অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান (১)


ময়মনসিংহের ছোট্ট একটা গ্রামে আমার ‘সত্যিকারের’ জন্ম। বাবা-মা, দুই বোন আর এক ভাই নিয়ে আমার মাঝারি পরিবার! আমি বাবা-মা’য়ের তৃতীয় সন্তান। বাবা সরকারি চাকরি করতেন, মাসশেষে মোটামুটি ভালো বেতন পেতেন। আমাদের পরিবার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল—তবে শুধু বাবার টাকায়, তা কিন্তু নয়; এক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকাও অনেকখানি। এই প্রসঙ্গ খণ্ডনের আগে বাবা-মা’য়ের কীভাবে বিয়ে হয়েছিল, সেই গল্পটা বলি।

সেকালে আমার মা ছিলেন বংশীয়; চৌধুরি পরিবারের একমাত্র মেয়ে, দেখতেও ছিলেন মাশাআল্লাহ! আমার তিন জন মামাও অবশ্য ছিলেন। ভাবছেন, তাহলে আমার মা একমাত্র হলেন কোন যুক্তিতে, তাই তো? আরে মশাই, একমাত্র মেয়ে বলেছি, আপনি একমাত্র সন্তান ভাবছেন কেন!

তো যা বলছিলাম, আমার বাবা তখন চৌধুরি পরিবারের ভাড়াটে মনিব ছিলেন। ভাড়াটে মনিব মানে বুঝলেন না? ওই লজিং-মাস্টার আর কি! বাবার যে খুব একটা টানা-পোড়েন চলছিল তখন, তা-ও নয়; দাদার যা সম্পত্তি ছিল, তার উত্তরাধিকারী আমার বাবাই ছিলেন, মানে একমাত্র সন্তান; তাঁর কিন্তু লজিং থাকার কারণ হলো মা! আমার নানু আবার শিক্ষিত, মার্জিত আর অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মহিলা ছিলেন। বাবার লজিং থাকার কারণ যদিও তিনি জানতেন না, তবু মনে মনে বাবাকেই মেয়ের জামাই করার পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন।

সে সময় পুরো তল্লাটে বাবার মতো শিক্ষিত আর কেউ ছিল না। বাইরে থেকে বাবা দেখতে একটু গোবেচারা গোছের, কিন্তু ভেতরের বাঁদরটাকে আর কেউ চিনতে পারুক না পারুক, আমার নানু ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন! বাবা বেশ দীর্ঘকায় সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন, যদিও গায়ের রংটা মলিন ছিল। স্যুট-টাই পরালে কিন্তু এক্কেবারে চৌধুরি বংশের জামাই জামাই ভাব চলে আসত। মা অবশ্য ছোট্ট-খাট্ট গোলগাল মুখের প্রতিমার মতো দেখতে ছিলেন।

নানুর দেওয়া বেশ কয়েকটা পরীক্ষায় পাশ করে অবশেষে বাবা তাঁর ছোট্ট ঘর আলো করে প্রতিমাটা নিয়ে আসতে পেরেছিলেন।

এক এক করে তাঁদের ভালোবাসার চিহ্নগুলো এক-একটা জীবন্ত ফুলের মতো প্রস্ফুটিত হয়ে স্বর্গউদ্যান থেকে মর্ত্যে নেমে আসতে থাকল! আমার বড়ো দুই আপা হবার পরে বাবা মাকে নিয়ে ঢাকার গাজীপুরে চলে এলেন চাকরিসূত্রে। সেখানে বাবা একটা বাড়ি বানালেন, বছরখানেক বাদে নানা মারা গেলেন, তখন নানু কেমন যেন ভেঙে পড়লেন। বড়ো আপা বা ছোটো আপাকে নিজের কাছে আমাদের গ্রামের বাড়িতে রাখতে চাইছিলেন। বড়ো আপা আর ছোটো আপা তখন বড়ো হয়ে গিয়েছিল, কেউই আর নানুর কাছে থাকতে চাইল না, দু-জনেই পড়াশোনা নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কী আর করা, নানুই মাঝে মাঝে এসে বেড়িয়ে যেতেন।

কার্তিক মাসের মাঝামাঝি হঠাৎই মা অসুস্থ হয়ে পড়ে। হাসপাতালে যাবার পরে সবাই জানতে পারল, মা দু-মাসের অন্তঃসত্ত্বা। রিপোর্ট দেখে বাবার মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা হলো। তখন আরেকটা সন্তান আসুক, সেটা বাবার মতো পরিবারের কেউই চায়নি। পৃথিবীতে আসার আগেই আমার নামের পাশে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ শব্দটা জুড়ে গেল!

