যখন চেতনা বহির্মুখ লীলায় সম্পূর্ণ নিমগ্ন হয়ে ক্লান্ত হয়—অর্থাৎ নাম, রূপ, ক্রিয়া, আনন্দ, বেদনা—সব অভিজ্ঞতার পূর্ণতা লাভ করে, তখন তার ক্রিয়াশক্তি ধীরে ধীরে শান্ত হতে শুরু করে। ক্রিয়া ধীর হয়, কারণ আর কিছু করবার নেই; অভিজ্ঞতার চক্র সম্পূর্ণ।
এরপর রস নীরবতায় মিশে যায়—অর্থাৎ চেতনা যে সুখ-দুঃখ, রাগ-ভয়, প্রেম-বিরহের রস উপভোগ করছিল, সেগুলো এখন নিস্তব্ধ তৃপ্তিতে বিলীন হয়। নাম-রূপ আলগা হতে থাকে—বস্তু ও চিন্তার সীমা ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়, যেন ঢেউয়ের ভেতর থেকে আবার সমুদ্র দেখা যায়।
এই ধাপে চেতনার অন্তরে এক গভীর রূপান্তর ঘটে—যাকে বলা হয় প্রত্যভিজ্ঞা (Pratyabhijñā), অর্থাৎ “আত্মস্বীকৃতি” বা “নিজেকে চিনে ফেলা।” এখানে চেতনা হঠাৎ উপলব্ধি করে—“এই বহুত্ব, এই জগৎ, এই অভিজ্ঞতাগুলো সবই তো আমারই দীপ্তির তরঙ্গ! আমি কখনোই হারাইনি, কেবল ভুলে গিয়েছিলাম।” এই স্বীকৃতি কোনো তাত্ত্বিক বোধ নয়; এটি প্রত্যক্ষ অনুভব, যেন মেঘের আড়াল থেকে সূর্য নিজেই নিজের আলো চিনে নেয়।
এই প্রত্যভিজ্ঞা যত গভীর হয়, ততই শুরু হয় প্রত্যাহার (Nimeṣa)—অর্থাৎ চেতনার প্রত্যাবর্তন। যেভাবে আগে “উন্মেষ” ছিল চেতনার প্রসারণ বা উন্মোচন, তেমনি “নিমেষ” হলো তার বিপরীত—নিজের মধ্যেই সংকোচন ও লয়। এখানে চেতনা নিজের প্রকাশিত আভাস, রূপ, চিন্তা, তত্ত্ব—সব কিছু নিজের ভেতরে টেনে নেয়। এই প্রত্যাহার প্রক্রিয়ায় সংখ্যান খুলে যায়—অর্থাৎ শ্রেণিবিন্যাস, ভেদবোধ, কারণ্য সম্পর্ক সব ভেঙে পড়ে; ক্ষেপ শান্ত হয়—সৃষ্টি-প্রক্ষেপণ থেমে যায়; উন্মেষের ডানায় ভর করে—চেতনা আবার সেই নিস্তব্ধ আত্ম-সচেতনতায় ফিরে আসে, যেখান থেকে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল।
এই অবস্থায় চেতনা পৌঁছায় অচিন্ত্য ঐক্যে—যা এখন আর সম্ভাবনা নয়, বরং পরিপূর্ণ উপলব্ধি। এখানে পূর্ণাহংতা (Pūrṇāhaṃtā) উদ্ভাসিত হয়—অর্থাৎ “আমি সম্পূর্ণ”—এই অনুভূতি। এটি কোনো অহং নয়, বরং সেই আত্ম-চেতনা, যা সব কিছুকে নিজেরই রূপ বলে জানে। চেতনা বুঝে যায়—“সৃষ্টিও আমি, লয়ও আমি, নৃত্যও আমি, নীরবতাও আমি।”
এইভাবেই চেতনার পরিক্রমা সম্পূর্ণ হয়। যেখান থেকে যাত্রা শুরু—অচিন্ত্য ঐক্য—সেই স্থানে আবার প্রত্যাবর্তন ঘটে, কিন্তু এবার তা অজ্ঞান নয়, সচেতন ঐক্য। এই পরিক্রমার দশ ধাপ বা তরঙ্গকে সংক্ষেপে বলা যায়—
১. ঐক্য (Āikya)—অবিভক্ত পূর্ণতা।
২. উন্মেষ (Unmeṣa)—আত্মসচেতনতার প্রথম জাগরণ।
