অনর্জিত পরাজয়

ঘুম আসছিল না সিরাজের চোখে।




ফলে অনেক কথা এসে উঁকি দিচ্ছিল মনে। সিরাজ ভাবছিল। ভাবতে ভাবতে তলিয়ে যাচ্ছিল।




চাকরি নেই ওর গত দু-মাস ধরে। সকাল-বিকাল টিউশনি করে টেনেটুনে কোনোরকম চলে যাচ্ছে সংসার।




সংসার বলতে ও আর সেলিনা।




আগে একটা চাকর-ছেলে ছিল। সিরাজের চাকরি ছাড়ার পর ছেলেটাকে বিদায় করে দিয়েছে সেলিনা। ঠিকা-ঝি দু-বেলা এসে কাজ করে দিয়ে যায়। বাসন-মাজা, পানি-তোলা আর মশলা-বাটা—কাজ বলতে তো এ-ই। বাকি সব কিছুই করতে হয় সেলিনাকে।




সিরাজের ভারি মায়া হয় সেলিনার জন্য। বেচারি। মা-বাবার সংসারে কোনোদিনই করেনি এসব কাজকর্ম। বড়ো আদুরে মেয়ে ছিল। আর আজ . . . !




সিরাজ আর সেলিনা। ভালোবেসে বিয়ে করেছে ওরা। একসঙ্গেই পড়ত দু-জন।




মন দেওয়া-নেওয়া হয়েছে অনেক দিন আগেই। সেলিনার বাবা-মা জানতেন না তা। এমএ পরীক্ষার পরই মস্ত বড়ো চাকুরের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করলেন মেয়ের।




বেঁকে বসল সেলিনা।




অনেক করেও যখন মা-বাবাকে রাজি করাতে পারল না, তখন নিজের পথ নিজেই বেছে নিল ও। কয়েক জন বন্ধুবান্ধবের উপস্থিতিতে সিরাজের সঙ্গে বন্ধনটা দৃঢ় করতে হলো ওকে কোর্টে গিয়ে, সামাজিকতার জন্য।




ভাগ্য সিরাজের ভালোই বলতে হবে, কেননা রেজাল্ট আউট হবার আগেই সিরাজ খুব ভালো একটা চাকরি পেয়ে গেল।




সেলিনাও কোনো একটা স্কুলে কাজ নেবার জন্য বায়না ধরেছিল। কিন্তু সিরাজ দেয়নি। বলেছে, যা বেতন পাই দু-জনের তো চলে যাচ্ছে, লিনা। কেন তুমি মিছেমিছি চাকরি করতে যাবে?




দিনগুলো তরতর করে বয়ে যাচ্ছিল ওদের রূপসী নদীর রুপোলি ঢেউরাশির মতো।




সেই নিরবচ্ছিন্ন দিনগুলোতে হঠাৎ একদিন এসে লাগল ঝড়ের প্রথম ধাক্কা।




সিরাজের বদলির হুকুম এল নদী-নালা, খাল-বিল, বন-বাদাড়-ময় কোনো এক মফস্বল শহরে।




সিরাজ ভেবেছিল, সেলিনা এ সংবাদে খুশি হয়ে উঠবে। কিন্তু সিরাজকে অবাক করে সেলিনা বলল, ওই বন-বাদাড়ের দেশে আমি গিয়ে কিছুতেই থাকতে পারব না, রাজ। মনই টিকবে না আমার।




: তাহলে?
: তাহলে আবার কী? ছুটি নাও মাসখানেক। এর মধ্যে নিশ্চয়ই অর্ডার ক্যানসেল হয়ে যাবে।




সেলিনার কথামতোই ছুটি চেয়েছে সিরাজ।




বদমেজাজি প্রধান কর্মকর্তা মঞ্জুর করেননি ওর ছুটি। জানিয়েছেন, আগে নতুন কর্মস্থলে যাওয়া, তারপর ছুটি। নাহয় চাকরি ছাড়ো।




নিজের সুখসুবিধে দেখতে গেলে আর সরকারি চাকরি করা যায় না। সব শুনে ঝংকার দিয়ে উঠেছে সেলিনা। দরকার নেই অমন চাকরির। কথায় কথায় বদলি! কোনদিন বলবে, জাহান্নামে যাও! রিজাইন দিয়ে এসো তুমি চাকরিতে।




: কিন্তু সংসার চলবে কী করে?
: ওঃ! তাহলে তুমি যাবে? বেশ, যাও। আমাকে যদি ভালোই বাসতে, তাহলে যেখানে আমার মন টিকবে না, হেলথ টিকবে না, সেখানে আর তুমি যেতে চাইতে না। আমি মরি, এ-ই তো তুমি চাও!
: লি-না!




