ক্ষেপ চেতনার প্রক্ষেপণ—যার দ্বারা সম্ভাবনা রূপ পায়; গতি সেই প্রক্ষেপণের সঞ্চারশক্তি—চেতনার ক্রমবিকাশ; সংখ্যান হলো এই গতির স্বনিয়ন্ত্রণ, যেখানে চেতনা নিজেকে পরিমাপ করে উপলব্ধির রূপ দেয়; শব্দ হলো সেই অভ্যন্তরীণ প্রকাশ, যা চেতনার ধ্বনি ও অর্থের রূপে প্রতিফলিত হয়; এবং জ্ঞান হলো এই সমস্ত ক্রিয়ার সমাহার—আত্মার নিজেরই আত্মাকে চেনা। এই পাঁচ কলনের সংযোজনে কালী প্রকাশিত হন চেতনার অন্তর্নিহিত মহাজাগতিক ক্রিয়া হিসেবে—যেখানে সৃষ্টি ও বিলয়, প্রকাশ ও প্রত্যাহার, বহির্মুখতা ও অন্তর্মুখতা—সবই একই চেতনার পরম নৃত্য।
এভাবেই কালী ক্রম দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু: তিনি শক্তি ও চেতনার সংহত রূপ, সময়ের হৃদস্পন্দন, যিনি সমস্ত অনুক্রমের ভেতর দিয়ে এক অবিচ্ছিন্ন আত্ম-প্রকাশের সংগীত বাজিয়ে চলেছেন। তাঁর মধ্যেই বাস্তবতা গতিশীল, তাঁর মধ্যেই সময় সচেতন এবং তাঁর মধ্যেই প্রতিটি মুহূর্ত পরিণত হয় চিরন্তন উপস্থিতির পরম নৃত্যে।
যখন “কালী” শব্দটি বহুবচনে “কালিকা” রূপে ব্যবহৃত হয়, তখন এর তাৎপর্য একক দেবীস্বরূপ কালী থেকে বহুবিধ চেতনার স্তরে সম্প্রসারিত হয়। “কালিকা”-রা কোনো পৃথক দেবতা নন, বরং পরম চেতনার আত্মপ্রকাশের নানা স্তর—বাস্তবতার নির্দিষ্ট স্তরে চেতনার বিভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশের প্রতীক। প্রতিটি কালিকা পরম সত্তার এক একটি প্রকাশমান ক্ষেত্র—যেখানে অসীম একতা নিজেকে আপাত বহুত্বের মধ্যে প্রতিফলিত করে। কিন্তু এই সমস্ত কালিকারা তাঁদের মূল নীতি থেকে কখনোই বিচ্ছিন্ন নন; তাঁরা সবাই সেই এক পরম কার্যকারিতার অভ্যন্তরীণ প্রকাশ, সেই আত্মতাড়িত চেতনার সৃষ্টিশীল তৎপরতা, যা নিজের মধ্যকার উদ্দেশ্যপ্রবণ আকাঙ্ক্ষা (intentional impulse) থেকে নিজেকে নানা আকারে বিকশিত করে। এভাবে কালী কখনও একটি স্থির সত্তা নন, বরং ক্রিয়াশীল শক্তির সমষ্টি—চেতনার মধ্যে ক্রিয়া, বিবেচনা, প্রক্ষেপণ, মুক্তি, প্রত্যাহার, গণনা ও জ্ঞান—সব একসূত্রে গাঁথা এক পরম ক্রিয়ানীতি।
শৈবাষ্টক কোষ এই তত্ত্বকে এক গম্ভীর ও সংক্ষিপ্ত বচনে প্রকাশ করেছে—“কালী মহাবিশ্বকে গ্রাস করেন এবং পুনরায় সৃষ্টি করেন; তাই তিনিই পরম শক্তি।” এই উক্তিতে কালীকে বলা হয়েছে সেই সৃষ্টিশীল শক্তি, যিনি একদিকে বিশ্বকে লয়ে নেন, অন্যদিকে সেই লয় থেকেই পুনরায় সৃষ্টি করেন। তাঁর এই সৃষ্টিশীলতা কোনো বাহ্যিক নিয়মে আবদ্ধ নয়; যদিও তিনি শৃঙ্খলা রচনা করেন, তিনি নিজে কোনো শৃঙ্খলার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন। তাঁর ক্রিয়া স্বাধীন (svatantrā), স্বতঃস্ফূর্ত (spontaneous) ও স্বনির্ধারিত (self-determined)। তাই বলা যায়—কালীই কলনের কর্তা, তিনিই কলনকর্তৃত্বের অধিষ্ঠাত্রী—যার দ্বারা চেতনার ক্রিয়া জগৎ হিসেবে প্রকাশিত হয়।