৩. ক্ষেপ (Kṣepa)—চেতনার প্রক্ষেপণ বা বহির্মুখ গতি।
৪. সংখ্যান (Saṅkhyāna)—বহুত্বের বিন্যাস ও সংগঠন।
৫. নাম-রূপ-ক্রিয়া—দৃশ্যমান জগৎ ও কার্যের গঠন।
৬. রস-বিমর্শ—অভিজ্ঞতার উপভোগ ও প্রতিফলন।
৭. আবরণ (Āvaraṇa)—সীমাবদ্ধতার জন্ম ও অজ্ঞান।
৮. অন্বেষণ (Anveṣaṇa)—উৎসের আকাঙ্ক্ষা ও আত্মসন্ধান।
৯. প্রত্যভিজ্ঞা (Pratyabhijñā)—আত্ম-স্বীকৃতি বা পুনরুদ্ধার।
১০. প্রত্যাহার (Nimeṣa)—চেতনার পুনর্লয় ও ঐক্যে প্রত্যাবর্তন।
এই পুরো গতিপ্রবাহই কালী-চেতনার নৃত্য—সৃষ্টি থেকে লয়, বহুত্ব থেকে ঐক্য, বিভ্রান্তি থেকে স্বীকৃতি। প্রতিটি ধাপ আসলে একই চেতনার ভিন্ন ভিন্ন কম্পন—যেমন সুরের মধ্যে ওঠা-নামা থাকলেও সংগীত এক থাকে। শেষে চেতনা আবার নিজের সেই নিস্তরঙ্গ, চিরসচেতন অবস্থায় স্থিত হয়—যেখানে “আমি” ও “তুমি,” “সৃষ্টি” ও “সংহার”—সব ভেদ মিলিয়ে যায় এক অনন্ত, নীরব, দীপ্ত ঐক্যে।
“বারো-কালিকা” ও “ষোড়শ-কালিকা” ধারণা—অর্থাৎ চেতনার বিকাশ ও প্রত্যাবর্তনের বারো (অথবা ষোলো) ধাপের তাল বা ছন্দ। “কালিকা” শব্দটি এখানে কোনো নির্দিষ্ট দেবীমূর্তি নয়; এটি “কাল-শক্তি” বা “সময়-তরঙ্গ”-এর একক—চেতনার এক একটি কম্পন, এক একটি স্ব-উন্মোচনের মুহূর্ত। প্রতিটি কালিকা হলো চেতনার যাত্রাপথের এক ধাপ, ঠিক যেমন একটি সুরেলা সংগীতে এক একটি মাত্রা বা রাগের ঘাট।
(১) অচিন্ত্য ঐক্য: এটি হলো সেই নিঃশব্দ অবস্থান, যেখানে সব সম্ভাবনা এখনও অনাবিষ্কৃত। যেমন ঘুমের গভীরতম স্তরে স্বপ্নের বীজ থাকে কিন্তু প্রকাশ পায়নি। উদাহরণ—সমুদ্রের স্থির জলে যেমন সমস্ত ঢেউ সম্ভাবনা হিসেবে আছে, কিন্তু কোনো তরঙ্গ এখনও ওঠেনি।
(২) উন্মেষ (Unmeṣa): এটি চেতনার প্রথম জাগরণ। সমুদ্রের জলে প্রথম হালকা দোলা উঠেছে—একটি তরঙ্গ জন্ম নিচ্ছে। মানুষের জীবনে এটি সেই মুহূর্ত, যখন আত্মসচেতনতা জাগে—“আমি আছি”—এই বোধের উদ্ভব।
(৩) ক্ষেপ (Kṣepa): চেতনা এখন নিজের সম্ভাবনাগুলো বাইরে নিক্ষেপ করছে—সৃষ্টি শুরু হচ্ছে। যেমন শিল্পীর মনে একসঙ্গে অসংখ্য রং, ভাব, আকৃতি ভেসে ওঠে কিন্তু তারা এখনও এলোমেলো।
(৪) সংখ্যান (Saṅkhyāna): এই এলোমেলো ভাবনাগুলিকে সংগঠিত করা—রূপ ও কাঠামো দেওয়া। শিল্পীর মন এখন আঁকায় রূপ পেতে শুরু করেছে; চিন্তার আভাস থেকে নির্দিষ্ট নকশা গঠিত হচ্ছে। প্রকৃতির ভাষায়, এটি হলো মহাকাশ থেকে তত্ত্বগুলির গঠন: আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, ভূমি ইত্যাদি।
