শৈব কালী: তিরানব্বই



কালগ্রাস—সময়ের গ্রাস: কালীকে কাল-সংকর্ষিণী (Kāla-Saṁkarṣiṇī) বলা হয়, কারণ তিনি সময়ের গ্রাসিকা—যিনি সীমিত সময়, অনুক্রম ও পরিবর্তনের সমস্ত চিহ্নকে নিজের চেতনায় বিলীন করে দেন। তাঁর এই “গ্রাস” কোনো ধ্বংস নয়; এটি সময়ের আত্মসাৎ, সময়ের নিজের উৎসে প্রত্যাবর্তন। এই প্রক্রিয়াকেই ক্রমপন্থায় বলা হয় কালগ্রাস—যার দ্বারা চেতনা সময়ের সীমাবদ্ধতা থেকে নিজেকে মুক্ত করে তার আদি-অকাল প্রকৃতিতে উদ্‌ভাসিত হয়।

ক্রম তত্ত্বে বলা হয়, সময়ের বিলুপ্তির এই প্রক্রিয়া ঘটে ধাপে ধাপে, বারোটি স্তরে—যেগুলিকে বলা হয় বারো (মতান্তরে ষোলো) কালিকা (Kālikāḥ)। প্রতিটি কালিকা সময়ের এক-একটি রূপ, এক একটি ঘনত্ব, যেখানে সময়ের অনুক্রম ক্রমে শিথিল হয়। প্রথম স্তরে সময় এখনও ধারাবাহিক প্রবাহরূপে অনুভূত হয়; পরবর্তী স্তরগুলোতে তার গতি ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে; আর দ্বাদশ স্তরে সময় সম্পূর্ণ বিলীন হয় চেতনার নিঃশব্দ কেন্দ্রে।

ক্রমপন্থার চূড়ান্ত তত্ত্বে “ত্রয়োদশ নীতি” এমন এক দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক অবস্থা নির্দেশ করে, যেখানে সময়, অনুক্রম এবং সৃষ্টি—সব কিছু নিজের উৎসে গলে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। যতক্ষণ চেতনা নিজেকে ক্রমধারায় প্রকাশ করে, ততক্ষণ “আগে-পরে”, “সৃষ্টি-লয়”, “ধ্বনি-নীরবতা”—এই দ্বন্দ্ব বা ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। কিন্তু ধ্যান বা চেতনার অন্তর্জাগরণ যত গভীরে প্রবেশ করে, তত দেখা যায়, এই ধারাবাহিকতার সূক্ষ্মতম স্পন্দনও এক সময় নিজের কেন্দ্রবিন্দুতে মিলিয়ে যায়। সেই কেন্দ্রে সময় আর সময় নয়, গতি আর গতি নয়—চেতনা নিজের মধ্যেই ফিরে আসে, নিস্তব্ধ, অকাল, অনন্ত।

ক্রম দর্শন এই অবস্থাকে “ত্রয়োদশ নীতি” বলে অভিহিত করে। কারণ সময়ের বারোটি রশ্মি বা ধারা—যা সৃষ্টির দ্বাদশ স্তর বা কালচক্রের প্রতীক—অতিক্রম করে চেতনা ত্রয়োদশ স্তরে পৌঁছায়। সেখানে আর কোনো পরিমাপ নেই, কোনো বিভাজন নেই; সমস্ত অনুক্রম একমুহূর্তে গলে যায় চেতনার উৎসআলোয়। এই অবস্থাই অকাল—অর্থাৎ কালহীন, কালাতীত। এখানেই কালী আর কাল নন, বরং অকাল স্বরূপ। এই অকাল অবস্থায় সময় নিজেরই উৎসে বিলীন হয়ে যায়, যেমন নদী নিজের সাগরে মিশে আবার জলে পরিণত হয়।

