সুখী হবার মূলমন্ত্র

প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই এমন কিছু মানবিক দিক আছে, যেগুলি নিজের জীবনে গ্রহণ করতে পারলে সেগুলির নিয়মিত চর্চায় জীবন সুন্দর হয়ে ওঠে। আমরা যখন কারও সম্পর্কে ভাবি, তখন সে ভালো কি মন্দ, এটা বিচার করতে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে, তার সুন্দর দিকগুলি আমাদের মাথায়ই আসে না। ফলে আমরা তাকে আমাদের মনের মতো করে বিচার করে তার সম্পর্কে একটা মীমাংসায় পৌঁছে যাই। আমাদের এই ধরনের আত্মতৃপ্তি আত্মঘাতী। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই: কেউই আসলে খারাপ হৃদয় নিয়ে বাঁচে না, পারিপার্শ্বিকতা এবং বাহ্যিক নানান প্রবৃত্তির কারণে মানুষ সুন্দর চিন্তাভাবনা থেকে ক্রমশ দূরে সরে যায়।

কোনো কিছু পাবার আশায় মানুষ যখন তার ভেতর ঘুমিয়ে-থাকা নিষ্ঠুর প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেয়, তখন মানুষের পশুত্ব জেগে ওঠে। সেসময় তার মস্তিষ্কও নির্দয়তা আর নির্মমতার পক্ষে তার ভাবনা ও কাজকে পরিচালিত করে। মজার বিষয় হলো, বেশিরভাগ সময়ই আমাদের কথা ও লেখা অন্যদের আমাদের সম্পর্কে ভুল ধারণা দেয়। হয়তো কোনো এক কারণে, কিংবা অকারণেই আমরা কোনো এক মুহূর্তে কিছু একটা বলে ফেলি, লিখে ফেলি। অথচ, অন্যরা ভুল বুঝে আমাদের সম্পর্কে এমন সব সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়, যা তাদের শান্তি দেয়, স্বস্তি দেয়। সাময়িক নীরবতা অনেক সমস্যা সমাধান করে দেয়, এমনকী প্রায়ই, সমস্যা তৈরি হতেই দেয় না।

সুখী হবার মূলমন্ত্র ৪টি:

কোনো কিছু সম্পর্কে নিজের মতো করে রায় না দেওয়া—রায় দেবার কাজটা সৃষ্টিকর্তার বা আদালতের উপরেই ন্যস্ত থাকুক;

যা-কিছু আমাদের কষ্ট দেয়, তা ভুলে যাওয়া, ভুলে যেতে না পারলেও অন্তত তা থেকে নিজেকে যে-কোনো মূল্যে দূরে রাখা;

মহত্ত্ব দেখানোর জন্য নয়, নিজেকে স্বস্তিতে রাখতে অন্যকে শর্তহীনভাবে ক্ষমা করে দেওয়া;

সব কিছুকে সহজভাবে নেওয়া কিংবা পুরোপুরি উপেক্ষা করে প্রয়োজনীয় কাজে মন দেওয়া—কোনো কিছু নিয়েই অহেতুক গবেষণা না করা, কারণ আমরা কোনো কিছু সহজভাবে নিতে পারি বা না পারি, এতে কিছু এসে যায় না, যা-কিছু যেমন আছে, তা ঠিক তেমনই থাকবে।

কার সম্পর্কে কে কী ভাবছে, এমনকী নিজের সম্পর্কে কে কী বলল, সেটা নিয়ে ভাবার কোনো মানে নেই। গোলাপকে কে কাঁটা বলল, আর কে জুঁই নামে ডাকল, এতে গোলাপের কী এসে যায়? গোলাপ তার নিজের সুবাসটাই ছড়াবে, গোলাপের কাঁটা নিজ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিদ্ধ করবেই। কারও কথায় তো আর গোলাপ বদলে গিয়ে ফুলকপি হয়ে যাবে না!

সাধারণ চোখ মানুষকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে দেখে। ও মুসলিম, ও হিন্দু, ও বৌদ্ধ, ও খ্রিস্টান, ও ফরসা, ও কালো, ও লম্বা, ও খাটো—এরকম করে। আর অসাধারণ চোখ মানুষের মনুষ্যত্বটাই দেখে। হৃদয়ের দিকে তাকালে মানুষের বাইরের খোলসটা আর চোখে পড়ে না।

মানুষের বাহ্যিক যা-কিছু, তা অর্জন করা যতটা সহজ, হারিয়ে ফেলা তার চাইতেও সহজ। কিন্তু মানুষের কূটস্থ হৃদয়টা যেমন, তেমনই থেকে যায় সবসময়। সেই হৃদয়টাকে চেনার মাধ্যমেই প্রকৃত মানুষটাকে চেনা যায়। যখন আমরা কাউকে তার ভালো দিকগুলিকে চিনতে সাহায্য করি, তখন যদি আমরা তাকে শুরুতেই বলতে থাকি, “তুমি এমন, তুমি তেমন, তোমার এটা খারাপ, ওটা খারাপ…”, তাহলে সে কিন্তু যে-কোনো উপায়েই হোক, আত্মপক্ষ সমর্থন করেই যাবে, এমনকী যদি সেটা ভুলও হয়, তবুও সে ভুলটাকেই আঁকড়ে ধরে থাকবে। সে আমাদের কোনো কথাই কানে নেবে না, এড়িয়েও চলতে পারে। তার চাইতে ভালো, যদি ও কেমন, সেটা নিয়ে ওকে আহত না করে, ও কেমন হলে ভালো হয়, সেটা কৌশলে বুঝিয়ে দিতে পারি। এমন করলে ও আমাদের সম্পর্কে খারাপ কিছু ভাববে না, এবং আমাদের সকল পরামর্শও সাদরে গ্রহণ করবে।

কারও আক্রমণাত্মক সমালোচনা করে তার কোনো উপকার করা যায় না, তার কাছে গ্রহণযোগ্যও হওয়া যায় না। কারও কাছে আসতে চাইলে, কাউকে নিজের মতো করে সাজাতে চাইলে, আমি যদি সমুদ্রও হই, তাকে ভাবতে হবে জল, যা ছাড়া সমুদ্রের অস্তিত্বই নেই। সে যদি জল হয়, তবে আমার নিজেকে তার জন্য তৃষ্ণার্ত করে তুলতে হবে, যাতে তাকে ছাড়া আমার অস্তিত্ব হয়ে পড়ে সংকটাপন্ন। কাউকে ভালোবাসা আগুন নিয়ে খেলার মতো—সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, ধোঁয়াটুকুও অবশিষ্ট থাকবে না। আর স্রষ্টাকে বা নিজের আত্মাকে ভালোবাসার অর্থই হলো, হয় আমি আমার ভালোবাসার বস্তুকে নিজের মতো করে পাবো, নতুবা নিজেই সে ভালোবাসার দহনে একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাব। এভাবে পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়াতেই পৃথিবীর সব সুখ নিহিত।
Content Protection by DMCA.com