সিরাজ দেখল, অভিমানে সেলিনার চোখের কালো পাপড়ি ভিজে উঠছে।




বড়ো স্বার্থপর মনে হলো নিজেকে সিরাজের। সেলিনা ওর জন্য কত কিছু ত্যাগ করেছে, আর ও কিনা সামান্য একটা চাকরির মোহ ত্যাগ করতে পারবে না! না, না! আজই কাজে ইস্তফা দেবে সিরাজ। সেলিনার মনে কিছুতেই ও দুঃখ দিতে পারবে না। চাকরি ও ছাড়বেই। দরকার নেই অমন চাকরির। নতুন কাজের সন্ধান করবে আবার।




কিন্তু সন্ধান করলেই তো আর সন্ধান পাওয়া যায় না। চাকরি ছেড়ে গত দু-মাস ক্রমাগত অনেক চেষ্টাই করেছে সিরাজ। সবখান থেকেই পেয়েছে ব্যর্থতা। দু-এক জায়গায় যা-ও একটু আশার আলো দেখতে পেয়েছে, কিন্তু সেসব ইচ্ছে করেই নাকচ করেছে সিরাজ; কেননা সেখানে সেলিনার মন টিকবে না, স্বাস্থ্য টিকবে না।




: এ কী! তুমি এখনও ঘুমাওনি?




সিরাজের চিন্তাস্রোতে বাধ পড়ল সেলিনার কথায়। নিজের দীর্ঘশ্বাস শুনে নিজেই চমকে উঠেছে সিরাজ।




: কী ভাবছ, রাজ?




সিরাজের কাছ থেকে কোনোরকম সাড়া না পেয়ে ওর চুলে বিলি কাটতে কাটতে আবার প্রশ্ন করল সেলিনা।




: উঃ না, কিছু না।




আত্মপক্ষ সমর্থনের সুর সিরাজের কণ্ঠে।




: না, তুমি লুকোচ্ছ। তুমি নিশ্চয়ই আমার চাকরির কথা ভাবছ। তোমার অমতের তো কোনো কারণই খুঁজে পাইনে আমি।
: ভেবে আর কী করব? কাল তো তুমি জয়েন করবেই!




কেমন বিষণ্ণ শোনাল সিরাজের কণ্ঠ।




: এত সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাচ্ছ কেন তুমি দিন দিন, বলো তো? তোমার কাজ নেই, এদিকে আমি পেয়েছি, আমাকেও করতে দেবে না। এ কেমন কথা হলো? এমএ পাশ করেছিলাম কি ঘাসকাটার জন্য? প্লিজ, রাজ, ডোন্ট বি সিলি। যদ্দিন না তোমার চাকরি হচ্ছে, তদ্দিন আমাকে কাজটা করতে দাও।




ছেলেমানুষের মতো সেলিনা স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরল।




: কিন্তু আমার যে আত্মসম্মানে বাধে!
: আত্মসম্মান! আত্মসম্মান! আত্মসম্মান! উঃ! শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল! চমৎকার আইডিয়া! পেটে ভাত নেই, আত্মসম্মান ধুয়ে পানি খাও!




অসহিষ্ণু কণ্ঠে কথাগুলো বলে পাশ ফিরে শুলো সেলিনা। তারপর একটু দম নিয়ে বলল, আমি পারব না দিনের পর দিন এভাবে থাকতে। আপাতত কাজ আমি করবই; তারপর যা হয় হবে।




সিরাজের মতামতকে উপেক্ষা করে চাকরি শেষপর্যন্ত নিয়েছেই সেলিনা। কোনো একটি বিদেশি ফার্মের কাজ। কাজ অনুপাতে বেতন ঢের বেশি।




এদিকে সিরাজ মরিয়া। কাজ চাই ওর…কাজ। রাজধানীতেই ভালো একটা কাজ। যা-ও একটা পাওয়া যায়, বেতন সেলিনার তুলনায় হয় কম। আত্মসম্মানে বাধে সিরাজের।




আশা-নিরাশার ঊর্মিদোলায় দুলতে দুলতে জীবন যখন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে সিরাজের কাছে, তেমনি একদিন সিরাজের জীবনের অববাহিকায় নেমে এল আলোর প্রপাত।




সিরাজের চাকরি হয়েছে স্থানীয় একটি কলেজে। রুপোর চাকতি সেলিনার মতো প্রায় সমান হলেও সম্মান পাবে সিরাজ সেলিনার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। ভীষণ খুশি হলো সিরাজ।




ছুটতে ছুটতে এল বাসায়।




সেলিনা সবে অফিস থেকে ফিরে কাপড় ছাড়ছিল তখন। সিরাজ আদরে আদরে অতিষ্ঠ করে তুলল ওকে।




: আহা, ছাড়ো! কী? হয়েছেটা কী?
: চাকরি পেয়েছি আমি, লিনা! চাকরি!