(৫) নামভব: এখন চেতনা প্রতিটি রূপকে নাম দেয়। ভাষা ও ধারণা জন্ম নেয়। যেমন কেউ ফুলকে দেখে বলে “এটি গোলাপ”—এভাবে পরিচয় ও চিন্তার সীমা তৈরি হয়। নামের জন্ম মানেই জ্ঞান-বিভাজনের সূচনা।
(৬) রূপভব: এখন সেই নামগুলির সঙ্গে আকার স্থির হয়—চোখে-দেখা দৃশ্যমান জগৎ তৈরি হয়। “গোলাপ” এখন কেবল ধারণা নয়, আকার ও রং-সহ বাস্তব অভিজ্ঞতা।
(৭) ক্রিয়ালীলা: চেতনা এখন কর্মে নেমেছে—সৃষ্টি, বিকাশ, বিনাশ—সবই ঘটছে। মানুষ কাজ করছে, ভাবছে, সৃষ্টি করছে; জগৎ গতিশীল। এটি শিব-শক্তির সক্রিয় লীলা।
(৮) রসাবেশ: অভিজ্ঞতা এখন রসের রূপ নেয়—আনন্দ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ, ন্যায়-অন্যায়। যেমন নাটক বা সংগীতের নায়ক এখন চরিত্রের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে ঢুকে গেছে—সে নিজের সৃষ্টিতেই মোহিত।
(৯) বিমর্শ-প্রভা: এখন চেতনা নিজেকে দেখতে শুরু করে—“আমি যা সৃষ্টি করেছি, সেটিই তো আমার প্রতিফলন।” এই স্তরে আত্ম-পর্যালোচনা জাগে। মানুষ নিজের কর্ম, অনুভব ও জীবনকে বিশ্লেষণ করতে শুরু করে।
(১০) আবরণ-সঙ্কোচ: এখন লীলা এত ঘন হয়ে যায় যে, চেতনা নিজের উৎসকে ভুলে যায়। মায়া ও কণচুক-এর পর্দা নামে। ব্যক্তি ভাবে “আমি আলাদা,” “আমি সীমিত,” “আমি কর্তা।” এটি অহং-বোধের স্তর।
(১১) প্রত্যভিজ্ঞা (Pratyabhijñā): অভিজ্ঞতার পূর্ণতা থেকে হঠাৎ উপলব্ধি জাগে—“এ সমস্তই তো আমারই প্রকাশ!” এই স্বীকৃতি আত্মস্মৃতির সূচনা—চেতনা নিজের উৎস চিনে ফেলে, যেমন স্বপ্নে-থাকা মানুষ হঠাৎ বুঝে ফেলে, সে স্বপ্ন দেখছে।
(১২) প্রত্যাহার-লয় (Nimeṣa): শেষে সমস্ত ক্রিয়া, রস, রূপ, নাম ধীরে ধীরে কেন্দ্রে ফিরে আসে—চেতনা আবার সেই নিস্তব্ধ ঐক্যে লীন হয়, যেখান থেকে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। যেমন নদী সাগরে মিশে আবার জলে পরিণত হয়। এখানেই পূর্ণাহংতা—“আমি সব, আমি এক।”
ষোড়শ-কালিকা সংস্করণ: ষোড়শ-কালিকায় এই বারো ধাপের মধ্যে মধ্যবর্তী সূক্ষ্ম দোলগুলোকে আরও বিস্তারিতভাবে ধরা হয়। যেমন—
আভাস (Ābhāsa): চেতনার প্রথম ঝলক, যখন ভাবনার আভা দেখা দেয়।
মায়া ও কণচুক: সীমাবদ্ধতার বিভিন্ন স্তর—সময়, স্থান, কারণ্য, জ্ঞান ইত্যাদি।
করুণা-উন্মোচন: চেতনার পুনরুত্থান—সীমার মধ্যে করুণার সঞ্চার।
অনুগ্রহ-ঝলক: চেতনার অনন্ত দিক থেকে আসা কৃপার আলো, যা পুনর্মিলনের পথে আহ্বান জানায়।
এভাবে ষোড়শ-কালিকা সংস্করণে চেতনার প্রতিটি সূক্ষ্ম নাড়ির (spanda) ধ্বনি ধরা হয়—যাতে বোঝা যায়, সৃষ্টির কোনো অংশই স্থির নয়; সবই এক চলমান মহা-স্পন্দন।
