শৈব কালী: এক-শো পাঁচ



“বিসর্গ” শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো নিঃসরণ বা প্রবাহিত হওয়া। তন্ত্রে বলা হয়, বিসর্গই চেতনার প্রাণস্পন্দন—যেখানে এক নিঃশ্বাসে সৃষ্টি ঘটে (উৎসারণ), আর পরের নিঃশ্বাসে সব কিছু নিজের উৎসে ফিরে যায় (প্রত্যাবর্তন)। অর্থাৎ, দেবী কৌলিকী সেই শক্তি, যিনি চেতনার এই শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে বিরাজমান।

“কৌলিকী” শব্দটি এসেছে “কুল” থেকে। “কুল” মানে একসূত্রে বাঁধা ঐক্য, যেখানে কোনো দ্বৈততা নেই; সব বিপরীত দিক একে অপরের মধ্যে দ্রবীভূত। কৌল দর্শনে শিব ও শক্তি আলাদা নন—তারা একই চেতনার দুই পরস্পর-নির্ভর দিক। শিবের স্থিরতা যেমন শক্তির গতিতে প্রকাশিত হয়, তেমনি শক্তির গতি আবার শিবের নীরবতায় বিশ্রাম পায়। এই পারস্পরিক মিশ্রণই “কুল”—আর সেই ঐক্যের জীবন্ত অভিব্যক্তি হলো কৌলিকী দেবী।

তাঁর অবস্থায় সৃষ্টি ও বিলয় কোনো দুই ভিন্ন প্রক্রিয়া নয়, বরং একটানা এক লীলার দুই দিক। সৃষ্টি মানে চেতনার বহির্মুখ গতি, আর লয় মানে তার অন্তর্মুখ প্রত্যাবর্তন—দু’টোই একই ছন্দের শ্বাস-প্রশ্বাস। তাই কৌলিকী দেবী আসলে চেতনার সেই মহাশ্বাস, যার মধ্যে জগৎ প্রতিক্ষণে জন্ম নিচ্ছে, আবার প্রতিক্ষণে নিজের উৎসে ফিরে যাচ্ছে।

কৌল বা কুল প্রথায় কৌলিকী হলেন অদ্বৈততার জীবন্ত রূপ—যিনি শিব ও শক্তিকে, পুরুষ ও প্রকৃতিকে, স্থিরতা ও গতিকে, সৃষ্টি ও লয়কে এক অখণ্ড ঐক্যে মিলিয়ে দেন। তাঁর মধ্যে চেতনা কোনো স্থির সত্তা নয়; এটি এক অনন্ত গতি—এক ছন্দ, এক শ্বাস, এক অবিরাম বিসর্গ—যেখানে শিব ও শক্তি একে অপরের মধ্যে চিরকাল নিঃশ্বাস নিচ্ছেন ও ছাড়ছেন।

মালিনীবিজয়োত্তর তন্ত্রে দেবীকে বলা হয়েছে মাতৃসদ্‌ভাব (Mātṛ-sadbhāva)—অর্থাৎ “মাতৃসত্তা” বা “জননীস্বরূপ চেতনা,” যিনি সমস্ত দেবী, সমস্ত শক্তি, এমনকি সমস্ত ভাবনা ও চেতনার উৎসজননী। এই রূপে দেবী কোনো নির্দিষ্ট শক্তির প্রকাশ নন; তিনি হলেন সকল শক্তির উৎস, সেই মহামাতৃচেতনা, যাঁর অন্তর থেকে সমগ্র বিশ্বজগৎ জন্ম নেয়, বিকশিত হয় এবং শেষে আবার তাঁর মধ্যেই লয় পায়।

“সদ্‌ভাব” শব্দটির অর্থ অস্তিত্ব বা স্বরূপে অবস্থিতি। তাই “মাতৃসদ্‌ভাব” মানে সেই মাতৃচেতনার স্বরূপাবস্থা—যেখানে চেতনা এখনো প্রকাশিত নয়, কিন্তু অসীম সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। তিনি যেন সৃষ্টির পূর্ববর্তী নিঃশব্দ গর্ভ—যেখানে প্রতিটি দেবী, প্রতিটি তত্ত্ব, প্রতিটি ধ্বনি ও রূপ এখনো সম্ভাবনার বীজরূপে নিদ্রিত।

