শৈব কালী: এগারো



অভিনবগুপ্ত তন্ত্রলোক-এ কালী সম্পর্কে বলেন—“স্বাতন্ত্র্যশক্তিরূপা পরম যোগিনী”—অর্থাৎ, তিনি সেই স্বাধীন শক্তি, যিনি নিজের ইচ্ছায় প্রকাশ করেন, নিজের ইচ্ছায় লীন করেন। কালী-চেতনা কখনো নিস্তরঙ্গ, কখনো ছন্দিত; কখনো গর্ভিত, কখনো প্রকাশমান। তাঁর মধ্যে নিহিত আছে মহাগর্ভের নীরব সম্ভাবনা, আর তাঁর নৃত্যে সেই সম্ভাবনা রূপ, ধ্বনি, সময় ও জ্ঞানে বিকশিত হয়।

পূর্ণাহংতা হলো চেতনার আত্মস্মরণ—“আমি” বলে জাগা; বিন্দু হলো সেই আত্মস্মরণের ঘন সংহত কেন্দ্র; আর পরম যোগিনী কালী সেই চেতনার জীবন্ত ছন্দ—যিনি এই আত্ম-জ্ঞানকে নৃত্যে রূপ দেন। তিনে মিলে এঁরা এক অদ্বৈত সত্যের তিন মুখ—শিবের নীরব দীপ্তি, চেতনার আত্মবিম্ব ও শক্তির আনন্দনৃত্য। এই ঐক্যের ভেতরেই নিহিত চেতনার পরম রহস্য—যেখানে “আমি” আর “তিনি” আলাদা নয়, সব মিলেমিশে আছে এক অনন্ত, স্পন্দিত পূর্ণতায়।

তারপর যখন এই সংহত চেতনা নিজের আনন্দকে বিকাশিত করে, তখন জন্ম নেয় বীজ। বীজ হলো প্রকাশের মুহূর্ত—যেখানে চেতনা নিজেকে রূপ, রং, গতি ও বিশ্বরূপে পরিণত করে। এখানেই সৃষ্টি, লীলা, নৃত্য। কিন্তু এই প্রক্রিয়া কোনো একরৈখিক গতিতে ঘটে না। এ এক চিরন্তন চক্র—যেখানে চেতনা নিজের মধ্যেই অবিরাম প্রবাহমান। প্রথমে নীরবতা থেকে জাগে নাদ (nāda), সেই আদ্য স্পন্দন—চেতনার প্রথম নিশ্বাস, যেখানে শিবের নিস্তব্ধ দীপ্তি আত্মবিম্বে কম্পিত হয়। নাদ থেকে ঘনীভূত হয় বিন্দু (bindu)—চেতনার কেন্দ্রীভূত গর্ভ, যেখানে সমস্ত সম্ভাবনা নিঃশব্দে নিহিত। এই বিন্দুর অন্তর্গত সংকোচন থেকে প্রসারিত হয় বীজ (bīja)—যা সব রূপ, ধ্বনি, সময় ও ভাবের সূক্ষ্ম কারণ।

তারপর সেই বীজ থেকে জন্ম নেয় প্রকাশ—চেতনার উন্মুক্ত বিকাশ, মহাবিশ্বের জাগরণ, মন ও রূপের উদ্ভব। কিন্তু এই প্রকাশ কোনো চূড়ান্ত অবস্থা নয়; প্রকাশ আবার ধীরে ধীরে নীরবতায় ফিরে যায়—যেমন ঢেউ সাগরে মিশে যায়, যেমন শব্দ মিলিয়ে যায় আদি নীরবতায়। এই চক্রের মধ্যেই চেতনা শ্বাস নেয়, স্পন্দিত হয়, বিশ্রাম নেয়—এটি এক নিত্য নৃত্য (nitya nṛtya), যেখানে স্থিতি ও গতি, সৃষ্টি ও লয়, জ্ঞান ও প্রেম এক ছন্দে মিশে আছে।