এই বারো (অথবা ষোলো) কালিকা হলো চেতনার পূর্ণ যাত্রার রূপরেখা—
নীরব ঐক্য থেকে জাগরণ, জাগরণ থেকে সৃষ্টি, সৃষ্টি থেকে অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞতা থেকে আত্ম-বিস্মৃতি, আর সেই বিস্মৃতি থেকেই আবার আত্ম-স্মৃতি ও প্রত্যাবর্তন।
এই চক্রই কালী-চেতনার মহা-নৃত্য—অভিন্ন ঐক্যের চিরন্তন ওঠা-নামা।
“কালিকা” বা চেতনার এই বারো/ষোলো ধাপ কেবল দর্শনের কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়, বরং সাধকের অন্তরজগতে বাস্তব অভিজ্ঞতা হিসেবে প্রতিফলিত হয়। অর্থাৎ, এই স্তরগুলো সাধকের ধ্যান, শ্বাস, মন্ত্র, অনুভূতি—সব কিছুর মধ্যেই প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হয়।
শ্বাসে উদ্গম-নীগম (প্রাণ-আপান)-এর মধ্যে এই স্পন্দন ধরা পড়ে। যখন আমরা নিঃশ্বাস নেই, তা হলো উদ্গম—চেতনার প্রসারণ বা “উন্মেষ”; আর যখন নিঃশ্বাস ছাড়ি, তা হলো নীগম—চেতনার প্রত্যাহার বা “নিমেষ”। এই নিয়মিত ওঠা-নামার মধ্যেই চেতনার মহা-নৃত্য ঘটে। জীবনের প্রতিটি শ্বাস আসলে সৃষ্টির এই চক্রের প্রতীক—সৃষ্টি, স্থিতি, সংহার। একে বলা যায়—মহাশক্তির অন্তর্লয়িত স্পন্দন।
মন্ত্র-ধ্বনিতে নাম-রূপের খেলায় অর্থ-আলো জাগে। যখন সাধক মন্ত্র জপ করেন, তখন সেই শব্দ কেবল উচ্চারণ নয়—এটি চেতনার ভেতরে এক বিশেষ কম্পন সৃষ্টি করে। মন্ত্রের শব্দে “নাম” ও “রূপ”-এর মধ্যে একটি সূক্ষ্ম সম্পর্ক জাগে—শব্দ (ধ্বনি) ও অর্থ (চেতনা)-এর সংযুক্তি ঘটে। তখন ধীরে ধীরে অর্থ-আলো জ্বলে ওঠে—অর্থাৎ জগৎ ও নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একত্ববোধ প্রকাশিত হয়।
ধ্যানে বিমর্শ বেড়ে উঠলে রস-আসক্তি আলগা হয়। বিমর্শ মানে স্ব-প্রতিফলন বা আত্মসচেতনতা। যখন ধ্যান গভীর হয়, তখন চেতনা নিজের অভিজ্ঞতাগুলিকে নির্লিপ্তভাবে দেখতে শেখে। আনন্দ বা বেদনার আসক্তি কমে যায়—সাধক বুঝতে শুরু করে যে, সব রস, সব অনুভূতিই একই চেতনার ভিন্ন তরঙ্গ। এতে মন ধীরে ধীরে শান্ত হয়, ভোগ বা প্রত্যাখ্যানের প্রবণতা মিলিয়ে যায়।
কৃপা-ঝলকে প্রত্যভিজ্ঞা ঘটে—“যাকে খুঁজছিলাম, আমি-ই তো সে।” সবশেষে ঘটে কৃপা বা অনুগ্রহ—চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ। তখন হঠাৎ উপলব্ধি হয়—“আমি” সারাজীবন ঈশ্বর, মুক্তি বা চেতনার সন্ধান করছিলাম, আসলে সেই আমি-ই তো সেই চেতনা। এটি কোনো যুক্তি নয়, এক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। এই মুহূর্তেই ঘটে প্রত্যভিজ্ঞা—আত্মস্বীকৃতি, আত্মস্মরণ, চেতনার নিজের দিকে ফিরে আসা।