তন্ত্র বলে, “মাতৃসদ্‌ভাবে বিদ্যমান সব শক্তিই একে অপরের প্রতিচ্ছবি।” এই স্তরে কালী, ত্রিপুরসুন্দরী, কৌলিকী, সারা—সব দেবীই নিজের পৃথক রূপ হারিয়ে এক পরম মূলে মিশে যান। কারণ মাতৃসদ্‌ভাব হলো সেই আদ্যশক্তি, যে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন সমস্ত প্রকাশের বীজ।

এই অবস্থায় দেবী যেন এক বিশাল নিস্তব্ধ সাগর—যেখানে এখনও ঢেউ ওঠেনি, কিন্তু ঢেউ ওঠার সম্ভাবনা নিঃশব্দে দ্যুতিময়। এখান থেকেই শব্দ ফোটে, রূপ জন্মায়, চিন্তা ও দেবতা উদ্ভূত হয়। তাই তাঁকে বলা হয় “সর্বশক্তিজননী”, কারণ তিনিই সমস্ত শক্তির উৎস ও পোষক।

মালিনীবিজয়োত্তর তন্ত্রের মাতৃসদ্‌ভাব মানে সেই মহামাতৃচেতনা, যিনি সমস্ত সৃষ্টির গর্ভরূপ—যেখান থেকে বহির্জগতের ধ্বনি, রূপ, ভাবনা, সময়, ও দেবতা সকলেই প্রসূত। তিনি কেবল শক্তির জননী নন, বরং চেতনারও পরম আদিস্বরূপ—নিঃশব্দ, অপ্রকাশিত, অথচ অসীম দীপ্তিতে ভরপুর সেই “জননীসত্তা,” যিনি নিজেই সমস্ত শক্তির মূলে দীপ্ত মহাশক্তি।

এই বিভিন্ন নাম বা রূপকে একে অপরের থেকে আলাদা করে দেখা যায় না, কারণ প্রত্যেকেই চেতনার একই পরম শক্তির ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। ত্রিপুরসুন্দরী যেমন চেতনার সৌন্দর্যের প্রকাশ, তেমনি কৌলিকী তার গতির, আর মাতৃসদ্‌ভাব তার আদ্যাবস্থার প্রতীক। এরা সবাই মিলিত হয়ে বোঝায়—শক্তি আসলে চেতনারই নিজস্ব নৃত্য, নিজেরই আনন্দময় প্রতিফলন।

এই কারণেই বলা হয়, ক্রমপন্থার সপ্তদশী কলা, যা চেতনার সর্বোচ্চ স্তর বা শিখর, কোনো নির্দিষ্ট দর্শনের সীমাবদ্ধ অংশ নয়। এটি সমগ্র তান্ত্রিক বিশ্বদর্শনের ঐক্যবিন্দু (point of convergence)—যেখানে সব দেবী, সব রূপ, সব দর্শন এক চেতনার মধ্যে এসে মিলিত হয়। এখানে ত্রিপুরসুন্দরী ও কালী, কৌলিকী ও মাতৃসদ্‌ভাব, ভিন্ন নন; তারা এক পরম সত্তার নানা দীপ্তি, যেন এক আলোর অসংখ্য প্রতিফলন।

ক্রমদর্শনের কালী কেবল আচার, রীতি বা প্রতীকের দেবী নন; তিনি সেই অভিন্ন পরম চেতনার জীবন্ত প্রকাশ, যার মধ্যে সময়, শক্তি, জ্ঞান, সৃষ্টি ও লয়—সব একসাথে মিশে আছে। সপ্তদশী কলা সেই চেতনার চূড়ান্ত পর্ব, যেখানে এই সমস্ত ভিন্ন ধারা এসে মিলিত হয় এক অবিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতায়—যেখানে না শিব আলাদা, না কালী আলাদা; উভয়েই একে অপরের চেতনার প্রতিফলন—একেই বলে অদ্বৈত তত্ত্বের তান্ত্রিক প্রকাশ।