অন্য দর্শনে, যেমন শৈব ত্রিক বা বেদান্তে, সময়ের পরিসমাপ্তি সাধারণত পরমেশ্বরের মধ্যেই ধরা হয়। সেখানে ঈশ্বর বা ব্রহ্ম হচ্ছেন সেই চূড়ান্ত কেন্দ্র, যার মধ্যে সময় ও সৃষ্টির ধারা শেষ হয়। কিন্তু ক্রমপন্থা এই ধারণাকে আরও গভীর ও সূক্ষ্ম করে তোলে। ক্রম বলে—কালী নিজেই সেই পরমেশ্বরেরও উৎস। তিনি শুধু সময়েরই অধিষ্ঠাত্রী নন, ঈশ্বরতত্ত্বেরও ভিত্তিশক্তি। অর্থাৎ, পরমেশ্বর যে-চেতনা, তার প্রকাশের যে-গতি সময় নামে পরিচিত, উভয়েরই আদি কারণ কালী। তাই তিনি সময়েরও অতীত, ঈশ্বরেরও অতীত। তাঁর এই অতীন্দ্রিয় স্বরূপে চেতনার প্রকৃত স্বাধীনতা প্রকাশিত হয়—এক এমন অবস্থা, যেখানে সৃষ্টিও এক আত্মাভিজ্ঞতার খেলা মাত্র।

এই অতিক্রমী স্বরূপ বোঝাতে শাস্ত্রে তাঁকে বলা হয়েছে “দ্বাদশারে-শ্মিময়-কালচক্র-ভক্ষিণী”—অর্থাৎ তিনি সেই শক্তি, যিনি সময়ের দ্বাদশ রশ্মি বা কালচক্রকে গ্রাস করেন। এখানে “ভক্ষিণী” মানে ধ্বংসকারিণী নয়, বরং সীমার বিলুপ্তিকারিণী। যে-চক্র সময়কে ঘুরিয়ে রাখে, সেই সীমা তিনি নিজের অন্তঃআলোয় শোষণ করে নেন। তখন সময় আর বাহ্যিক প্রবাহ থাকে না, তা পরিণত হয় চেতনার অন্তর্লীন স্পন্দনে।

আবার তাঁকে বলা হয় “ষোড়শান্ত-কালভূমিকা”—যিনি ষোলো স্তরের সীমা অতিক্রম করে অবস্থান করেন। ষোড়শ সংখ্যা এখানে পূর্ণতার প্রতীক—ষোলো-কলা বা ষোলো স্তর, যেখানে ভাষা, সময় ও শক্তি তাদের শেষ সীমায় এসে মিশে যায় শান্তিতে। এই স্তরে কালী আর কোনো ক্রমে অবস্থান করেন না; তিনি ক্রমেরও অতীত, সমগ্র গতির অন্তর্লীন স্থিতি।

দর্শনের দৃষ্টিতে এই অবস্থাই কালী-চেতনার মুক্তি ও পূর্ণতার প্রতীক। সময়, স্থান ও কারণ-ফল সম্পর্ক আসলে চেতনার নিজেরই প্রকাশের উপায়। চেতনা যখন নিজেকে সীমাবদ্ধভাবে অনুভব করে, তখন সে সময় ও স্থানের ছাঁচে নিজেকে ফেলে। কিন্তু যখন সে নিজের সত্যস্বরূপে জেগে ওঠে—যেখানে জানা ও জানার বস্তু, ধ্বনি ও নীরবতা, সৃষ্টি ও লয়—সব এক হয়ে যায়—তখন সে আর কোনো ক্রমের অধীন থাকে না। তখন চেতনা জানে, যে আমি সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছি, সেই আমিই সময়; যে ঈশ্বরকে আমি উপলব্ধি করছি, সেই ঈশ্বর আমারই প্রকাশ। এই স্বীকৃতি হলো চেতনার “স্বাতন্ত্র্য” বা নিজের স্বাধীনতা, যা ক্রমদর্শনের চূড়ান্ত উপলব্ধি।