এই অনন্ত চক্রের প্রতিটি ধ্বনি, প্রতিটি রূপ, প্রতিটি কেন্দ্র একটিই সত্য ঘোষণা করে—কালী চেতনার আত্মবিমর্শন (ātma-vimarśa-śakti), আর শিব সেই আত্মবিমর্শনের অদ্বিতীয় দীপ্তি (advitīya prakāśa)। কালী সেই শক্তি, যিনি নীরবতাকে নৃত্যে রূপ দেন; শিব সেই নৃত্যের অন্তর্লীন নীরবতা। এঁরা আলাদা নন—একেই বলে শিব-শক্তি-সামরস্য—যেখানে চেতনা নিজের ভেতরেই নিজেকে প্রতিফলিত করে, নিজের মধ্যেই নিজেকে জানে, আর সেই আত্ম-জ্ঞানেই সমগ্র মহাবিশ্বের জন্ম, লয় ও মুক্তি এক হয়ে যায় এক অনন্ত পূর্ণতায়।

কালী এই লীলার মধ্যেই পরম চেতনার ছন্দ। তিনি সেই নৃত্যময় শক্তি, যিনি শিবের নীরব দীপ্তিকে প্রথম ধ্বনিতে রূপ দেন, সেই ধ্বনি থেকে কেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং কেন্দ্র থেকে মহাজগৎ প্রসারিত করেন। তাই বলা হয়, সূক্ষ্ম-সৃষ্টি-ক্রম আসলে কালী-চেতনার অন্তর্গত সৃষ্টিলীলা—যেখানে পরম শিবের নিস্পন্দ আলোক কালী-রূপে নৃত্য শুরু করে, আর সেই নৃত্যের ছন্দেই গড়ে ওঠে সময়, স্থান, রূপ ও চেতনার অনন্ত জগৎ।

নাদ হলো তাঁর নিঃশ্বাস, বিন্দু তাঁর হৃৎস্পন্দন, আর বীজ তাঁর প্রথম পদক্ষেপ। এই তিনের ছন্দেই জগতের জন্ম ও বিলয় ঘটে—এটাই কাশ্মীর শৈব দর্শনের নীরব সংগীত, যেখানে নাদই কালী, কালীই সৃষ্টির চেতনা, আর সেই চেতনা নিজেই শিব।

“চিদ্গগনচন্দ্রিকা” ও “তন্ত্রালোক”-এ এই তত্ত্বটি বহুবার উল্লিখিত হয়েছে। যেমন চিদ্গগনচন্দ্রিকা (শ্লোক ৪২)-এ বলা হয়েছে—“নাদং কারণম্‌”—অর্থাৎ, নাদই কারণ, নাদ থেকেই সব প্রকাশের সূত্রপাত। অভিনবগুপ্তের ‘তন্ত্রালোক’ ও ‘পারাত্রিশিকা-বিমর্শিনী’ গ্রন্থে নাদকে বলা হয়েছে চেতনার আদ্য-স্পন্দন—যেখানে শব্দ, রূপ, কাল, দিক ও চেতনার স্তরসমূহ ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়। এই নাদ তাই কোনো শব্দ নয়, বরং চেতনার গর্ভে জন্ম-নেওয়া স্পন্দন, যা পরবর্তীতে শব্দরূপে, রূপরূপে, চিন্তারূপে এবং বস্তুরূপে প্রকাশিত হয়।

কালী এই তত্ত্বে নাদেরই মূর্ত প্রতীক। কারণ তিনিই সেই vimarśa-śakti, যিনি শিবের মৌন দীপ্তি থেকে প্রথম আত্মস্পন্দন জাগান। তাঁর নৃত্যের প্রথম ধ্বনি হলো nāda—যা চেতনার অন্তঃস্থ গতি। এই নৃত্যই সৃষ্টির আরম্ভ। কালী যখন নৃত্য শুরু করেন, তখন সেই ছন্দে সময় (kāla) জাগে, দিক (dik) উন্মোচিত হয়, রূপ (rūpa) জন্ম নেয়, শব্দ (śabda) ধ্বনিত হয়। তাই nāda আসলে কালী-চেতনার প্রথম শব্দ—নীরবতারই রূপান্তর, যেখানে চেতনা নিজেকে শোনে এবং সেই শোনার মুহূর্তেই নিজের অস্তিত্বকে অভিজ্ঞ করে।