তখন বড়ো আপা কলেজে আর ছোটো আপা এন্ট্রান্স ক্যান্ডিডেট।

এমন সময় মা আবার সন্তানসম্ভবা, বিষয়টা তারা মেনেই নিতে পারেনি। বড়ো আপার বান্ধবীরা প্রায়ই বড়ো আপাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করত। বলত, কীরে সাভেরা, ফিডার কিনবি না? ক-দিন পর তো ছোটো-ভাই/বোনকে ফিডার খাওয়াতে হবে!

আপা বাসায় এসে প্রায়শই মায়ের সাথে রাগারাগি করত।

প্রতিদিনই চলত এসব, একপ্রকার মানসিক অশান্তির মধ্যেই মায়ের দিন কাটত। মা খাওয়া-দাওয়ায়ও বড্ড অনিয়ম করতেন! বাবাও কখনও যত্ন নিতেন না—মানে আমার আর কি, মায়ের যত্ন ঠিকই নিতেন। বড়ো দুই আপা হবার সময় বাবা যেমন মায়ের উদরে হাত রেখে তাদের হৃদ্‌স্পন্দন অনুভব করতেন, তাদের নড়াচড়া অনুভব করতেন, হাত বুলিয়ে আদর করতেন, কান পেতে শুনতে চাইতেন…কোনো সাড়া দিচ্ছে কি না, আমার বেলায় বাবা কখনোই ওসবের কিছুই করেননি। কেনই-বা করবেন! আমি তো অনাকাঙ্ক্ষিত, বিনা অনুমতিতে নির্লজ্জের মতো সবাইকে লজ্জায় ফেলতে চলে এসেছি!

আমায় তো তখন কেউ বলেওনি যে, আমি অনাকাঙ্ক্ষিত, আমাকে কেউ চায় না, আমি সবাইকে লজ্জায় ফেলছি প্রতিমুহূর্তে! কেন কেউ বলেনি? বললে আমি সত্যিই আসতাম না, বিধাতাকে বলে দিতাম, আমায় লজ্জার উৎস বানিয়ে পাঠিয়ো না গো, খোদা! আমি বোধ হয় তোমার বানানো দুনিয়ার জন্য বড্ড বেমানান। একটা সুখের সংসারে শাস্তির পুঁটুলিটা ছুড়ে ফেলো না!

আমি আসার খবর শুনে যদি কেউ খুশি হয়ে থাকে, তবে তিনি হচ্ছেন আমার নানু বেগম নাহার চৌধুরি! ময়মনসিংহ থেকে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে ছোটো মামাকে সঙ্গে নিয়ে সোজা আমাদের গাজীপুরের বাসায় চলে এলেন।

এরপর থেকে নানুই মায়ের দেখাশোনা করতেন, জোর করে খাওয়াতেন; আমি অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মা ঠিকমতো খেতে চাইতেন না বোধ হয়! কার্তিক মাসের শেষের দিকে কোনো এক নতুন ভোরের সূচনালগ্নে সবাইকে চূড়ান্ত লজ্জা দিতে নির্লজ্জ আমি এসে হাজির হয়ে গেলাম!

নানুর বর্ণনামতে, আমি দৈর্ঘ্যে মোটে একহাত, আর বর্ণে ঈষৎ কৃষ্ণ! ছোটো ছোটো হাত-পা নেড়ে পাতলা সুরে কোনোমতে আওয়াজ তুলে জানান দিলাম, আমি বেঁচে আছি! মুসলিম পরিবারে সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পরে, ছেলেসন্তানের কানে প্রথম আজানের ধ্বনি পৌঁছনোর দায়িত্বপালন করে বাবা। বাবার অবর্তমানে নানা/দাদা/মামা/চাচা, অর্থাৎ পুরুষ সদস্য যাঁরা থাকেন, তাঁরা। কিন্তু আমার বেলায় বাবা বতর্মান থেকেও প্রথম আজানের ধ্বনি পৌঁছনোর দায়িত্ব মামাই পালন করলেন!

আমি পৃথিবীতে আসার পর মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, কারণটা ছিল দুর্বলতা! বাবা মাকে নিয়ে হাসপাতালে গেলেন, শুধু সঙ্গে আমাকে নিতে ভুলে গেলেন। এক চামচ পাউডার মিল্ক পাতলা করে গুলিয়ে নানু আমার মুখে দিলেন, জীবনের প্রথম খাবারের স্বাদ নিলাম কৃত্রিমতার মধ্যে! ওই যে মা ভীষণ দুর্বল ছিলেন, এক ঘণ্টা বয়েসি দুর্ভাগা আমি, যার মার্বেল সাইজের বিশাল পাকস্থলিটা পূর্ণ করার মতো মায়ের বুকের একটুও দুধ কপালে জোটেনি! খাবারের স্বাদটা নাহয় দু-চার ঘণ্টা পরেই নিতাম!