ধ্যান বা সাধনায় এই তত্ত্ব অভ্যন্তরীণভাবে অনুভূত হয়। সাধক যখন শব্দের স্তর পেরিয়ে নীরবতার গভীরে যায়—বর্ণ থেকে পদ, পদ থেকে মন্ত্র, মন্ত্র থেকে নাদ, নাদ থেকে নিস্তব্ধতা—তখন শব্দ ও নীরবতার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। সেই অবস্থায় সময় থেমে যায়, কারণ সময়ের ধারাই শব্দের ওঠানামা। সেখানে না অতীত আছে, না ভবিষ্যৎ, আছে কেবল এক চিরন্তন বর্তমান—এক এমন অবস্থা, যেখানে চেতনা নিজের মধ্যে নিজের প্রতিফলন মাত্র। এই অবস্থাই “অকাল” বা কালহীন চেতনা—যেখানে কালী ও কাল, সৃষ্টি ও লয়, ঈশ্বর ও শক্তি—সব একই অনন্ত দীপ্তিতে মিশে যায়।

এইভাবে “ত্রয়োদশ নীতি” কোনো সংখ্যাগত স্তর নয়; এটি এক দার্শনিক প্রতীক—চেতনার সীমাহীনতার অনুভব। দ্বাদশ কালচক্র অতিক্রম করা মানে ক্রম, সীমা ও পরিবর্তনের সীমানা পার হওয়া। সেই সীমার ওপারে কালী দাঁড়িয়ে আছেন চিরনীরবতায়, যেখানে সময়ের প্রতিটি তরঙ্গ, প্রতিটি সৃষ্টি, প্রতিটি বিনাশ তাঁরই অন্তর্লীন আলোয় ভেসে ওঠে ও মিলিয়ে যায়। কালী তাই ক্রম তত্ত্বে চেতনার চূড়ান্ত প্রতীক—এক এমন স্বাধীন শক্তি, যেখানে সময় ও স্থান উভয়ই তাঁর অনন্ত আত্মপ্রকাশের তরঙ্গমাত্র।

কাল-সংকর্ষিণী—এই নামেই কাশ্মীর শৈব দর্শনে কালীকে বর্ণনা করা হয়—যিনি অতীন্দ্রিয় বুদ্ধি, অর্থাৎ পরম জ্ঞানের শক্তির রূপ। “সংকর্ষিণী” শব্দটির মূল ধাতু কৃষ্ (আকর্ষণ করা), যা এখানে নির্দেশ করে সেই সর্বব্যাপী শক্তিকে, যিনি স্বয়ং কাল—ভৈরবকেও নিজের মধ্যে আকর্ষণ করেন। ভৈরব হলেন সমস্ত প্রকাশের আদ্যস্রোত, সেই পরম চেতনা যিনি শিবতত্ত্ব থেকে শুরু করে পৃথিবীতত্ত্ব পর্যন্ত—সমগ্র অস্তিত্বের স্তরগুলিকে প্রকাশ করেন। এই কারণেই তাঁকে “কাল” বলা হয়; কারণ তাঁর মধ্য দিয়েই সময়, ক্রম ও সৃষ্টির ধারা সম্ভব হয়।

কিন্তু কাল-সংকর্ষিণী অর্থাৎ কালী তাঁর নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য-শক্তিতে সেই ভৈরবেরও ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। তিনি সেই অন্তর্বর্তী ও নিয়ন্ত্রণকারী নীতি, যার মাধ্যমে ভৈরবের প্রকাশ ও লয় উভয়ই সংঘটিত হয়। অন্যভাবে বললে, ভৈরবের প্রকাশ কালী ছাড়া সম্ভব নয়, আবার তাঁর লয়ও কালী ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। কালী তাই ভৈরবের চেতনার “অন্তঃগতি”—তাঁর নিজের শক্তিস্বরূপ, যার দ্বারা ভৈরব নিজের চেতনা-সীমাকে উপলব্ধি করেন।

ভৈরব ও কালী-র সম্পর্ক এবং চেতনার গতি ও স্থিতির দ্বন্দ্ব-অভেদ শৈবতত্ত্বের এক গভীর সত্য-উন্মোচন। এখানে বলা হচ্ছে, ভৈরব নিজেই “কাল” বা সময়; তাঁর প্রকৃতি “নাদ” ও “প্রাণ”—অর্থাৎ কম্পন ও জীবনশক্তি। এর মানে, ভৈরব কেবল স্থির চেতনা নন; তিনি সেই জীবন্ত, কম্পনময়, স্বয়ংচল চৈতন্য, যার মধ্য দিয়ে মহাবিশ্বের সমস্ত গতি, স্পন্দন ও প্রাণশক্তি প্রবাহিত হচ্ছে। “নাদ” (ধ্বনি) হলো চেতনার প্রথম স্পন্দন—যেখান থেকে সৃষ্টি শুরু হয়, আর “প্রাণ” হলো সেই স্পন্দনের শক্তি, যা সত্তাকে গতিশীল রাখে। এই দুই মিলেই ভৈরবের জীবন্ত মহাশক্তি—চেতনার আত্ম-কম্পন।