ক্ষেপ, অর্থাৎ প্রক্ষেপণ, কালী-চেতনার প্রথম বহির্মুখী গতি—যার দ্বারা পরম চেতনা নিজের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে জ্ঞাতা (knower), জ্ঞেয় (known) এবং জ্ঞানের উপকরণ (means of knowing)-এর রূপে প্রসারিত করে। এই ক্ষেপই জগতের সূচনা। অচিন্ত্য চেতনা, যা স্বয়ং এক, নিজেকে উপলব্ধির ধারায় নিক্ষেপ করে, যেন নিজেরই প্রতিবিম্ব দেখে। ফলে মুহূর্তে সে জ্ঞাতা, পরমুহূর্তে জ্ঞেয়, আর তৃতীয় মুহূর্তে এই দুইয়ের ঐক্য। এই আত্ম-প্রক্ষেপণেই সময়ের উদ্ভব, কারণ প্রতিটি প্রকাশের মধ্যেই ক্রম ও পরম্পরার ধারা থাকে। তাই ক্ষেপ হলো সেই চেতনার কর্ম, যা নিজের অচিন্ত্য ঐক্যকে অভিজ্ঞতার ধারায় বিকীর্ণ করে—নিজেকে জানার নৃত্যে প্রবেশ করে।
এই চেতনার প্রক্ষেপণ থেকে জন্ম নেয় জ্ঞান ও সংখ্যান—দুটি অবিচ্ছেদ্য ধারা। জ্ঞান মানে এখানে তথ্যগত জ্ঞান নয়; বরং সেই আত্মপ্রতিফলিত চেতনা, যা জানে ও জানা হয় একসঙ্গে। এটি এমন এক বোধ, যেখানে বিষয় ও বস্তু, জানন ও জানা, কর্তা ও কর্ম—সব মিলেমিশে যায় এক অনন্ত ঐক্যে। আর সংখ্যান হলো সেই চেতনার নির্ধারণী শক্তি—যা অসীম সম্ভাবনাকে সীমানাবদ্ধ রূপ দেয়। সংখ্যান মানে গণনা, পার্থক্য নির্ধারণ, সীমা স্থাপন। এই সীমার মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় ধরণা—“এটি এই” ও “এটি ওটা নয়।” এই জ্ঞানের পরিসরেই গঠিত হয়—দার্শনিকভাবে যাকে বলা হয় অপোহ (Apoha) বা বিকল্প (Vikalpa)—অর্থাৎ কোনো বস্তুকে বোঝার জন্য, সেটি যা নয়, তা বর্জন করা। বস্তু থেকে কর্তার ধারণাকে বাদ দেওয়া, বা কর্তা থেকে বস্তুর অনুভূতি বাদ দেওয়া—এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই চেতনা জগৎকে অর্থপূর্ণ করে তোলে। বাস্তবতা তখন আপাত পৃথক হয়ে ওঠে, কিন্তু সেই পৃথকতা মূল ঐক্যেরই প্রকাশ।
ক্রমপন্থা চেতনার বিকাশকে কোনো হঠাৎ “লাফ” নয়, বরং ধারাবাহিক আত্ম-উন্মোচন হিসেবে বোঝে—যেন এক সুনিয়ন্ত্রিত নৃত্যানুষ্ঠান, যেখানে প্রতিটি দোল, প্রতিটি মুদ্রা এক একটি স্বতন্ত্র সুর ও তাৎপর্য বহন করে। এই ধারাবাহিকতার প্রতিটি স্পন্দনকে বলা হয় “কালিকা”—অর্থাৎ চেতনার আত্মপ্রকাশের একেকটি পর্ব। কখনো এদের গণনা দ্বাদশে (বারো), কখনো ষোড়শে (ষোল) করা হয়; কিন্তু সংখ্যা যা-ই হোক, মূল বোধ একই—সব কালিকা এক পরম চেতনারই ধারাবাহিক প্রকাশ ও প্রত্যাহার।