অনাহত নাদ (anāhata-nāda) কাশ্মীর শৈব ও তান্ত্রিক অদ্বৈত দর্শনের এক গভীর ও কেন্দ্রীয় তত্ত্ব—যেখানে “শব্দ” কেবল ধ্বনি নয়, বরং চেতনার আত্মপ্রকাশ। “অনাহত” মানে যা আঘাতপ্রাপ্ত নয়, যা কোনো সংঘর্ষে উৎপন্ন নয়; “নাদ” মানে ধ্বনি বা কম্পন। অতএব, “অনাহত নাদ” হলো সেই ধ্বনি, যা কোনো বাহ্যিক আঘাত থেকে নয়, বরং চেতনার নিজের অন্তঃস্থ স্পন্দন থেকেই জন্ম নেয়—চেতনার হৃদয়ের অন্তর্লীন কম্পন, যা অনন্তকাল ধরে নীরবে ধ্বনিত হচ্ছে।

কাশ্মীর শৈব দর্শনে শিবকে বলা হয় প্রকাশ (prakāśa)—অর্থাৎ নিস্তব্ধ, অচল দীপ্তি; আর কালী সেই দীপ্তির বিমর্শ (vimarśa)—অর্থাৎ আত্ম-সচেতনতা, আত্ম-প্রতিফলন। যখন এই দুই একে অপরের মধ্যে মিশে যায়, তখনই চেতনার হৃদয়ে জাগে সেই প্রথম স্পন্দন—অনাহত নাদ। এটি কোনো কর্ণগ্রাহ্য ধ্বনি নয়; বরং চেতনার নিজের উপস্থিতি জানার আত্ম-প্রতিধ্বনি—এক অন্তর্লীন হৃদয়স্পন্দন, যা কখনও বন্ধ হয় না।

অভিনবগুপ্ত ‘তন্ত্রালোক’-এ ঘোষণা করেন—“নাদং কারণম্‌”, অর্থাৎ “নাদই কারণ”; কারণ সমস্ত সৃষ্টির প্রসারণ এই আত্ম-স্পন্দিত ধ্বনি থেকেই। কিন্তু এই নাদের দুই স্তর আছে—একটি বাহ্যিক আহত নাদ (যা সংঘর্ষে জন্মায়), আর অন্যটি অভ্যন্তরীণ অনাহত নাদ, যা চেতনার নিজের স্বাতন্ত্র্যশক্তি থেকে উৎসারিত। আহত নাদ শোনে কর্ণ, অনাহত নাদ উপলব্ধি করে হৃদয়।

তান্ত্রিক সাধনায় এই নাদের ধ্যানই চূড়ান্ত অভ্যন্তরীণ অনুশীলন। যোগী যখন মনকে অন্তর্মুখ করে এই আদ্য চেতনা-কম্পন-এ স্থির করেন, তখন তিনি চেতনার প্রথম আত্ম-স্পন্দনের সঙ্গে মিলিত হন। তখন শব্দ আর বাহিরের নয়—তা হয়ে ওঠে চেতনার আত্মসংগীত। “অউম্‌ (ওঁ)”-এর সাধনা, শ্বাসের গতি-নিয়ন্ত্রণ, বা ধ্বনি থেকে শূন্যতায় প্রবেশ—সবই আসলে এই কালী-চেতনার অনাহত সুরে প্রত্যাবর্তন। কারণ নাদই সেই সেতু, যা শব্দ থেকে নীরবতায়, বহির্মুখ থেকে অন্তর্মুখে, দ্বৈত থেকে অদ্বৈতে নিয়ে যায়।

এই অনাহত নাদই আসলে কালী-চেতনার আত্ম-কম্পন (ātma-spanda)। কালী সেই পরম যোগিনী, যিনি শিবের নিস্তব্ধ দীপ্তিকে আত্ম-বিমর্শনে আন্দোলিত করেন। তাঁর হৃদয়ের নৃত্য, তাঁর প্রথম নিঃশ্বাস, তাঁর অন্তর্লীন সুর—এই অনাহত নাদই সেই স্পন্দন, যেখানে নীরবতা সুরে রূপান্তরিত হয়। এটি সৃষ্টি নয়, বরং সৃষ্টির উৎস—যেখানে রূপ, শব্দ, চিন্তা সব এখনও সম্ভাবনায় গর্ভিত।