অদ্বৈত তত্ত্বের তান্ত্রিক প্রকাশ আসলে সেই অবস্থার বর্ণনা, যেখানে “এক ও অদ্বিতীয় চেতনা” (একমেবাদ্বিতীয়ম্—ছান্দোগ্য উপনিষদ, ৬.২.১) নিস্তরঙ্গ, বিমূর্ত ধারণা হিসেবে নয়, বরং জীবন্ত ও অভিজ্ঞতাযোগ্য বাস্তবতা হিসেবে প্রকাশিত হয়। বেদান্ত যেখানে বলে ব্রহ্ম স্থির ও নিরাকার, তন্ত্র সেখানে বলে—ব্রহ্মই হলো চেতনার স্পন্দন (স্পন্দতত্ত্ব), অর্থাৎ শিবের নীরবতা ও শক্তির গতি একে অপরের মধ্যে মিলিত।

অদ্বৈত বেদান্তে বলা হয়েছে—“ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ” (শাঙ্করভাষ্য, ব্রহ্মসূত্র, ২.১.১৪)। অর্থাৎ, ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, জগৎ মায়া বা আপাত। এই দৃষ্টিতে ব্রহ্ম স্থির, নিরাকার, নির্বিকার, আর জগৎ তার উপর অজ্ঞানের আচ্ছাদনমাত্র।

কিন্তু তন্ত্র, বিশেষত কাশ্মীর শৈব দর্শন, একেবারে বিপরীত আলোকপাত করে। এখানে জগৎকে বিভ্রম নয়, বরং চেতনার প্রকাশ বলা হয়েছে—“চিতিরেব চিতিরূপিণী শক্তিঃ” (তন্ত্রলোক, ১.৯৯)। অর্থাৎ, চিত্ত বা চেতনা নিজেই শক্তিরূপে প্রকাশিত হয়ে জগৎ সৃষ্টি করে। এই চেতনা যখন নিজেকে প্রত্যক্ষ করে, তখনই সৃষ্টি, আর যখন নিজের গভীরে ফিরে যায়, তখনই লয়।

তান্ত্রিক অদ্বৈতবাদে শিব ও শক্তি কোনো দুই পৃথক সত্তা নয়; তারা একই চেতনার স্থিরতা ও গতি। অভিনবগুপ্ত বলেছেন—“নৈকাত্ম্যমাত্রং পরমার্থতত্ত্বম্‌” (তন্ত্রালোক, ১.৪৩)—অর্থাৎ, চূড়ান্ত সত্য হলো ঐক্য, যেখানে বিভাজন কেবল অভিব্যক্তির কৌশল।

শিব চেতনার নিঃস্তব্ধ দীপ্তি (প্রকাশ), আর শক্তি সেই দীপ্তির আত্মপ্রতিফলন বা গতি (বিমর্শ)। এই দুই দিক মিলেই চেতনা সম্পূর্ণ।

তাই বলা হয়—“শিবঃ শক্ত্যাযুক্তো যদি ভবতি শক্তঃ প্রভাবিতুম্‌।” (তন্ত্রালোক, ১.৫) অর্থাৎ, শিব যখন শক্তিসমেত, তখনই তিনি সৃষ্টিশীল। শক্তি ছাড়া শিব কেবল নিস্তরঙ্গ সম্ভাবনা; শক্তিই তাঁকে জীবন ও গতি দেয়।

এই ঐক্য-ভাবই তান্ত্রিক অদ্বৈতের প্রাণ—যেখানে “নিষ্ক্রিয় শিব” আর “সক্রিয় শক্তি” আসলে এক চেতনার দুই ছন্দ, যেমন নিঃশ্বাস ও প্রশ্বাস এক প্রাণেরই দুই দিক।

স্পন্দতত্ত্ব—চেতনার গতিশীল অদ্বৈত। কাশ্মীর শৈব তত্ত্বে “স্পন্দ” শব্দটির বিশেষ গুরুত্ব আছে। “স্পন্দ” মানে স্থির চেতনার অন্তর্লীন কম্পন, সেই স্বতঃস্ফূর্ত গতি যা কখনো থামে না। স্পন্দকারিকা (১.২) বলে—“যদেতদ্‌ স্পন্দনরূপং চেতঃ তত্ত্বং তদীশ্বরঃ।” অর্থাৎ, চেতনার স্পন্দনই ঈশ্বর, আর সেই স্পন্দনেই সমস্ত সৃষ্টি ও লয় নিহিত।

