সুচিত্রা-উত্তম

“কাব্য প'ড়ে যেমন ভাব
কবি তেমন নয় গো।”
 
—রবীন্দ্রনাথের লেখা এই কথাটি বোধ হয় মহানায়ক উত্তমকুমারের বেলায় অনেক বেশিই প্রযোজ্য। অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়ের উত্তমকুমার হয়ে ওঠার যে-যাত্রা, সেই যাত্রাপথে কত যে কাঁটা, কত যে অপমান, কত যে যন্ত্রণা আর কত যে অপেক্ষা ছিল, আমরা দর্শকেরা সিনেমা দেখে তা কখনোই ধরতে পারি না। স্বয়ং সুচিত্রা সেনও কখনো কখনো অপমান করেছেন উত্তমকে!
 
পরাজিত হতে হতে একসময় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে বিদায় জানানোর ডিসিশনও নিয়ে ফেলেছিলেন উত্তম। নিজের সবটুকু দিয়ে শেষ পর্যন্ত কেবল টিকে থাকার যুদ্ধ করতে হতো তাঁকে। আহা, মানুষের কত রকমের কষ্ট থাকে!
 
উত্তম-সুচিত্রা জুটির চার্ম, পর্দায় তাঁদের দু-জনের জাদু ছড়ানোর কথা তো সবাই জানে। কিন্তু সবাই যেটা জানে না, তা হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে যেমন ঝগড়া হতো, আবার দু-জন দু-জনকে শ্রদ্ধাও করতেন। তাঁদের মধ্যে ইগোর লড়াই চলত, আবার অন্যদিক দিয়ে, একজন আরেকজনের বন্ধুত্বকে সবসময় স্বীকারও করেছেন।
 
উত্তম-সুচিত্রা জুটি চরম সাফল্যের মুকুট নিয়ে আসার পর সুচিত্রার একসময় মনে হতে থাকল যে, শুধু তাঁর জোরেই সিনেমা চলে। তাই জুটির নাম উত্তম-সুচিত্রা না হয়ে সুচিত্রা-উত্তম হতে হবে। সেই সময়ে তাঁদের সিনেমা ‘একটি রাত’-এর পরিচালক চিত্ত বসুকে সুচিত্রা জানান তাঁর ইচ্ছের কথা। বলেন, ছবির টাইটেল এবং পোস্টারে তাঁর নামটাই আগে দিতে হবে। চিত্ত বসু সবিনয়ে উত্তমকে এই প্রস্তাব জানাতেই তিনি বলেন, “বেশ তো, রমার নামই আগে দাও না, আপত্তি কোথায়? রমা এত সুন্দর দেখতে যে, ওকে দেখতেই তো দর্শক আসে!”
 
বাংলা সিনেমার ধারাবাহিক নিয়মকে ভেঙে কোনো ইগোর লড়াইয়ে না গিয়ে এত সহজে এত বিশাল একটা ব্যাপার মেনে নিয়েছিলেন উত্তমকুমার। অবশ্য এমন মানসিকতার কারণেই উত্তমকুমার একদমই উত্তম হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। অন্য সাধারণ কেউ হলে নিশ্চয়ই ইগোর কাছে হেরে যেতেন আর খুইয়ে ফেলতেন নিজের ক্যারিয়ার। ওই ঘটনার পর থেকেই তাঁদের জুটির নাম হয়ে গেল সুচিত্রা-উত্তম জুটি।
এ ঘটনা থেকে সুচিত্রার সিদ্ধান্তের প্রতি উত্তমের শ্রদ্ধার ব্যাপারটাও খুব সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। তিনি কখনো সুচিত্রার প্রেমে পড়েছিলেন কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “কে বলল, আমি রমার প্রেমে পড়িনি? রমাকে ভালো না বেসে থাকা যায় নাকি? তবে, ও খুব বুদ্ধিমান মেয়ে। কী বলেছিল জানো? বলেছিল, আমরা যদি প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে পড়ি, তাহলে স্বপ্নের প্রেমিক-প্রেমিকা ইমেজটায় চোট লাগবে।
আমাদের ছবি তেমন আর চলবে না। দর্শক আমাদের আর রোম্যান্টিক জুটি হিসেবে আর গ্রহণ করবে না।”
 
তা ছাড়া সুচিত্রার বিভিন্ন সময়ের কাজকর্ম দেখে মনে হতো, তাঁকে উত্তম থেকে আলাদা করে অর্থাৎ কেবলই সুচিত্রা সেন বলে যদি দর্শক মনে না রাখে, এরকম একটা দুশ্চিন্তা, এরকম একটা ভয় নায়িকাকে প্রায় প্রায়ই পেয়ে বসত। অথচ উত্তমের কাজে কখনো মনে হয়নি যে, তিনি এরকম করে কিছু ভাবেন কিংবা এরকম কোনো ভয় তাঁর মধ্যে ছিল।
 
সুচিত্রার পর্দার আড়াল হবার দু-এক বছর পর উত্তমকুমার তাঁর মৃত্যুর কিছু আগে এক ইন্টারভিউতে বলেন, “সিনেমাপাড়া আর আগের মতন নেই; আমরাও বদলে গেছি, সিনেমার ধরন বদলে গেছে, কলাকুশলী এমনকি এখনকার গল্পগুলোও বদলে গেছে। নিজেকে অনেক কিছুর সাথেই এখন আর খাপ খাওয়াতে কিংবা মিলিয়ে নিতে পারি না। হয়তো রমাই ঠিক কাজ করেছে। সঠিক সময়ে সরে দাঁড়িয়েছে। সবাইকেই সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে জানতে হয়।”
 
সুচিত্রাকে সুচিত্রার মতো থাকতে দিয়ে উত্তম সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন; ন‌ইলে হয়তো অমন অক্ষয় একটা জুটির অপমৃত্যু ঘটে যেত মিসেস সেনের আকাশছোঁয়া ইগোর ঘায়ে। আবার পর্দার আড়ালে চলে গিয়ে সুচিত্রাও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছিলেন; ন‌ইলে হয়তো আত্মিক মৃত্যুর ঘায়ে ঘায়ে মহানায়িকাকে অবধারিতভাবে জীবনের শেষ দিনের দিকে যাত্রার ক্ষণ গুনতে হতো অকালেই, বিষণ্ণ আয়ুর অভিশাপ মেনে নিয়ে।