পঁচিশ দিন পর প্রথম বার মায়ের দুধ পান করার সৌভাগ্য হলো আমার...বয়স যখন দু-মাস, তখন নানু খেয়াল করলেন, আমার শরীর অনুযায়ী পা-দুটো পুষ্ট নয়, হাঁটুর নিচ থেকে অনেকটা সরু হয়ে গেছে। আহা, আমার অদৃষ্ট! কথায় বলে না, অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়! আমারও হলো সেই দশা! ছয় মাস বয়স যখন, তখন বাবা বললেন, চাইলে নানু সাথে করে আমাকে ময়মনসিংহে নিয়ে যেতে পারেন।

নানুও তা-ই করলেন, মা অবশ্য অনেক কান্নাকাটি করলেন, দ্বিতীয় দফায় অসুখেও পড়লেন।

নানুর সাথে ময়মনসিংহের চৌধুরি বাড়িতে আমার নতুন পথচলা! বয়সটা কিন্তু এক-শো আশি দিন; এর মধ্যেই পথ দু-ভাগে ভাগ হয়ে গেল! ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ শব্দটাতে জোর কিন্তু কম নয়, তাই না?

বৈশাখের মাঝামাঝি নানু আমাকে নিয়ে ময়মনসিংহে চলে এলেন। সাথে তিন মামাও ছিলেন।

গ্রামে পা রাখতে না রাখতেই এই ঘটনার ব্যাখ্যা-ব্যবচ্ছেদে নেমে পড়ল গ্রামবাসী! চারদিকে নানা গল্প, কাহিনি, ঘটনার ক্রমাগতই রটনা হচ্ছে! যে যেখানে পারছে, দুটো মন্দকথা বলতে ছাড়ছে না। অনেকেই বলেছে, এই ছেলে নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে হাঁটতে পারবে না, পঙ্গু হয়ে জন্মেছে! পারছে তো এ-গ্রাম ও-গ্রাম নিন্দা করেও বেড়াচ্ছে, তবে নানুর ওসব নিয়ে তেমন কোনো অস্বস্তি ছিল না। নানাবাড়ির ক্ষমতা ছিল, তাই রক্ষে; নাহয় ছ-মাসের বাচ্চাকে মায়ের কাছ থেকে নিয়ে আসার অপরাধে হয়তো নানুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হতে পারত! যত যা-ই বলুন না কেন, মায়ের থেকে মাসির দরদ বরাবরই একটু বেশিই হয়! এই কথা অস্বীকার করার কিন্তু উপায় নেই, মশাই!

চৌধুরি বাড়িতে আমাকে নিয়ে নানুর নতুন যুদ্ধ শুরু হলো। প্রতিদিন সরষের তেল দিয়ে পায়ে মালিশ করা, পায়ের দু-পাশ দুটো বালিশ দিয়ে বেঁধে রাখা, ডাক্তার—হাতুড়ে কিংবা ডিগ্রিধারী, থেরাপিস্ট, কবিরাজ, হোমিওপ্যাথি কি অ্যালপ্যাথি, সব কিছুই ট্রাই করা—কী নেই, যা নানু করেননি আমার জন্যে! আমাকে দু-পায়ে দাঁড় করানোর জন্যে এ যেন নানুর নিত্যকার যুদ্ধ! এ যুদ্ধ আমাকে বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ, দু-পায়ে হাঁটানোর যুদ্ধ, একজন অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ! সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি কখনও অনাকাঙ্ক্ষিত হয় না, সব সৃষ্টির পেছনেই একটি যথার্থ উদ্দেশ্য থাকে—এই সত্যটি প্রমাণ করার যুদ্ধ, একটা লজ্জার সম্মানে পরিণত হবার যুদ্ধ—এ যুদ্ধ ঠিক কার? আমার, না কি নানুর? সৃষ্টির সম্পর্কে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার যুদ্ধে আমি আছি, নানু আছে; আছে অদৃষ্ট আর সাথে আছে বিধাতা—এ নিয়েই দাবার ছকে আঁকা আমার জীবনের এগিয়ে চলা!

সুস্থ-স্বাভাবিক শিশুরা দশ থেকে এগারো মাসের মধ্যেই হাঁটা শুরু করে, আর আমার আঠারো মাস লেগে গিয়েছিল! সূর্যের প্রখর তাপে সদ্যগজানো পুঁইলতা নুইয়ে পড়ার পর পানির একটু স্পর্শে যেমন সতেজ হয়ে মাথা তুলতে শেখে, আঠারো মাসের যুদ্ধশেষে আমিও ঠিক ওভাবেই মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখে গেছি! ক্লান্ত-শ্রান্ত বয়সের ভারে বুড়িয়ে-যাওয়া বেগম নাহার চৌধুরির ভাঙা চোয়ালে সেদিন আনন্দের জোয়ার উঠেছিল।
Content Protection by DMCA.com