এখানে অদ্বৈত মানে স্থিরতা নয়; বরং স্থিরতা ও গতির অবিচ্ছেদ্য মিলন। চেতনা যখন স্থির, তখন সে শিব; আর যখন গতিশীল, তখন সে শক্তি। এই দুই অবস্থা একে অপরের পরিপূরক—একটি ছাড়া অন্যটির অস্তিত্ব নেই।

মায়ার রূপান্তর—বিভ্রম থেকে লীলা। বেদান্তে মায়া হলো অজ্ঞানের শক্তি, যা সত্যকে আড়াল করে। কিন্তু তন্ত্রে মায়া কোনো বিভ্রম নয়, বরং চেতনার নিজস্ব সৃষ্টিশক্তি, যা জগৎকে প্রকাশ করে।

তন্ত্রালোক (৩.৭৮)-এ বলা হয়েছে—“মায়া তু শক্তিরূপা স্বাতন্ত্র্যলীলাবহুলা।” অর্থাৎ, মায়া শক্তিরই এক লীলা—চেতনার আনন্দময় খেলা, যা নিজের ভেতর থেকেই বহু রূপ সৃষ্টি করে।

তাই তান্ত্রিক অদ্বৈতবাদে জগৎ পরিত্যাজ্য নয়; জগৎই ঈশ্বরের আনন্দ-নৃত্য। মুক্তি মানে জগত থেকে পালানো নয়, বরং জগতে থেকেই ঐক্যের উপলব্ধি করা যে, জগৎ ও ব্রহ্ম এক এবং অভিন্ন।

তন্ত্রে মুক্তি কোনো স্থির নির্বাণ নয়; এটি এক সজীব অভিজ্ঞতা, যেখানে ধ্যানের নিস্তব্ধতা ও জীবনের গতিময়তা একই সঙ্গে পূর্ণ। এখানে জ্ঞান ও কর্ম, ধ্যান ও লীলা, নিস্তব্ধতা ও নৃত্য—সব এক চেতনার প্রকাশ।

এই অবস্থায় সাধক উপলব্ধি করে—“যদি তাঁকে নীরবতায় অনুভব করো, তিনি শিব; যদি তাঁকে গতিতে অনুভব করো, তিনি শক্তি; আর দুটিই মিলে সেই এক অদ্বিতীয় চেতনা।”

এই উপলব্ধিই তন্ত্রে “অদ্বয়দর্শন” নামে পরিচিত—যেখানে দর্শক, দর্শন ও দর্শনীয়—এই তিনের ভেদ লুপ্ত হয়ে যায়।

অদ্বৈত তত্ত্বের তান্ত্রিক প্রকাশ হলো এমন এক চেতনার উপলব্ধি, যেখানে শিবের নীরবতা ও শক্তির স্পন্দন এক হয়ে যায়। ব্রহ্ম এখানে নিস্তরঙ্গ নয়, বরং সজীব; সে নিজের আনন্দে নৃত্য করছে, দীপ্ত হচ্ছে, সৃষ্টি করছে।

ছান্দোগ্য উপনিষদ বলেছিল—“সদৈব সোম্য ইদমগ্র আসীৎ, একমেবাদ্বিতীয়ম্‌”—“এই বিশ্ব একক সত্তা ছাড়া আর কিছু নয়।” তন্ত্র সেই একক সত্তাকে বলে—চিতি, পরাশক্তি, মহাকালী—যিনি নীরবতায় শিব, আর স্পন্দনে বিশ্ব।

অদ্বৈত তত্ত্বের তান্ত্রিক প্রকাশ হলো সেই পরম অভিজ্ঞতা, যেখানে চেতনা নিজেরই লীলায় নৃত্য করছে, নিজের নীরবতাকে নিজের গানে রূপান্তরিত করছে—আর যেখানে জগৎ, শক্তি, ও ব্রহ্ম—সব এক অখণ্ড দীপ্তিতে মিলেমিশে গেছে, যাকে অভিনবগুপ্ত বলেছেন—“চিতিঃ স্বাতন্ত্র্যরূপা পরমেশ্বরী।”—চেতনা নিজেই পরমেশ্বরী, নিজেই সৃষ্টি, নিজেই অদ্বৈত সত্য।