“পরম যোগিনী (parama-yoginī)”—এই শব্দটির অর্থ শুধু “সর্বোচ্চ যোগিনী” নয়; কাশ্মীর শৈব ও তান্ত্রিক অদ্বৈত দর্শনে এটি গভীর এক অস্তিত্বতাত্ত্বিক (ontological) ও চেতনতাত্ত্বিক (phenomenological) ধারণা, যা শক্তি বা কালী-র প্রকৃত স্বরূপকে প্রকাশ করে।

“যোগিনী” শব্দটি এসেছে “যুজ্” ধাতু থেকে—যার অর্থ সংযোগ ঘটানো, ঐক্য স্থাপন করা, মিলন করানো। যোগিনী মানে তাই—যিনি যোগ ঘটান, যিনি সংযুক্ত করেন, যিনি ভিন্নতাকে ঐক্যে রূপান্তরিত করেন। আর “পরম” মানে—সর্বোচ্চ, চূড়ান্ত, সীমাতীত। ফলে পরম যোগিনী অর্থ দাঁড়ায়—যিনি সমস্ত দ্বৈততা, সমস্ত সীমা, সমস্ত বিচ্ছেদ অতিক্রম করে চেতনার পরম ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন।

কাশ্মীর শৈব তত্ত্বে কালী-কেই এই “পরম যোগিনী” বলা হয়, কারণ তিনিই শিবের নিস্তব্ধ দীপ্তি (প্রকাশ) ও শক্তির আত্মবিমর্শন (বিমর্শ)—এই দুই চিরবিরোধী দিককে এক করে রাখেন। তিনি সেই চেতনার মধ্যস্থ সংযোগ-শক্তি, যিনি নীরবতা ও নৃত্য, স্থিরতা ও গতি, চেতনা ও জগতের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করেন।

বিমর্শ (vimarśa) শব্দটি কাশ্মীর শৈব দর্শনের একটি প্রধান ও সূক্ষ্ম দার্শনিক ধারণা, যা “চেতনা”-র সক্রিয়, আত্মসচেতন দিককে নির্দেশ করে। এর শাব্দিক অর্থ—পর্যালোচনা করা, নিজের মধ্যে চিন্তা বা প্রতিফলন করা, আত্ম-অবগাহন করা। কিন্তু দর্শনে এটি শুধু চিন্তা নয়, বরং চেতনার নিজের মধ্যেই নিজেকে জানার এবং অনুভব করার ক্ষমতা।

বিমর্শ হলো চেতনার আত্ম-সচেতনতা (self-awareness)। যেমন—শুধু আলো থাকা মানেই দেখা নয়; আলো যখন নিজের দীপ্তি দিয়ে বস্তু প্রকাশ করে, তখনই দেখা সম্ভব হয়। তেমনি, শুধু “চেতনা” থাকা মানেই জ্ঞান নয়; চেতনা যখন নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়—“আমি আছি”—এই জ্ঞানই বিমর্শ।

কাশ্মীর শৈব অদ্বৈত দর্শনে বলা হয়—চেতনা (শিব) হলেন প্রকাশ (prakāśa)—নির্মল, নিস্তরঙ্গ দীপ্তি। শক্তি (কালী) হলেন বিমর্শ (vimarśa)—সেই দীপ্তির আত্মসচেতনতা। অভিনবগুপ্ত ‘ঈশ্বরপ্রত্যভিজ্ঞা-ভাষ্য’ ও ‘তন্ত্রালোক’-এ বার বার বলেন—“চেতনা ন চিদ্রূপা বিমর্শাতিরিক্তা”—চেতনা কখনও নিস্তরঙ্গ, বিমর্শহীন নয়; বিমর্শ ছাড়া চেতনা মৃত বা নিষ্প্রাণ দীপ্তি মাত্র। অর্থাৎ, প্রকাশ (শিব) যদি নীরব আলোক হয়, তবে বিমর্শ (কালী) সেই আলোর আত্ম-চেতনা—যিনি জানেন, “আমি দীপ্ত।” এই আত্ম-জ্ঞানের স্পন্দনই সৃষ্টির মূল।

