সুখী ক্লিনারের গল্প

“আপনিই রুম পরিষ্কার করেন?”
“জি স্যার।”
“আপনার নাম কী?”
“রহিম।”
“আচ্ছা, ভালো। রুমটুম ভালোমতো পরিষ্কার করবেন। অফিস পরিষ্কার থাকলে দেখতে ভালো লাগে।”




(এতক্ষণ রহিম মাথা নিচু করে ঘষে ঘষে টাইলসের ফ্লোর পরিষ্কার করছিলেন। আমি এটা বলাতে মাথা তুলে বিনীতভাবে দাঁড়ালেন।)




“স্যার, আপনি হঠাৎ এটা বলসেন কেন? আমি গত বাইশ বছর ধরে ফ্লোর পরিষ্কার করি। আমার কাজ নিয়ে কখনওই কোনও বড়ো স্যার আমাকে কিছু বলতে পারেন নাই।”
“না না, রহিম, আমি আপনাকে এটা বলি নাই। আপনি ভালোভাবে কাজ করবেন। তাহলেই হবে।”
“স্যার, এটা আমার আর আমার বাচ্চাদের রিজিক। আমার ফ্লোর পরিষ্কার করতে ভালো লাগে, স্যার।”




রহিমের বয়স হবে ৪০-৪৫’এর মত। আমি ওঁর আত্মসম্মানবোধ আর কাজের প্রতি ভালোবাসা দেখে থ হয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন ছিল ওই অফিসে আমার প্রথম দিন। প্রথম দিনেই আমি ওঁর কাছ থেকে নতুন করে শিখলাম, কীভাবে নিজের চাকরিকে ভালোবাসতে হয়, নিজের কাজটাকে সম্মানের চোখে দেখতে হয়, আর সেই কাজটা এতটাই ভালোভাবে করতে হয়, যাতে অন্যদের কাছে নিজের কাজের মান সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী হওয়া যায়, ওটা নিয়ে বুক ফুলিয়ে কথা বলা যায়। চাকরি জিনিসটা আমার কাছে কখনওই প্রীতিকর কিছু মনে হয়নি। আমি জীবনানন্দের মতো করে বলি, “পৃথিবীতে নেই কোনও বিশুদ্ধ চাকরি।” রবি বাবু চাকরি করলে নিশ্চয়ই লিখতেন, “চাকরি যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে সর্বদাই করে যে বঞ্চনা।” তবুও আমরা চাকরি করি, চাকরি করতেই হয়, তাই। চাকরি বড়োই মায়াবী জিনিস। যতক্ষণ চাকরি থাকে শুধু ততক্ষণই এটাকে মন্দ বলা যায়। চাকরিকে গালি দেওয়ার জন্যও একটা চাকরি থাকা লাগে।




জব ফর লাইফ। নট, লাইফ ফর জব। তবুও চাকরি অনেক কিছুই কেড়ে নেয়। জগতের নিয়ম হল, কিছু কেড়ে না নিয়ে কিছু দেওয়া যায় না। গিভ অ্যান্ড টেক। এরই মাঝে জীবন কাটে, মানে কেটে যায়। চাকরি নিয়ে মন খারাপ করে থাকলে তো পুরোটাই লস। ইফ ইউ থিংক, ইউ ডিজার্ভ অ্যা বেটার জব, স্টপ কমপ্লেইনিং অ্যান্ড জাস্ট গো ফর ইট! অ্যাজ সিম্পল অ্যাজ দ্যাট! আচ্ছা, যা বলছিলাম। আমি সেই অফিসে ছিলাম ৬ মাস। এই ৬ মাসে কোনও দিনই রহিমকে বকশিস চাইতে দেখিনি। আমি কিংবা আমার অফিসাররা তা দিলেও উনি খুবই বিনীতভাবে সেটা রিফিউজ করতেন। ওঁকে একটা পয়সাও বকশিস দেওয়ার মতো অত টাকা কারও কাছে ছিল না।




রহিমের দুই ছেলেমেয়ে। বড়ো ছেলে বুয়েটে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ে। (ও আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। ও সে সময় সেকেন্ড ইয়ার ফার্স্ট সেমিস্টারে ছিল।) ছোটো মেয়েটা সে বছররই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিংয়ে ভর্তি হয়েছে। ভালো কথা, এ ঘটনাটি ২০১২ সালের শেষের দিকের।