চেতনার সৃষ্টিপ্রক্রিয়া বা আত্মপ্রকাশের ধারাবাহিক ধাপ—যেভাবে এক নিঃসীম, অবিভক্ত ঐক্য থেকে ধীরে ধীরে বহুত্ব, রূপ, নাম ও ক্রিয়ার জগৎ গঠিত হয়, তার যাত্রার সূচনা হয় “অচিন্ত্য ঐক্যে”—এটি সেই আদ্যাবস্থা, যেখানে চেতনা এখনও নিজের কোনো প্রকাশ ঘটায়নি। এখানে শিবচেতনা পরম নীরব, অবিভক্ত, অপরিসীম—যেন সমুদ্রের মতো স্থির, যার গভীরে অসীম সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, কিন্তু এখনও কোনো তরঙ্গ ওঠেনি। এই নীরবতাই মহাকালীর নিস্তব্ধ দীপ্তি—যেখানে সৃষ্টির বীজ নিঃশব্দে সুপ্ত অবস্থায় আছে।
তারপর ঘটে “উন্মেষ (Unmeṣa)”, অর্থাৎ চেতনার প্রথম জাগরণ। এটি সেই মুহূর্ত, যখন অচিন্ত্য ঐক্যের নিস্তব্ধতা নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করে। যেন আলোক নিজেই বুঝতে পারে, “আমি আছি।” এটি আত্মবিমর্শনের সূচনা—শিবের নিস্তরঙ্গ চেতনা এখন শক্তির রূপে নড়ে ওঠে। মহাশূন্যে প্রথম তরঙ্গ জাগে; এটি সৃষ্টির সূক্ষ্মতম নাড়ি।
এই আত্মসচেতনতার সঙ্গে সঙ্গে আসে “ক্ষেপ (Kṣepa)”, অর্থাৎ আত্মপ্রকাশের প্রক্ষেপণ। চেতনা নিজেকে বহির্মুখ করে, নিজের অন্তর্গত শক্তিগুলিকে অসংখ্য আভাস বা ধারণায় ছড়িয়ে দেয়। এই পর্যায়ে মহাশক্তি নিজেকে প্রকাশ করতে শুরু করে—তত্ত্ব, রূপ, গুণ, ভাব—সব সম্ভাবনা অবচেতনার গভীর থেকে উঠে আসে, কিন্তু এখনও তারা অসংগঠিত।
যখন মহাশক্তি (অর্থাৎ পরম চেতনার গতিশীল শক্তি) নিজের প্রকাশ শুরু করে, তখন তিনি সৃষ্টির সম্ভাবনাগুলিকে একে একে জাগিয়ে তোলেন, কিন্তু সেই পর্যায়ে তারা এখনও “গঠিত” বা “নির্ধারিত” নয়; তারা এখনো একধরনের আদি সম্ভাবনার অবস্থায় থাকে।
অর্থাৎ, যেমন কোনো শিল্পী আঁকতে বসে প্রথমে কেবল রং ও রেখার ভাবনা অনুভব করেন—চিত্র তখনও তৈরি হয়নি, কিন্তু তার সব উপাদান মনের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে—তেমনি চেতনার গভীরে তত্ত্ব (অস্তিত্বের মূল উপাদান), রূপ (আকারের সম্ভাবনা), গুণ (প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য), ভাব (চেতনার মানসিক প্রতিক্রিয়া)—সব কিছুই তখনও কেবল সম্ভাবনামূলক অবস্থায় থাকে।