এইসব অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, “কালিকা” কোনো বাহ্য দেবীর ধারাবাহিক তালিকা নয়—এটি অভ্যন্তরীণ সময়-স্বর—চেতনা নিজেকে যেভাবে সময়ের মধ্যে অনুভব করে, সেই স্বরবৃত্তি। তাই একে বলা হয়েছে শক্তির অন্তরঙ্গ তালের পরিমাপ।
বহুত্ব কোনো ভ্রান্তি নয়; এটা ঐক্যের সুরারোপ। অর্থাৎ, জগৎ ও অভিজ্ঞতার বহুবিধতা কোনো মায়া নয় যা অস্বীকার করতে হবে—এটি পরম চেতনারই স্বরচিত সংগীত, তারই আত্মপ্রকাশ। যেমন এক সংগীতে নানা সুর, তাল, ভঙ্গি মিলেও সংগীত এক থাকে—তেমনি সৃষ্টি, স্থিতি, সংহার, তিরোভাব ও অনুগ্রহ—এই পাঁচ ক্রিয়াও একই চেতনার পাঁচ ভিন্ন সুর।
ক্ষেপ না হলে প্রকাশ নেই—অর্থাৎ বহির্মুখ গতি না হলে সৃষ্টি হয় না। সংখ্যান না হলে অর্থ নেই—অর্থাৎ সংগঠন ছাড়া চেতনার প্রকাশ অস্পষ্ট। বিমর্শ না হলে স্বীকৃতি নেই—অর্থাৎ নিজের দিকে না তাকালে চেতনা নিজেকে চিনতে পারে না। প্রত্যাহার না হলে শান্তি নেই—অর্থাৎ সমস্ত অভিজ্ঞতা শেষে নিজের উৎসে ফিরে না গেলে পরিপূর্ণতা আসে না।
প্রতিটি কালিকা, প্রতিটি স্তর, প্রতিটি নৃত্য—একই চেতনার ভিন্ন ভিন্ন কম্পন। তাদের মিলিত ছন্দেই গাওয়া হয় কালী-চেতনার মহাগান—সৃষ্টি-স্থিতি-সংহার-তিরোভাব-অনুগ্রহ—সবই এক, সবই বর্তমান, সবই তাঁরই লীলা।
কালী কেবল এক দেবী নন—তিনি চেতনার ছন্দ, সৃষ্টি ও বিলয়ের নিত্যগতি, যেখানে একতা নিজেকে ভাঙে, আর ভাঙনের মধ্য দিয়েই নিজের পূর্ণতাকে পুনরুদ্ধার করে। কালী সেই অনন্ত প্রক্রিয়ার প্রতীক, যেখানে চেতনা ক্রমে ক্রমে নিজেকে চেনে—এক থেকে বহু, বহু থেকে আবার এক।
“গতি”, “ক্রমণ” এবং “কলন”—এই তিনটি মূল ধারণা কালী-তত্ত্বের গভীর দার্শনিক অর্থ তুলে ধরে। “গতি” কেবল শারীরিক চলাচল বা স্থানগত পরিবর্তন নয়; বরং এটি চেতনার চিরন্তন সৃজনশীল প্রবাহ—এক এমন গমন, যেখানে চেতনা নিজেই নিজেকে প্রকাশ করছে এবং আবার নিজের ভেতরে লীন হচ্ছে।
গতি মানে গমন, অর্জন ও প্রাপ্তি। সাধারণত আমরা গতি বলতে স্থান বা অবস্থার পরিবর্তন বুঝি, কিন্তু ক্রমপন্থা (Krama) দর্শনে, “গতি” মানে চেতনার ভেতরে চলমান সেই অনাদি তরঙ্গ, যেখানে চেতনা কখনো নিজের দীপ্তিকে বাইরে প্রকাশ করে (উন্মেষ), আবার কখনো নিজেকে নিজের কেন্দ্রে প্রত্যাহার করে (নিমেষ)। এই ওঠা-নামাই সৃষ্টির স্পন্দন—Spanda। এটি শাশ্বত; কোনো প্রথম মুহূর্ত বা শেষবিন্দু নেই।