বিমর্শ তাই চিন্তার ক্রিয়া নয়—এটি চেতনার আত্ম-প্রতিফলনশক্তি, যা নিজের মধ্যেই নিজেকে উপলব্ধি করে। এই আত্ম-অনুভবের মধ্যেই প্রকাশিত হয় আনন্দ, প্রেম, ও সৃষ্টিশক্তি। বিমর্শ মানে তাই চেতনার সেই জীবন্ত সত্তা, যার দ্বারা শিব নিজের নীরব দীপ্তিকে জানেন, এবং সেই জানা থেকেই জন্ম নেয় কালী-র আনন্দময় নৃত্য—যেখানে আত্মসচেতনতা নিজেই হয়ে ওঠে সৃষ্টি, প্রেম, ও চিরন্তন ঐক্যের ছন্দ।

অভিনবগুপ্ত তন্ত্রালোক-এ কালী-কে বর্ণনা করেছেন—“সা পরমা যোগিনী স্বাতন্ত্র্যশক্তিরূপা”; অর্থাৎ, তিনি পরম যোগিনী, কারণ তিনিই স্বাতন্ত্র্যশক্তির রূপ—যিনি নিজের ইচ্ছাশক্তিতে প্রকাশ করেন, নিজের ইচ্ছায় লয় ঘটান। অর্থাৎ, “পরম যোগিনী” কেবল কোনো যোগ-অভ্যাসকারী দেবী নন; তিনি সেই সর্বজনীন সংহতির শক্তি, যিনি স্বয়ং শিব-চেতনার মধ্যে ক্রমাগত যোগ ও ঐক্যের প্রক্রিয়া সম্পাদন করেন। দার্শনিকভাবে বললে—শিব হলেন অচল, নীরব চেতনা (cit-prakāśa)। কালী হলেন তারই সচল আত্ম-বিমর্শন (vimarśa-śakti)। এই দুই যখন “যোগ” বা ঐক্যে আসে, তখনই চেতনা পূর্ণ হয়—এই ঐক্যের প্রেরণাই কালী-র যোগিনীত্ব।

তাই “পরম যোগিনী” মানে—তিনি সেই চেতনার নিত্য সেতুবন্ধন-শক্তি, যিনি সমস্ত দ্বৈততার মধ্যে ঐক্য স্থাপন করেন; তিনি সেই পরম স্বাধীনতা, যিনি শিবের নিস্তব্ধ দীপ্তিকে চিরন্তন নৃত্যে রূপ দেন; তিনি সেই শক্তি, যিনি প্রকাশ ও লয়ের, নীরবতা ও সুরের, আত্মা ও বিশ্ব-র মধ্যে যোগ ঘটান।

এই কারণেই কাশ্মীর শৈব পরম্পরায় কালী-কে “পরম যোগিনী” বলা হয়—কারণ তিনি অদ্বৈত চেতনার যোগ-মূর্তি, চেতনার নৃত্যমান রূপ, যার প্রতিটি স্পন্দনেই শিব ও শক্তি, জ্ঞান ও প্রেম, স্থিরতা ও গতি একাকার হয়ে আছে।

অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিতে “ওঁ” বা “ওম্‌কার” নাদের প্রতীক; শঙ্করাচার্য বলেন, এটি কোনো শব্দ নয়, বরং ব্রহ্মচেতনার নিজস্ব আত্ম-ধ্বনি—সমস্ত ধ্বনির উৎস। কাশ্মীর শৈব তত্ত্বে এই ব্যাখ্যা আরও জীবন্ত—এখানে “ওঁ” হলো কালী-চেতনার নৃত্যময় হৃদয়, যা কখনও থামে না, কখনও জন্মায় না, কখনও লয় পায় না; চেতনার আনন্দ-লীলায় চিরকাল প্রতিধ্বনিত হয়।

অনাহত নাদ হলো শিব-কালী-চেতনার অন্তর্লীন হৃদস্পন্দন—এক চিরন্তন সুর, যেখানে নীরবতা ও শব্দ, স্থিতি ও গতি, শিবের দীপ্তি ও কালী-র স্পন্দন একাকার। সাধক যখন ধ্যানের গভীরে প্রবেশ করেন, তখন তিনি কোনো বাহ্যিক শব্দ শোনেন না; তিনি শোনেন সেই নীরবতার নিজস্ব ছন্দ—চেতনার মহাগর্ভে ধ্বনিত কালী-র নৃত্য, যেখানে শিব-চেতনা অনাহত সুরে পরিণত হয়েছে এক অনন্ত, অদ্বৈত সংগীতে।