কালী, প্রজ্ঞাপারমিতা ও তন্ত্রের অভিন্নতা: আধুনিক কাশ্মীর শৈব বা তান্ত্রিক দর্শন বিশ্লেষক শিবোপাধ্যায়ের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে এই তত্ত্ব আরও গভীর হয়ে ওঠে। তাঁর মতে, ক্রমপন্থার পরম দেবী কালী এবং বৌদ্ধ তন্ত্রের প্রজ্ঞাপারমিতা—এই দুই দেবীচিন্তা আসলে একই অদ্বৈত চেতনার দুটি ভাষা। দু-জনই এমন এক চেতনার প্রতীক, যা নিজের মধ্যে নিজেকে জানে, নিজেকে ধারণ করে, আর নিজেকেই সমস্ত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে উপলব্ধি করে।

প্রথমে দেখা যাক, প্রজ্ঞাপারমিতা কী। শব্দটির অর্থ “জ্ঞানের পারমার্থিক পরিপূর্ণতা”—অর্থাৎ এমন জ্ঞান, যা সমস্ত সীমা, বিভাজন ও ধারণাকে অতিক্রম করে চূড়ান্ত সত্যে পৌঁছায়। “প্রজ্ঞাপারমিতা” (Prajñāpāramitā) শব্দটি দুটি অংশে গঠিত—প্রজ্ঞা (Prajñā) এবং পারমিতা (Pāramitā)। প্রতিটি অংশের অর্থ গভীর ও প্রতীকপূর্ণ, কারণ এই দুটি মিলেই মহাযান বৌদ্ধ তত্ত্বে “জ্ঞানের চূড়ান্ত পূর্ণতা” বা “অদ্বৈত বোধির মাতা” অর্থ প্রকাশ করে।

প্রথম অংশ প্রজ্ঞা (Prajñā) এসেছে সংস্কৃত ধাতু ‘জ্ঞা’ (jñā) থেকে, যার অর্থ “জানা”, “বুঝতে পারা”, বা “উপলব্ধি করা”। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উপসর্গ “প্র”, যার মানে “সম্পূর্ণভাবে”, “উচ্চতরভাবে” বা “অন্তর্গতভাবে”। ফলে প্র + জ্ঞা = প্রজ্ঞা, যার অর্থ দাঁড়ায় “পূর্ণ জ্ঞান”, “উচ্চতর উপলব্ধি”, বা “অন্তরজ্ঞান”। বৌদ্ধ তত্ত্বে এই প্রজ্ঞা কোনো সাধারণ জ্ঞান নয়; এটি এমন এক জাগরণ, যা বস্তু ও ভাবনার সীমা অতিক্রম করে বাস্তবতার প্রকৃত স্বরূপ (তথতা বা Suchness) উপলব্ধি করে। এখানে জ্ঞানী, জ্ঞান, ও জ্ঞেয়—এই তিনের ভেদ মুছে যায়, আর চেতনা নিজেকে নিজেরই প্রতিফলনে দেখে।

দ্বিতীয় অংশ পারমিতা (Pāramitā) এসেছে মূল শব্দ “পার” (pāra) থেকে, যার অর্থ “অপর পার”, “অন্য তীর”, বা “চূড়ান্ত গন্তব্য”। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রত্যয় –মিতা (mitā), যার মানে “অর্জিত” বা “সম্পন্ন”। ফলে পার + মিতা = পারমিতা, যার অর্থ “অপর পারে পৌঁছানো”, “চূড়ান্ত পরিপূর্ণতা”, বা “সীমার অতীত পরিণতি”। বৌদ্ধ পরিভাষায় “পারমিতা” মানে সেই পরিপূর্ণ গুণ, যা মানুষের সসীম মনন ও সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে অসীম চেতনার স্তরে পৌঁছে দেয়—যেমন দান, শীল, ক্ষান্তি, বীর্য, ধ্যান ও প্রজ্ঞা—এই ছয় পারমিতা।