এটি এমন এক স্তর, যেখানে সৃষ্টি এখনও সংগঠিত হয়নি, কিন্তু তার সব বীজ জেগে উঠেছে। তাই বলা হয়, মহাশক্তি তখন নিজের অন্তর্গত সম্ভাবনাগুলিকে অবচেতনার গভীর থেকে তুলতে শুরু করেন—যেন মহাশূন্যে প্রথম আলো ঝলকে ওঠে, কিন্তু সেই আলো এখনও রূপ নেয়নি।
এই অবস্থায় চেতনা জানে যে, সে প্রকাশিত হতে চলেছে—সব কিছু জন্ম নিতে প্রস্তুত—কিন্তু এখনও কোনো নির্দিষ্ট রূপ, নাম, বা ক্রিয়া গঠিত হয়নি। এটি অসীম সম্ভাবনার জাগরণের মুহূর্ত, যেখানে সৃষ্টি কেবল একটি “অন্তর্লীন ভাবনা”—একটি অগঠিত কিন্তু জাগ্রত সম্ভাবনা।
তারপর শুরু হয় “সংখ্যান (Saṅkhyāna)”, অর্থাৎ এই আভাসগুলির বিন্যাস, শ্রেণিবিভাগ ও সম্পর্ক স্থাপন। চেতনা এখন নিজের অভ্যন্তরীণ সম্ভাবনাগুলোকে সংগঠিত করে জগৎ গঠন শুরু করে। এই পর্যায়েই গঠিত হয় তত্ত্ব (tattva)—অস্তিত্বের মৌলিক স্তরগুলি, গুণ (guṇa)—প্রকৃতির গুণধর্ম, আর শক্তি (śakti)—যে বল-বেগে সব কিছু কাজ করে। এই সংখ্যান প্রক্রিয়া থেকেই জন্ম নেয় নাম—ধারণাগত পরিচয়, রূপ—দৃশ্যমান আকার, এবং ক্রিয়া (karma)—কারণ-ফল সম্পর্কের গতিশীলতা।
অর্থাৎ, যেখানে উন্মেষ ছিল স্ব-চেতনার জাগরণ, ক্ষেপ সেখানে ছিল সৃষ্টির নিক্ষেপ, আর সংখ্যান হলো সেই সৃষ্টির বিন্যাস—যেখানে বহুত্ব প্রথম বার পূর্ণরূপে দৃশ্যমান হয়।
এভাবে চেতনা নিজের নিঃসীম ঐক্য থেকে বেরিয়ে আসে, নিজের সম্ভাবনাগুলোকে আকার দেয়, এবং এক জীবন্ত, অর্থবহ, সম্পর্কপূর্ণ জগৎ গঠন করে। এই ধাপগুলির মধ্যে নিহিত আছে এক গভীর তত্ত্ব: সৃষ্টির উদ্দেশ্য কোনো বিভক্তি নয়, বরং নিজেরই অগণন রূপে আত্মবিস্তার—যাতে পরম ঐক্য নিজেকে বহুরূপে চিনতে পারে, এবং শেষে আবার সেই বহুত্ব থেকেই ঐক্যে ফিরে যেতে পারে।
চেতনার মধ্যবর্তী পর্ব—যেখানে সে নিজের সৃষ্টির খেলায় সম্পূর্ণ নিমগ্ন হয়, কিন্তু সেই নিমগ্নতার মধ্যেই ধীরে ধীরে নিজের মূল ঐক্যবোধ হারিয়ে ফেলে। একে বলা যায়, চেতনার “আত্মবিস্তার ও আত্মবিস্মৃতির” স্তর।
প্রথমে যখন নাম-রূপ-ক্রিয়া (অর্থাৎ চিন্তার নাম, দৃশ্যমান রূপ এবং কর্ম বা কার্য) সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন চেতনা সৃষ্টির জগতে সম্পূর্ণ প্রবেশ করে। এখন প্রতিটি অভিজ্ঞতা আলাদা আলাদা মনে হয়—কিছু সুন্দর, কিছু অসুন্দর; কিছু প্রিয়, কিছু অপ্রিয়। চেতনা এখন রসাস্বাদে মগ্ন—অর্থাৎ অনুভব করছে আনন্দ, দুঃখ, ভালো, মন্দ, ন্যায়, অন্যায়। এটি চেতনার মূল্যায়নের স্তর, যেখানে সে নিজের প্রকাশিত জগৎকে নানা মানদণ্ডে বিচার করতে শুরু করে।
