনগুলির মতো করে আজ আকাশের নীল ছুঁতে খুউব ইচ্ছে করছে। তোমার বইয়ের ভাঁজের শুকনো মালতি হতে ইচ্ছে করছে।
আজ আমি স্মৃতি হয়ে ফেলেআসা সময়ের কথা বলছি। আজও জ্যোৎস্না হলে শরীর ভেজাই আগেরই মতো, তবু মন ভেজে না। কলম থেমে যায়, তবু ডায়েরির পাতা শূন্য থাকে না। এলোমেলো কবিতা লিখে কেউ আর সেধে বলে না, একটু পড়বে? অনুব্রত, আমার ফুসফুসের দখল আজ অন্য কারও, তবু সেখানেই তুমি থেকে যাচ্ছ, শুধু বেরোতে পারছ না।
আমার সমস্ত প্রহরে আজও তুমি বেঁচে আছ, আমার সাথে খুনসুটিতে মেতে উঠছ, হাসছ। আমার মাথায় টোকা মেরে বলছ, তুই এত বোকা কেন রে? আমি তোমার দিকে ঠায় তাকিয়ে আছি আর ভাবছি, একটাজীবনই তো! নির্বোধ হয়ে কাটিয়ে দিলে কী-ইবা হবে?
অনুব্রত, কেন চলেই যেতে হলো? থেকে গেলে হতো না? আমায় একা ফেলে আকাশের তারা হতেই হলো! তুমি সত্যিই কি খুব ভালো আছ আমাকে ছেড়ে?