রহিম গর্ব করে বলেন, “স্যার, আল্লাহ আমাকে অনেক দিসেন। আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি। আমার ২ ছেলেমেয়ের জন্য আমার কোনও দিনই কোনও টাকাপয়সা লাগে নাই। ওদেরকে প্রাইভেট পড়ানোর সামর্থ্য আমার ছিল না। স্কুলের স্যাররা টেস্ট পরীক্ষার পর ফ্রিতে প্রাইভেট পড়াইসেন। আমি অশিক্ষিত মানুষ। সবাই বলে, ওরা অনেক ভালো করতেসে। সবার কাছে ওদের সম্পর্কে ভালো কিছু শুনলে ভালো লাগে। আমার ছেলে আমাকে প্রতিমাসে ৮ হাজার টাকা পাঠায়। আমার এত টাকা লাগে না। মেয়েটাকে পড়াশোনা শেষ করানোর পর বিয়ে দিব। আমি টাকা জমাচ্ছি, স্যার।”
“আপনার বাসায় কে কে আছেন?”
“স্যার, আমি আর আমার বউ। মেয়ে হলে উঠসে। বউ টুকটাক সেলাইটেলাই করে। আমি ওকে নিষেধ করসি। বলসি, আর দরকার নাই, রেস্ট নাও। ও শোনে না। ওর নাকি বসে শুয়ে খেতে ভালো লাগে না।”
“আপনি অফিসের পর আর কিছু করেন?”
“না স্যার, বাসায় থাকি। বউটা সারা দিন একা থাকে, কত কষ্ট করে। ওর সাথে কাজ করি, ছেলেমেয়ের সাথে ফোনে কথা বলি। ছুটির দিনে আমরা সিনেমা দেখতে যাই, ঘুরি। আল্লাহ অনেক ভালো রাখসেন, স্যার। রোগবালাই দেন নাই, কোনও অশান্তিও দেন নাই।”




রহিমের কাজ আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছিল। আলমারির কোনায় যে ঝুলটা চোখেও পড়ত না, রহিম সেটাও পরিষ্কার করে ফেলতেন। সবসময়ই হাসিমুখে কাজ করতেন। ওঁর কাছ থেকে আমি শিখেছি, ছোটো চাকরি বড়ো চাকরি বলে কিছু নেই। একটা চাকরি ছোটো কিংবা বড়ো হওয়ার পেছনে দায়ী মূলত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, চাকরিটা নয়। আমরা চাকরি পাই আমাদের যোগ্যতা ও নিয়তি অনুযায়ী। ওঁর আরেকটা চমৎকার ব্যাপার ছিল, যেটা উনি কখনওই কাউকে বলতেন না। উনি একটা এতিমখানায় প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা করে দিতেন। আমি মাঝে মাঝেই ওঁকে রুমে ডেকে গল্প করতাম, ভালো-ভালো পরামর্শ দিতাম। এই অশিক্ষিত মানুষটার কাছ থেকে জীবনদর্শনের সহজপাঠ নিতাম। সহজভাবে বাঁচতে যে কত সুখ, তা ওঁকে দেখে বুঝতাম। ভাবতাম, আমরা কী কঠিনভাবেই না বাঁচি!




উনি বলতেন, “স্যার, দুনিয়ার সব মানুষই কারও না কারও উছিলায় বাঁচে। এতিম বাচ্চাগুলোকে আমরা না দেখলে কে দেখবে? আল্লাহ আমাকে অনেক ভালো রাখসেন। কেন রাখসেন? নিশ্চয়ই কোনও-না-কোনও কারণ আছে! আমার উছিলায় যদি কেউ একটু ভালো থাকে, তাহলে অসুবিধা কী?” আমি ওঁর কাছ থেকে ওঁর জীবনের গল্প শুনতাম। “স্যার, আমার বাচ্চাগুলোকে মানুষ করার জন্য অনেক কষ্ট করসি। নিজে না খেয়ে ওদেরকে খাওয়াইসি। কখনও ভালো কাপড় দিতে পারি নাই, দামি খাবার খাওয়াতে পারি নাই, কিন্তু ঠিকমতো বইখাতা কিনে দিসি। ওরা নাইনে উঠার পর থেকেই টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ চালাইসে। ঈদের সময় বউ মানুষের নতুন কাপড় সেলাই করে দিত, কিন্তু নিজে নতুন কাপড় কিনতে পারে নাই। আমার ছেলে আর ওর বন্ধুরা সবাই মিলে ঢাকায় রাস্তার কিছু ছেলেপেলেকে সন্ধ্যার সময় ফ্রিতে পড়ায়। শুনে আমি অনেক খুশি হইসি। আমরা কখনও কাউকে ঠকাই নাই। আল্লাহও আমাদেরকে কখনও ঠকান নাই।”