কিন্তু ক্রমশ এই গতির গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায়—চেতনার এই গতি, ধ্বনি ও প্রাণ প্রবাহের এক উৎস আছে। সব স্পন্দনের পেছনে থাকে এক গভীর নীরব স্থিতি, যা নিজে অচল, কিন্তু তার থেকেই সমস্ত গতি উদ্ভূত। যখন সাধনা বা অভিজ্ঞতায় ভৈরবের এই নাদ-প্রাণময়তা, অর্থাৎ সমস্ত ধ্বনি, তরঙ্গ, প্রাণপ্রবাহ, সম্পূর্ণভাবে কালী-র মধ্যে শোষিত হয়, তখন প্রকাশ পায় সেই উৎসস্বরূপ—অপ্রাণভূমি। “অপ্রাণ” মানে প্রাণশক্তির অভাব নয়; বরং এমন এক অবস্থা, যেখানে জীবনীশক্তিও নিস্তব্ধতার সঙ্গে একীভূত হয়েছে—যেখানে আর কোনো ক্রিয়া নেই, কোনো গতি নেই, কোনো কম্পন নেই, তবু চেতনা সম্পূর্ণ জাগ্রত, স্ব-দীপ্ত।

এই অবস্থাকে বলা হয় চেতনার নিঃশব্দ স্বরূপ—যেখানে শব্দ ও ধ্বনি, নাদ ও প্রাণ, সবই তাদের উৎসে ফিরে গিয়ে বিলীন হয়েছে। এখানে চেতনা আর নিজের প্রকাশের মধ্যে ছিন্ন নয়; সে নিজেই নিজের মধ্যে স্থিত, নিজের দীপ্তি দিয়ে আলোকিত। এটিই কালী-র পরম স্বরূপ—অপ্রাণ, অর্থাৎ প্রাণেরও অতীত; অকাল, অর্থাৎ সময়েরও অতীত; অচল, অর্থাৎ গতিরও অতীত। কিন্তু এই “অপ্রাণ” মানে নিস্তেজতা নয়, বরং এমন এক অভ্যন্তরীণ পূর্ণ জাগরণ, যেখানে সবকিছু থেমে থেকেও সম্পূর্ণভাবে জীবন্ত।

এই কারণেই কালী-কে বলা হয় “ভৈরবের গ্রাসকারিণী”—যিনি ভৈরবকেও নিজের মধ্যে ধারণ করেন ও অতিক্রম করেন। ভৈরবের নাদ ও প্রাণ—এই গতিশীল চেতনা—তাঁর মধ্যে লীন হয়, আর তিনি সেই গতির অন্তর্গত নীরব কেন্দ্র হয়ে ওঠেন। অন্যভাবে বললে, ভৈরব হচ্ছেন গতি, কালী হচ্ছেন স্থিতি; ভৈরব হচ্ছেন কম্পন, কালী সেই কম্পনের উৎস নীরবতা; ভৈরব হচ্ছেন সময়ের প্রসার, কালী সেই সময়ের গর্ভ, যেখানে সমস্ত প্রসার বিলীন হয়ে যায়।

এখানে “গ্রাস” মানে ধ্বংস নয়, বরং আত্মীকরণ। কালী সীমিত গতির প্রতিটি তরঙ্গকে নিজের অসীম স্থিতিতে মিশিয়ে দেন। গতি থেমে যায়, কিন্তু চেতনা নিভে যায় না—বরং আরও দীপ্ত, আরও স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। এই “গ্রাসকারিণী কালী” আসলে প্রতিটি সাধকের অন্তর্জাগতিক যাত্রার প্রতীক—যেখানে মন, প্রেরণা, শ্বাস, ধ্বনি, এমনকি প্রাণশক্তি পর্যন্ত একে একে অন্তর্মুখী হয়ে শেষ পর্যন্ত নিস্তব্ধ দীপ্তিতে মিলিয়ে যায়।