এই পর্যায়ে বিমর্শ (Vimarśa) গভীর হয়। “বিমর্শ” মানে স্ব-প্রতিফলন—চেতনা এখন নিজের কর্মকাণ্ডকে, নিজের জগৎকে পর্যবেক্ষণ করছে। সে যেমন সৃষ্টি করে, তেমনি সেই সৃষ্টির প্রতিক্রিয়াও অনুভব করে। এটি যেন এক অন্তর্দৃষ্টি, যেখানে চেতনা ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে—“এটি আমারই লীলা, আমারই খেলা।”
কিন্তু এই লীলার গাঢ়তা যত বাড়ে—অর্থাৎ নাম, রূপ, ক্রিয়া যত ঘনিষ্ঠ ও আকর্ষণীয় হয়—ততই চেতনা নিজের আসল ঐক্যকে ভুলে যায়। সে এখন সম্পূর্ণভাবে “অংশগ্রহণকারী” হয়ে পড়ে; “সাক্ষী” থাকা হারিয়ে যায়। এই অবস্থাতেই জন্ম নেয় আচ্ছাদন (Āvaraṇa)—চেতনার দীপ্তির উপর জমে যায় অজ্ঞানতার কুয়াশা।
তন্ত্রশাস্ত্র এই আচ্ছাদনের দুটি রূপ ব্যাখ্যা করে—
মলা (Mala): এটি হলো সূক্ষ্ম “আমি” ভাবের কলঙ্ক, যা চেতনার স্বচ্ছ দীপ্তিকে ঘোলা করে দেয়। এতে মানুষ ভাবে—“আমি কর্তা, আমি ভোগী, আমি আলাদা।”
কণচুক (Kañcuka): এগুলি হলো চেতনার উপর পড়া সীমাবদ্ধতার আবরণ—যেমন কাল (সময়), দেশ (স্থান), নিয়তি (কারণ্য), বিদ্যা (সীমিত জ্ঞান), রাগ (আসক্তি) ইত্যাদি। এই পর্দাগুলি চেতনার অসীমতাকে সংকুচিত করে।
এইভাবে চেতনা ধীরে ধীরে নিজেকে “সীমিত সত্তা” হিসেবে অনুভব করতে শুরু করে—যে ভাবছে “আমি পৃথক”, “আমার সুখ-দুঃখ আছে”, “আমি জন্মেছি, মরব”, “আমি করতে পারি, আবার পারি না।”
কিন্তু এখানেই এক নতুন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই সংকোচনের মধ্যেই জন্ম নেয় বিচ্ছেদ-বেদনা—অর্থাৎ নিজের উৎস থেকে বিচ্ছিন্নতার কষ্ট, এবং অন্বেষণ-তৃষ্ণা—অর্থাৎ সেই উৎসে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। যখন চেতনা সীমাবদ্ধতার পূর্ণ অভিজ্ঞতা লাভ করে, তখন তার ভেতর থেকে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে—“আমি কে?”, “এ সবের উৎস কোথায়?”—এই প্রশ্নই প্রত্যাবর্তনের বীজ।
চেতনার যাত্রায় আনন্দ, ভোগ, মূল্যায়ন ও বিভ্রান্তি কোনো ত্রুটি নয়; তারা অপরিহার্য ধাপ। কারণ, এই নিমজ্জনের মধ্য দিয়েই চেতনা নিজের সীমা চিনে ফেলে, আর সীমার ভেতর থেকেই তার অনন্তের সন্ধান শুরু হয়। এখান থেকেই শুরু হয় প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়া—যা শেষ পর্যন্ত নিয়ে যায় আত্মস্বীকৃতি, বা প্রত্যভিজ্ঞা-র দিকে।
চেতনার যাত্রার প্রত্যাবর্তন পর্যায়—অর্থাৎ যখন চেতনা, দীর্ঘ লীলার পর, নিজের উৎস বা স্বরূপে ফিরে আসে। এটি একপ্রকার অন্তর্মুখী প্রবাহ, যেখানে সৃষ্টির সমস্ত বহির্মুখ গতি ধীরে ধীরে নিজ কেন্দ্রে লীন হয়।