আচ্ছা, সাফল্য কী? আফসোস ছাড়া বাঁচাই সাফল্য। জীবনে বেঁচে থাকতে অনেক বড়ো বড়ো ডিগ্রি লাগে না, অনেক বেশি টাকাপয়সা লাগে না; সুখ লাগে, শান্তি লাগে, ভালোবাসা লাগে। কষ্ট নিয়ে অনেক দিন জীবনটাকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার চাইতে ছোট্ট একটা চড়ুইয়ের জীবন কাটানোও অনেক ভালো। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণই ফুড়ুৎফাড়ুৎ। জীবন মানে, সকালবেলা আফসোস ছাড়া ঘুম থেকে জাগা, রাতের বেলা কাছের মানুষের ভালোবাসা নিয়ে ঘুমুতে যাওয়া। এই তো! দেশ ও দশের কল্যাণ করতে করতে নিজের ছেলেকে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে দেওয়া জীবন নয়। আমি হার্ভার্ড-গ্রাজুয়েট এক ভদ্রলোককে চিনি, যাঁর একমাত্র ছেলে এইচএসসি পাস করার পর অখ্যাত একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। কিছুদিন ব্যান্ডফ্যান্ড করে আর কিছুদিন ইয়াবা খায়। সে ছেলের জীবন এভাবেই কাটছে।




আপনার ছেলে যখন আপনারই টাকায় কেনা দামি গাড়ি থেকে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে নেমে ব্ল্যাক লেভেলের বোতল হাতে নাইট ক্লাবে যায়, আর যদি এই ব্যাপারটা আপনাকে পীড়া দেয়, তবে এই কষ্টের দায় কিন্তু আপনি নিজেই এড়াতে পারেন না। আপনার সন্তানের জন্য সবচেয়ে ভালো লিগ্যাসি কী হতে পারে? টাকাপয়সা? কখনওই না। অনেক ধনী লোককে দেখেছি, নিজের সুস্থসবল ছেলেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকাপয়সা দিয়ে কীভাবে পঙ্গু করে দেন। আমার পরিচিত এক অনেক বড়ো অফিসারের ছেলে এবং ওঁর ড্রাইভারের ছেলে একই সাথে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিল। ড্রাইভারের ছেলে এখন পড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে আর ওঁর ছেলে পড়ে একটা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে। আপনিই বলুন, কোন লিগ্যাসিটা বেটার? (আমার পাঠকদের আমি সবিনয়ে অনুরোধ করব, এই কথাটার ভেতরের অর্থটা বুঝতে। এটা কোনওভাবেই কারও কিংবা কোনও সিস্টেমের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার নয়।) অশিক্ষিত কিংবা অল্পশিক্ষিত বাবা-মা’র ছেলেমেয়ে যখন অনেকদূর পাড়ি দেয়, তখন এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ওই বাবা-মা’র জীবনদর্শন অনেক উচ্চশিক্ষিত ব্যর্থ বাবা-মা’র জীবনদর্শনের চাইতে অনেক অনেক এগিয়ে।




সার্টিফিকেটের শিক্ষার চাইতে জীবনের দর্শন বড়ো। আপনি আপনার ছেলেমেয়ের হাতে অনেক মাছ দিয়ে গেলে ওরা হয়তো ক’বেলা ভালোমতো খেতে পারবে। কিন্তু এরপর যখন মাছ ফুরিয়ে যাবে, তখন? তার চাইতে ভালো, ওদেরকে মাছধরাটা শিখিয়ে দিন। ওরা নিজেরাই ধরে খেতে পারবে। মাছ আর কোনও দিনই ফুরোবে না। আমার কাছে বিল গেটসের ছেলেমেয়েকে পৃথিবীর সব থেকে দুঃখী সন্তান মনে হয়। ওরা কোনও দিনই ‘বেটার’ লাইফস্টাইলের খোঁজ পাবে না।