সেই নিস্তব্ধ দীপ্তি-তেই ভৈরব নিজেকে নিজের উৎসে চেনে। সেখানে আর কর্তা-কর্মের ভেদ থাকে না; নাদ নিভে যায়, কিন্তু তার অন্তর্গত চেতনা থেকে যায়। এই অবস্থায় চেতনা আর কোনো গতি বা ভাষার অবলম্বন করে না; সে কেবল নিজের স্বরূপে জাগ্রত—অকাল, অচল, অপ্রাণ, অথচ সর্বত্র প্রাণসঞ্চারক। এই হল কালী-র প্রকৃত অর্থে মহাকালাতীত স্বরূপ—যিনি গতির মধ্য দিয়েই স্থিতিকে প্রকাশ করেন, এবং স্থিতির মধ্যেই সমস্ত গতির সম্ভাবনা ধারণ করে রাখেন।

ভৈরব শৈবতত্ত্বের এক অত্যন্ত গভীর ও বহুমাত্রিক প্রতীক, যাঁকে কেবল দেবতা হিসেবে বোঝা শক্ত, বরং চেতনার মৌল স্বরূপ হিসেবে বোঝা অপেক্ষাকৃত সহজ। “ভৈরব” শব্দটির সংস্কৃত ব্যুৎপত্তি হলো—“ভি” (বিশেষরূপে), “র” (রব, কম্পন বা ধ্বনি) ও “ভ” (ভব, সত্তা, অস্তিত্ব)। অর্থাৎ ভৈরব মানে “যিনি বিশেষভাবে চেতনার ধ্বনিময় অস্তিত্ব” বা “যিনি নিজেই অস্তিত্বের চেতনা ও কম্পনের ঐক্য”। অন্য একটি ব্যাখ্যা অনুযায়ী, “ভী” মানে ভয়, আর “র” মানে নাশ—সুতরাং ভৈরব মানে সেই শক্তি, যিনি ভয়কে নাশ করেন। কিন্তু এই “ভয়” আসলে বহির্জগতের কোনো ভীতিকর বস্তু নয়; এটি আমাদের অজ্ঞতার ভয়—অসীমের সামনে সীমাবদ্ধ আত্মবোধের সংকোচ। ভৈরব সেই চেতনা, যিনি এই অজ্ঞতার ভয় ভেঙে আত্মাকে তার নিজের পরম অসীমতায় ফিরিয়ে দেন।

কাশ্মীর শৈবদর্শনের দৃষ্টিতে, ভৈরব কোনো মানবাকৃতি দেবতা নন; তিনি হলেন অচিন্ত্য, অদ্বৈত, সর্বব্যাপী চেতনা, যাঁর মধ্যে সৃষ্টি ও সংহার, ধ্বনি ও নীরবতা, স্থিরতা ও গতি—সব এক হয়ে আছে। ভৈরব তন্ত্র বা বৈরবীয় দর্শন বলছে, ভৈরব কোনো নির্জীব শূন্য নয়; তিনি সেই সচেতন শূন্যতা, যা একই সঙ্গে নিস্তব্ধ ও জাগ্রত, অচল ও কম্পনশীল।

অভিনবগুপ্ত তাঁর তন্ত্রালোক-এ বলেছেন—“ভৈরবঃ সর্বসত্ত্বানামন্তঃস্থো ভাবরূপধৃক।” অর্থাৎ, ভৈরব সকল সত্তার অন্তরে, অনুভবের রূপে অবস্থান করেন।

এখানে ভৈরব মানে সর্বসত্তার প্রাণরূপ চেতনা—যিনি নিজেকে প্রকাশ করেন শব্দে, চিন্তায়, প্রাণে, রূপে, আবার প্রত্যেক প্রকাশেই নিজের মধ্যে ফিরে যান।