আনন্দে, উত্তেজনায়, উচ্ছ্বাসে সিরাজ হাঁপাচ্ছে রীতিমতো।




: ওঃ! আমি ভাবলাম, না জানি কী। তা কোথায় হলো?




খোঁপা থেকে কাঁটা খুলতে খুলতে কেমন নির্লিপ্তভাবে বলল সেলিনা।




ভীষণ আহত হলো সিরাজ। তবুও চোখে-মুখে খুশির ব্যর্থ আলো ছড়িয়ে বলল, কলেজে।




: প্রফেসর?




কুঁচকে উঠল সেলিনার নাকের পাশটা। “বোরিং!” বলে তোয়ালে আর সাবান নিয়ে এগিয়ে গেল বাথরুমের দিকে।




মাসের চার তারিখ। বেতন পেল আজ সিরাজ। অদ্ভুত একটা উন্মাদনা আর বিচিত্র একটা অনুভূতি নিয়ে অধীর চিত্তে বাসার উদ্দেশে কলেজছুটির আগেই রওনা হলো সিরাজ।




পথে আসতে আসতে এলোপাথাড়ি কত-কী ভাবল ও—তার কিছুর অর্থ হয়, কিছুর হয় না।




. . . বাসায় গিয়েই প্রথমে বেতনের টাকাটা সেলিনার হাতে দেবে ও। মনে পড়ল, কতদিন হলো ওরা বেড়াতে বেরোয়নি। ঠিক করল, চা খেয়ে সেলিনাকে নিয়ে আজ বেড়াতে বেরুবে। বেড়িয়ে তারপর টুকিটাকি কেনাকেটা করে ছবি দেখবে একটা ‘দেবদারু’-তে। ওরই এক সহকর্মী বলছিল, ভালো একটা ছবি এসেছে নাকি।




ওহ্‌! কতদিন হয়ে গেল ছবি দেখেনি ওরা!




সেলিনা নিশ্চয়ই খুব খুশি হয়ে উঠবে। ছবি দেখার নামে ও যা পাগল! আর ইংরেজি ছবি হলে তো কথাই নেই!




তারপর অনেক রাতে বাসায় ফিরে ধীরেসুস্থে সিরাজ সেলিনাকে বলবে, "এবার চাকরিটা ছাড়ো, লিনা। শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে তোমার দিন দিন। তা ছাড়া যা বেতন পাচ্ছি, আমাদের দু-জনের সুন্দর কুলিয়ে যাবে।" এবার হয়তো আর অমত করবে না সেলিনা।




এ কী! থমকে দাঁড়াল সিরাজ গেইটের সামনে এসে। দরজা খুলে ওদেরই ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে সৌখিন বেশভূষায় সজ্জিত একজন যুবক। প্রসাধন আর দামি সিগারেটের উগ্র গন্ধ ছড়িয়ে ওর পাশ কাটিয়ে গিয়ে উঠল রাস্তার একধারে দাঁড়-করানো রেডওয়াইন কালারের সুন্দর প্রিমিয়ো গাড়িটায়।




কয়েক মুহূর্ত যেন অভাবনীয় ভাবনায় তলিয়ে গেল সিরাজ। স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে গেল যেন ও!




গাড়িটা চলে গেল ওর মুখের উপর একরাশ ধুলো উড়িয়ে। একটা পুরোনো ব্যথা যেন তীব্রভাবে চাড়া দিয়ে উঠল সিরাজের বুকটাতে।




হাত দিয়ে বুকটা চেপে ধরতে গিয়ে হাতটা গিয়ে ঠেকল ওর পকেটে। সদ্য-বেতন-পাওয়া ঝকঝকে কড়কড়ে নোটগুলো রয়েছে সেখানে। সিরাজের হাতটা শিথিল হয়ে নেমে এল নিচে সেই মুহূর্তেই।