আর, ভালো কথা, রহিমের নাম কিন্তু রহিম না।




পুনশ্চ। এই গল্পের অন্যতম একটা অ্যাপ্রিসিয়েশন শেয়ার করছি। অ্যাপ্রিসিয়েশনটা সৌমিত্রদার৷




সুশান্ত, দারুণ! সত্যিই খুব চমৎকার একটা কাজ করছ! লোকজনকে স্বপ্ন দেখতে শেখাচ্ছ এবং সুন্দর একটা পথ বেছে নিতে ইন্সপায়ার করছ। তোমার এই চেষ্টাকে আমি মন থেকে সাধুবাদ জানাই। আমি নিজেও এটা করি অনেক দিন থেকেই। কিন্তু, যারা আমার সামনে আসে, কিংবা যাদের সাথে আমার দেখা হয়, তাদেরকেই শুধু আমি হেল্প করতে পারি। এদের সংখ্যা খুব সীমিত। আমি অতটা লিখতে পারি না। তুমি সবার জন্যে লিখছ। তোমার ভাবনাগুলো তোমার লেখার মধ্য দিয়ে সবার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এটা অনেক বড়ো একটা কাজ, কারও জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সাহায্য করা। তুমি বিনে পয়সায় সেমিনার নিয়ে সবার স্বপ্ন বুনে দিচ্ছ। আমাদের সমাজের জন্যে এটার দরকার আছে। এটা করার ইচ্ছে হয়তো অনেকেরই আছে। কিন্তু, করছে কয়জন? সময় থাকলে, আমার সাথে দেখা কোরো। আমার সত্যিই ভালো লাগবে। আমি অনেক ব্যস্ত থাকি, তবুও সময় করে তোমার লেখাগুলো পড়ি। আমি তোমার লেখার ফ্যান হয়ে গেছি। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।




ওই যে একটা গল্প লিখলে না? সুখী ক্লিনারের গল্প। রহিমের জীবনের গল্প। বিশ্বাস করো ভাই, অনেক ভালো লেগেছে। ভেরি গুড এক্জামপল, আই মাস্ট সে! কাজকে ভালোবাসার গল্প, সহজভাবে সবচেয়ে সুন্দর জীবনটা কাটানোর দর্শন। এটা খুব খুব সময়োপযোগী হয়েছে। ভাই, আমি জানি একটা পয়সা আয় করতে কতটা কষ্ট করতে হয়। শিল্পপতিদের ছেলেমেয়েরা কখনওই সেটা জানতে পারবে না। আমি আমার সিনিয়র শিল্পপতি বন্ধুদের বলি, আপনার ছেলেটাকে পৃথিবীর পথটা চিনতে দিন। ওকে পঙ্গু করে রাখবেন না। আপনি যে শ্রমের বিনিময়ে আজকের আপনি, ওদেরকে সেটা বুঝতে দিন। কষ্ট লাগে তখন, যখন দেখি, বেশিরভাগ সময়ই ওরা কেউ এই প্রস্তাবে রাজি হয় না। আমি ওদেরকে বলি, আয় করা কতটা কষ্টের কাজ, এটা ওদের ছেলেমেয়েকে ওরা শেখাক। ছেলেমেয়েদের সরাসরি কোম্পানির ডিরেক্টর/ মালিক বানিয়ে দিলে ওদের কখনওই এই অভিজ্ঞতা হবে না, কীভাবে লোকের সাথে ব্যবহার করতে হয়। কারণ, ওদের স্টাফরা ওদের সাথে মালিক হিসেবে যে আচরণটা করা দরকার, সেটাই করবে এবং এতে ওরা কোম্পানির আসল সমস্যাগুলো কোথায় কোথায়, সেটা প্রকৃত চিত্রটা নিজে দেখে বুঝতে পারবে না। এমনকি ওরা কোম্পানিতে একজন চাকরিজীবী হিসেবেও ক্যারিয়ার শুরু করতে পারে, কিন্তু সরাসরি ডিরেক্টর/ মালিক হিসেবে কিছুতেই নয়!!